Thursday 21 June 2012

আমার কবিতার অন্তরালে শব্দ বর্ণ স্রোত...



সাত পর্বে সমাপ্ত আমার এই লেখাটা ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হয়ে চলেছে জার্নি '৯০ পত্রিকায়, -সদ্য প্রকাশিত হয়েছে এর তৃতীয় পর্ব (মে ২০১২)। 

জার্নি '৯০র সম্মতিক্রমে এই ব্লগের পাঠকদের  জন্যে  আগেই আপলোড করা হয়েছিলো লেখাটার প্রথম পর্ব, -এবারে রাখা হোল পাঁচ মাস আগে প্রকাশিত দ্বিতীয় পর্বটি।  - শংকর লাহিড়ী   




-------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------

.  “ জন্ম-পঙক্তি থেকে একটা লাইন পড়ো, সারা সৃষ্টিতে এই প্রথম একবার কাজ...”  ( স্বদেশ সেন ) 

      

       উইলিয়াম বারোজ বলেছেন ‘প্যারিস রিভিউ’ ইন্টারভিউতে, ‘আমাকে ওরা প্রশ্ন করছে, আমি যদি একা নির্বাসিত হতাম কোন সমুদ্র-ঘেরা নির্জন দ্বীপে,যদি জানতাম কেউ কখনো পড়তে পাবে না আমার লেখাগুলো, আমি কি তাহলে চালিয়ে যেতাম লেখালিখি ? এর উত্তরে অবশ্যই বলবো, হ্যাঁ।  কারণ, লেখা দিয়ে আমি তৈরি করি আমার নিজস্ব এক জগৎ যা আমাকে সঙ্গ দেয়। যা আমার চিরদিনের, আমার বাসভূমি।’    

শিল্পে সাহিত্যে একজন পর্যবেক্ষকের কাজ ঐ নিজস্ব জগতের তৈরি হওয়ার ইতিহাসকে বুঝে নেওয়া
কীভাবে রচিত হয় সেই নিজ বাসভূমি যা আজীবন সঙ্গ দেয়। শৈশবের নরম মাটিতে ভিত কেটে কীভাবে  সময়ের সাথে ক্রমে গড়ে ওঠে তার স্তব্ধ রঙিন ঝংকৃত আলোঅন্ধকার সিঁড়ি ও বারান্দাগুলো, যা তার চিরদিনের। তার স্নান ও তৃষ্ণা, তার ভোরের সূর্য ও সাঁঝবাতি। আর সেইসব জোহারি জানালা ( Johari  window), যার ফ্রেমের মধ্যে সীমায়িত হয়ে আছে তার অস্তিত্বের জানা ও অজানা অংশগুলো।  

   
 
 
      
 আমরা যারা ১৯৫০ সালে ভারতবর্ষে জন্মেছি। সদ্য স্বাধীনতা পাওয়া সেকালের যুবক যুবতীদের হৃদয়ে তখন এক বিস্মিত হিন্দোল। সেই এক জটিল ও উল্লসিত সময়ের প্রেমের ফসল আমরা। কলকাতা শহর তখন মাত্র কয়েক বছর আগে জাতি-দাঙ্গা থেকে ফিরেছে। আর দেড়শো মাইল দূরে জামশেদপুরের লৌহনগর আস্তে আস্তে ভুলতে চেষ্টা করছে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের ধোঁয়াটে দিনগুলো। সেই সফল সময়ে আমার বাবা মায়ের বিয়ে হয়ে গেল, তখন ১৯৪৯ সালমা ছিল স্কুলের বেসবল টিমের প্লেয়ার  সাম্যবাদী প্রিয় কবি নজরুল আর প্রিয় গান ছিল ‘কদম কদম বাড়ায়ে যা, খুশি কি গীত গায়ে যা...।’ গানের তালে তালে  আঙুল ঝাঁকিয়ে আর শরীর দুলিয়ে, অদ্ভুত জেশ্চার সহ, সামান্য প্ররোচনাতেই আধো লজ্জায় আধো  নিবেদনে মা গেয়ে দিতো এই গানটা। সম্ভবত এইটাই ছিল শিশু বয়সে আমার শোনা প্রথম গান। এই গান দিয়ে মা আমাকে পৃথিবীর আলোয় নিয়ে এসেছিলো          

যুদ্ধের দিনগুলোয় বোমারু বিমানের আক্রমণ থেকে সপরিবারে বাঁচার জন্যে জামশেদপুরে ভেতর-বাড়ির উঠোনের একপ্রান্তে দাদু মাটি খুঁড়ে বানিয়েছিল একটা ছোট বাঙ্কার; মাটির নীচের সেই ঘরে সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেলে  ভেতরে আলো জ্বালানো যেতো। উঠোনের পাঁচিলে আলকাতরা দিয়ে তীর চিহ্ন এঁকে ইংরিজিতে বড়ো কোরে লেখা  ছিল ‘টু দি ট্রেঞ্চ’। সুদূর আমস্টারডামে অ্যান ফ্রাঙ্কদের পরিবার যখন নাৎসিদের গ্যাস চেম্বার থেকে বাঁচার জন্যে আত্মগোপন করে আছে, বিশ্বযুদ্ধের সেই ভয়াবহ দিনগুলোতেই জামশেদপুরে নিজের পরিবারের জন্য দাদু তৈরি করেছিলো এই
অবিশ্বাস্য ট্রেঞ্চ।  

আমার জন্মের মাত্র দু-মাস আগে আমার দিদিমাও সন্তান প্রসব করেন। এগারোটি ছেলেমেয়ের মধ্যে সেই তাঁর সর্বশেষ, সেই আমার ছোট মাসি। জামশেদপুরে দাদুর বাড়িতে ধাইমার-হাতে-প্রসূত দুই ছেলে  মেয়েকে প্রতিদিন ধুয়ে মুছে সাফ কোরে, তেল মাখিয়ে, উঠোনে সেই ট্রেঞ্চের খুব কাছেই হেমন্তের নরম রোদে
সজনেগাছের ছায়ায় একটা পরিত্যক্ত ক্যারম বোর্ডের ওপরে শুইয়ে রেখে সংসার সামলাতো আমার মা ও দিদিমা। বাড়িতে একটা সাঁওতাল মেয়ে কাজ করতে আসতো, তার কালো চিকন গায়ে নিম তেলের গন্ধ; বহুদূরে ডিমনা-লেকের কাছে কোনও এক অজ গ্রাম থেকে পাহাড়-ডুংরি শালজঙ্গল পেরিয়ে প্রতিদিন আট-দশ মাইল হেঁটে আসতো সেআকাশের বিস্তৃত নীলিমায় ভাসমান মেঘের কিউপিড, আর অনেক নীচে সিংভুমের লাল মাটির নিকনো উঠোনে ক্যারম বোর্ডের ওপর পাশাপাশি শুয়ে উদোম দুই শিশু। -সেই  থেকে নীলাকাশ আমার চোখে লেগে গেল। কতো মেঘের শব্দরূপ ও ধাতুরূপ। সেই থেকে আমি ‘ভালবাসি মেঘ, চলিষ্ণু মেঘ, ঐ ওপরে, ঐ ওপরে’ (র‍্যাঁবো / বুদ্ধদেব বসু)  

তার পরে আরও কতো ‘কোদালে মেঘের মউজ’ উঠলো, আর ‘আকাশের নীল গাঙে হাবুডুবু’ খেলো কতো তারা। জীবনে তার পরে কতো মেঘের সংসারের ভেতর দিয়ে কতো রকম বিমানে উড়ে গিয়েছি আমি। নিচু মেঘের মধ্যে দিয়ে কখনো ফকার, সেসনা, কিং এয়ার, বীচক্র্যাফট্ বোনাঞ্জা। কখনো মেঘের অনেক ওপর দিয়ে বিশালাকায় জেট, -এয়ারবাস, বোয়িং। মেঘও কতো রকমের; ল্যামিনেটেড, রেখায়িত, বিচ্ছুরিত আলোর মেঘ। কখনো তারা পেঁজা তুলো, ক্ষীরসমুদ্র, উড়ন্ত সিফন
কালো পাথরের বিশাল চট্টান আর ভারী দূর্গের মতো বজ্রগর্ভ, ঝলকানো মেঘ। যেন তারা ডুইনো দুর্গের দেবদূত পর্যায়ের শ্রেণীবদ্ধ শ্রোতারা।

ছোটবেলায় আমার খুব ভালো লাগতো মেঘ-ডাকা ব্যাং-ডাকা বৃষ্টির দিনগুলো। জামশেদপুরে মামার বাড়িতে মেজমামা গুনগুন করে একটা গান গাইতো, ‘এই
মেঘলা / দিনে একলা / ঘরে থাকে না তো মন’। তখনো তার বিয়ে হয় নি। আর যুদ্ধের দিনগুলোর কথা মনে পড়লে দাদু প্রায়ই গাইতো তার প্রিয় একটা গান, ‘...ভয় কি মরণে / রাখিতে সন্তানে / মাতঙ্গী মেতেছে আজ সমর রঙ্গে’। কখনো নেচে নেচে, মুষ্টিবদ্ধ দুই হাত শূন্যে তুলে  পুর্ববঙ্গীয় উচ্চারণে দাদু আমাদের শোনাত সেই গান। নিজের হাতে দাদু একটা বড়ো কাঠের বন্দুকও বানিয়েছিল, তাতে গুলি ভরার ব্যবস্থা ছিল না কিন্তু তার ট্রিগার টানা যেত। বোমারু বিমান নয়, দাদু ওটা বানিয়েছিল যুদ্ধ শেষ হলে সারাদিন পাঁচিলে বসা কর্কশ দাঁড়কাকগুলোর জন্যে। উঠোনের মাঝখানে একহাঁটু মুড়ে, খাকি হাফপ্যান্ট আর সোলার টুপি পরা দাদু সদর্পে সেই বন্দুক বাগিয়ে ধরতো পাঁচিলের কাকগুলোর দিকে, আর একটু দূরে আড়াল থেকে আমার ছোটো মামা একটা তারে-বাঁধা লোহার খোলে এক চিমটে বারুদ ঠেসে দেওয়ালে আছড়ে সশব্দে ফাটিয়ে দিতো। দাদুর ট্রিগার টানা আর মামার শব্দবাজি একযোগে হলে কাকের দল তারপরে শুধু বন্দুক দেখলেই উড়ে পালাতো, আমরা দেখেছি। উঠোনে সজনে গাছের ডালে দাদু ঝুলিয়ে রাখতো বন্দুকটাআমার জীবনের স্মরণীয় ভিশুয়ালগুলোর মধ্যে কবেকার এই দারুণ সিনেমাটিক দৃশ্যটা আজও রয়ে গেছে।

মামার বাড়িতে সাহিত্য-কবিতার কোনও রেওয়াজ ছিলোনা
তবে দিদিমা অনেক প্রাচীন ছড়া জানতেন, আর দাদুর সাথে কখনো রাগে অভিমানে ঝগড়ায় খুলে যেত তাঁর পূর্ববঙ্গীয় ঢাকা-বিক্রমপুরের লোককথা আর প্রবাদের ভান্ডার। মেজমামার পছন্দ ছিল রামলীলা, কাওয়ালি। মামাবাড়ির উলটো দিকে বিহারী বাড়ির তিনতলার ছাদে প্রতি বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় দেহাতি গানের আসর বসতোগায়কদের পরনে ছিল হেঁটো ধুতি, ফতুয়া, আর কাঁধে গামছা। বাতাসে সজনে ফুল আর নিম ফুলের গন্ধ। অনেক রাতে ঢোল খঞ্জনি সহযোগে সমবেত কন্ঠে সেই সব রামগানের বিলম্বিত ও ক্রমিক দ্রুত লয়ের অপার্থিব ভোজপুরি  ঝনঝনা ছড়িয়ে পড়তো দূরে দূরে। রবীন্দ্র-নজরুল-বাউল গানের চেয়েও অনেক বেশি সারল্য ও মাদকতা ছিল সেই সব দূরগামী সুরে, লয়ে, তানে                     

আমার বাবা-কাকাদের বাড়ি ছিল কোলকাতায়। চাকরি ছিল ডালহৌসিতে, ইস্টার্ন রেলের সদর দপ্তরে। বসিরহাটের কাছে বিথারি গ্রামে ঠাকুরদা-ঠাকুমার মৃত্যুর পর, পাড়াগাঁর বাস্তুভিটে আর ধান পাট পুকুর বাঁশঝাড় সুপুরী কলা খেজুর নারকেল গাছ, -সবই শরিকদের ব্যবস্থায় ছেড়ে দিয়ে বাবারা কোলকাতায় এসে ছাত্র পড়িয়ে কলেজ পাশ করে রেলের চাকরি পেয়েছিল। ইছামতী নদীর কাছে সেই গ্রামের বাড়িতে আমার কখনো যাওয়া হয়নি। কোলকাতায় আমাদের বাসা ছিল উত্তর কোলকাতার বাগবাজারে, গোপিমোহন দত্তের লেনে; আঁকাবাঁকা দীর্ঘ সর্পিল গলির শেষপ্রান্তে এক ভাড়াটে বাড়ির দোতলায়। রট আয়রনের রেলিংয়ের ওপর সরু এক-চিলতে আকাশ থেকে কাক, শালিক, পায়রা ও চড়াই পাখী উড়ে  এসে বসতো। -সেই ছিল জন্মের প্রথম বছরে জামশেদপুর থেকে ফিরে কোলকাতায় আমার নাগরিক জীবনের প্রথম ঠিকানা।

ছুটির দিনে সকালবেলায় বাবা
-কাকার কোলে চড়ে বেড়াতে যেতাম। তখন পালোয়ানরা আখড়ায় মুগুর ভাঁজত, আর ভিস্তিরা রাস্তাগুলো ধুয়ে দিতো হাইড্রান্টের গঙ্গাজলেবাড়ী ফেরার সময় ঐ সরু সর্পিল গলিপথে একটা বাড়ির খোলা জানালায় গরাদ ধরে এলোচুলে দাঁড়িয়ে থাকতো কল্যাণী নামের এক উদ্ভ্রান্ত পাগলিনী। গলির মুখ থেকে কখনো শোনা যেত তার শীতল চিৎকৃত সুরেলা গান ‘মধুর আমার মায়ের হাসি...’ -আর আমি ভীষণ ভয়ে মুখ ঘুরিয়ে থাকতাম। বাড়ি ফিরেও আর একটা হার্ডল ছিল। বাড়ির ভেতরে ঘোরানো সিঁড়ির পাশে মিহি অন্ধকারে হাতুড়ি দিয়ে কয়লা ভাঙ্গতো এক মাঝবয়েসী ভারি  মেয়েমানুষ তার আবলুশ কাঠের মত রঙ আর গুড়াকু-উজ্জ্বল দাঁত নিয়ে সে আমাকে দেখলেই অন্ধকার  ঝাঁকিয়ে বলে উঠতো, ‘ছুঁ...য়ে দেবো’ তখন আমার বছর দুই বয়েস; তখনো আমি ঠাকুমার ঝুলির  গল্পগুলো পড়িনি। সেই ছিল আমার দুধ-ছেলেবেলা, আমার যা আজও মনে পড়ে, -কোল থেকে কোলে, টলমলে পায়ে কত কিছু আবিস্কারের, আর স্তনবৃন্তে ঠোঁট রেখে অবেলায় ঘুমিয়ে পড়ার দিনগুলোএকদিন দমদমে ছোটোপিসির বাড়িতে গিয়েছি, আমি তখনও মার কোলে কাঁখে। মনে আছে, সেদিন আমি  শিশির দুধ সরিয়ে রেখে পিসির দুধ খেতে চেয়েছিলাম। শুনে, পিসির কি খিলখিল হাসি, আর এক নিমেষে ব্লাউজের বোতামগুলো খুলে মুখের কাছে তার উন্মুক্ত দুধে-আর্দ্র স্তন! -কতো সহজ চাওয়া পাওয়ার কাল ছিলো সেই শৈশব। পিসির তখন বাইশ বছর। তারও কোলে মেয়ে, বয়সে আমার চেয়ে সামান্যই ছোটোজীবনের অর্দ্ধেক পথ পেরিয়ে বিবাহবিচ্ছিন্না সেই বোন একদিন ক্যান্সারে মারা গিয়েছিলো                     

বাড়িতে আমাদের সাথেই থাকতো বাল-বিধবা মেজো পিসি ও তার মেয়ে, আমি যাকে ছোড়দি বলতাম। আর ছিল দুই পিঠোপিঠি কাকা, দুজনেরই শখ ছিল দেশভ্রমণ আর ফটোগ্রাফি। হরিদ্বার মুসৌরি লালকেল্লা আর কন্যাকুমারিকার সাদাকালো অজস্র ছবিতে ভরা ছিল তাদের অ্যালবাম। মেজকাকা যাতায়াত করতো কম্যুনিস্ট পার্টি অফিসে; ট্রাম ভাড়া এক পয়সা বাড়ানোর প্রতিবাদে মিছিলে গিয়ে পুলিসের লাঠি খেয়ে বাড়িতে ফিরে হৈ চৈ, -এ আমার এখনও মনে আছে। আমরা সবাই একসাথে এক হাঁড়িতে দীর্ঘ দিন ছিলাম
            
    
       যে কোনও রচনার গঠনসৌষ্ঠব, যাবতীয় অলঙ্কার ও বিমূর্ত রূপের অন্তরালে থাকে লেখকের  সামুদায়িক ভাষার, ভাবনার ও মননশৈলীর ক্রমবিকাশের ইতিহাস। কীভাবে তৈরি হয় লেখার প্ররোচনা,  বিষয়, শব্দ, যতি, নিজস্ব স্টাইল। কতোটা ভুমিকা থাকে শৈশবের কৈশোরের অনুভবগুলোর, পঠন পাঠনের, আনন্দ-আহ্লাদ-যন্ত্রণা-বিষাদের।  কীভাবে সে কথা বলা শিখেছে, কী পরিবেশে। কানে বেজেছে কোন সুর, ধ্বনিতাদের ফোনেটিক নোটস, স্বরলিপি ও সরগম। কীভাবে আবিষ্কার ও বিস্ময়। কীভাবে প্রথম জল পড়ার শব্দ, ঝর্ণার শব্দ, ঝড়ের শব্দ, কাঠ পোড়ার শব্দআর তার নিজস্ব সিন্দুকে সঞ্চিত যাবতীয় বিশেষ্য পদগুলো। যাবতীয় বিশেষ্য ও সর্বনামের মধ্যবর্তী সম্পর্কের সব টানাপোড়েন। কীভাবে জন্মের সাত পাউন্ড ওজন থেকে ক্রমে বেড়ে উঠেছে ঐ দুশো ছয়টা হাড়, বল-জয়েন্ট, মাংসপেশি, ভ্রুপল্লব, গ্রীবা ঠোঁট ও স্নায়ুগ্রন্থি সকল। আমাকে আজও অবাক করে, কীভাবে মায়ের  কোলে চড়ে মেটারনিটি হোম থেকে বেরিয়ে আসে রোঁয়াওঠা শিশুরা। ক্রমে সে মায়ের কোল থেকে নেমে হামাগুড়ি দিয়ে টলমল পায়ে উঠে দাঁড়িয়ে, দুধের শিশি ছেড়ে, এক পা দুপা কোরে হেঁটে দৌড়ে তালে তাল দিয়ে, একটা সম্পূর্ণ নতুন ভাষায় কথা বলা ও বর্ণমালা শিখে, আদর হিংসে বায়না ও বজ্জাতির রহস্য ভেঙ্গে, কতশত বিশ্বাস অবিশ্বাস শিক্ষা ছলনা ও আবিস্কারের মধ্য দিয়ে ক্রমে একটা পূর্ণ মানুষ হয়ে উঠে দাঁড়ায় মাত্র কয়েক বছরে!   

–এই সবই আলোচ্য, যার মধ্যে নিহিত রয়েছে যাবতীয় রচনার আবৃত রহস্যের উৎসমুখ। - কী কথা তার সাথে এক মারণ রোগের ? কী সম্পর্ক তার সাথে মাঝ রাতের হিম হাওয়ার, আর অন্ধকার সিঁড়ির ? কিভাবে ভরে  উঠেছে তার দীর্ঘ দিনের অর্জিত ব্যাগেজ, যাতে আছে ব্যক্তিগত ফাঁকা কফির টিন, ভ্রঙ্গুর ফ্রুটবোল, দিব্য কাঁসা, প্রবল বারুদ, চতুর্দশপদী গন্ধ, উন্মাদের তীব্র আফটার শেভ, ব্রোঞ্জের ডানা, গুঞ্জনময় জল, দেওয়াল ও বিছানা, হিম পেন্ডুলাম, চাবুক ও হারপুণ
! - জীবনের জানা অজানা অনেক অভিঘাত থেকে ক্রমে তৈরি হয়েছে তার বোধ, বাচনভঙ্গি, শব্দচয়ন। তার সুরের কম্পোজিশান। তার ছবি ও কবিতার বুনট, টেক্সচার, রঙ যা ছড়িয়ে যায়, দোলা দেয়, ভাবায়। নিজেকে মুগ্ধ উদাসীন আপ্লুত করে, আর প্রচুরের রঙ লাগে মন-পেন্টিয়ামে। এই সব নিয়েই ধীরে ধীরে একদিন তৈরি হয় প্রথম কবিতার বই ‘শরীরী কবিতা’র অ্যাবস্ট্রাকশান, -ব্যক্তিগত বোধের এক স্তব্ধ শিহরিত জগত ও তার বিন্যাস, -তাকে ‘জাগাবে বলে উড়ে আসে দীর্ঘ ডানার পাখিরা’                        
একজন নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষকের মতো তাকে আজ দেখতে চাওয়া, বুঝতে চাওয়া তার টানাপোড়েনের সুতো, তার হস্ত-চালিত তাঁত। পাঁজরে নাভিতে লিঙ্গে কশেরুকায় যে আমি, সেই আমিই আমার ইচ্ছায় কল্পনায় হরমোনে স্নায়ুগ্রন্থিতে। ঐ যে আকাশে উড়ে যাচ্ছে এক ঝাঁক টিয়া, খোলা ছাদে রোদে শুকচ্ছে তারে মেলে দেওয়া হলুদ রঙের শাড়ি, -এর প্রতিফলিত আলোর কম্পমান ফোটনস্রোত এসে আমাদের  চোখের মণি দিয়ে প্রবেশ কোরে আছড়ে পড়ছে রেটিনায়, আর ছড়িয়ে যাচ্ছে মস্তিষ্কের দুই অর্ধে। তৈরি হচ্ছে একই ছবির আলাদা চারটে প্রিন্ট, -তার আকার গতি গভীরতা ও রঙ। কীভাবে চারটে ছবি মিলেমিশে নিমেষে আবার এক হয়ে গিয়ে কি হিল্লোল তোলে মগজের গোপন কক্ষে; আমরা দেখি জল পড়ে, পাতা নড়ে, পাখী ডানা মেলে উড়ে যায়। -আর উড়ে যায় আমাদের মন। শরীরে তার স্পর্শ গন্ধ স্বাদ। তার শব্দ বর্ণ তরঙ্গস্রোত

এভাবে এক মুহূর্তে টুকরো করে ভেঙ্গে তাকে সহসা পুনর্নির্মাণে হিল্লোলিত কোরে তুলতে পারে একটা কবিতাও।  -প্রকৃতির এইসব অবিশ্বাস্য জটিলতা প্রতি মুহূর্তে কতো সরল বিন্যাসে ও ব্যঞ্জনায় প্রকাশিত হচ্ছে আমাদের চোখে মনে ভাবনায় অস্তিত্বে। এত ইন্দ্রিয়গত, এত ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য, এবং কখনো অতীন্দ্রিয়। কোথায় বসে রয়েছে আমাদের মন? সে কি হৃদয়ে, না মস্তিস্কে? নাকি সর্বাঙ্গে, পায়ের পাতায়, ঠোঁটে, চিবুকে, নাভিতে, শরীরের প্রত্যেক কোষে, -ভাবি আমি।      

জীবন ও জগতের সব আবিষ্কার আর রহস্য-জানালাগুলো খুলে খুলে দুচোখ ভ’রে তাদের
সহস্র লক্ষ  সম্পর্কগুলোকে দেখা ও দেখানোই আমাদের কাজ। এইসব এক্সপ্লোরেশান। এই নিয়েই আমাদের শিল্প সাহিত্য ভাস্কর্য চিত্রকলা সঙ্গীত। এবং প্রকৃত প্রস্তাবে কবি নয়, পেন্টার নয়, শুধুই এক্সপ্লোরার। অবশ্য শুধু আবিষ্কার আর পর্যবেক্ষণ নয়, শুধু কবিত্বপূর্ণ পরিস্থিতিতে অবস্থান নয়, তার সমগ্র জটিলতার সকল নতুন   ব্যঞ্জনার প্রকাশের যে সারল্য তাকে আয়ত্ত করাই তো মূল কাজ। এবং তা মূলতঃ নিজেরই প্রয়োজনে।  

কবি নামেই আমার তাই আপত্তি। কবি মানে, কবিতা রচয়িতা ? কিন্তু কে বলবে, প্রকাশিত সকল রচনার কোনটা কবিতা আর কোনটা কবিতা নয় ? ব্যবহৃত হতে হতে হতে তাই কবি নামের থেকে ক্রমে খসে  গেছে তার ঈর্ষনীয় সব সৌন্দর্য বোধ বিকিরণ ও উদ্ভাস, তার দোলায়িত ম্যাজিক।

সম্ভবতঃ অসাবধানেই জীবনানন্দ বলে ফেলেছিলেন, ‘সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি’। বরং যদি এভাবে ভাবা যায় যে, যতো রকমের মুগ্ধ পাঠক আছেন ততো রকমেরই কবি, তাহলে বুঝি মেহফিলে শান্তি বিরাজ করে।  মদের যেমন নানান মেক, -কোনটা ব্লেন্ডেড, কোনটা সিংগল মল্ট, এবং সেই মতোই তার নাম দাম, স্বাদ ও চাহিদা, সেরকমই আছে শ্যাম্পেন কনিয়াক ও আঙুরের ক্ষেত। ভাতের মদ, গুড়ের মদ আর মল্টেড বার্লির মদের গুণাগুণ বুঝে সেইমতো নেশাড়ু এবং কনয়সিয়র এসে যায় আশেপাশে। আলাদা আলাদা টেবিলে, মজলিশে, নির্বাচনে, নিজ নিজ রুচি ও সামর্থমতো নেশা হয়। শিল্প সাহিত্যেও সেই একই বিচার। সকলেই আদৃত, নিজ নিজ সঙ্ঘারামে, বিবেচনায়, গোষ্ঠীতে
এনিয়ে কোনও শেষ কথা হয় না।   

সাহিত্যের মুল্যায়নে, আনন্দ ও মুগ্ধতার উৎসমুখে মেধা ও মননগত শ্রেণীবিভাজন তাই অনস্বীকার্য।  সময়ের সাথে সাথে জীবনবোধ ও ভালো লাগার সূত্রগুলোও অনেকটাই বদলে যেতে পারে
তবে যে মদ  সময়ের সাথে বিক্রিয়া করেও দীর্ঘকাল নষ্ট হয়না, আরও সুস্বাদু হয়, তারই প্রশংসায় মেতে থাকে কনয়সিয়ররা। কবিতাও অনেকটা তেমনি। কোনও ওয়াইনের যেমন আছে স্পার্কল, যেমন তার কালার, বোকে, প্যালেট, ফিল, ফিনিশ, -সেই রকম কবিতার আস্বাদনেও থাকতে পারে অনেকগুলো স্তর। একটা ভালো পারফিউমের অন্তর্গত বিভিন্ন নোটসের মতোই কবিতার গঠনও বিন্যস্ত হতে পারে স্তরে স্তরে, রৈখিকতার সীমাকে অতিক্রম করে কবিতার মতোই ভালো ওয়াইন ও পারফিউমের রহস্যময় আবেদন তাই আমার প্রিয়। -“ইজ ইট পারফিউম ফ্রম এ ড্রেস /দ্যাট মেক্স মি সো ডাইগ্রেস ?” (প্রুফ্রক / এলিয়ট)

স্বদেশ সেন বিশ্বাস করেন, ‘কবি’ হচ্ছেন হৃদয়ের কারিগর, -এঞ্জিনীয়ার অফ হিউম্যান সোল। আর সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় একদিন বলেছিলেন জামশেদপুরে কৌরবের এক আড্ডায়, যা ছাপা হয়েছিলো  ‘কবিতার ক্যাম্প-৩ (১৯৮২)’তে,  “...অনেকে অধ্যাপক হয়ে যায়। তুমি ভাবতে পার ? যদি বল আমি অধ্যাপক নয় তবে ঝি বাসন মাজবে না, জানলায় পর্দা উড়বে না। সব বন্ধ হয়ে যাবে। ঐ জন্য ঝিও জানে আমি অধ্যাপকের বাসন মাজছি। ভাবতে পারেন আপনি, বউও জানে, আয়াম স্ক্রুড বাই আ প্রফেসর ? সব্বাই। বিশেষ কোরে কবি টবি যখন হয়ে যাও, ভাবা যায় না। আমি কে, না আমি কবির ঝি। ভাবতে  পারো, একটা কবি এসে দাঁড়ালো ? অথচ এটা বাঁচিয়ে না রাখলে ওদের উপায় নেই কোনও। কবি গেলো তো সব গেলো...
” –কমল চক্রবর্তীর বাড়িতে সেই আড্ডায় আমরা কয়েকজন। সন্দীপনের কোনও সংশয়ই ছিল না, দ্বিধাহীন তাঁর মন্তব্য।  

বৃষ্টিতে আগুনে বাতাসে মানুষে শ্বাপদে চরকায় কার্পেটে চিতায় ঘুঙুরে দলিলে দানপত্রে যে সহস্র লক্ষ সম্পর্ক প্রতিদিন জন্ম নিচ্ছে, ভাঙ্গছে, পুনরায় গড়ে উঠছে, -সেই সবই আমার বিষয়। কবি নয়, এক্সপ্লোরার। ব্যক্তিগত নিরীক্ষণের সেই অসীম সাম্রাজ্য, যেখানে বাদ থাকবে না কোনও কিছু
যা কিছু জ্যামিতিক ও অ-জ্যামিতিক, যা কমলালেবু ও না-কমলালেবু। যা কিছু যৌন এবং অযৌন। যা কিছু শাদা-কালো ও রঙিন, আর যা কিছু না-রঙিন। বিষয় আমার কবিতায় সরাসরি থাকেনা; একটা অস্পষ্ট সূক্ষ্ম তারজালির মতো কবিতাকে সে ধরে রাখে। সময়ের সাথে সাথে সমস্ত সম্পর্কের ভাঙ্গা-গড়া, আর ক্রমাগত পাল্টে যাওয়া তাবৎ দৃষ্টিভঙ্গি যেভাবে জীবনকে দেয় প্রতিনিয়ত এক অচেনা আলোর উদ্ভাস, -যেভাবে টান লাগে রক্তনাড়িতে
 

 
 
      শৈশবে সেই অন্ধকার সিঁড়িঘর আর ‘ছুঁয়ে দেবো’ কথাটা আমাকে ভয় দেখাতো। আর খোলা জানালায় চেনে-বাঁধা এলোচুলের পাগলিনী তাতে যোগ করতো আরও রহস্য আর ভয়। এই যতি চিহ্ন গুলোর মধ্যে জীবন ভরে থাকতো অনেক আদরে কান্নায়, আনন্দে আলোয় দুধে, ছবিতে সুরে রঙে। ক্রমে একদিন বাগবাজারের সেই বাড়ি ছেড়ে আমরা দমদমে চলে এলাম। পরপর দুটো বাড়িতে অল্প কিছুদিন কাটিয়ে বাড়িওলার সাথে বনিবনা না হওয়ায় উঠে এলাম একটা নতুন বাড়িতেসে বাড়ির বাড়িওলা থাকতেন শ্যামবাজারে, ফলে পুরো দোতলা বাড়িটাতেই আমরা। সেই পাড়ায় ছিল অনেক গাছ, সাহেব বাগান, খেলার মাঠ, বিরাট নীল আকাশ, আর আমাদের রেলিং-ঘেরা দশ-বাই-বারো একটুকরো ছাদ।  এক কাঠারও কম জমিতে লাল রঙের সেই ছোট্ট নতুন বাড়িটা তৈরি হয়ে যেতেই বাবারা সেটা ভাড়া নিয়েছিলো আশেপাশে অনেক খালি জমিতে বিকেলে খেলা করতাম আমরাঅনেক বাড়ির ভিতের মধ্যেও খেলতে নেমেছি আমি। সবুজ ঘাসের ওপর চুনের দাগ, ভূমি পূজো, গাঁইতি, কোদাল। রাতে বিছানায় শুয়ে দেখেছি, নখের কোণে মাটি লেগে আছে। ভিতের মধ্যে রঙিন পাথর, কাদামাটি, জলভিতের মধ্যে হাফ প্যান্ট আর ইজের খুলে হিসি করা, কুড়িয়ে পাওয়া ঝিনুক। আমি একটা স্লেট রঙের পাথর কুড়িয়ে পেয়েছিলাম; রোদ্দুরে সমস্ত শৈশব জুড়ে তার অভ্র চিকচিক করতো।     

ছোটবেলায় পাখি-ডাকা ভোরের মধ্যে খুব একটা শিহরণ থাকে। খুব ভোর বেলা ঘুম ভেঙ্গে যেত আমার। ঘামে ভেজা কাঁথার প্রান্তে কোথা থেকে ছুটে আসতো হাল্কা  হাওয়ার পাল, ছোট কাকা যাকে মলয় বাতাস বলতো। জেগে উঠতাম জল পড়ার কলকল শব্দে। বাথরুমের বালতিতে ভরা হচ্ছে ভোরবেলার জল। ঘাম শুকিয়ে কপাল তখন হিম হয়ে উঠেছে
মা ভাবতো, ইস, হিম লেগে গেছে ছেলেটার। ঘুমের দরজা থেকে  এক পা বাড়িয়ে আমি স্পষ্ট শুনতাম সেই কথা। ভোরের বালতিতে জল পড়ার সেই কলকল শব্দ আমার কানে লেগে রইলো আজীবন। -আর কী সুন্দর গন্ধ ছিল সেই ভোরের কাঁথায়, তেল জল আর দুধের বাটির গন্ধ। রোদে তেল মেখে হুটোপাটি, আর স্নান। ছিল আয়না চিরুনি আর টিনের কৌটোয় পাউডার, বরফ-ঢাকা হিমালয় পর্বতের ছবি থাকতো সেই টিনে। তখন আমি পাহাড় আঁকা শিখেছি। সারি সারি ত্রিভুজ-পাহাড়ের পেছনে লাল সূর্য উঠছে আর ফোরগ্রাউন্ডে ধোঁয়া উড়িয়ে ছুটে যাচ্ছে রেলগাড়ি,-এই ছিল আমার প্রথম জলরঙে আঁকা ছবি। আমার আঁকা ছবিগুলো হতো সবুজ কমলা আর বাদামী রঙে। একদিন রং-তুলির টিনের বাক্সয় দেখলাম একটা কালচে নীল রঙের উজ্জ্বল অব্যবহৃত শুকনো খটখটে ট্যাবলেট। জলেভেজা তুলি দিয়ে তাকে কাগজে লাগাতেই অদ্ভুত প্রুসিয়ান-ব্লু রঙে বদলে গেলো সব ঘোলাটে আকাশ। সেই অসম্ভব নীল রঙ আজীবন চোখে লেগে রইলো আমার ‘দেখেছি স্রোতের রঙ ঘন নীল / রেখেছি মেঘের নাম ঘন নীল / দেখেছি শরীর নগ্ন নীল ...’ (শরীরী কবিতা)।     

এ লেখার উদ্দেশ্য আমার জীবনী ব্যাখ্যান নয়। শুধু জীবনের সেইসব সময়চিহ্ন অনুষঙ্গ ও আইকনগুলো স্মৃতির গভীর থেকে খুঁজে বেছে নিজেই চিনে নেওয়ার চেষ্টা যা আমার ভাবনা বিশ্বাস বোধ ও অনুভবকে প্রভাবিত করেছে, যার সাথে সম্ভবতঃ এক গোপন ও ব্যক্তিগত যোগসূত্র রয়ে গেছে আমার সমস্ত রচনার, আমার তাবৎ লেখালিখির।                          

আমার চেয়ে মাত্র এক বছরের ছোট ছিল আমার বোন। টলমলে পায়ে হেঁটে বেড়াতো সে। তার ঘুমের পাশে আমি কতো দুপুর জেগে থেকেছি। দমদমের এই নতুন বাড়িটা, যেটা ছিল আমার জন্মের পরে  পঞ্চম ঠিকানা, -কৈশোরের সবটাই কেটেছিল এই লাল বাড়িতে।  কয়েকটা বাড়ি পেরিয়েই থাকতেন জ্ঞান প্রকাশ ঘোষ, সারাদিন তবলায় আর হারমোনিয়ামে কতো সুর তাল ওঠা নামা করতো সেখানে। আর আমাদের বাড়ির সামনেই ছিল জ্ঞানাঞ্জন নিয়োগিদের বিরাট বাগানবাড়ি। কবি অক্ষয়কুমার বড়ালের   কবিতার আবহ নিয়ে  দুপুরবেলা সেখানে আমবনে ঘুঘু ডাকতো। -বোনের দুপায়ে কাজলের টিপ, গায়ে মাছি বসেছে। বোনের গায়ে এক চিলতে রোদ, দমকা এলোমেলো হাওয়া। একদিন অনেক রাতে সংসারে ঝড় উঠেছিলো। ঘুম ভেঙ্গে বিছানা থেকে শুনেছি পাশের ঘরে বাবার বকুনি। মা বোধ হয় নিঃশব্দে কাঁদছে। টেবিল থেকে এক ঝটকায় ছিটকে পড়া দুধ ভর্তি গ্লাস ; অনেক রাতে নিথর বারান্দায় ভাঙ্গা কাঁসার ঝনঝন শব্দ। পরদিন বোনটা সারাবেলা পড়ে পড়ে ঘুমোলো, -বাসনওয়ালার কাছ থেকে মা কিনেছিল কাঁসার বড়ো গ্লাস আর কাঁধা-উঁচু থালা। শৈশবের স্মৃতিবিজড়িত এই আমার “দিব্য কাঁসা, পানপাত্র...”। দুপুরবেলা বহুদূর থেকে থালা বাজিয়ে বাসনওয়ালা আসছে, শুনতে খুব ভালো লাগতো আমার
         

আমাদের বাড়ি থেকে অনেক দূরে ছিল নদী। খুব ভোরবেলা মুনিলাল আসতো গরু নিয়ে; তার শিশির- ভেজা পায়ে ভোরবেলার খড়কুটো, পাখির পালক, আর শিরায় ছিল ভেরিকোজ
আমি দেখতাম গরুর  পেছনের পা-দুটো বাঁধা। তাল গাছের নীচে এক চিলতে ঘাসের জমিতে কাঠের তৈরি চারপেয়ে বাছুর। তাকে জিভ দিয়ে আদর করতো মৃতবৎসা গরুটা। দেখতাম টিনের বালতিতে গরম দুধ মেঘের মতো ফুলে ফুলে উঠছে। কখনো সন্ধেবেলা দূরে জুটমিলে আগুন লাগতো। আকাশ সামগ্রিক লাল হলে দিগন্তে দেখা যেতো লকলকে শিখা। এক একটা স্ফুলিঙ্গ হাউইয়ের মতো ছুটে যেতো আকাশে। আমরা সবাই ছাদ থেকে দেখতাম। আকাশের পশ্চিম দিকে আঙুল তুলে মা বলতো, ঐ আগুনের ওপারে আছে গঙ্গা নদী, ঐ দিকে মামার বাড়ি তোর, সারারাত ট্রেনে চেপে যাওয়া। সেদিন আমাদের খুব মন খারাপ হতো। আকাশে গনগনে স্ফুলিঙ্গের মতো অজস্র তারা, -সারা রাত তারা খসে পড়তো উত্তরে পশ্চিমে দক্ষিণে।   

আমাদের ঘরে একটা সতরঞ্চি ছিল, আমার খুব পছন্দ ছিল তার লাল নীল ডোরা। বহুদিনের ব্যবহারে ক্রমে জীর্ণ ও ফ্যাকাসে, তার পাড় থেকে একে একে সুতো খুলে আসতো। প্রবল বর্ষায় জানালার খড়খড়িতে সতরঞ্চি টাঙিয়ে আমরা ভারি জলের ছাঁট থেকে বিছানা বাঁচিয়েছি। আমার সাথে সাথে ঐ সতরঞ্চি ক্রমে বড় হয়ে উঠেছে। সময়ের ছোট ছোট চিহ্নগুলো আঁকা হয়ে যেতো তার শরীরে। কতবার দুধের বাটি উল্টে পড়েছে তার ওপর, মায়ের জবাকুসুম তেল, বেঞ্জিনের শিশি। রাঁচি এক্সপ্রেস ট্রেনে এই সতরঞ্চি বিছিয়ে আমরা রাতের বিছানা পেতেছিলাম; -জানালার পাশে ভোররাতের ধলভুমগড় স্টেশান ! আমাদের ঘরে কান্নাকাটির জায়গা ছিল একটা
চৌকির একপাশে জড়ো কোরে রাখা তোষক বালিশ চাদর। সেই স্তুপাকার বিছানা ঢাকা থাকতো ঐ সতরঞ্চি দিয়ে। কতদিন ওর ওপর আমরা মুখ রেখে কেঁদেছি, -পেন্সিল হারিয়ে, ফুলদানি ভেঙ্গে, বানান ভুল কোরে। কতদিন মাকেও কাঁদতে দেখেছি ঐ অন্ধকার কোণে।  নির্জন দুপুরে একলা চোখের জলে ভেজা আমাদের সেই সতরঞ্চি।   

একেকদিন আমাদের বাড়ির অগ্নি কোণে মাঠ পেরিয়ে আকাশ কালো করে ঝড় আসতো। নৈঋত কোণে একটা ঝাঁকড়ালো কদম ফুলের গাছ ছিল। পশ্চিমে ছিল একটা বড় পুকুর, বর্ষায় তার পাড় উপচে কতো পুঁটি-ল্যাঠা-মৌরলা মাছ ভেসে যেতো রাস্তা দিয়ে। সেই রাস্তার নাম ‘হরে কৃষ্ণ শেঠ লেন’। সেই রাস্তার  ডাস্টবিনগুলোয় লেখা থাকতো ‘ময়লা ছুঁইলে শাস্তি পাইবে’। -ছোটোদের কথা ভেবেই লিখতো হয়তো। রাস্তার মোড়ে মোড়ে গ্যাসের বাতিগুলো প্রতি সন্ধ্যায় জ্বালিয়ে দিয়ে যেতো একজন মইওয়ালা লোক।  প্রত্যেক ল্যাম্পপোস্টে থেমে, মই বেয়ে উঠে, দেশলাই দিয়ে গ্যাসবাতি জ্বালালে মৃদু নীলাভ আলোয় দমদমে সন্ধ্যা নেমে আসতো। সেটা ১৯৫৭ সাল।    

সেই রাস্তা দিয়ে সকালবেলা বালতি মাথায় কোরে খাটা-পায়খানার মলমুত্র নিয়ে যেতো মেথররা। বড়ো ট্যাঙ্কারে ঢালার আগে, সারা রাস্তায় তার আঁকাবাঁকা ফোঁটা-চিহ্ন ছড়িয়ে পড়ে থাকতো। বাবার হাত ধরে ছোট ছোট পায়ে  ডিঙি মেরে আমরা সেইসব রাস্তা পেরিয়ে যেতাম। শীতের সকালে কখনো সেই রাস্তায় হরিণঘাটার দুধের গাড়ির ভাঙ্গা-বোতলের প্রচুর দুধ, আমাদের চমকে দিয়ে, গড়িয়ে যেতো শিশিরে ভেজা  রাস্তা ভাসিয়ে। দুধ, শিশির ও মলমুত্রে অভিষিক্ত  শৈশবের সেই রুপবান রাস্তা ! দুপাশে পুটুস ফুলের ঝোপ। ভোরের হাওয়া-বাতাসে তার অদ্ভুত চাপা ঝাঁঝালো ভেষজ গন্ধ। আমি তখন সহজপাঠ পড়ছি, ‘ছায়ার ঘোমটা মুখে টানি আছে আমাদের পাড়াখানি’, কিম্বা ‘ঘন মেঘ বলে ঋ, দিন বড় বিশ্রী।’ একদিন ঘনবরষায় ভোররাতে আকাশ কাঁপিয়ে বাজ পড়লো মাঠের নারকেল গাছে ; জানালার খড়খড়ির মধ্যে দিয়ে প্রবল আলোর ভয়ংকর শব্দ-ঝলকের দাপটে হুঁঙ্কারে সেই প্রথম কেঁপে উঠেছিলো শৈশবের বিছানা

আমার ছোট কাকা শখ করে গল্প লিখতো
কেরানি জীবনের সুখ দুঃখ হাসি মজার গল্প। সচিত্র ভারতী আর বসুমতী পত্রিকায় কখনো ছাপা হতো সেই সব লেখা। তখন আমি স্লেট-পেন্সিল ছেড়ে খাগের কলমে  লিখতে শিখেছি। খাগের কাঠি সারাদিন জলে ভিজিয়ে তার একটা পাশ ছুরি দিয়ে কেটে নিবের মতো চিরে সরু করা হতো।  আর নীল রঙের একটা বড়িকে সারারাত দোয়াত-জলে ভিজিয়ে রাখলে সকালবেলা তৈরি হয়ে যেতো নীল কালি। সেই গাঢ় নীল রঙ, সেই মৃদু নীলাভ আলোর দুধ-রাস্তা, সেই ঈশান কোণ থেকে নেমে আসা বৃষ্টি আর অগ্নি কোণে প্রবল আলোর শব্দ-ঝলক আমার ভেতরে রয়ে গেছে। -এর প্রায় তিরিশ বছর পরে ‘শরীরী কবিতা’ বইয়ে লেখা কবিতায় যার ছায়া পড়েছিলো।                  

আমাদের স্নানঘরটা ছিল আধো অন্ধকার। পায়খানায় কয়েকটা বড়ো মাকড়শা ছিল মাথার ওপরে,  তাদের কোনটা যেন রোমশ টরানটুলা, আর নীচে জলেভেজা দেওয়ালে সারাদিন দুতিনটে কেঁচো চুপ কোরে আটকে থাকতো। কলে যেদিন জল থাকতো না, পাশের বাড়ির কাকিমারা চলে যেত পুকুরঘাটে। মা পুকুরকে ভয় করতো তাই বসে থাকতো কলতলায়, খোলা চুলে, বুকে গামছা জড়িয়ে। আমার তখন ছ’ বছর বয়েস, মায়ের সাতাশ।  একেকদিন, পুকুরে যখন জাল  টানতো জেলেরা, রুই মাছের ঝাঁক খলবল কোরে দাপিয়ে উঠতো জালে। আমরা পাড়ে  দাঁড়িয়ে ভাবতাম, জলের গভীরে আছে নাকি সাতটা নরখাদক কুয়ো। - একদিন ভোরবেলা পুকুর পাড়ে ভেসে উঠেছিলো একটা লাল ডুরে শাড়ি, শাদা শাঁখা; উপুড় হয়ে হাতপা ছড়িয়ে, চুল এলো কোরে।  সেই আমার দেখা প্রথম শব, সকালের মলিন চট আর বাঁশ দিয়ে বাঁধা। সেদিন আমি স্কুলে টিফিন খেতে ভুলে গেছিলাম।      



       দমদমের সেই ছোট্ট বাড়িতে আমাদের গরমের ছুটির দুপুরগুলো ছিল দীর্ঘ। চৌকির নীচের লাল অন্ধকারে শুয়ে প্রসারিত আলোয় মুখ বাড়িয়ে রেখে কতো আশ্চর্য গল্পের বই আমি পড়েছি। কতো রকমের অসুখে ভুগেছি রোগা ছেলেবেলায়। হাম-হুপিংকাশি-মাম্পস, ম্যালেরিয়া-টাইফয়েড-ব্রংকাইটিস। একেকটা   অসুখ মানেই স্কুল ছুটি, আর অনেকগুলো গল্পের বই পড়া। পাড়ার এবাড়ি ওবাড়ি লাইব্রেরী থেকে আমার জন্যে রোজ বই নিয়ে আসা হতো। জ্বর বাড়লে দেখতাম, কাঁচের ভেতর চকচকে পারদের ওঠা নামা মা  কোলোন-জলে তুলো ভিজিয়ে কপালে দিতো; জ্বর না ছাড়লে ইঞ্জেকশান, কান্নাকাটি, আর স্পিরিটের তীক্ষ্ণ ঝিম গন্ধে উদ্বিগ্ন বাড়িটা আমি তখন ঘুমঘোরে দেখতাম অনেক উঁচু একটা জায়গা থেকে নীচে পড়ে যাচ্ছি যাচ্ছি যাচ্ছি,-চকিতে কেঁপে উঠতো শরীর      

সারাদিন ধরে  কতো ফেরিওলা চলে যেতো জানালার ওপার দিয়ে নানা সুরে ডেকে।  আলুকাবলি, কুলফি,  সনপাপড়ি, মালাইবরফ, চিঁড়ের মোয়া, আইসক্রিম, নলেন গুড়ের সন্দেশ, তাঁতের শাড়ি, শিলকোটা,  বঁটিশানওলা, চোঙ্গামুখে-ঘুঙুরপায়ে-চানাচুরওয়ালা, ধুনুরি, কাঁসার বাসন, -সব। আসতো অনেক বহুরুপী আর সঙ। মাথায় ঝাঁকা নিয়ে হাঁক পেড়ে ফেরিওলা আসতো বটতলার বই নিয়ে। তাতে থাকতো ব্রতকথা, লক্ষ্মীর পাঁচালি, গোলোকধাম। এই গোলোকধাম আমরা অনেক খেলেছি; ঘরকাটা ছাপানো কাগজের ওপর সাপলুডোর মতোই গুটি দিয়ে খেলতে হতো। মর্ত্য থেকে রওনা দিয়ে ছক্কার চাল ফেলে, অনেক তীর্থ স্নান তর্পণ দান ধ্যান করে সাবধানে নরকের দরজা এড়িয়ে অনেক হ্যাপা সয়ে বৈকুণ্ঠে পৌঁছনো আর হয়ে উঠত না।     

একেক দিন ভোরবেলা এক বৃদ্ধ বোষ্টম আসতেন খঞ্জনী বাজিয়ে হরিনাম গেয়ে; ভিক্ষা নিতেন না, উল্টে     পকেট থেকে রংবেরঙের মৌরি লজেন্স বের কোরে দিতেন ছোটদের। বলতেন, ‘হরি বলো বাছা, একবার  হরি বলো’
একটু বেলায় আসতো লুঙ্গি আর জোব্বা পরা মুস্কিলাসান ফকির, অনেকগুলো লাল নীল আংটিপরা হাতে কালো চামর নেড়ে গাইত সে ‘বিপদে পড়িয়া যেবা করিবে স্মরণ / থাকিলে অঙ্গের ব্যাধি হয় নিবারণ...’ একটানা সুরে ভিক্ষা না দেওয়া  অব্দি দীর্ঘ সেই গান আর কালো চামরের হাওয়ায় খুব একটা চাপা ভয় ছিল আমার। আর একদিন এক বাউল এসে গান শুনিয়েছিল, তার হাতে ছিলো গুপীযন্ত্রসেই আমি প্রথম শুনেছিলাম, ‘আমি একদিনও না দেখিলাম তারে / আমার বাড়ির পাশে আরশীনগর, এক পড়শি বসত করে’। লালন শাহ ফকিরের সেই গান আমি পরেও কতো বার শুনেছি, ‘...গেরাম বেড়ে অগাধ পানি, / ও তার নাই ঠিকানা নাই তরণী পারে’। -মানে কিছুই বুঝতাম না, কিন্তু কি একটা গোপন রহস্যের ইশারা ছিল সেই সুরে, গানে     

ভর দুপুরে আমাকে ভয় পাইয়ে গলিপথে আসতো আর একটা ভিখিরি, রক্তাক্ত খালি গায়ে নিজেকে চাবুক মারতে মারতে বিকৃত স্বরে সে ভিক্ষা চাইতো । আর সন্ধ্যের একটু পরে কখনো আসতো আরেক জন, গলির প্রান্ত থেকে তার ভারী কর্কশ চাপা গলায়, ‘আম্মাআআআআ, দুটি ভাতদেনা মাআআআআ’। আমরা ভয়ার্ত, কান পেতে শুনতাম গলির প্রান্ত থেকে ক্রমশ এগিয়ে আসা লাঠির ঠক ঠক ঠক শব্দ; -যেন ট্রেজার আইল্যান্ড উপন্যাসের সেই সরাইখানা, যার নাম ‘অ্যাডমিরাল বেনবো ইন’, যে রাস্তার প্রান্ত থেকে লাঠি ঠুকে ঠুকে সরাইখানার দিকে হেঁটে আসছে এক ভয়ংকর জলদস্যু, যে অন্ধ, যার নাম পিউ।  ‘ফিফটিন মেন অন দা ডেড ম্যান্স চেস্ট...’ সেই মতো আবহ !  

সন্ধ্যে বেলার পড়াশুনো আর রাতের খাবারের মাঝের ছোট্ট বিরতিতে আমরা দুই ভাইবোনে ঘোরানো লোহার সরু সিঁড়ি দিয়ে উঠে দোতলায় মেজোপিসির কাছে গল্প শুনতে বসতাম। গ্রামের বাড়ির গল্প। শালি ধান আর বিন্নি ধানের গল্প। খেজুর গুড় আর তাল-পাটালি বানানোর গল্প। বাঁশঝাড়ের টং-এ বসা ভূত, বাবা তারকনাথের কালা ভূত, আর ইছামতী
নদীর মজা বাঁওড়ে আলেয়া ভূতের গল্প; ভাদ্র মাসে অন্ধকার মাঠের প্রান্তে কীভাবে তারা ছুটোছুটি করেআমি যখন ক্লাস ফোর, এই পিসিকেই আমার লেখা ছড়াগুলো  প্রথম পড়ে শোনাতাম। সেই যে “শরত কাল, শরত কাল, জলে ভর্তি পুকুর খাল / মেঘগুলো ঐ যায় ভেসে, সাগরপারের দূর দেশে,” –তার ১৫ আর ১৬ লাইন দুটো তো পিসিই মিলিয়ে দিয়েছিলো, “চাষির ঘরে ফিরল হাল, শরত কাল শরত কাল।” শীত-সকালের প্রথম আলোয়, মা তখন রান্নাঘরে শুকনো কড়ায় মুগডাল ভাজছে, গন্ধে ম ম করছে ঘর, পিসি বঁটিতে তরকারী কাটছে, আর আমি পাশে উবু হয়ে বসে আছি, দাঁতে মাজন, হাতে পদ্য লেখার খাতা। 
  
    

     
          আরও কয়েক বছর পরে সমস্ত মধ্যবিত্ত বাঙালি পরিবারের মতো আমাকেও বাবা আবৃত্তি শিখিয়েছিল, রবীন্দ্রনাথের ‘প্রশ্ন’, ‘শিশুতীর্থ’, ‘সোনার তরী’, দেবতার গ্রাস’। স্টেজে উঠে মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে, বই না দেখে, ঝাড়া কুড়িবাইশ মিনিটে আমি মুখস্ত বলতে পারতাম ঐ দীর্ঘ কবিতাটা, ‘গ্রামে গ্রামে সেই বার্তা রটি গেলো ক্রমে...’। আমাদের পরিবারকে পাড়ায় সবাই খুব সম্মান করতো। আমার ছোট বোনের মতো আমিও ছিলাম ক্লাসের ফার্স্ট। অনেক প্রাইজ পেতাম। পড়তাম অবৈতনিক পৌরনিগম প্রাথমিক স্কুলে । সহপাঠিরা  অনেকে  ছিল কামার কুমোর ছুতোর পরিবারের।


সেই ছোট সামান্য স্কুলে ক্লাস ফোরে সরকারি বৃত্তি পরীক্ষায় সারা
কলকাতা শহরের মধ্যে তৃতীয় স্থান পেয়ে আমি বিখ্যাত হয়ে গেলাম।   পরবর্তী চল্লিশ বছরেও ঐ স্কুলে আর কেউ সেই রেকর্ড ভাঙ্গেনি।   - স্কুলে সেদিন তাড়াতাড়ি ছুটি ঘোষণা হোল আমাকে টেবিলের  ওপর দাঁড় করিয়ে মাস্টাররা গোলাপ-রজনিগন্ধার মালা
পরালেন,  ভাষণ দিলেন, বাড়ি ফেরার পথে ছেলের দল মালাসমেত আমাকে  পাড়া অব্দি পৌঁছে দিলো।

স্কুলের ফাংশানে সবাই আবার শুনতে চাইলো আবৃত্তি, ‘গগনে গরজে
মেঘ ঘন বরষা’। কিন্তু আমার  পড়তে বেশি ভালো লাগতো ‘ছিপ খান তিন দাঁড়, তিনজন মাল্লা...’ আর, ‘মেঘমুলুকে ঝাপসা রাতে, রামধনুকের আবছায়াতে...’  যখন সহজপাঠে পড়তাম, ‘কাল ছিল ডাল খালি, আজ ফুলে যায় ভরে / বল দেখি তুই  মালি, হয় সে কেমন করে’..., তখনি জানালার ওপারে ব্রাহ্মদের বাগানবাড়ির হেঁটোধুতি আর ঘোলাটে চশমাপরা ভীষণ বদরাগী   মালিটার মুখ মনে পড়তো, -তাকে কিছু জিগ্যেস করতে গেলেই হয়তো বেঁধে ফেলবে আমায়, ভাবতাম আমি।  খেলার বল পড়ে গেলে আমি নয়, লালু নামতো পাঁচিল টপকিয়ে আম জাম গাছের অন্ধকার থেকে বল কুড়িয়ে আনতে।   




পুজোয়, জন্মদিনে, নববর্ষে বাবা কাকারা নিয়মিত বই কিনে দিতো আমায়রবীন্দ্র-অবন-নজরুল-শিব্রাম-সত্যেন-সুনির্মল-সুকুমার-উপেন্দ্র–প্রেমেন্দ্র-লীলা। তখন দেব সাহিত্য কুটিরের পূজাবার্ষিকীগুলো ছিল  সঙ্গের সাথী। আর খুব প্রিয় বই ছিল ‘সহজপাঠ’, ‘ক্ষীরের পুতুল’, ‘টুনটুনির বই’, ‘পাগলা দাশু’। সেসব বইয়ে শাদা কালোয় আঁকা ছবি, যাদের অনেকটাই উডকাট, - কত অবাধ প্রাণের গভীর আনন্দ-ইশারা ছিল সেই সব ছবিতে। কোনও রঙের প্রয়োজনই যেন ছিল না। প্রিয় ম্যাগাজিন ছিল মাসিক ‘শুকতারা’ আর ‘সন্দেশ’। একটা বইয়ের নাম ছিল ‘পাতালপুরীর রূপকথা’। ধূসর কাগজের ওপর কালো কালির কলমে পাতালপুরীর ছবি আঁকা ছিল সেই বইতে। জলের নীচে কালো পাথরের বাড়ি, মৎস্যকন্যা, লতাগুল্ম, ঝিনুক, জেলিফিশ, প্রবালঅচেনা জলের বেশ গা-ছমছমে  আহ্বান ছিল সেই  ছবিতে। এর পরে হাতে এলো একটা অপূর্ব রঙিন বই, যার নাম ‘ছবিতে পৃথিবী’। সেখানে পাতার পর পাতা কতো রঙে ছবি এঁকেছেন প্রতুল বন্দ্যোপাধ্যায়। জলচর ও নভচর অজস্র প্রানী, উদ্ভিদ, মাছ, পাখী, প্রবাল, ছায়াপথ, আগ্নেয়গিরি। বিশাল বিপুল ব্রহ্মান্ডের অদ্ভুত রঙিন ব্লু-প্রিন্ট সেই প্রথম আমার দেখা হোল। মনে হোল, পৃথিবী যদি এতো সুন্দর তবে একবার আকাশে উড়ি, একবার জলে নেমে যাই।    

আর আমাকে মাতিয়ে দিতো ‘ছড়া সঞ্চয়ন’ নামের একটা বই। সেখানে অজস্র ছড়া, -কোনওটা মজার, আর কোনওটা মন-কেমন-করানো
আমার খুব প্রিয় ছিল শব্দকে উল্টে-পাল্টে দেওয়া সেই মজার ছড়াটা, “দাদখানি ডাল, মুসুরির চাল, চিনিপাতা কৈ / দুটা পাকা তেল, সরিষার বেল, ডিমভরা দই।” ছড়ার সেই আশ্চর্য বইয়ে ছিল কতো রহস্যময় বিমূর্ত সব লাইন, যার মানে বোঝা যেতো না। সেই যে, ‘সরল পথে তরল গাছ, তার ওপরে বাসা’...। এই সরল পথ আর তরল গাছ, আর ঐ রামধনুকের আবছায়া আমাকে খুব টানতো। মনে হয় ঐখান থেকেই শুরু হয়েছিলো আমার কবিতার ক্লাস।                  

আমাদের ছোটদের খেলার টিমে একজনের নাম ছিল বীথি। সে ছিল ক্রিকেট টিমের একমাত্র মেয়ে।  লাল- হলুদ চেককাটা স্কার্টের ওপরে একটা শাদা টপ পড়ে খালি পায়ে বীথি বোলিং করতো, আম কাঠের ব্যাট হাতে চার-ছয় মারতো ক্যাম্বিস বলে। সেই বল কখনো গিয়ে পড়তো দূরে, চাষিদের সেচের জলে, সব্জির ক্ষেতে, ফুলকপি বেগুন আর লাউ মাচায়। সেই বীথি একদিন কাঁচা বয়সে ক্যান্সারে মারা গেলো, আমাদের  না জানিয়ে।  খেলার প্রধান কাল ছেড়ে, বহুদূরে কোনও অচেনা ঠিকানায় চলে গেল সে
  

শৈশব ও কৈশোরের কতো অজস্র  অনুভব রহস্য ও আবিষ্কার, -তার মাদার লিকার ক্রমে কেলাসিত হয়ে জমে ওঠে মনের গভীরে। সেই সব উজ্জ্বল আইকন, এ্যাতো ব্যক্তিগত তারা, সময়ের ভারী জলের চাপে অভিঘাতে স্রোতে ক্রমে তারা টুকরো হয়, ভাঙ্গে। সেইসব চূর্ণ দিয়েই তৈরি হয় আমাদের ভাবনার ও বোধের সতত জায়মান কেন্দ্রীয় অক্ষ দন্ডটি। দা চার্জড্ সেন্ট্রাল কোর। তার আয়নিত বলয়ে কখনো আবেশজনিত কম্পন ওঠে, বিদ্যুতক্ষরণ হয়
যা দিয়ে সৃষ্টি হতে পারে সাহিত্য চিত্রকলা শিল্প ও সঙ্গীত।    

মনে পড়ে যাচ্ছে, নিজের লেখা ‘উত্তরমালা, বেরিয়ে এসো প্লীজ’ বইয়ের ২৪ নং কবিতার শেষাংশ,   
“আমার দুহাতে আছে, তোমাদেরও রয়েছে সঙ্গীরা  

গোপন দুধের শোক,   চেনা নাম  অচেনা ঠিকানা
বোঝা যায় একা আছি,      সময়ের অন্তস্থঃ একা - 

অর্বুদ একক বিন্দু সৃষ্টি করে রেখা ও কম্পন।"
             


     

 আমাদের পাড়ার ক্লাবের নাম ছিল ‘হ য ব র ল’। একটা বড়ো পুকুরের চারধার দিয়ে গড়ে উঠেছিলো পাড়ার বাড়িগুলো। গরমের ছুটির বিকেল বেলায় চার-পাঁচটা পাড়া দাপিয়ে আমরা হুশহুশ খেলতাম। অনেক গাছ চিনে, পাতা চিনে, পথ চিনে, আকাশের পড়ন্ত আলো মেপে খেলতে হতো সেই খেলা।  আমাদের উত্তরে একটা পাড়া ছিল তার নাম ‘বিশ্বনাথ কলোনি’। বাবার এক প্রিয় বন্ধুর নামও ছিল  বিশ্বনাথ। তিনি ভাখ্রানাঙ্গাল প্রজেক্টে সিভিল ইঞ্জিনীয়ার ছিলেন। বাবা বলতো, কাকুর মতো  ইঞ্জিনীয়ার হবি ? আমার বাবা ছিল সাত্ত্বিক ব্রাহ্মণ। শাদা ধুতি, ঘিয়ে রঙের পাঞ্জাবী আর পাম্পশ্যু।  –বাবা নিজে খুব ভালো ছাত্র ছিল, বিজ্ঞানমনস্কআইএসসিতে দারুণ রেজাল্ট করেছিলো; ভালো র‍্যাঙ্ক পেয়েও অর্থাভাবে উচ্চশিক্ষার মোহ ছেড়ে রেলে চাকরি। ইংরিজি ছিল খুব সুন্দর। ওয়াটারম্যান কলমে ক্যালিগ্রাফিক অক্ষরে যা লেখা হতো। -বাবা প্রায়ই স্বপ্ন দেখত আমাদের বাড়িতে আইনস্টাইন এসেছেন অতিথি হয়ে, তাঁকে কোথায় বসানো হবে এই ভেবে সবাই অস্থির। কর্মজীবনে টাটা স্টিলের ম্যানেজিং ডাইরেক্টর রুসি মোদীর কাছে আমি শুনেছিলাম, উনি যখন অক্সফোর্ডে তখন পাশের রুমে থাকতেন আইনস্টাইন, কখনো বেশী রাতে একা একা বেহালা বাজাতে দেখা যেতো তাঁকে। সেই আইনস্টাইন আমার বাবার স্বপ্নে দেখা অতিথি।     


আমাদের ঘরে চৌকির নীচে বাবার একটা বড়ো তোরঙ্গ ছিল। তার ভেতরে স্টিলের বাক্সে ইঞ্জেকশান  দেওয়ার কাঁচের সিরিঞ্জ, সুঁচ, স্টেথোস্কোপ। ওগুলো ঠাকুরদার। ঠাকুরদা গ্রামে ডাক্তার ছিলেন। পাঁচ দশটা  গ্রামের মানুষ তাঁকে চিনতো, সম্মান করতো
ওনার হাতেই তৈরি হয়েছিলো গ্রামের ইস্কুল আর পাঠাগার ঠাকুরদা কবিতা লিখতেন, নাটকের দল গড়েছিলেন। বাড়িতে রিহার্সাল হতো, আর ঠাকুমাকে শর্ট নোটিসে উনুনে রান্না চড়াতে হতো পুরো দলটার জন্যে। ঠাকুরদার একটা ঘোড়া ছিলো। ঠাকুরদা যখন ঘোড়ায় চড়ে রোগী দেখতে যেতেন সঙ্গে থাকতো ঘোড়ার সহিস, যার নাম ছিল শ্রীহরি। দীর্ঘ দিনের সঙ্গী শ্রীহরি যেদিন  মারা যায় ঠাকুরদা চীৎকার কোরে কেঁদে ভাসিয়েছিলেন।

সেই ঠাকুরদার লেখা একটা কবিতা আমি ঐ তোরঙ্গের ভেতরে খুঁজে পেয়েছিলাম। ৪২ লাইনের সেই কবিতার প্রথম ৬ লাইন, “আজকে খবর পেলেম খাঁটি / মা আমার এই শ্যামল মাটি / অন্নে ভরা শোভার নিকেতন // স্বর্ণচূড় মন্দিরে তার / আছে বেদী প্রাণদেবতার / ফল ফুলেতে নিত্য আরাধন।” এর কিছু পরে আছে, “যন্ত্র জাঁতায় পরাণ কাঁদায় / ঘুরি বনের গোলকধাঁধায় / রিক্ততারে সাজাই নানা সাজে...”। এটা ছিল পরাধীন ভারতে ১৯৩০ সালে লেখা, যখন ভয়ংকর মন্দায় ভেঙ্গে পড়ছে সাগরপারের দেশগুলো আর বিশ্বযুদ্ধের প্রস্তুতি চলছে। এই কবিতা পড়ে আমি অনেকক্ষণ ঠাকুরদার ছবির দিকে তাকিয়ে থাকি; সাদাকালো পেন্টিং, চেয়ারে বসে আছেন, চশমা, ধুতি-পাঞ্জাবি-পাম্পস্যু, হাতে ওয়াকিং স্টিক। -মাঝ বয়সে গলার ক্যান্সারে ঠাকুরদা মারা গিয়েছিলেন।      

আমার মেজোপিসি ছিল স্কুলের টীচার, বালবিধবা, -মা যাকে ঠাকুরঝি বলতো। অমাবস্যার রাতে আগুনে পুড়ে পিসেমশায় মারা যান। শীতকালে আমাদের ছোট্ট ছাদে বিউলি ডালের বড়ির বিয়ে দিতো পিসি, তেল-হলুদ মাখিয়ে, সিঁদুর পরিয়ে
কখনো দুর্বৃত্তের মতো কয়েকটা হনুমান এসে ঝাঁপিয়ে পড়লে লন্ডভন্ড হয়ে যেতো বিয়ের আসরকখনো পিসি সারা রাত জেগে  শিবের পুজো করতো, প্রহরে প্রহরে দুধ ঘি মধু ঢেলে স্নান হতো শিবের, আমরা মাঝ রাতে ঘুম ভেঙ্গে উঠে দেখে আসতাম প্রদীপের আলোয় তামার পাত্রে দুধ আর আকন্দ-মালার মধ্যে ছোট্ট টিমটিমে শিবলিঙ্গ। পিসি কোজাগরী পূর্ণিমায় লক্ষ্মী পুজো করছে, ... “দোল পূর্নিমার নিশি নির্মল গগন / মন্দ মন্দ বহিতেছে মলয় পবন”..., আর বাড়ির পাঁচিলে নীলাভ জ্যোৎস্নায় একটা শাদা লক্ষ্মীপেঁচা এসে বসেছে, আমরা দেখেছি। তখনো আমি ‘রুপসী বাংলা’ পড়িনি। আমাদের চাঁদ বুড়ি হয়ে বেনোজলে ভেসে যায়নি  তখনো।    

তখন ছুটির ভোরবেলায় বাবার হাত ধরে আমরা শিশিরে রোদে হাঁটতে হাঁটতে অনেক দূরে রাজহাঁসের বাড়ি অব্দি চলে যেতাম। সেই এক বিশাল বাড়ির সবুজ ঘাসের লনে ঘুরে বেড়াতো সুন্দর দুটো ময়ূর আর একপাল শাদা রাজহাঁস। তাদের চলার ভঙ্গিও ছিল সুন্দর, কিন্তু আলাদা। আমরা সম্ভ্রমে দেখতাম সেই বাড়িটাকে
বাবা বলতো, তুমি একটা হাঁ-করা ছেলে। কখনো বিকেল বেলা বাবা-মার সাথে আমরা দক্ষিণেশ্বরেও চলে যেতাম। বাবা দেখাতো মন্দিরে ভবতারিণী কালীর মূর্তি, -নীচে প্রশস্ত চত্তর পেরিয়ে কখনো আমরা দূরে গাছতলায় পঞ্চমুন্ডি আসনের সামনে। আমরা ফিসফিস করে কথা বলছি, আর নদীর দিকে মুখ করে ঘাটে বসে একলা কেউ আপন মনে গাইছে, ‘ভাবের নদীতে আমি ডুউউব দিলাম না...’। খালি পায়ে ঘাটের সিঁড়িতে সূর্যাস্তে  জোয়ারের জল তখন ছলাত ছলাত করছে। সেই নদীর নাম জাহ্নবী। রানি রাসমণির বাঁধানো ঘাট। সেই ঘাটে দু’একটা পাটনি নৌকো বাঁধা, ... “শীঘ্র আসি নায়ে বসো, দিবা কিব বলো / দেবী কন, দিব, আগে পারে লয়ে চলো”। -ঐ ভরা কোটাল, ভারী জলের সম্ভ্রান্ত জলীয় গন্ধ, কখনো দূরে ভেসে যাওয়া পোড়া কাঠ, পালতোলা দু’একটা নৌকো, আর দমকা হুহু হাওয়ায় দূরাগত  কাঁসর-ঘন্টার আওয়াজে গড়ে উঠতো এক অদ্ভুত সম্মোহন। আমার কেমন ভয় হতো, অস্বস্তি হতো।     

একদিন আমাদের বাড়ির ছাদ থেকে পিসি দেখিয়েছিলো পুবের আকাশে একটা কালো মেঘের কালী মূর্তি, চার হাত, মুন্ডমালা, খাঁড়া। আমাদের বিস্মিত চোখের সামনে সেই মেঘ কয়েক মিনিটে বিবর্ণ ধোঁয়া হয়ে আকাশেই মিলিয়ে গিয়েছিলো। মেঘের মধ্যে একবার ‘হাঁসজারুর’ ছবিও আমি দেখেছিলাম। সেই যে, “হাঁস ছিল সজারু, ব্যাকরণ মানি না...” !      

               
      ছোটবেলার সেইসব দিনগুলোয় আমি ছিলাম সুবোধ, সুশীল, বরাবরের ফার্স্ট বয়। স্কুলের সেকেন্ড বয় ছিল ঐ বিশ্বনাথ কলোনির ছেলে গৌরীশঙ্কর, আমরা ডাকতাম গৌরী। ছুটির বিকেলবেলা গৌরী আমাদের বাড়িতে এসে মা কাকিমাদের গল্প শোনাত; জাতকের গল্প, পুরাণের গল্প। বেলা পড়ে এলে আমরা সবাই মুগ্ধ হয়ে শুনতাম। আমি ভাবতাম, এত গল্প গৌরী জেনেছে কিভাবে ! একেকদিন গৌরী মৌন থাকতো। বিকেল বেলায় পাড়ার কাছেই এক জঙ্গলের ভেতরে নিম-অশ্বত্থ গাছের মোটা ডালে বসে গৌরী চোখ বন্ধ কোরে ধ্যান করছে, -আমি আড়াল থেকে ওকে ফলো কোরে আবিষ্কার করেছিলামআমরা তখন ক্লাস ফোরগৌরী তখন ইশ্বরকে খুঁজছে।    

একদিন বিকেল বেলা হন্তদন্ত হয়ে গৌরী এসে আমার খেলা থামিয়ে আমাকে ডেকে নিলো।  বলল, কী সব খেলাধুলো করছিস আমার সাথে আয়, আমি এইমাত্র একটা মরুভূমি দেখে এসেছি, সেখানে আছেন আমাদের কাঠের কাজের স্যার আর একটা উটও রয়েছে, বিশ্বাস কর। রাজস্থানের মতো এখানেও আছে মরুভূমি ? -আমি একটা আবিস্কারের আশায় ওর সাথে অনেকটা পথ হেঁটে যেতে, ও একটা মুদিদোকানে নিয়ে গিয়ে উঠলো। দেখি সেখানে একটা টুলের ওপর বসে আমাদের স্কুলের কাঠের কাজের স্যার। তারপর বাড়ি থেকে দেওয়া লম্বা লিস্ট মিলিয়ে গৌরীকে জিনিষ কিনতে দেখে আমি যখন ওকে মরুভূমির কথা জিগ্যেস করলাম, নির্লিপ্ত চোখে আমাকে হতবাক কোরে চিনির বস্তার পেছনে দেওয়ালে টাঙানো একটা ক্যালেন্ডার দেখিয়ে দিলো। দেখলাম তাতে পাতাজোড়া বিস্তৃত মরু-বালিয়াড়ি আর একটা উট ! গৌরী ছিল এইরকম বজ্জাত, শেষ লাইনে সবার জন্য একটা চমক ওর আস্তিনে লুকোনো থাকতো। ওর বলা  গল্পগুলোও ছিল সেই রকম, মা কাকিমারা শেষ অব্দি হাঁ কোরে শুনত সেইসব
জনপ্রিয়তার হাইওয়েতে এই ‘শেষ লাইনের চমক’ চিরকাল কার্যকরী, গল্পে তো বটেই এমনকি কবিতায়ও। আমার মনে পড়ছে সুকান্ত ভট্টাচার্যর সেই বিখ্যাত কবিতার সর্বশেষ লাইন, ‘কিন্তু খাবার খেতে নয়, খাবার হিসেবে’। এক সময়ে খুব রমরমা ছিল ওইসব কবিতার।            

প্রাইমারী স্কুলের ক্লাস ফাইভ মানে আমরা যখন শেষ বছরে। স্কুলের বার্ষিক উৎসবে সেবার ঐতিহাসিক নাটক হচ্ছে। জীবনে সেই আমার প্রথম নাটক। নবাব সিরাজঊদ্দৌলার মৃত্যুর পর তাঁর সমাধিতে ফুল    দিতে আসা বিধবা পত্নী বেগম লুৎফুন্নেসার ভুমিকায় আমি। একটু নার্ভাস তো বটেই। কারণ সারা স্কুলের ছাত্র শিক্ষকদের কাছে আমাকে নিয়েই সেদিন সবচেয়ে কৌতূহল। আর নাটকের শুরুতে প্রথম দৃশ্যেই আমার এন্ট্রি। পর্দা উঠে যেতেই মাঠভর্তি গিজগিজে ভিড়ের মুখোমুখি ফাঁকা স্টেজে একা আমি দাঁড়িয়ে   সিরাজের সমাধিতে। কালো সিল্কের গাউন, বুকে ভারী প্যাডেড ব্রা, চোখে কাজল, মাথায় কালো উড়নি। সঙ্গে আর কেউ নেই যে সাহস যোগাবে। শাদা স্পট লাইটের কিউ ধরে টানা পনেরো  মিনিটের একক দীর্ঘ শোকবিহ্বল মোনোলগ। “বাংলা বিহার উড়িষ্যার মহান নবাব, তুমি নিশ্চিন্তে নিদ্রা যাও মাটির বুকে, যে মাটিকে তুমি ভালোবেসেছিলে...”। তার সাথে গানেও সেই প্রথম ও শেষ প্লেব্যাক
উইংসের পেছনে হারমোনিয়ামে গানটা গাইছে একজন, আর আমি স্টেজে তাতে লিপ দিচ্ছি। “ঘুমাও প্রিয় ঘুমাও সুখে / অন্ধ তিমির অতল ...” । গলা খুবই সুরেলা। এবং তার পরে, “আজিকে প্রিয় মৃত্যুতিথিতে / ভ’রে ওঠে  বুক তোমারি ব্যথাতে”... আমি তখন সমাধির ওপরে মাথা নুইয়ে হাতের ফুল নামিয়ে রেখেছি, “তোমারে   স্মরিয়া বাঙ্গালীর চোখে / ঝরে আজি অশ্রুজল”। গান ও মোনোলগ শেষ হয়ে পর্দা নামতেই দীর্ঘ হাততালি। -বাকি নাটকে বেগম লুৎফার আর কোনও অ্যাপিয়ারেন্স ছিল না। কুড়ি মিনিটের ঐ রোলটুকুর জন্যেই আমায় সেদিন নীল রিবনে বাঁধা মেডেল দেওয়া হোল। এর কুড়ি কুড়ি বছরের পরে আবার আমি  স্টেজে অভিনয় করার সাহস করেছিলাম, জামশেদপুরে কৌরবের ‘ভুবনমেলা’য় ।         

বাবার খুব প্রিয় জিনিষ ছিল সিগারেট। ঘরে আমি ক্যাপস্টানের টিন দেখেছি, নাম্বার টেনের প্যাকেটও।  আমরা ছোটোরা খালি সিগারেটের প্যাকেট নিয়ে রাস্তার ধারে খেলতাম। কতো রকমের নাম, চারমিনার,  ফোর স্কোয়ার, উইলস, রেড অ্যান্ড হোয়াইট, ৫৫৫, ক্যাভেন্ডার, পলমল, মার্লবোরো, -হাতের মুঠোয় আর হাফ প্যান্টের পকেটে গোছা গোছা থাকতো সেইসব দামী ব্র্যান্ডের খালি প্যাকেট, হরদম লেনদেন হতো  সেগুলো; সেই নিয়ে চেঁচামেচি, হিংসা, মারপিট। আমিও একদিন সাহস কোরে বাবার অ্যাশট্রে থেকে  আধপোড়া একটা বাট লুকিয়ে পায়খানায় নিয়ে গিয়ে ম্যাচিস মেরে, কেশে, আঙুল পুড়িয়ে, একাকার। ক্রমে আমরা বড়ো হয়ে উঠলাম, ফুটবলের টীম তৈরি হোল, আমাদের খেলার সরঞ্জাম আর হাঁকডাক থেকে ক্রমে আলাদা হয়ে গেল লম্বা টানের মেয়েরা।    

একদিন হঠাৎ সুদূর ভাখ্রানাঙ্গাল প্রজেক্ট থেকে খবর এলো, বাবার বন্ধু বিশ্বনাথ কাকু হৃদরোগে মারা গিয়েছেন।  তখনো আমি জলবিদ্যুৎ জানতাম না, বুঝিনি ভারী জলের চাপ, প্রবল কিউসেক, আর ঢালাই  কংক্রিটের ময়দানবীয় চেহারাগুলো
তখন আমার নতুন খেলনা হয়েছে, তার নাম ‘মেকানো’। তার বাক্সভরা নক্ড্-ডাউন পার্টস আর নাট বোল্ট স্ক্রু-ড্রাইভার দিয়ে আমি, ভবিষ্যতের এঞ্জিনীয়ার, বানাচ্ছি গোটা একটা  ট্রাক আর চলমান  ক্রেন।  সুতো-বাঁধা সিগারেট বাক্সে চীনাবাদাম বোঝাই কোরে, হাতল ঘুরিয়ে, মেঝে থেকে চৌকির ওপরে ধীরে ধীরে সেই কার্গো টেনে তুলছে আমারই হাতে বানানো একটা হলুদ-মেরুন বুম্ ক্রেন, আর আস্তে আস্তে ধূসরতা ছেড়ে ক্রমে উজ্জল ও বড়ো হয়ে উঠছে আমার কৈশোরের অবাক-পৃথিবীর রঙ রূপ আয়তন।         


সেই শুরু হোল আমার বড়ো হওয়া, সেই থেকে এক্সপ্লোর অ্যান্ড এক্সপেরিমেন্ট। তবে আমরা যেহেতু গরীব মধ্যবিত্ত পরিবার, স্কুল জীবনে ঘরে ইলেকট্রিক ফ্যান ছিলো না, রেডিও ছিলো না, গৃহশিক্ষক ছিলো না, কিন্তু চোখে অনেক স্বপ্ন আর অভিমান ছিল, আমাদের চলাচল তাই অনেকটাই সীমায়িত, অনেক দিকেই টানা ছিল তার নিঃশব্দ লক্ষ্মণরেখা। তাই পরবর্তী জীবনে আমি পেরেছিলাম মারিজুয়ানা হাশিশ    সোনাগাছি আর খালাসিটোলার সম্মোহন বাঁচিয়ে চলতে
আমি ময়দানে বেশ্যার চিৎকৃত আস্ফালন শুনেছি, জুহুবীচে চৌপাট্টিতে পাতাখোর আর জিগোলোদেরও দেখেছি। আমস্টারডামের বিখ্যাত ‘ড্যাম স্কোয়ারে’ রেড লাইট এরিয়ার পথে দেখেছি কালো সিল্ক, হাইবুট আর চড়া-লাল লিপগ্লস মেয়েদের। কিন্তু সেসব এক্সপ্লোর করিনি। -বদ্ধ ঘরে ঝিম মাদকাসক্ত নয়, প্রেমহীন শরীর নয়, রক্তের সজ্ঞান ঝাঁজই ছিল আমার প্রিয়।   

সেই সব উচ্চারণই আমার প্রিয়, যা “মৃত্যু-চীৎকার থেকে বড়ো ও সমানে ছড়িয়ে যায়” (স্বদেশ সেন)।
আমার ভালো লাগে নীলাকাশের নীচে এই শিহরিত জীবন, যা প্রকৃত প্রস্তাবে এক দীর্ঘ অলৌকিক ট্রেক।                                

আমার আজও ভালো লাগে ‘দা ওল্ডম্যান অ্যান্ড দা সি’-র সেই বুড়ো মানুষটাকে। আর বার্তোলুচ্চির
‘স্টিলিং বিউটি’ ছবির লুসি নামের সেই একা নিঃসঙ্গ মেয়েটা যে নিউইয়র্ক থেকে ইটালিতে ছুটি কাটাতে গিয়েছিলো তার পৈতৃক খামার বাড়িতে, যে নিজেকে আবিস্কার করতে চেয়েছিলো ক্যানভাসে প্রকৃতিতে আঙ্গুরলতায়, ভাস্কর্যে যৌনতায়  প্রেমে। যার কবি ও বিবাহ-বিচ্ছিন্না মা একদিন আত্মহত্যা করেছিলো।           
 ( ক্রমশঃ )