Monday 24 October 2011

আমার কবিতার অন্তরালে শব্দ বর্ণ স্রোত...

শংকর লাহিড়ী

১.  “সৃষ্টির পূর্বাহ্ণে দ্যাখো, নিজেকেই সৃষ্টি করা প্রয়োজন হয়” ( বিনয় মজুমদার )
একদিন সূর্য যখন মাঝ আকাশে, নিজের ছায়া না-মাড়িয়ে পথ চলা যখন অসম্ভব, সেইমত মধ্যদিনে লিভিং রুমের শীতলতায় চারিদিকে বই-খাতা-কলম-ক্যামেরা-কম্পিউটার সাজিয়ে বসে আছি,  কিছু একটা করবো বলে সামনে ছড়ানো আছে আয়তাকার সাদা পাতাগুলো  -কখনো যারা লিখিত হবে,  ক্রমশঃ  জটিল হয়ে উঠবে তাদের অবয়ব, - মাঝে মাঝে একটা মাছি উড়ে এসে বসছে তার ওপর  তখনই মনে পড়লো সেই দ্বন্দ্ব, আমরা কি আদৌ কিছু সৃষ্টি করতে পারি ?  প্রবাহিত সময় যখন এক এক নিমেষে অবিরল নির্মাণ করে চলেছে সহস্র লক্ষ ফ্রেম সকল, আমাদের বিনা-অনুমতিতে - তবুও পারি আমরা  সেই চলমান ক্যানভাসে তড়িত-আঙুলে কিছু রেখা-রঙ-শব্দ সংযোজন করে দিতে । ফ্রেমের মধ্যবর্তী স্পেসকে উল্টেপাল্টে টেনে বাঁকিয়ে, সম্পর্ককে জুড়ে ভেঙ্গে চূর্ণ করতে, উড়িয়ে দিতে বুদ্বুদের মতো - এ ছাড়া আর কিই বা পারি আমরা ঐ ননস্টপ দুরন্ত ট্রেন, রঙিন প্যাস্টেল তাকে উজ্জ্বল করেছে, প্যান্টোগ্রাফে  শব্দ উঠছে হিস হিস ।   ছুটছে সে একজোড়া সমান্তরাল অসীম সময়-রেখার ওপর । সমান্তরাল সাহিত্য, অর্থনীতি, প্রশাসন, সমাজ, সংসার, সম্পর্ক ।  ..ঐ ট্রেনে নব্বই আর শূন্য দশকের কয়েকজন তরুণ কবিওরা যাবে উত্তরে,  ডুয়ার্স পেরিয়ে পাহাড়ি পথে, স্নো-লাইনে     
 -পরদিন সন্ধেবেলা সিকিম থেকে তাদের ফোন।  বলল, আমরা কয়েকজন বেড়াতে এসেছি, সঙ্গে নিয়ে এসেছি ‘মুখার্জিকুসুম’ বইটা সবাই মিলে পড়ছি, আলোচনা চলছে  এই পরিবেশে ‘এক অলৌকিক অভিজ্ঞতা।  -হ্যাঁ, ‘অলৌকিক’ শব্দটাই পরের দিন আমাকে লিখেছিল সে সিকিমে মনোরম শীতের ভোরে  আগের  রাতের  হুইস্কি ও ‘কুসুমের’ হ্যাংওভার কাটিয়ে সকালের প্রথম উষ্ণতায় সে যখন কমোডে  বসে ফোঁটা ফোঁটা জল পড়ার শব্দে ঝিম হয়ে আছে তখনই জানালার ওপারে এক মনাস্টেরিতে  ভারী ধাতব ঘণ্টার ধর্মীয় অলৌকিক ঘঘঘঙঙঙঙঙঙঙ...শব্দ, যা তাকে আমূল নাড়িয়ে দেয় ক্রমে সেই শব্দ-সুর  উপত্যকায়  সুদূর ছড়িয়ে গেলে  কমোডে যথোচিত জলোছ্বাসের পর বেরিয়ে এসে ফেসবুকে আমাকে সে জানায় ঐ অভিজ্ঞতার  কথা ।  ‘অলৌকিক’ শব্দ সহযোগে।  ক্রমে তার রেশ কলকাতায় আমাকেও স্পর্শ করে
ওরা ফিরে এসে আমাকে প্রস্তাব দেয় একটা দীর্ঘ গদ্য লেখার আমার জীবন সময় ও কবিতার সম্পর্কগুলো, এবং এ পর্যন্ত প্রকাশিত যাবতীয় গদ্য পদ্য, যার মধ্যে আমার চারটে কবিতার বইও রয়েছে, - তাদের নির্মাণ, আর্কিটেকচার ও টারনিং পয়েন্টস  নিয়ে এক দীর্ঘ আলোচনা,  যা ছাপা হতে পারে ধারাবাহিক ভাবে এবং হয়তো কোনও একদিন পুস্তকাকারে সেই বই, – বিশেষতঃ পেপারব্যাক হলে, –পারবে নিয়ে যেতে কবিতার ওই সব প্রেমিক পুরুষরা তাদের পরবর্তী কোন মরু-বিজয়ে, জঙ্গল-সাফারিতে বা, স্নো-লাইনে, নিজস্ব হাই-অলটিচিউড্ তাঁবুতে মুন্সিয়ারি থেকে পঞ্চাশ কিলোমিটার পথে কখনো কোনও অলৌকিক ট্রেকে তাদের রাকস্যাকে থাকতে পারে সেই বই         
খাতা-কলম-কম্পিউটার ও শাদা পাতার প্রশান্তির সামনে আমি তখন অলস বসে আছি কানে বাজছে –আব্বা নয়, বনি-এম বা মহিনের ঘোড়া নয়, - উস্তাদ রশিদ খানের ‘কাহে করত মোসে   ঝ গ ড়া’  - রাগ বিলাসখানি  টোড়ি আহা, মুহূর্তে আমি সেই মেহফিলে সান্ধ্য বাসরে !  ... কোঁচানো ধুতি, পানপাত্র, অম্বুরি তামাক যেন সারেঙ্গী বাদকের পাশে, মোমের আলোয়, একা ...এবং তখনই আমার মনে পড়ে যায় সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের কথা সন্দীপনের ‘পণ্ডশ্রম চেতনা’ এই যে ১৯৭৯-৮০ সালে কৌরবে আমার লেখালিখি শুরু করা থেকে আজ অব্দি প্রায় তিরিশ বছরের দীর্ঘ সময়পথ, যার অতি সামান্য অংশই নিয়োজিত হয়েছে বাংলা কলমে। আর বেশিটাই কেটেছে একজন প্রফেশানাল ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে, ইস্পাত শিল্পের  বিশাল বহুজাতিক কম্পানিতে সেই সব দৈনন্দিন সৃষ্টি  উল্লাস ব্যর্থতা উদ্বেগ,  ট্যুর-ও–টার্গেট, পরিকল্পনা ও নির্মাণের অসম্ভব অবিশ্বাস্য তৃপ্তি ও অতৃপ্তির মিলিত কনসার্ট ...আমার মনে হোল, কেন আবার হৃদয় খুঁড়ে  স্মৃতি খুঁড়ে সেই বিস্মৃতপ্রায় ঘটনাপ্রবাহ নিজের সামনে উন্মুক্ত কোরে নিজেরই সমগ্র রচনাকে প্যাক খুলে মেপে ভেঙ্গে খুঁজে দেখা তার পথ-পরিক্রমা ?  তার যাবতীয় রঙ রূপ স্বাদ গন্ধ প্রবাহ সমাস সম্পর্ক  বোধ ও  নির্মাণের অন্তরালে রহস্যময় ও রোমাঞ্চিত অধ্যায়গুলো ! মনে পড়লো, কীভাবে তিরিশ বছর ধরে ক্রমে  পালটিয়ে গিয়েছি আমি । আমার পরিবার, বন্ধু, শিক্ষক, সহকর্মী আমার গৃহকোণ, স্বদেশ,  পৃথিবী, সৌরমণ্ডল আমার পোশাক, খেলাধুলো, ভ্রমণ, উৎকণ্ঠা, আবিষ্কার ও অর্জন ক্যামেরা কম্পিউটার বুকর‍্যাক আমার পড়া ও না–পড়া বইগুলো গানের ভেতর দিয়ে ও বাইরে দিয়ে দেখা ভুবনখানি আমার রং-তুলি ও কালিকলম জন্মদাগ ও প্রণম্য দেবতারা  চিনে নিতে হবে এইসব সাজাতে হবে সময়ের জরির ফিতেগুলো খুলে খুলে  ঘ্রাণ নিয়ে স্পর্শ করে বুঝতে হবে তাদের কর্কশ ও মসৃণ তল গুলো তাদের গুঞ্জন ও ঝঙ্কার - অর্থাৎ এটা হবে একান্তই এক নিজস্ব আলাপচারিতা, শুধু নিজেরই জন্য এই উন্মোচন  বন্ধ দরজার সেই সব দ্রবীভূত স্মৃতি নিয়ে আমার নিজের গানই আমি গাইবো ?  
হঠাৎ খুব একা মনে হয় একক বিশ্বে নিজেরই করতালিতে মুখর হয় রাতের আকাশ সমস্ত রচনাই যখন অত্যন্ত ব্যক্তিগত, তার প্রত্যেক ছেনি–হাতুড়ি-চিজেল, তার ডগেরোটাইপ  ও হ্যান্ড প্রিন্ট,  লং শট ও জুম, ...ক্রমে তারা একটা বন্ধ দরোজার ওপাশে সময়-জলে ডুবে আছে !  দরোজা বন্ধ, তালায় জং নীল লবণাক্ত ভারী জলে গভীরে, ধীরে ধীরে গ’লে দ্রবীভূত হয়ে যাচ্ছে তারা এই উদ্ধার কি সম্ভব,  -আমি প্রশ্ন করি নিজেকেই  কী হবে এই পরিশ্রমে, কী হবে এই লেখা লিখে  ? কোন উপকারে লাগবে ঐ মুদ্রিত হাজার হাজার শাদা কালো অক্ষর, শব্দ, বাক্য ?  ক্রমে আমাকে পণ্ডশ্রম-চেতনা চেপে ধরে নিজের সাথে নিজেই তর্কে জড়িয়ে পড়ি আমি । তখনো কানে বাজছে উস্তাদ রশিদ খানের বিলাসখানি টোড়ি, ‘কাহে করত মোসে ঝ    ড়া...’।  তার অপূর্ব তানকারি,  লয়শুনতে শুনতে কলম বন্ধ করে ক্রমে শান্তিতে ঘুম আসে আমার ।   
     
 কৌরবে প্রায় চোদ্দ বছর আগে প্রকাশিত ‘কবিতার এরিনা’ প্রবন্ধের চতুর্থ পর্বে লিখেছিলাম “বিংশ ও একবিংশ শতাব্দীর মধ্যে সংযোগকারী পঞ্চাশ বছর, - ১৯৭৫ থেকে ২০২৫ সাল, - আমাদের পরিচিত  পৃথিবী, জড়জগৎ, আমাদের বোধ-বুদ্ধি-বিচার, ভিউ পয়েন্ট, - আমাদের অস্তিত্বের সমস্ত কলাকে উপহার দেবে নতুন কয়েকটা ডাইমেনশাননতুন জন্মের মতো, হাঁটতে শেখার মতো মৌলিক ।” এই সব পরিবর্তন ধীরে ধীরে প্রকাশিত হচ্ছিলো সমাজে প্রযুক্তিতে শিল্পে ভাবনায় । আমি যখন কৌরবে যোগ দিয়ে কাগজ কলম কিনে লেখাটেখা শুরু করি, সেটা  সেই ১৯৭৮-৭৯ সাল, - মাত্র কিছুদিন আগে কৌরবের কবিদের সাথে তখন আলাপ হয়েছে কলকাতায় শ্যামপুকুর স্ট্রীটের ‘শৈলেন্দ্র সরকার’ স্কুল (১৯৬৭) আর দুর্গাপুরের ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ (১৯৭২) থেকে বেরিয়ে আমি তখন জামশেদপুরে  টাটা কম্পানির ষ্টীল প্লান্টে সদ্য-রিক্রুট       
- এই সেই জামশেদপুর, যেখানে আমার জন্মভুমি । কবি কমল চক্রবর্তীর কবিতায় আছে ‘সিংভুম পেরিয়ে গেলে কবিতার রম্যভুমি শেষ’। তো এই সেই সিংভুম জেলা, এখন যা বিহার থেকে বেরিয়ে এসে ঝাড়খণ্ডে পড়েছে । একশো বছেররও আগে এখানকার শাল-জঙ্গল আর লাল মাটির দেশে ঘুমিয়ে ছিল একটা  আদিবাসি-গ্রাম, যার নাম ‘সাকচি’সেই সাকচি-তে  জামশেদজি টাটা প্রথম ভারতীয় ইস্পাত কারখানা তৈরি করার স্বপ্ন দেখেন এবং তাঁর মৃত্যুর পরে গড়ে ওঠে সেই কারখানা তখন রেল স্টেশানের নাম ছিল  ‘কালিমাটি’, এখন যা ‘টাটানগর’ । এই সাকচিতে ১৯৫০ সালের শরতে -যখন ‘নীল রবারের থাবা’  আকাশের গায়ে গায়ে পড়ে গেছে, - ট্যামারিয়া রোডের ১০ নং কোয়ার্টারে মামার বাড়ির আম-সজনে-কাঁঠাল গাছের ছায়ায় আমার জন্ম হয়েছিলো । সে বাড়ির উঠোনে দুটো ছাগল বাঁধা থাকতো, আর রাতের  আকাশ কতবার লাল হয়ে উঠত গলিত স্ল্যাগের আলোয় । দাদু সোলার টুপি মাথায় দিয়ে সাইকেল চড়ে টাটা কারখানায়  শিফট ডিউটিতে যেতেন । দু পাশে প্রতিবেশী ছিল তেলেঙ্গি আর পাঠান ।  ছিল কাল্লু মিয়াঁর পরিবার।  পেছনের   গলি-দরোজায় চুড়িওয়ালীর কাছ থেকে মেয়েরা কাচের চুড়ি পড়তোকালো   বোরখার ভেতর থেকে বেরিয়ে আসতো তাদের  ফর্সা হাত । দাদুর বাড়িতে ছিল তাঁর নিজের হাতে গড়া এক আশ্চর্য ওয়ার্কশপ । ছিল, পেতল তামা দস্তা জুট সীটমেটাল কাঠ রাবার গালা মোম তুঁত অ্যাসিড রাংঝাল । ছিল, হাতুড়ি হাপর  ছেনি বাটালি উকো করাত ভাইস । সারাদিন ডিউটি শেষে সেই ময়মনসিংহের ছেলে, -এক অক্লান্ত বিশ্বকর্মা, প্রতিদিন কিছু না কিছু তৈরি কোরে চলেছেন । অবসর  সময়ে সেই তিনিই আরাম-কেদারায় চোখ বুঁজে গড়গড়ায় নিবেদিত, আর আমরা গল্প শুনছি গোয়ালন্দ থেকে বিকেল বেলা স্টিমার ছাড়ার । সেই বাড়িতে সাত মামা আর তিন মাসি।
-এই সব নিয়েই ছিল ছোটবেলায় গরমের ছুটিতে জামশেদপুরে  মামার বাড়ি বেড়াতে আসা । রাঁচি এক্সপ্রেসে সারারাত জানলার পাশে জেগে, বিশাল স্টিম এঞ্জিনের কয়লা-গুঁড়োয় ধোঁয়ায় জলবাস্পে মথিত হয়ে ভোর রাতে ধলভুমগড় স্টেশনে থেমে  শিশিরে-ভেজা লালমাটী আর মহুয়া-নিম-সজনে-সিরিষ ফুলের অপার্থিব গন্ধে মনে হতো ‘এলেম নতুন দেশে’ । -তখন আমার বয়স আট-দশ ।      
             
কথাটা নাকি বলেছিলেন অস্কার ওয়াইল্ড । জীব জগতে দুটো সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রজাতির মধ্যে, -যেমন লাল পিঁপড়ে ও মাগুর মাছের মধ্যে -যে পার্থক্য আছে তার থেকেও বেশি আছে যে কোনও দুজন পাশাপাশি বসে থাকা মানুষের মধ্যে । মানুষের রাগ অভিমান সংস্কার অজুহাত । বোধ, সৃষ্টি ও বিশ্বাস ।  মানুষের সারল্য ও জটিলতা, আশ্লেষ ও আত্মহনন । গর্ভস্থ কোষ ক্রমে বিভাজিত হতে হতে হতে একদিন জরায়ুসম্ভূত প্রাণ । ক্রমে জলরাশি পেরিয়ে রক্তনাড়ি ছিহ্ন ক’রে সে জেগে ওঠে, তার সম্পূর্ণ ত্রিমাত্রিক  আয়তন ও শরীরী চৈতন্য নিয়ে । শৈশব কৈশোর ও যৌবনের ফ্রেমগুলো ক্রমে গড়ে ওঠে, আর পেরিয়ে যায় । বদলে যায় ভাষা রং শব্দ ব্যবহার পক্ষপাত প্রেম ও বিশ্বাস, ভালোবাসা ও কামনার  গ্রন্থিগুলো । যা কিছু তাকে সৃষ্টি করে, ভাঙ্গে, পুনরায় যুক্ত করে, সম্পর্কিত করে, আর ক্রমে সে নিজেও রচনা করে যা কিছু । এইভাবে একদিন রচিত হয় তার নিজের ছবি ও কবিতা, গান, চিত্রকলা, ভাস্কর্য । যাতে বিম্বিত হয় তার জীবন যাপন, তার অভিজ্ঞতা ও বোধ । তার নির্বাচিত শব্দ লাস্য সুর, পোশাক ও ধুলোবালি ।
সুতরাং জীবনে  লাগুক অভিজ্ঞতার নির্যাস, আর হতে হবে সতত পরিবর্তনশীল, আমি ভাবি সমাজে সংসারে অঙ্গাঙ্গি জড়িয়ে থেকেও একটা ডিটাচমেন্ট । নিরালায় নির্জনে নয়, রেলস্টেশনে বোর্ডরুমে কৃষিখামারে, সকলের মধ্যে থেকেও যে আছে একাকী । দূর থেকে নিজেকেই খুঁটিয়ে দেখা অপরিচিতের মতো । নিজেরই রচনার  অন্তরালে যে শব্দ-বর্ণ-স্রোত তাদের উৎসমুখ ও উদ্দেশ্যসকল বুঝতে শেখা । কোনও সরকারি মানপ্ত্র নেই, বন্ধুজনের কেয়াবাৎ নেই, আহাউহু নেই । -এক অতি ব্যক্তিগত ও অন্তহীন নিরীক্ষণ । নিজের মনোজগতকে ক্রমশ পরিশীলিত করা, আর ভাবনায়-বোধে-রচনায়  নিজেকেই ক্রমে ছাপিয়ে যাওয়ায় যে উত্তরণ । যেখান থেকে প্রতিবার অন্যরকম আয়োজন শুরু হবে, আর খুলে যাবে আরও কতো রহস্য-জানালা ।  ক্রমে আরও মুল্যবান কোনও প্রাপ্তি ।
-যেমন জঙ্গলের মধ্য দিয়ে কাঠুরে চলেছে তার হারানো কুড়ালের সন্ধানে । একে তো অন্ধকার, তায় মাঝে মাঝেই সন্দেহবাগীশ হাবিলদার আর বেপরোয়া কুকুর । এছাড়াও আছে ইতস্ততঃ ল্যান্ডমাইন,  বুবিট্র্যাপ আর লুকোনো টাইমবম্ব । এইসব বাঁচিয়ে সাধুর নির্দেশে  চলতে চলতে একদিন সে পেয়ে গেল একটা লোহার কুড়াল । সাধু বললেন থামিস না, আরও এগিয়ে যা । আরও এগিয়ে অনেক পথ পেরিয়ে জলাশয়ের ধারে পাওয়া গেল একটা পিতলের কুঠার । পেয়ে খুবই খুশি সাধু বললেন আরও চল, আরও গভীরে । ক্রমে রূপোর । ক্রমে সোনার । সাধু তখনো বলছেন, না থামিস না, আরও এগিয়ে চল । - অর্থাৎ এক অন্তহীন পথ চলা, যার কোনও শেষ নেই । জঙ্গল গভীরতর হলে, পথ বলেও যখন কিছু নেই আর । আছে শুধু খুঁজে যাওয়া আর ক্রমে খুলে দেওয়া রহস্যের লুকোনো জানালাগুলো, নিজের রচনায় । কোনও সমালোচক নয়, বৈয়াকরণ নয়, দূরবর্তী পাঠক নয় কোনও, - নিজের সৃষ্টির বিম্বিত উদ্ভাস নিজের চোখেই ধরা পড়ুক প্রথমে । 
- তবে এই খুঁজে যাওয়া পথেই কি পৃথিবীর ক্রমমুক্তি হবে ? হয়তো হবে না কোনও দিন । ‘হবে না’–এই সত্যই ক্রমে প্রতিষ্ঠিত । সহস্র-লক্ষ-অর্বুদ সম্পর্কের বাঁধনে বাঁধা এই জগত ও জীবন থেকে মুক্ত হওয়ার কোনও দরজাই যখন নেই, নেই কোনও অন্তিম উত্তরমালা, তখন সেই দরজাটাকে খুঁজে বের করার বেদম ও অন্তহীন প্রচেষ্টাই আমাদের গান কবিতা শিল্প ভাস্কর্য ‘দা জার্নি ইজ দা ডেস্টিনেশান’, –ভাবি আমি ।      

 সাহিত্যের হাটেবাজারে চিড়িয়াখানায় শপিং মলে রেস্তোরাঁয় কবিতা অনেক রকমেরনানান  প্রজাতির ।  খরগোশ, পর্কুপাইন, লেজঝোলা ফিঙে, মুখব্যাদানকারী সিংহ, গর্তলোভী কাঁকড়া, সামুদ্রিক ডলফিন, অথবা  মরুভূমির উট । গ্রীবার দীর্ঘ প্রান্ত থেকে উটের গম্ভীর চোখে যে তাকিয়ে থাকে পাঠকের দিকে ।  হাইড্রোকার্বনের  দেহ তাদের জন্ম, বেড়ে ওঠা ও ক্রমে মৃত্যুও থাকে । ধীরে নিশ্চিত ভাবে ক্রমশ নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় কিছু কিছু  প্রজাতি । পাঠকের শিক্ষা-সামর্থ-বোধ-পরম্পরা অনুযায়ী  সম্পর্ক ও সখ্যতাও তৈরি হয় । তখন তারা অংশ নেয় সংসারে পরিবারে গৃহকর্মে খেলাধুলায় । ক্রমে এমন আসক্তি তৈরি হয় যে পোষা কবিতার জন্যে অনেকটা জায়গা ছেড়ে দেয় মানুষ । অনেকটা অর্থ আর সময় । অনেকটা ছেলেমানুষি চাতুরি ও বিবাদ । -আরও অনেক রকম কবিতা যা রান্নাঘরে তৈরি করা হয় । দেশ-কাল-পার্বণ বিশেষে তাদের অনেক স্বাদ গন্ধ স্যালাড গারনিশ ও পরিবেশন । যে কবিতা খাদ্যনালী দিয়ে সোজা আমাদের ভিতরে পৌঁছে যায়, আর শুরু হয় পাচনপ্রণালী । এইসব কবিতা পাঠককে খুব সহজেই মজায় । বারবার ইচ্ছে করে পছন্দের স্বাদে গন্ধে ভ্যানিলায় ভরে উঠুক ব্রেকফাস্ট টেবিল, সান্ধ্য দারু-মজলিশ আর মাঝরাতের যূথবদ্ধ কাবাব পার্টি ।   
আরও এক রকমের কবিতা আছে যে প্রাণী আমরা শোণপুরের পশুমেলায় দেখিনি, যে খাবারের রেসিপি জানা নেই আমাদের । যে কবিতা তৈরি হয় কয়েকটা সরু তীক্ষ্ণ টানে । বেহালার ছড় থেকে ছড়ছর  মুত্রস্রোত, - সমস্ত নিয়েই যার স্পেকট্রাম আর অক্টেভ সময়ের ছুটন্ত তীরকে সে বাঁকিয়ে দেয় । প্রদীপ থেকে বিচ্ছিন্ন করে শিখা । একটা কম্পমান লেসার বীমের গুঞ্জন, যা ট্রিগার করবে একটা ডিটোনেটরকে একটা বিনাশী ঘ্রাণ, আর ভয়ঙ্কর শব্দে ধ্বসে পড়বে একটা কংক্রিটের দেওয়াল । এক পাশে  ভাঙবে আর গড়ে তুলবে অন্য পাশে । ঘুম ভাঙলে চেতনায় এক   ‘পেরেক ও রত্নখচিত দেওয়াল, নীল প্রলেপ’, -যার কোনও স্থানাংক নেই ।  তৈরি হয় অ্যাবস্ট্রাক্সন, এক অসম্ভব ও অসংযত জ্যামিতি । ক্রমে এক ও অনেক সম্পর্ক ইশারিত হয়, আর ছড়িয়ে পড়ে তার তরঙ্গ-মূর্ছনা ।  মস্তিস্কের করটেক্সে লিম্বিকে তার রেশ থেকে  যায় দীর্ঘ দিন । মরজগতে জীবনে সমাজে, প্রকৃতি-প্রাণী-বস্তু-ও-অবস্তুর মধ্যে সতত পরিবর্তনশীল সমস্ত সম্পর্কের নিরন্তর সৃষ্টি-কৌতূহল-যুক্তি-ও-আবিস্কারের নামই হোল কবিতা, - ভাবি আমি ।         
নিউ ইয়র্ক শহরের এক অপ্রচলিত রাস্তার কিনারে বসে ছিল তিনজন পাঙ্ক । একজন সমাজবিজ্ঞানী, ভ্রাম্যমাণ-নোটবই-ও-টেপরেকর্ডার, প্রচণ্ড উৎসাহ, ওদের বললেন ‘এই শহরে আপনাদের অবস্থান নিয়ে যদি কোনও প্রতিক্রিয়া ...’। একজন পাঙ্ক বললো, ‘একটু পরেই আমি ওই দেওয়ালটায় ছড়ছর কোরে পেচ্ছাব করবো, আওয়াজটা টেপ কোরেই কেটে পড়ো’
-কবিতা কখনো সাজিয়ে রাখার আর জড়িয়ে থাকার । কপালের বিন্দি, আর কোমরের প্যান্টালুন ।  জোব্বার নীচে জ্বলন্ত কাংরি । কবি কালিদাস যেমন বলেন, উপমা-ই কবিতা । -ব্যবহৃত হতে হতে হতে ক্রমে সে  হারাতে পারে তার স্বাদ গন্ধ উষ্ণতা । সময়ের টান লাগে কবিতার ত্বকে । কবিরা জানেন এই  সবই । তাই অমরতা, তাই ত্বকের যত্ন নিন ।  সন্দীপনই সম্ভবত, লিখেছিলেন ‘সমুদ্র-ঢেউয়ের ধারে লাল বলের ওপর এক পা রেখে দাঁড়িয়ে ছিল যে বালক, তার চেয়ে বেশি কবিতা আর দেখিনি’ । - কেন, তা কে বোলবে ?  অথবা, কবিতা কি সেই নীল দ্বিচক্রযান ? পাঠককে নিয়ে যে পারে একযোগে মুখ থুবড়ে পড়তে ? আহত ও বিপর্যস্ত ! অথবা সে প্রকৃতই বহন করে, নিয়ে যায় কক্ষ থেকে কক্ষান্তরে, চলে যায় তীব্র বেগে দূরে বহুদূরে, গ্রহান্তরে বুঝিবা । রেখে যায় শব্দ তরঙ্গে বর্ণালীতে তার নিজস্ব সিগনেচার, ডপলার এফেক্ট ।    
- আমি কীভাবে কবিতা লেখা শুরু করবো জানতাম না। কেউ বলে দেয়নি আমাকে । ছোটবেলার ছড়া-গান-আর-পদ্য লেখার খাতা । দশ বছরের বালকের হাফ প্যান্ট আর উড্ পেন্সিল । - নীল বোর্ডে বাঁধানো সেই ডায়েরি  আমি আজ খুঁজে পেলাম পঞ্চাশ বছর পরে !  তার সারা গায়ে জল ও মাটির দাগ, যে মাটিতে তিন পা হাঁটলেই কবিতার পাখি কলমের আগায় এসে বসে । সেই গাঙ্গেয় হাওয়া, জল আর এঁটেল মাটি ।  পঞ্চাশ বছরের সূর্য কিরণে তাদের আজ টেরাকোটা বলে ভ্রম হয় ।  আমি তাকে স্পর্শ করি আর গন্ধ শুঁকে দেখি, - পাতায় পাতায় কতো জন্মদিন, কতো ঝড়ের রাত আর খেলার মাঠ । কতো হীরামন, নাচুনি, আর স্তনদায়িনী দেখি, কবিতার নাম ‘প্রার্থনা’, ‘মুক্তি’ ! কবিতার নাম ‘মহালগ্ন’ ! সময়ের জমাট অ্যাম্বারের স্বচ্ছতার ভেতরে তারা আটকে রয়েছে স্থির, ফসিলের মতো ।  দেখে  আমি  নির্বোধ  হেসে  উঠি। 
( ক্রমশ )
-----------------------------
'জারনি৯০স'  সাহিত্য পত্রিকায় আমার এই লেখাটা ধারাবাহিক প্রকাশিত হতে শুরু করেছে। প্রথম অংশটি বেরিয়েছে ওদের সদ্য-প্রকাশিত অক্টোবর-২০১১ সংখ্যায়।  অনেকের অনুরোধে এবং জারনি৯০স-এর সম্মতি নিয়ে শুধু এইবার এটা আমার ব্লগেও পোস্ট করা হোল।