Wednesday 12 October 2016

কবিতার ছায়া, ছায়ানৌকো



[ কবি কমল চক্রবর্তীর কবিতার বইয়ের আলোচনা ]

 
শংকর লাহিড়ী 


কবি কমল চক্রবর্তীর কবিতার বই ‘ছায়ানৌকো’ । কৌরব থেকে প্রকাশিত পরীক্ষা-সাহিত্য পর্যায়ের  নবতর সংযোজন । গত বছর কলকাতা বইমেলা-২০১০ এ কমলদার হাত থেকেই পেয়েছিলাম ঐ বই। আটচল্লিশ পাতার পেপার ব্যাক। সেই নৌকোর পেছনে লেখা অনন্ত থেকে অনন্তর কালে ছড়িয়ে যায় কবিতার ছায়া। আর নৌকোর ভেতরে ছায়ায় প্রথম পাটাতনে কমলদারই  হাতে লেখা আমাকে নিবেদিত অক্ষরমালা : ‘শঙ্কর কে আমার যা যা / এ জীবনের / ভুল, ভালবাসা / কমল দা / ০৬-০২-১০ / ব. মে।’ – তো এইখান থেকেই আমি বইটা পড়া শুরু করি। 

প্রায় এক বছর পরে এই বইটা আবার পড়তে বসে আজ মনে পড়ছে বহুদিন আগে কমলদার সাথে এক নৌকোয়, বুড়ি বালাম নদীর টালমাটাল জোয়ারে, চাঁদিপুরে। সেই সব অনেক সূর্য গ্রহণের দিন, ঝাউবন, শেষ বিকেলের ঝড়। আমরা এক নৌকোয়। সেই সব দিনের আলোছায়া, তার কুঁড়ি ও কঙ্কর, মদ-মাংস, তন্ত্র-নিম। ক্রমশঃ যা ক্যানভাসে, রঙ-তুলিতে। কবি কমল চক্রবর্তীর কলমে। আশির দশকে রচিত সেই সময়ের কবিতাগুলো নিয়ে প্রকাশিত হয়েছিলো কৌরবের পরীক্ষা–সাহিত্য সিরিজের দারুণ একটা বই, যার নাম ‘মিথ্যেকথা’।
এতদিন পরে সেই কলমেই ‘ছায়ানৌকো’। খুব আগ্রহ নিয়ে  বইটা খুলে আমি প্রথমেই হোঁচট খাই। প্রকাশকের কথায় ‘এই বই বৃক্ষনাথ–এর’! - না, আমি বৃক্ষনাথ বুঝি না। আমি জানি এই বই কবি কমল চক্রবর্তীর। তাকে বৃক্ষনাথ বলার চেয়ে আমি বরং শাল-সেগুনের জঙ্গলকে কমলনাথ বলতে রাজি আছি। ফার্নেস, জল, মিথ্যেকথা, সরলরেখা, আর ছায়ানৌকোর কবি কমল।   

ছায়ানৌকো বইটা নিয়ে আমার আগ্রহ ছিল অসীম, কিছুটা দ্বিধাও। কারণ, বলা হয়েছিলো এর কবিতাগুলোর পরীক্ষিত সত্য হোল এগুলো কমল চক্রবর্তীর পুরনো কবিতারই ‘নবরূপ’। কারণ, ‘নতুন নির্মাণ সম্ভব ছিল না’ ! – এ এক রোমাঞ্চকর ও নতুন পরীক্ষা যা প্রকৃতই বিপদজনক, আমার মনে হয়েছিলো। নিজেরই পুরনো কবিতাগুলো পড়ে অবচেতনের অচিন কুঠুরিগুলোতে নিজেরই মুখোমুখি হয়ে আজ এত বছর পর কবিকে পুনরায় নতুন কোরে সাজিয়ে তুলতে হচ্ছে তার হারিয়ে যাওয়া লুপ্ত স্মৃতির বোধের অনুভবের শব্দমালার অক্ষরের হর্ষ ও বিষাদ। এই মতো তার স্কিম। -‘যে কবিতা তিরিশ চল্লিশ বছর আগের, তাকে অন্য মেধা ও অক্ষরে পুনর্নির্মাণ’

বইয়ের শুরুতেই আট পাতায় আটটি পৃথক প্রস্তাবনায় (ছায়ানৌকো – ১,২,৩,৪,৫,৬,৭,৮) দীর্ঘ ভনিতা রয়েছে, যা আমাকে ক্রমশঃ সন্দিহান করে। কেননা আমি চেয়েছিলাম পুরনো লেখার রিমেক নয়, বরং আজকের কমল চক্রবর্তীর একটা পূর্ণ রচনা যার ক্যানভাসে আছে তার সময়োপযোগী শস্যভাণ্ডার, মদ ও ময়ূর। ব্যক্তিগত জীবনের ধূসর ক্যানভাসে কীভাবে আবার সেজে উঠছে রঙ, শুরু হচ্ছে আর একটা র‍্যাপিড ফায়ার রাউন্ড।

বইয়ের শুরুতে ঐ টুকরো গদ্যগুলোয় রয়েছে ‘যশলোভী খ্যাতিলোভী হামবাগ’ কবিদের বিরুদ্ধে জেহাদ। কবি কমল আঙুল তুলেছেন কাফেলার সেই ৯৯ . ৯৯৯ ‘কবি’দের দিকে যাঁরা ‘পৃথিবীর রঙ রূপ কিছুই দেখলেন না, গভীরের অনুভব শূন্য। যাঁদের মরীয়াপনা কবিতায় ছিল না, ছিল প্রচারে। ছাপাখানা ও খ্যাতির পতাকায়। যাঁদের পক্ষে অক্ষরে নিমজ্জিত হয়ে বুকে বালিশ চেপে কেবল শব্দবাজি তৈরিই সম্ভব।’  কমল বলেছেন  ০ . ০০১ দের কথাও ‘যাঁর স্পর্শে জাগ্রত হয় পরিবেশ। জড়ে চেতনা, মৃতকে অমৃত। কবি জানেন বৃষ্টির ভাষা, কুন্দ অতসী নিমের ভাষা। ঈগল, শঙ্খচিল, টুনটুনির। কারণ তিনি একজন পরিবেশ- ভাষাবিদ। শুরুর গদ্যেই লেখা হয়েছে এই সব।
  
প্রকৃত প্রস্তাবে নৌকোর ছায়া-১ থেকে ৮ নম্বর অব্দি লেখাগুলো আমাকে জব্দ করতে পারে না। আমি আকুল হয়ে খুঁজি ‘মিথ্যেকথা’-র কবি কমল চক্রবর্তীকে। গিমিক-হীন, স্কিম-হীন, পরিকল্পনাহীন। খুঁজি যা ‘না পিষ্টক, না ঝুমঝুমি’। এবং কি আশ্চর্য, লো এন্ড বিহল্ড, ছায়ানৌকোয় শেষ পর্যন্ত পেয়ে যাই তাকে। প্রথম পাঠেই আবার সে মুগ্ধ করে। সেই ব্র্যান্ড কমল। সেই রক্ত-মাংস-ঘৃণা-প্রেম-আশ্লেষ-ধিক্কার। সেই শালবন, জলপিপি। যাবতীয় বিছানা বালিশে জড়িয়ে ধরা কবিতা। লোহায়, বোল্ডারে , ….সারা গায়ে শূয়োরের তেল, …. ফুল সাইজ ট্রমা!  

তো এই হোল পুরনো কবিতায় সুঁচ হয়ে ঢুকে ফাল হয়ে বেরিয়ে আসা ? -আমি চমকিত হই, স্যালুট করি।  
‘যে দেশে হরিদ্বার আর বারাণসী, ...শালপাতায় মাংস, কালোজিরে, দোক্তাপাতা, মদ, ...আর সারারাত মাদল, ...যেখানে ব্যাভিচার, দালাল, ঘুষখোর বজ্জাত, ... যেখানে ষ্টীল প্ল্যান্ট, ঢালাই মেশিন, আর ফোরম্যান, ... যেখানে শ্মশান কালী, জানালায় গেছোভুত আর নিশি পাওয়া, ... যে দেশে অসংখ্য সাপ আর সবুজ কাছিম’, ... সেই দেশের কবির নাম কমল চক্রবর্তীএই সমস্তটা নিয়েই কবিতার রম্যভুমি তার।  সমস্ত তত্ত্ব কথা ও ইজম থেকে দূরে। 

কমলদার জীবন ও কবিতার পরিমণ্ডলের কাছেকাছে, আনাচে কানাচে আমি দীর্ঘ দিন থেকেছি। কবি কমল চক্রবর্তী আমার প্রিয় কবিদের অবশ্যই একজন। শালবনে, কবিতার ক্যাম্পে, বিবাহ বাসরে, শবযাত্রায়, আদালতে, হার্ডকোর কৌরবে, আমি তার দীর্ঘ দিনের সঙ্গী। আজ ছায়ানৌকোয় এসে আমি দেখছি কীভাবে সময়ের ক্ষতচিহ্ন ও প্রলেপ লেগেছে তার জীবনে।  কীভাবে নির্মাণ।  ছায়ানৌকোয় এসে বোঝা যায়, ‘কি বিশ্রী যৌবন ছিল, যা হারিয়ে গেল জাহ্নবী- হাওয়ায়’- তবু আজও সে আছে ‘নদী-পাগলী মেয়েদের গোপন খেলায়’! সেই সব মেয়েরা, যারা ‘ফুরফুরে’। যাদের ‘মায়ের আদলে হাসি, থুতনি চোয়ানো অশ্রু’। আর কেউ কেউ ‘দামড়ি পিশাচ’।  

কবি কমল তাঁর পাঁচটা বইয়ের ( ফার্নেস, জল, মিথ্যেকথা, সরল রেখা, গার্ল ফ্রেন্ড) নির্বাচিত কবিতাগুলোকে নিয়ে এসেছেন এক নৌকোর ছায়ায়। আদি কবিতার নামগুলো একই রাখা হয়েছে এই রিমেক সিরিজে। ছায়ানৌকোর প্রতিটি কবিতার নীচেই দেওয়া আছে মূল বইয়ের সেই নামী কবিতার পৃষ্ঠা সংখ্যার নির্দেশ, যাতে আগ্রহী পাঠক ও গবেষক মিলিয়ে নিতে পারেন মূল লেখাটার সঙ্গে এই পুনর্নির্মিত লেখাটা। অর্থাৎ দুভাবেই পড়া যায় কবিতাগুলো।

কমলদার ‘মিথ্যেকথা’ আমার প্রিয় কবিতার বইগুলোর একটি।  দেখা যাচ্ছে ছায়ানৌকোর অনেক কবিতাই প্রধানত জল ও মিথ্যেকথার নির্বাচিত কবিতার পুনর্নির্মাণ। মিথ্যেকথা যখন লেখা হয়, তখন প্রায় প্রতিটি সন্ধ্যাই কাটতো আমার ও কমলদার দ্বৈত আড্ডায়। সপ্তাহে একদিন বসা হত স্বদেশদার বাড়িতে। কমলদা পড়তো তার দারুণ নতুন লেখা গুলো, ......কাপ প্লেট, লাল টম্যাটো ! মনে পড়ে তার আক্ষেপ, ‘আমাদের প্রেস নেই, সেক্সি যুবতী নেই’!

- ছায়ানৌকোর সাথে মিলিয়ে নিতে আমি তাই বুক র‍্যাক থেকে নামিয়ে আনলাম মিথ্যেকথা বইটাইআর পর পর অনেকগুলো কবিতা পড়লাম। বোঝা গেল ছায়ানৌকোয় পুনর্নির্মিত লেখা গুলো কবিতার ছায়া মাত্র। মূল কবিতার কাছে তাদের অ্যাবস্ট্রাক্সান, তানকারী, রোয়াব,  -তাদের বাইসেপ্স ও চিকবোন, কোথাও অনেকটাই কৃশকায়, রক্তাল্পতা। মিলিয়ে পড়তে গিয়ে আমার এরকম মনে হোল।    
যেমন মূল কবিতা ‘কবি এখন কারখানায় যাচ্ছে’মিথ্যেকথা বইতে এই কবিতায় ছিল এরকম আবহ : ‘কবিকে একটা ঝিমিয়ে পড়া লেদ মেশিন ডাকে’ ...... ‘একটা মিলিং কাটারের দাঁতে সারারাত ময়েশ্চার জমেছে’ ...... ‘ক্যাঙ্গারুর পেট থেকে লাফিয়ে নামছে ইনগট’ ......‘লোহা টলমলে পায়ে হাঁটা, হাঁটতে হাঁটতে বিবর্তন’ ..... ‘বাতাসে বাতাসে অস্পষ্ট কার্বন’ ..... ‘ওয়াগন বোঝাই লোহা পাথর' .... এই মতো।
এই কবিতা একই নামে ছায়ানৌকোয় পুনর্নির্মিত হয়েছে দেখা গেলো। ছায়া নৌকোর কবিতায় কবি যখন কারখানায় যাচ্ছে তখন আর লেদ মেশিন তাকে ডাকে না। সেখানে লোহার ইনগট নেই, মিলিং কাটারের দাঁত নেই। লোহা টলমলে পায়ে হাঁটা নেই। আর ওয়াগন বোঝাই লোহা পাথরের বদলে এখন এসেছে ওয়াগন বোঝাই মুণ্ডু, কারও হাত কারও পা! অদ্ভুত।

কবি এখন হুটারে নির্বিকার! কিন্তু তবুও সে কারখানায় যাচ্ছে কেন? আমরা তো আরও একাত্ম হয়েছিলাম গিয়ার ও মিলিং কাটারের দাঁতে ময়েশ্চার জমতে দেখা ভারী বুট পরা সেই কবিকে দেখে, যেমনটা মিথ্যে কথায় লেখা হয়েছিলো। ...এখন মেশিনের বদলে কবিকে ডেকে নিচ্ছে নিভু বাতাসিয়া আর বনের কাহিল দোপাটি। কবিকে আজ ‘জল-জিরা ডাকছে’! তুলিতে অন্য রঙ। একটা অন্য সুর বাজছে সাব-উফারে।
বোঝা যায় ছায়ানৌকোর কবি এখন অনেক ক্লান্ত।  কোথায় যেন জল ঢুকে গেছে ভেতরে। ভিজে গেছে বারুদ। ‘জল’ নামক কবিতায় একদিন ‘লিগিরদা-লিগিরদা-বাহা’ বয়ে গিয়েছিল যে জল, এখনও তার স্মৃতি রয়ে গেছে, কিন্তু এখন তা ‘দূর জল-প্রপাত’। - এ এক বাহিত জীবন, এর আবহ অনুষঙ্গ গুলো সময়ের সাথে দ্রুত বদলে যাচ্ছে। পালটে যাচ্ছে দৃষ্টিকোণ।  

আসলে, এই লেখা যখন কমলদা লিখছে তখন সে আর টাটা মোটর কারখানায় বদ্ধ মেশিন রুমে গলদঘর্ম হয়ে শিফট ডিউটি করে না। ‘ইঞ্জিন টেস্টিং বে’ থেকে অনেক দূরে ভালোপাহাড়ে এখন সে ব্যক্তিগত সাজানো জংগল-খামারে শিরিষ-সেগুন-মহানিম–অর্জুনের গায়ে গায়ে পোষা হাঁস-মুরগি-ছাগল- কাকাতুয়াদের মাঝে সংসার পেতে লক্ষ্য করছে অন্য এক চলমান জীবন। এই তার নতুন সঙ্ঘারাম, যা তাকে চিনিয়ে  দিচ্ছে তার প্রকৃত সুর ও শিকড়। আর কবিতায় লাগছে এক ভিন্ন রঙ।  

কমল চক্রবর্তীর কবিতার একটা প্রধান অংশ জুড়ে থাকে প্রকৃতি। আর থাকে যুবতী মেয়েরা। ‘মেয়েরা, শুধু তোমাদের জন্য এই দীর্ঘ-কবিতা’।  আর একদিন ভোজালির মতো খিদে নিয়ে দাঁড়ায় যুবতী। - কিন্তু আজ শুধু আলোর আঁকিবুঁকি। সূর্যাস্ত। - ‘যৌবন হারিয়ে গেলো জাহ্নবী হাওয়ায়’। ‘এত যে কবির কান্না, .. বোঝ অভিমান’। প্রান্তরে সূর্য ঢলে, রাখাল। আর ‘তার গরু ভেড়া কুয়াশা নেশায় তিমিরে ঝিমোয়’। .... ‘কুয়ো তলায় কবি কাঁদছেন’ !     

আমি দেখতে চেয়েছিলাম মিথ্যেকথার সেই বিখ্যাত কবিতাগুলোর পুনর্নির্মাণ কেমন হয়েছে। সেই ‘অষ্টাদশ পেয়ালায় পা  ফেলে ফেলে উঠে’ আসা, অথবা ‘জীবনের জন্য ডায়াল এম’। খুঁজে পেলাম তাকে, সেই     ‘ডায়াল এম’ কে। এটা ছিল কমল চক্রবর্তীর একটা বিখ্যাত কবিতা। কিন্তু দেখা গেল তার পুনর্নির্মাণ সম্ভব হয়নি। যা হয়েছে  তা যেন এক দুর্বল অনুবাদ । প্রায় লাইন বাই লাইন, বাংলা থেকে বাংলায় !   

এখানেই আমি কিছুটা দ্বিধায় পড়ে যাই। মনে হয়, কী দরকার ছিল যৌবনের ঐ সব অমোঘ কবিতার রিমেক, যা আমাদের ছত্রে ছত্রে পরিবর্তন গুলোর সামনে দাঁড় করিয়ে দেয় ? পুরনো লেখাকে সামনে না রেখেও লেখা যেতে পারতো আজকের তুলি ও কলমে আজকের নতুন লেখাটা । কিন্তু লক্ষ্য করা গেলো, নিজের ভিন্ন ভিন্ন বইগুলোর মুখোমুখি হয়ে নানা ধরনের মিশ্র প্রতিক্রিয়া হয়েছিলো তার আজকের লেখার টেবিলে। সেই জন্য মিথ্যেকথার রিমেক এবং জলের বা সরলরেখার রিমেক-এর অভিজ্ঞতা এক নয়।
এটা আমি আবিস্কার করলাম ‘সরলরেখা’ বইয়ের ‘শুঁড়ির মেয়ে’ কবিতাকে পুনর্নির্মিত দেখে। একটা ভরপুর লেখা, যার সমস্ত লাইনেই আজও আছে কবি কমলের সেই পরিচিত অমোঘ অকাট্য  সিগনেচার। এই সেই শুঁড়ির মেয়ে,  এখনও যার ‘আঙুর লতায় বুক ঢেকেছে, ডালিম লতায় নাভি ....এই মেয়েটি চোলাই-খুকু, ...ওর সারা গা গুড়ের মড়াই, ওর হাসি গান চুমু কান্না দ্রাক্ষা- বৃষ্টি’ ... এই মেয়েটি রহস্য-জাল, এই মেয়েটি আমার কেউ’ !  পুনর্নির্মিত, কিন্তু নতুন তার সেলাইয়ের ফোঁড়। অ্যাপ্লিকের কাজ।   

তেমনি আমি আবিস্কার করলাম ‘জল’ বইয়ের ‘সুবর্ণরেখা’ কবিতাকে পুনর্নির্মিত দেখে। এটা একটা অদ্ভুত সুন্দর উচ্ছল কবিতা যার গভীরে রয়েছে গোপন প্রেম আর যৌবনের আর বিদায়ের কথা। আছে  গুপ্ত-স্নান, যৌন-সন্ত্রাস আর দিব্য-হাহাকারের কথা। কবিতাটা শুরু হচ্ছে, ‘ তুই সুন্দরী, তুই পরিত্রাণ!  প্লিজ, তোকে কখনো ছোঁব না।’ ... পরে আছে ‘ ওঁরাও-যুবতী নিয়ে গুপ্ত-স্নান, সাবানের ফেনা।’ ...  শেষে,  ‘কখনো বেদনা-হুহু বিদায়ের রেখা / তোকে মনে পড়ে, তোকে’ ।  - একটা চিরকালিন নদী, নাম সুবর্ণরেখা, এই ভাবে অমর হয়ে রইল তার সোনালি-পালক নিয়ে ! ...যেখানে ‘রক্ত তুলি, বিবাহের বালুবেলা’ !

একক ভাবে ছায়ানৌকো বইয়ের কবিতাগুলো পড়ে অন্য এক  উদ্ভাস আমাকে স্পর্শ করে। ভালো লাগে দেখে যে বয়সের নুব্জতা তার কলমে এখনও আসেনি। কমলদার পুরনো কবিতার ঘাটে ঘাটে তার সাথে একই নৌকোয় এতদিন পর মোহগ্রস্তের মতো আমার এই সফর।  চারিদিকে যখন আন্তর্জাল মজলিশে ‘শিশি ফাটছে হাঁড়ি ভাঙছে, ছিপি উড়ছে ভিন্নতর’,  তখন একত্রে আবার এই ‘বোতল ঢালা, তপ্ত গেলাস’! বহুদিন পরে আবারো তাই তাকে নিয়ে বিস্ময়। এখানে কমলদা লিখেছে ‘দুঃখী মানুষেরা বনে যায়, দূর থলকোবাদ’। আর আমার মনে পড়ছে, থলকোবাদের  সেগুন-জঙ্গলে জ্যোৎস্নায় ঝরা পাতা মাড়িয়ে অনেক বছর আগে কমলদা ও আমি। আমরা অবাক বিস্ময়ে  লক্ষ্য করেছিলাম, কীভাবে নিঃশব্দে সময় বয়ে যাচ্ছিলো জঙ্গল-মহলে, নির্জন সন্ধ্যায় সময়ের সেই ছাপ আজ কবিতায়, জলে।  নদীবাহিত এলোমেলো হাওয়ায় কাঁপছে কবিতার ছায়া, ছায়ানৌকো।   

Wednesday 23 March 2016

ভুলগুলো সরাও, আমার লাগছে


 - শংকর লাহিড়ী


< কোলকাতা বইমেলা ২০১৬ তে, কৌরব পত্রিকার ১২১ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছে আমার এই লেখা। বিষয় ঃ একুশ শতকে এসে কীভাবে বদলে গেল আমার কবিতা ? >


একুশ একটা বিষয় । একুশ কি একটা বিষয় ? আমি প্রশ্ন করি আমাকে। একুশে ফেব্রুয়ারি, একুশ শতক, একুশ বছর বয়স। যখন আমার একুশ বছর বয়স, সেটা ১৯৭১ সাল, সেই সত্তরের দশক এবং ‘তুমি যে  গিয়াছ চলি, বকুল বিছানো পথে’। তখনও নিজের কোনো কবিতার খাতা ছিলো না। কৌরবে যোগ দিয়ে,  আশির দশকে যখন কাগজ কলম নিয়ে তৈরী হলাম, তখন বেলা হয়ে গেছে। আমার প্রথম কবিতার বই  ‘শরীরী কবিতা’ প্রকাশিত হয়েছে ১৯৯০ সালে, তখন আমার বয়স চল্লিশ।

জামশেদপুরের ছোট্ট আদিবাসী গ্রাম সাকচি; শাল-নিম-কুসুম-মহুয়া গাছের ছায়ায় যেখানে এক আদিবাসি দাইমা-র হাতে আমার জন্ম হয়েছিল। আমার কবিতায় কখনো আমি আদিবাসী শব্দ, তাদের কথ্য ভাষা, ব্যবহার করিনি। সেই কোলেকাঁখে বয়সে, আমি বেশি কাঁদলে বাড়ির সাঁওতাল পরিচারিকা সুরজমুনি মাকে বলেছে, ‘টুকুন আফিম খাওয়ায়ে দিস কেনে ইয়াকে’। দলমা পাহাড় আর ডিমনা লেকের ওপার থেকে রোজ দশবারো কিলোমিটার পথ পায়ে হেঁটে সে কাজে আসতো। তবুও সাঁওতাল, মুন্ডা, হো, ওঁরাওদের ভাষা আমার লেখা থেকে দূরে থেকেছে। আমি জানতাম না, ‘ইশুভুকিন বুরু’ শব্দের অর্থ কী। বস্তুত, উত্তর  কোলকাতার শৈশব জীবন, গাঙ্গেয় হাওয়া, তাল-নারকেল সারি সারি, লাল দোতলা বাস, ঘুঁটের উনুন, চ্যাঙারীতে সিঁদুরমাখা প্যাঁড়া আর জবাফুল পরিবেশকে এতটা শাক্ত করে তুলেছিল, যে আমি  পাহাড়চটির মারাংবুরুকে বেমালুম বিস্মৃত হয়েছিলামকৈশোরে স্কুলের ছুটিতে জামশেদপুরের পথে, রাতের স্টীম-এঞ্জিনে-টানা রাঁচী এক্সপ্রেসে কৃষ্ণকায় সাঁওতাল রমণীদের ঘর্মাক্ত নিমতেলের গন্ধে আমার বিবমিষা হয়েছিল। অনেক পরে, ভোরের আলোয় ধলভূমগড় স্টেশনের লাল মাটিতে ট্রেন থামলে, হিম কুয়াশায় মহুয়া, শিরিষ ও নিমফুলের অপার্থিব গন্ধে ঘ্রাণে আমার মনে পড়ে যেত জন্মদিনের সেই সাকচি-গ্রামের কথা।    
      
সত্তরের দশক পেরিয়ে সর্বাঙ্গে ব্যান্ডেজবাঁধা দুই বাংলা। আশির দশকে এসে তখনো কোলকাতা-কেন্দ্রিক  কবিতা, যা চিরকালীন চিৎকৃত দুনিয়ার মজদুর এক হও, অথবা কলেজপালানো ক্যান্টিনসেবীদের প্রিয়া-প্রেয়সী-পল্লবিনী, হাংরিদের এফোঁড়-ওফোঁড়, কলকাতার যীশু, আর মুক্তমঞ্চে ‘তুমি ভাঙ্গা বাথরুমে  ঝকঝকে মুতের বেসিন’ অন্ত্যমিল, অক্ষরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত ‘ভুলগুলো সরাও আমার লাগছে’, -বলেছিলাম  আমি। সাদা কাগজের ধু-ধু নির্জনতা, দোয়াতের তরল টার্কোয়াজ-- উভয়েই তখন স্থির প্রতীক্ষায়। তখনও  শান্তিনিকেতন যাওয়া হয়নি, দেখা হয়নি নোবেল প্রাইজও। প্রতি বছর দেদার রবীন্দ্র, আনন্দ, বিদ্যাসাগর,  বিষ্ণু দে, একাডেমি। ভূমিহীন কৃষকদের মতো পাঠকহীন কবিদের কাতারে আমি, আমরা, যারা কবিতাকে জলোচ্ছ্বাসের মতো বাজুকার মতো অন্তর্বাসের মতো কর্তৃত্বময় দেখতে চেয়েছিলাম।

আশির দশকে আমি জামশেদপুরে, টাটাস্টীলে কর্মরত। শৈশবের সেই সাকচি গ্রাম থেকে তখন মহুয়া   গাছের অন্তর্হিত ছায়া, আর বাড়ির পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া সেই সুবর্ণরেখা নদী আমার সাদা পাতা একান্তে ধীরে, ক্রমশঃ ‘শরীরী কবিতা’। ...তার আবৃত রহস্য, জলের হিম চ্ছলাৎ শব্দ, মধ্য উরুর ক্ষত, ভঙ্গুর ফ্রুটবোল, বিনাশী ঘ্রাণ, ফাঁকা কফির টিন, মারমুখী পতঙ্গ, পারলৌকিক শ্রাব, অদ্ভুত বোতাম, শিরাকাটা চীৎকার, বরফের দেওয়াল, হিম পেন্ডুলাম, রক্তঅস্থিময় মেঘ, যন্ত্রমানুষ, উন্মাদ ক্যাকটাস, উন্মাদের তীব্র আফটার শেভ, উষ্ণ প্রশ্নবোধক স্যুপ, চাবুক ও সসেজ

কবিতার মর্মে তার প্রবেশপথ কখনো ফানেল-শেপ্‌ড্‌। বৃত্তাকার সামগ্রিক থেকে ধীরে একটি কেন্দ্রিক অনুভূতিতে পৌঁছোনো। বিভিন্ন অনুষঙ্গযোগে ও বিন্যাসে উপস্থাপিত হয় দুই বহির্মুখী ও অন্তর্মুখী বিপরীত বল। যে বল আর্কাইক, আমাদের সামগ্রিক জড় ও অজড়ে, দেহকোষে, নক্ষত্রমন্ডলে নিরন্তর কাজ করে।

আমার মনে হয়েছিল, একান্তে নিজস্ব বাগানে বুঝিবা অর্কিড নিয়ে জেনেটিক কাজকর্ম করে চলেছি আমি। নব্বইয়ের দশকে, পরবর্তী বই ‘মুখার্জী কুসুম’ যেন এরই ফাঁকে একপাশে কিচেন গার্ডেনে কিছু নতুন  প্রজাতির শালগম, টম্যাটো। ...‘নতুন কবিতা, আমি পাইনা তোমাকে কেন / যেভাবে মুখার্জীর ছেলে / আপন শালীকে নিয়ে ম্যাকলাস্কিগঞ্জে চ’লে যায় / অসংযত, কৈফিয়তহীন’  
   
 ‘মুখার্জী কুসুম’ সিরিজের এই কবিতাতেই প্রকৃত প্রস্তাবে প্রথম রাখা হয়েছিল, ‘নতুন কবিতা’-এই কয়েনেজ ও তার লক্ষ্মণগুণ । কবিতার সঙ্গে তৈরী করতে চেয়েছিলাম এমন এক সম্পর্কের আশ্লেষ, যা প্রথাগত থেকে বিচ্যুত ও অবৈধ।  কবিতাকে নিয়ে যেতে চেয়েছিলাম ম্যাকলাস্কিগঞ্জের মতোই এক নতুন ভূখন্ডে, অন্বেষণ যেখানে অন্তহীন, ‘অসংযত’ ও বিন্যাস ‘কৈফিয়তহীন’। সেই সময়ে, যখন কবিতাভুবন  নিজস্ব ছন্দহীন, সমাসবদ্ধ এবং প্রকৃতই রাত্রিযাম। --সেই স্পেস-টাইমের প্যারাডাইম ভেঙ্গে শান্টিংয়ের শব্দমালা আলোড়িত করা গান এবং উন্মুক্ত শরীরে তাকে ছোঁয়ার আর্তি অবিশ্বাস্য !
   
শরীরী কবিতার প্রচ্ছদে জীপার-খোলা জিনসের প্যান্ট, অথবা মুখার্জী কুসুমে দরোজার আর্চ, বা পার্কের ল্যাম্পপোস্ট, সবই ক্রমশঃ নতুন এক স্পেস-টাইম ডোমেন। ম্যাজিকাল মুভমেন্টস, ত্বরণ, মন্তাজ, মিউজিক্যাল অ্যাবস্ট্রাক্সান, - এভাবেই আমি বোঝাতে চেয়েছি । যে শব্দ যে ভাষায় সঠিক ঝংকার তোলে তাকে আমি সেভাবেই ব্যবহার করেছি ; মৌলবাদীর মতো সর্বগ্রাসী বঙ্গানুবাদের সচেতন বিরোধিতায়।
উৎপলকুমার বসুর ‘হ্যাঁ তোমার কবিতাগুলি / পড়েছিলাম / পাগল প্যান’ আমাকে থমকে দিয়েছিল। ক্রমে, ‘কবিতাগুলি বাংলা অক্ষরে / পাগল প্যান, আমাকে করো লাজুক’ আমাকে প্রকৃতই প্ররোচিত করে। আমি  তাঁর কাছ থেকে প্রধানতঃ দুটো শব্দ শিখেছিলাম, -নীলিমাবিথার আর মর্মবনকুকুরের সারি জঙ্গলের মর্মে ছুটে চলে’। আর সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের কাছ থেকে আরো দুটো ব্যবহার, -সতত আর নীহার। আইজেনস্টাইনের ‘ব্যাটল্‌শিপ পটেমকিন’ ছবির মন্তাজে শুধু সেই কশাক-সেনা আর ওডেসা স্টেপ সিকোয়েন্স  ছাড়া আর কিছুই আমার কবিতার স্মৃতিতে নেই।        

আশি-নব্বইয়ের দশকে আমার কবিতায় কোনও প্রেমিকার নাম কখনোই ছিলোনা ; রিনা, নীরা, সুখলতা,  শেফালি বা সাবিত্রী। কেননা আমি দেখেছি বরাবরই অনেকটা চড়াই পেরিয়ে, গভীর হ্রেষার শব্দে জেগে উঠে-- লাইলাক, রডোডেন্ড্রন, কুসুমিত পলাশ।  এরই মধ্যে শহীদ বেদী, অমর বেদী ইত্যাদিও গড়েটড়ে   ওঠে। বাবুর বাগানে সামিয়ানার নিচে ভিড় করে অসুস্থ স্তাবকেরা। তো এটা আমাকে চার্জড্‌ করে। আর আমি দেখি সফল মানুষদের ; বোর্ডরুমে ও বাগানবাড়িতে, নাচঘরে ; - তারা সবকিছু, নারীকে, এমনকি কবিতাকেও লুঠ করে নেয়। একটা আতঙ্ক, একটা ইমিডিয়েসী আমাকে গ্রাস করে, যা আমি কবিতায় তখনো লিখতে পারিনি। ক্রমে আমাকে ছবিতে পেয়ে বসে। আমার প্রিয় বিষয় ছিল পোর্ট্রেট ; চিবুকের  ডৌল, ভ্রূপল্লব, ঠোঁটের পাউট। আমার মনে হয়েছিল একজন প্রকৃত কবি তিনিই, যিনি সতত মরণশীল, পুনরপি ক্যামেরাবাহক এক কূট পর্যটক। প্রচলিত কবিতাধারার দেহাতি রোদ্দুরে আমি চেয়েছিলাম কবিতা বাঁক নিক দুন এক্সপ্রেসের মতো। ইচ্ছে হয়েছিল, ‘একটা দীর্ঘ সরলরেখাকে স্প্রিং-এর মতো গুটিয়ে এনে একপ্রান্ত ছেড়ে দিয়ে দেখবো কী প্রচন্ড বেগে লাফিয়ে ওঠে তেজঃপূর্ণ রেখাসকল। আমরা নকল করবো থান্ডার মেঘের গম্ভীর ডাক, আর যে রকম শব্দে শালের জঙ্গল থেকে লাল পিঁপড়েরা ছড়িয়ে পড়ে গভীর শিকড়ে। সেই শব্দ শোনাবো আমরা ফাঁকা খনিগর্ভে নির্বাচিত বন্ধুদের’।  তখন নব্বইয়ের দশক শেষ হয়ে আসছে আমার অন্বেষণ ছিল এক নতুন রহস্যময় ও গভীর জটিলতা  

           
ক্রমে ভাষার অপদার্থতা আমাকে সন্ত্রস্ত করে তোলে। অক্ষরের অধিকার অস্বীকার করে আমার মনে হয়,  শুধুমাত্র প্রাকৃতিক শব্দমালা দিয়ে রচনা করা যায় নতুন কবিতা, যাকে আমি সিম্ফনি কবিতা বলেছিলাম। আমার মনে হয়েছিল, রবিশংকরের সেতারের চেয়ে কবিতা অনেক বেশী জটিল ও শব্দিত হ’য়ে রয়েছে ঝোড়ো হাওয়ায়, বুনো কুকুরের চীৎকারে। একজন মরণপণ গেরিলার ছুটে যাওয়া তীব্র বাজুকায়। ঝরাপাতা মাড়িয়ে যাওয়ার শব্দে। যেভাবে মাটি ঝরে পড়ে কবরে। -প্রতিটি শব্দই এক রহস্য। এক গাঢ় ও অসীম অনুভুতি। এভাবে শব্দের পর শব্দ সাজিয়ে শুরু হয় এক নতুন খেলা। ‘দেখি আমি এই খেলা, সুবর্ণ কুসুম, / আপন সাঁতার জানা তরঙ্গ মাছেরা / সঙ্গী জল  জলবাস্প, / পাথরের পশমের উদ্ভিদের পতঙ্গকীটের / অঙ্গাঙ্গী সম্পর্ক সব’...।   
  
একুশ শতকের বোধোদয়ের জন্য প্রয়োজনীয় যা কিছু, তার একান্ত নতুন প্যারাডাইম ; Y2K-কে নিয়ে তার    ক্ষণিক ধ্যাস্টামো, চকিত উষ্ণায়ন ও বিশ্বায়ন, বাজার-অর্থনীতি, কম্পিউটার ও ইন্টারনেট প্রযুক্তি, দূরত্বের সংকোচন, বিদ্যুৎগতি যোগাযোগ, মরণপণ প্রতিযোগীতা, উচ্চনীচতার নতুন মাপ ও মাপকাঠি, বহুরৈখিক ও বহুবৈষয়িক উপস্থাপনা। প্রয়োজন ছিল ভুলগুলোকে একে একে চিহ্নিত করা। ত্যাগ করতে হবে এযাবৎ অর্জিত সব শিক্ষা। প্রাণজীবন ও সভ্যতাকে ধ্বংস থেকে বাঁচাতে ভেঙ্গে ফেলা দরকার পুরোনো প্রকাশভঙ্গি, দৃষ্টিভঙ্গি আর যুক্তির চিরায়ত ভঙ্গিমাগুলো। সমস্ত মতামতকে আমি সন্দেহের চোখে দেখেছি। সমস্ত ওপিনিয়নই biased and is valid only from a particular viewpoint, within a space-time domain.  সমগ্র বাংলা শব্দকোষ থেকে ‘আপেক্ষিক’ শব্দটাই আমার কাছে সবচেয়ে মূল্যবান মনে হয়েছে।   

এসবই আমার মনোযোগ অধিকার করেছিল। এই সময়ে আমার যোগাযোগ হয় বিশ্বখ্যাত চিন্তা-বিজ্ঞানী ও ল্যাটারাল থিংকিংয়ের প্রবক্তা ডঃ ডি’ বোনো-র সাথে। আমারই প্ররোচনায় সুদূর ভূমধ্যসাগরীয় দ্বীপ মাল্টা থেকে সেই প্রথম তাঁকে ভারতবর্ষে ডেকে এনে জামশেদপুরে টাটাস্টীলে মনোজগতিক ওয়ার্কশপের সুচনা করা হয় । তাঁর ‘সেলফ্‌ অর্গানাইজিং অ্যান্ড প্যাটার্নিং সিস্টেম’ সম্পর্কিত প্রস্তাবনা আমার একুশ শতকীয় দৃষ্টিকোণকে নির্দিষ্ট করেছিল‘ওয়ার্ডরোবে, স্নানঘরে, বাগানের অন্ধকার কোণে ; কার্পেটের নীচে, স্লেটে, ডায়েরীর পরিশিষ্ট পাতায়’  

ক্রমে নির্মাণের বিবিধ পর্যায় আমার চেতনায় ছড়িয়ে পড়তে থাকে। যাবতীয় সমুদ্রবন্দর, লাইট হাউস, শততল মিনার, এবং অবশ্যই রন্ধন প্রণালী। কীভাবে আতার পুডিং, লেমন সুফ্‌লে, মাশরুম স্যুপ। ফ্রুটবোল, পানপাত্র, ব্লাডিমেরী, ব্লু লেগুন। পদার্থের কঠিন তরল ও বাস্পরূপ ক্রমে আমি লক্ষ করি। পাইনের বনে কীভাবে কুন্ডলি পাকিয়ে ধোঁয়া ওঠে, কীভাবে উপত্যকায় ধীরে ছড়িয়ে পড়ে কুয়াশা।   টুটেনখামেনের সমাধির মতো, গ্রানাইটের অন্ধকার দেওয়ালে অঙ্কিত ইয়েরোগ্লিফের মতো, গাণিতিক ‘পাই’য়ের দশমিক মানের (৩.১৪১৫৯২৬৫৩৫৮৯৭৯৩২৩৮৪৬২৬৪৩৩৮...)মতো, ‘ফিবোনাচ্চি’ সিরিজের সুবর্ণ অনুপাতের মতো সর্বত্র আমি এক নতুন ছন্দকে, ছন্দের নিয়মকে, আবিষ্কার  করি। ‘সৃষ্টি-ঘুম-বীজগণিত, ও নিবিড় কুয়াশা আমার / আমারই তরঙ্গ অবয়ব’...। প্রকৃত প্রস্তাবে একুশ শতকের শুরুতে  এই ছিল আমার কবিতার নির্যাস। 
     
কীভাবে সৃষ্টি হয় কেওস, বিশৃঙ্খলা। কীভাবে ছন্দিত হয়, ভেঙ্গে পড়ে, পুনরায় গঠিত হয়ে ওঠে আমাদের যাবতীয় সম্পর্ক। এই সুদূর বিস্তৃত প্রাণজীবন, যোনিরক্ত ও জরায়ুর জং ।

হ্যাঁ, সম্পর্কই আমার দৃষ্টিকোণ। সম্পর্কই আমার টেলিলেন্সে, তারজালিতে, খলনুড়িতে, বুনসেন বার্নারে।      

কফি হাউসে আমি একবারই গিয়েছি । একুশ শতকে
মিনিট পাঁচেকের সেই এপিসোডে আমার মনে পড়েছিলো উৎপলকুমারের কবিতার লাইন, ‘চতুর্দিকে গরাদের স্তব্ধ ছায়া পড়েছে এখন’। অথচ কফির গন্ধ তখনও ছড়ানো ছিলো আমার অনেক কবিতায়।  আমার মনে হয়েছিল, বিনির্মাণ সম্পর্কিত সমগ্র ডিসকোর্সকে অনায়াসে দেড় পাতায় লিখে ফেলা উচিত ছিলো কিনা। আমি সমস্ত ভাষাবিদদের কাজকে নিতান্ত পন্ডশ্রম, ও জীবিকার্জনের জন্যে কত ভুল কাজই যে মানুষ করে যাচ্ছে ভেবে পুলকিত হয়েছি মৃত্যুর আগে দেরিদাও কি বুঝে গিয়েছিলেন সেই কথা ? ভুলগুলো সরাও, আমার লাগছে, -বলেছি আমি।            

আমার কবিতায় ক্রমবর্ধমান তৎসম শব্দের আধিক্যের কারণ ছিল আমার আগুন ও পাথরের কাছাকাছি   অবস্থান। ব্লাস্ট ফার্নেসের প্রবাহিত গলনাঙ্কের পাশে, স্টিলমেল্টিং শপের দাউদাউ আগুনের মুখোমুখি আমি দানবীয় রোলিং মিলের নীচে, সংকীর্ণ পাতালপথের তপ্ত গর্জিত বাস্পময়তায়, আদিবাসী কুলি-কামিনদের পাশাপাশিকনভেয়রে, বাঙ্কারে, পিঙ্গল গন্ধক-বাস্পে, অন্ধকার খনিগর্ভে, সমুদ্রবন্দরে, খনিজ আকরিকের স্তুপে ; ঘর্মাক্ত, আপোষহীন । বিশেষতঃ একুশ শতকের প্রথম দিকে প্রকাশিত ‘বন্ধু রূমাল’ বইয়ে আমার সমস্ত শব্দচয়ন এসেছে এইসব স্পেস-টাইম পরিমন্ডল থেকে। জলপ্রপাতের মতো, জেট এঞ্জিনের মতো,  অবিরল স্যাক্সোফোনের মতো একটা টানা ব্যাকগ্রাউন্ড আছে এইসব লেখার। ‘সময়-দুধের পাত্রে সময়-ঝিনুক ডুবে আছে’। বর্ণমালা নয়, ক্রিয়াপদ নয়, আমি তো দাঁড় করাতে চেয়েছিলাম আমার পাঠককে ঐ  সাস্পেনসান ব্রীজের সামনে। ঐ লাল-হলুদ ডোরাকাটা চিমনির মাথায়, ধোঁয়া ও উত্তাপের মুখোমুখি।   
একুশ শতকের প্রথম দশক পেরিয়ে আসতে আসতে আমার মনে পড়েছিল সেই ‘ভয়েজার’ নামক মহকাশযানের কথা। আমার কবিতা লেখার প্রত্যেকটি বাঁকেও সে অবিরল ছুটে চলেছে মাধ্যাকর্ষণের গণ্ডি ছাড়িয়ে একে একে গ্রহদের কক্ষপথগুলো পেরিয়ে ; এখন সে সৌরমন্ডলের সীমানা ছাড়িয়ে দূরগামী নীহারিকাদের দিকে ধাবমান।  
   
সেইমতো, ‘নীল কাগজ’ সিরিজের লেখাগুলোয় আমি চেষ্টা করেছি, এক প্রান্তিক দূরত্ব থেকে, যাপিত জীবন সম্পর্কগুলোকে নিবিড় ও অন্তরঙ্গভাবে পুনরায় নিরীক্ষণ করতে। নতুন ডিকশানে। কবিতা অসমাপ্ত জেনে, জীবন অপূর্ণ দেখে। ‘আমি লিখছি আমারই জন্যে এইসব লেখা / কাগজে কলমে জলছবিতে, কাঠখোদাই করা / ঢালাই করা ধাতুর গায়ে, মৃৎপাত্রে জঙ্গল-লতায়’...। ‘আমি লিখছি সেই লেখা যা কখনো শেষ ও সমাপ্ত / হবে না, যা ভেসে থাকবে জলের ওপর জল হয়ে’...।  
  
হয়তো এই সেই কলম বন্ধ করে চুপ করে বসে থাকার সময়। আর কি নতুন নেই ? ভাবি আমি। ছিন্নভিন্ন দৃশ্যকে ছবি করে তোলাই এবার কবিতা। কারণ আমার কথারা এখনো অসমাপ্ত ঘুমে জাগরণে আমি আজও তাদের ধীরে ধীরে সজ্জিত হয়ে উঠতে দেখি। কাঠ-খোদাইয়ের মতো, লিনোকাটের মতো, অরিগামীর মতো নিপুণতায় আমি রচনা করি সেই অসমাপ্ত কথারা, আজ দুপুরবেলায় যা যা দেখলাম ।

‘-সাদা লিনেনের ওপর ছলকে পড়েছে গরম কর্ন স্যুপ ; জানালা-কাচের ওপাশে রাজপথে দগ্ধ মৃতদেহ ঘিরে কয়েকটি ওবি ভ্যান।

 -জনহীন মাল্টিপ্লেক্সের অন্ধকার সোফায় সঙ্গমে উদ্দাম দুই যুবক যুবতী। তাদের চশমা চাবি মোবাইল আর মানিব্যাগ ঝাঁট দিয়ে নিয়ে গেল একজন অন্ধ জ্যানিটার।  


-আদি গঙ্গায় রাজনৈতিক জোয়ার এসেছে। স্রোতে ভাসছে জরির টুপি, ঠ্যাং-ভাঙা গলিত দেবীপ্রতিমা আর  রক্তাক্ত টিনড্রামগুলো’।


মনে হয়, এখনও এতদূর বিস্তৃত এই ভার্জিন ভূভাগ। এখনও কবিতার পাঠক তাহলে তৈরী হয়নি কি ? আমার কবিতার প্রথম পাঠক তো আমিই। নিশ্চয়ই কোথাও ভুল থেকে গেছে শব্দ-ব্যবহারে।  ভুলগুলো সরাও, আমার লাগছে।  

-----------------

Tuesday 15 March 2016

'৯'য়া দশক' পত্রিকার উতসব-২০১৬ সংখ্যায় আমন্ত্রিত সম্পাদকীয়

রাজর্ষি চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত '৯'য়া দশক' পত্রিকার সাম্প্রতিক
উতসব-২০১৬ সংখ্যায় আমন্ত্রিত সম্পাদকীয় লিখতে আমাকে 
অনুরোধ করা হয়েছিল। সেই মুক্তগদ্যটি এখানে উদ্ধৃত হল, যারা ওই 
কাগজটি পড়েননি তাঁদের জন্যে। 

(এটি আমার একটি পুরনো গদ্যের 
পুনর্লিখিত ও পরিবর্ধিত রূপ।) :


---------------------------------------------------------------------------



আজও লাল রঙ আমাদের শিহরিত করে। কালো কালি দিয়ে ‘লাল’ শব্দটি লিখে তাকিয়ে থাকলে, ক্রমে প্রপাতের গর্জন শোনা যায়। ঘন নীল রঙের প্রবল ব্যবহার দেখেছিলাম ক্যান্সার ওয়ার্ডে, হাতে লেগেছিল। যে কোনও সকালেই আবিষ্কৃত হতে পারে, বারান্দা বেডরুম ভাসিয়ে ঝরে পড়ছে গোপন ও উদ্দাম এক জলপ্রপাত। চেয়ার টেবিল ও বুকর‍্যাকগুলো খোলা আকাশের নীচে ইতস্ততঃ ধোঁয়া উঠছে কুন্ডলি পাকিয়ে। জঙ্গলের তীক্ষ্ণ প্রান্তে ইউক্যালিপ্টাসের শীর্ণ শাখাকে জড়িয়ে ধরে কেউ ডেকে উঠছে ‘প্রভু...’ !    

মাথার ওপরে অসীমে ভাসমান তিন ট্রিলিয়ন অগ্নিপিন্ড থেকে যে হল্কা সতত ঝরে পড়ছে স্নায়ুতে, তা আমাদের নিয়ত হত্যা করতে চায়। তবুও আমরা জুড়ীগাড়ি চড়ি, রেকাবী সাজাই, নারীর নাম দিই অরুন্ধতী, ক্লিওপেট্রা। কেননা আমরা সতত শংকিত ও আড়ষ্ঠ। ‘যেতে যেতে একলা পথে’ –এই গান আমাদের প্রিয় মনে হয়। আতংকই আমাদের প্রেরণা, গান।

কোথায় ছিন্ন হয়েছে আলো, কোথায় রয়েছে হুল, কোথায় সেই শ্বাসগন্ধ, যোনি, শুককীট, কমলাসন, -আমরা আর সঠিক কখনই জানি না। প্রেমে, বন্দরে, নৈঃশব্দে, সাইরেনে, বিস্ময় আমাদের প্রথম ও শেষ অবস্থা। হাত কখনো ব্যান্ডেজে, নীল রঙে, স্তনে, মদের গেলাসে, দোয়াতে। তবুও অভাবরূপ। বিস্ময়। কালো ও প্রকান্ড এক উদয়ের অপেক্ষায়, নিশ্চিত আমরা সমবেত বসে আছি। আমাদের প্রিয় সমস্ত ফলই গোলাকার ও পতনশীল।

তবুও, আজ অবধি বৃষ্টিতে সমর্পিত হয়ে, ভিজে, মা ডেকে তৃপ্তি পেলাম না। কতবার জলাধারে, শৈলাবাসে, প্রকৃত রডোডেনড্রনের জানালায় গিয়ে বসা হোল। ফিরে এসে, অফিসে পর্ষদে কর্পোরেশানে নতুন টেবিল সাজালাম। দেওয়ালে লেখা হোল ‘শ্রী’ ও ‘সিদ্ধি’। ঢের রাতে বান্ধবী এসে গেয়ে শোনালো ‘আমারে যদি জাগালে আজি নাথ...’। সেই আরামকেদারায় প্রশ্নবোধক স্যুপের পাত্র হাতে আমাদের কত রাত ঝিঁকচোখে কেটে গেছে। 

আমাদের একটা দূরগামী মোটরহোম ছিল, যার চাকার নাম ছিল ‘হবে জয়’। একটা রাবারের নৌকা ছিল, যার নাম দিয়েছিলাম ‘হাওয়ার রাত’। আমাদের ছিল এক ঝাঁক পায়রা আর একটা ধূসর আতাগাছ। ছিল নানারকম মদ, তীরধনুক, বর্শা, দক্ষিণাবর্ত শাঁখ, বাঁশি, এসরাজ ও মোমবাতি। আর গান ছিল কাঙাল  হরিনাথের। ফুলদানিতে ছিল ভ্যান গঘের আঁকা সূর্যমুখী ফুল। তবু আমাদের ফিরে আসতে হয়েছিল।     

নিরুপায় আমরা সন্তানের নাম দিয়েছিলাম ‘জয়’ ও ‘শান্তি’। মনে হয়েছিল, পশমের কম্বলে বুঝিবা আমাদের মানায়। আমরা পশম কিনলাম। তারপর একদিন সহসাই, সমূহ অন্তর্বাস খুলে ফেলে, আরও সর্বস্ব খুলতে চেয়ে দেখা গেল, যায় না। তখন আমরা অক্ষর ভাঙ্গলাম, ইতিহাসের পাতা কুটি কুটি করলামকাব্যগ্রন্থের উতসর্গ পাতায় এসে থমকে দেখলাম, প্রবল নীল রঙ ও ক্যান্সার ওয়ার্ড। 

-একদিন  মর্গ থেকে বেরিয়ে শেষ নার্সটির সাথে ভোরের আলোয়। দেখা হোল কাঁটাতারের ওপারে যেখানে হলুদ পলাশ ফুটেছে, সর্বস্ব ছিন্ন করে আগুনফ্রক পরে ঝাঁপ দিয়েছে আমাদের কিশোরী মেয়ে। দেখা হোল, সাগরসৈকতে জেলিফিশ আর ঝিনুকের পাশে ঘুমিয়ে আছে আমাদের শিশুপুত্র ; ঢেউ এসে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে তার পোশাকের নীলরঙ ও শেষ রক্তিম আকাঙ্ক্ষাগুলো। -এবং ‘আকাশ আজ দেবতার ছেলেমেয়েদের নীল শার্ট পাজামার মতো বাস্তবিক। একা ময়ূর ঘুরছে খালি দোতলায়’ ...     -শংকর লাহিড়ী ।