Wednesday 29 November 2017

'এ দুখবহন করো মোর মন...


[গত ২৩ অক্টোবর ২০১৭-য় রাজর্ষি চট্টোপাধ্যায়ের ‘নয়াদশক’ আন্তর্জাল পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল আমার লেখা ‘রৌদ্রময় সকাল ও জ্বলন্ত হ্যারিকেন’ নামক দীর্ঘ গদ্যটি। এতে আছে নতুন কবিতার পথ নিয়ে ২০০৪ সালে প্রকাশিত কবি বারীন ঘোষালের লেখা তাত্ত্বিক প্রবন্ধের বই ‘অতিচেতনার কথা’ সম্পর্কে আমার পাঠ-প্রতিক্রিয়া, বিশ্লেষণ এবং তাঁর তত্ত্ব ও তথ্যের বিভিন্ন ভ্রান্তিগুলোকে চিহ্নিত করার কাজ। তাঁর মৃত্যুর মাত্র কয়েকদিন আগে প্রকাশিত এই লেখাটি বারীন ঘোষালের পড়া হয়নি। কিন্তু তাঁর কাব্যতত্ত্বের প্রবল অনুগামী, ভক্ত ও অনুজ কবিরা আমার লেখাটি পড়ে একে চূড়ান্ত ঈর্ষা ও বিদ্বেষপ্রসূত সাব্যস্ত করেন এবং ফেসবুকে বিপুল সংখ্যায় আমার প্রতি তীব্র অশ্লীল আক্রমণে কুৎসা ও ছিছিক্কার করেন। এরই পাশাপাশি অনেক তরুণ ও প্রবীণ কবি ও পাঠক এই বিষয়ে আমার প্রতি তাঁদের পূর্ণ সমর্থন জানান এবং আমার লেখাটিকে একটি অতি প্রয়োজনীয় ও জরুরী উন্মোচন বলে ঘোষণা করেন। এই প্রেক্ষিতে সোশ্যাল মিডিয়ায় আমার প্রতি তীব্র আক্রমণকে অনেকেই সাইবার ক্রাইম ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে আইনি ব্যবস্থা নিতেও পরামর্শ দেন। সব আক্রমণ সহ্য করেও দীর্ঘ একমাস নিরুত্তর থাকার পরে, এখানে আমার ব্যক্তিগত ব্লগে নিজের  বক্তব্য রাখলাম।]  


১।  এতগুলো দিন কেটে গেল নীরব বেদনায়, অপমানে, রক্তপাতে। আজ মনে হোল কিছু কথা, শেষবারের মতো, বলা দরকার। একটা প্রবন্ধ লেখাকে নিয়ে এই চূড়ান্ত অসহিষ্ণুতা, তীব্র আক্রমণ, এই কুৎসিত চরিত্রহনন! এ কাজ করেছে কারা? --যারা আমাকে দীর্ঘদিন ধরে দেখে এসেছে, পড়েছে আমার অনেক লেখা, আমি যাদের এতদিন বন্ধু বলেই জানতাম। কেউ কেউ ব্যক্তিগতভাবে জানিয়েছেন যে, আমার প্রতি এই রেজিমেন্টেড আক্রমণ শুরুর পেছনে আছে এক চতুর সুযোগসন্ধানী, হয়তো আছে তার কলমের সংকট আর কিছু অপূর্ণ উচ্চাশা কিন্তু এর বাইরেও আছে অনেক পাঠক পাঠিকা, যাদের আমি ফ্রেন্ডলিস্টে আসার অনুমতি দিয়েছিলাম, অথচ আমার কোনও বই হয়তো তারা কখনো পড়েনি, ব্যক্তিগতভাবে জানে না আমার কিছুই, জানে না কৌরব পত্রিকার শ্রেষ্ঠত্বের ইতিহাসের এক কণাও কিন্তু আজ তারাও, হাওয়া ওঠানো হয়েছে দেখে, একই ভাবে আমার প্রতি কুৎসায় সমর্থন দিয়েছে। মৃত্যুর ওপার থেকে যদি দেখা যেত, তবে কবি বারীন ঘোষাল নিশ্চয় এখন শিউরে উঠতেন তাঁর সাহিত্যচর্চার উত্তরাধিকারীদের এইমতো কদর্য স্বরূপ দেখলে। হয়তো লজ্জিত হতেন, হায় হায় করতেন। যাঁরা শুভবুদ্ধির মানুষ, তাঁরা ভাবছেন- ‘অনেক বেশিই সহ্য করা হ’ল চারদিকের এই কদর্য অসহিষ্ণুতা’সময়ের এই সন্ধিক্ষণে আমারও মনে পড়ছে শ্রদ্ধেয় অমর্ত্য সেনের সেই কথা-- "We Have Been too Tolerant, Even of Intolerance"  

আমি তো কিছুই লিখবো না ভেবেছিলাম। কিন্তু অনেকেই এখন বলছেন, আমার প্রতি এইসব অশ্লীল আক্রমণ অবশ্যই প্রতিবাদযোগ্য। আমিও কি কখনো এদের ক্ষমা করে দিতে পারবো ? –জানিনা, হয়তো একদিন পারবো। তবে অনেক রকম মানুষের পরিচয় পাওয়া গেল এই অবসরে। এটাও একটা লার্নিং। এই সব নিয়েই জীবনপ্রবাহ ; এই প্রবাহের কোথাও দেখা হোল বড় নদী, কোথাও শাখানদী, চোরাবালি, পচাখাল, বাঁওড়, কাঁচা নর্দমা, ভাগাড়। কমলদা বললো, “তুমি দুঃখ পেয়ো না। দেখো, আমরা ভাষাব্যবহার শিখেছি রবীন্দ্রনাথ বিদ্যাসাগর বঙ্কিম বিবেকানন্দ পড়ে ; আমরা তো ফাটাকেষ্ট, হাতকাটা দিলীপ বা পেটকাটা গণ্‌শার কাছে ভাষা শিখিনি”আমার মনে পড়লো- কথামৃতে ঠাকুর রামকৃষ্ণ বলেছেন, তোদের চৈতন্য হোক। আমার মতো মানুষদের উদ্দেশেই বলেছিলেন বোধহয়।     

            
    
২।  বারীনদার সাথে আমার দীর্ঘদিনের আন্তরিক সম্পর্ক ও মাঝের কিছু টানাপোড়েনের কথা আজ একটু জানাতে ইচ্ছে করছে। এর বাইরে আর কিছুই বলবো না। এসব খুবই ব্যক্তিগত, গোপনে রেখে দেওয়াই ভালো। আমার কাছে নানা শ্রদ্ধা ভালোবাসা আনন্দ বিস্ময় ক্ষোভ মিলেমিশেই বারীনদার স্মৃতি, যা শুধুই গাজরের হালুয়া নয়-মনে পড়ছে, অনেক বছর আগে জামশেদপুরে আমি তখন টাটা-হাসপাতালে, ভীষণ অসুস্থ, চাপ চাপ রক্তবমি হচ্ছে। বারীনদা একদিন আমায় দেখতে এসেছিল। দেখে ঘাবড়ে গিয়েছিল, কোনও কথা বলতে পারেনি। বারীনদার শেষ দিনগুলোতে আমি দেখা করতে যেতে পারিনি, আমার স্ত্রীর দীর্ঘ অসুস্থতার জন্যে। তাছাড়া, এবারও তো নিশ্চিত ছিলাম যে ফিরে আসবে, প্রণবকে লিখেছিলামপ্রণব আজীবন বারীনদার সকল বিপদে পাশে থেকেছে দেখেছি, পাহাড় থেকে ফিরে এসে আমাকে জানিয়েছে কতবার। বলেছে, ‘এরকম মদ খেলে আর বাঁচবে না, আর কখনও ওকে নিয়ে যাবো না পাহাড়ে’। এবার কমলদাও ফোনে জানিয়েছে। কিছুদিন আগে বারীনদার বাড়ি থেকে ফিরে অনেক রাতে কমলদা জানালো—‘খুব খারাপ অবস্থা, একটা ঘোরের মধ্যে আছে, বিশেষ কাউকে চিনতেও পারছে না, বিছানাতেই অসাড়ে’সেদিনই রাতে রাজর্ষিদের ব্লগটা যখন বেরোয়, তখন অনেক দেরী হয়ে গেছে। এর ছ’মাস আগে হলে বারীনদাকে লেখাটা পড়ানো যেত। সেই নিয়ে সে নির্বাক থাকতো, নাকি নতুন করে ভাবতো, -জানিনা। হয়তো বলতো : ‘আমি নিজেই তো ওই তত্ত্বকে ডিসকার্ড করেছি’-- কিন্তু আমাকে অন্তত আক্রমণ করতো না কখনো। তিন-চার মাস আগে, যখন তার বইটার আলোচনা জরুরী বলে ফেসবুকে লিখেছিলাম, বারীনদা সেটা ‘লাইক’ করেছিল। এর অনেক আগে, ২০১১ সালে, যখন আমার ব্লগে স্বদেশ সেনের সাক্ষাৎকার প্রকাশ করেছিলাম, (স্বদেশদারই আগ্রহে ও বিশেষ অনুরোধে) বারীনদা নিজে তাকে সহজভাবে নিয়েছিল ; আমাকে তা লিখে জানিয়েও ছিল, কারণ তার ‘নতুন কবিতার পথ’ নিয়ে কবি স্বদেশ সেনের যথেষ্ট ক্ষোভ ও পর্যবেক্ষণ সম্বন্ধে আগেই স্পষ্ট ধারণা ছিল তারতবে স্বদেশ সেনের কবিতা বারীনদার খুবই প্রিয় ছিল, এবং এই যুক্তিতে বারীনদার কবিতাও স্বদেশ সেনের কাছে খুব প্রিয় হওয়া উচিত, -বলেছিল সে। সেটা হয়নি বলে, পরে স্বদেশ সেনকেই দোষী সাব্যস্ত করে লিখেছিল বারীনদা, যা কালিমাটি পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। আমি খুব বিস্মিত হয়েছিলাম বারীনদার এমন অদ্ভুত যুক্তিতে।  
                    
আমার ব্লগে স্বদেশ সেনের জীবনের শেষ সাক্ষাৎকারটি, তাঁরই অনুরোধে প্রকাশ করায়, আমাকে তীব্র আক্রমণ করেছিল রঞ্জন মৈত্র এবং অরুণ চক্রবর্তীর মতো মানুষ। কিন্তু এর পরে একদিন সেই অরুণবাবুই আমাকে ফেসবুকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছিলেন কেন, জানিনা। আমিও তাঁকে সুযোগ দিয়েছিলাম কৌরবকে জানার, আমার কাজগুলোকে জানারআজ তিনিই আবার প্রশ্ন করেছেন- ‘এই এক শংকর লাহিড়ী ! তাঁকে কেউ চেনেন ?’ --আসলে আমিই ভুল করেছি। ইনি আমাকে সম্যক না চিনেই ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছিলেন ! ইনি আমার পাঠক নন, ফ্রেন্ড তো নয়ইএই নিয়ে বেশি কিছু বলতেও আমার রুচিতে বাধছে।  
        
কিন্তু যে কথা কেউ জানে না সেটা হোল, শ্রীমান আর্যনীলকেও আমি অতিচেতনা নিয়ে আমার এই ‘বিতর্কিত’ তিরিশ পাতা লেখাটার ড্রাফট আড়াইমাস আগেই দু’বার মেইল করে পাঠিয়েছিলাম, অগাস্ট ২০১৭ তে। সৌজন্যবশতঃ জানতে চেয়েছিলাম তার মতামত, যেভাবে শিক্ষাক্ষেত্রে ও শিক্ষিত সমাজে চাওয়া হয় এবং কি আশ্চর্য, লেখাটা নিয়ে এতকাল কিছু জানায়নি সে ! আজ হঠাৎই সুযোগ বুঝে ঝাঁপিয়ে পড়েছেআমার লেখাটার যাবতীয় যুক্তি ও তথ্য থেকে পাঠকের মনোযোগ ফেরাতে এবং পাঠককে ক্ষেপিয়ে তুলতে সে জিগির তুলেছে যে, বারীন ঘোষালের প্রতি অসূয়া, দ্বেষ ও মর্মান্তিক প্রত্যাখ্যান রয়েছে নাকি আমার লেখায়। এখান থেকেই শুরু হয়েছে পরবর্তী সব আক্রমণ, এমনকি শরীরী ভাষায় জবাব ও প্রাণনাশের হুমকিও -কেউ কেউ এইসব আক্রমণকে সরাসরি ফ্যাসিবাদের সাথে তুলনীয় বলেছেন। তবে আইনের চোখে এটা একটা পরিকল্পিত অপরাধ। এর মধ্য দিয়ে শ্রীমান আর্যনীল তার বোধ-বুদ্ধি-শিক্ষা-সৌজন্যের অনেকগুলো দুর্বল দিক নিজেই উন্মুক্ত করে প্রকাশ্যে আনলো। 
             
বছর সাতেক আগে সে আমায় ইমেলে জানিয়েছিল (১-৭-২০১০) : বারীনদার এই ‘সৎকার’ ও অতিচেতনা-কাব্যতত্ত্ব নিয়ে কৌরবের ভেতর থেকেই একটা লেখা তৈরী করা দরকার, আমরাই লিখবো, কারণ এগুলো কখনোই ‘যাদব দত্তের মতো রটন আকাডেমিয়া'-র কাউকে দিয়ে হবে না’-তার অনেক চিঠিতে এভাবেই বহু মানুষের নামে উল্লেখ আছে অনেকের সাথে তার দীর্ঘদিনের নষ্ট সম্পর্ককে এখন, এই সুযোগে, পুনোরদ্ধার করতে পারা যাবে ভেবে, প্রধানতঃ তার নেতৃত্বেই আজ এমন বিপজ্জনকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে আমার প্রতি আক্রমণ, যা নাকি ধমক দিয়ে শেয়ার করতেও বলা হয়েছে প্রকৃতই কবিজনোচিত এইসব প্রয়াস !! কৌরবে তার সম্পাদকীয় যোগ্যতা নিয়ে বহুবার প্রবীণ নবীন অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন, তবু আমি এতদিন আর্যনীলকেই সমর্থন জানিয়ে এসেছি। আমার কি তবে ভুল হয়েছিল ? আজ এত কুৎসিত আক্রমণের মুখেও আমি বুকর‍্যাক থেকে পড়বো বলে নামিয়ে এনেছি তারই বই ‘স্মৃতিলেখা’, যাকে সে একটি ‘সম্পূর্ণ কবিতা’ বলেছে, তাকে পুনরায় ফিরে দেখতে চেয়ে ! 

                               
    
৩।  কিছুদিন আগে ফোন ক’রেছিলেন প্রবীণ কবিদম্পতি ; দেবারতিদি (মিত্র) দীর্ঘ সময় প্রবোধ দিলেন, বললেন—‘এখন সর্বত্র এরকমই। কারো বই নিয়ে কিছু বলা যায় না। তুমি ভেঙ্গে পোড়োনা, পনেরো দিন ধৈর্য ধরো’-এসেছে আরও কিছু ফোন, কয়েকজন সম্পাদক সাক্ষাৎকার চেয়েছেন, লেখা চেয়েছেন, আর আমাকে ব্যক্তিগত সমর্থন জানিয়ে এসেছে অনেক মেসেজ। অনেকে বলেছেন যে, পরিণত পাঠক লেখাটা পড়ে অবশ্যই ভাববে। ভাববেই। এই প্রসঙ্গে, আমি আজ প্রাজ্ঞ কবি সমীর রায়চৌধুরীকে খুব মিস করছি। আজকের এইসময়ের অনেক কবিদের সম্পর্কে তিনি আমায় জানিয়েছিলেন (তাঁর শেষ রেকর্ডেড সাক্ষাৎকার) তাঁর মোহভঙ্গের কথা ; বলেছিলেন, ‘কবিতায় এদের সব ফরমুলা আমি ধরতে পেরে গেছি। এরা যেখানটায় ফেল করছে, তুমি কিন্তু সেখানে ফেল করছো নাতোমার কাজে আনন্দ পাচ্ছি, রসদ পাচ্ছি, ভাবছি, কেননা তুমি ভাবার জায়গাটা অব্দি আমাকে পৌঁছে দিতে পারছো, যেটা ওরা পারছে না’-আজকের এই অবস্থা দেখলে সমীরদা কী বলতেন আমার জানতে ইচ্ছে করছে। 

আজ প্রবীণদের কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন—একটা তাত্ত্বিক বইয়ের পাঠ-প্রতিক্রিয়া লেখার জবাবে এই অকথ্য কুৎসা করে যাওয়া মানুষরা কি আদৌ সাহিত্যের লোক ? -এখান থেকে, এদের থেকে, বহু দূরে সরে যাওয়া  উচিত, একথা আমাকে বলছেন অনেকেইকারণ, আমি তো বারীন ঘোষালের কবিজীবনের একটা মধ্যবর্তী অধ্যায়ের মাত্র আলোচনা করেছি, যা ওই ‘অতিচেতনার কথা’ নামক বিতর্কিত ও ভ্রান্ত বইটির জন্ম দিয়েছিল, যা কালো মেঘের মতো সাময়িক আড়াল করে রেখেছিল তার অন্তরের কাব্যবোধকে। যেখান থেকে সে নিজেই পরবর্তী কালে সরে আসার কথা জানিয়েছিলআমি তো একথাও লিখেছি যে, ‘যখনই এইসব তত্ত্ব থেকে সরে এসে কবিতা লিখেছেন উনি, সেখানেই ওঁর কবিতা উজ্জ্বল হয়েছে’লিখেছি, ‘কবি বারীন ঘোষালের অন্তর্লোকের কাব্যবোধকে আমি তাই সম্মান জানাই, কারণ নানাভাবে তাঁর গভীরের প্রতিভার সন্ধান পেয়েছি’

যাঁরা এখন আমাকে আক্রমণ করছেন, সম্ভবতঃ তাদের মধ্যে অনেকেই লেখাটা পড়েননি, আবেগে প্রভাবিত এবং জিগিরে প্ররোচিত হয়ে আমার বিরুদ্ধে অশ্লীল কুৎসার ঢেউ তুলেছেনভেবে দেখেননি, নতুন কবিতা-পথের সন্ধানের আন্তরিকতাকে আমি তো অভিনন্দন জানিয়েছি, প্রশংসা করেছি ওঁর শ্রমের। আমার ওই লেখাতেই রয়েছে সেইসব কথা। নতুন কবিতার সন্ধান কৌরবে কিভাবে আমরা শুরু করেছিলাম, আশির দশকের গোড়াতেই, তাও জানিয়েছিএকুশ শতকে এসে, স্বদেশ সেনের শেষ সাক্ষাৎকারে আমি বলেছিলাম যে, বারীনদা---ভুল হোক ঠিক হোক---নতুন কবিতার পথ নিয়ে তরুণদের একটা ঝাঁকানি দিতে পেরেছিল। স্বদেশদার সেই মূল্যবান সাক্ষাৎকারটা আমার আগামী বইয়ে রয়েছেবারীনদার গদ্যের মধ্যে ছোট গল্পগুলো আমার প্রিয় ছিল, এ কথাও আমি আগে অন্যত্র লিখেছি। কবিতায় ওঁর ‘সুখের কালক্রম’, ‘মায়াবী সীমুম’ ও অন্য আরও কিছু লেখা থেকে যত্ন নিয়ে বেছে একটা কবিতাসংগ্রহের প্রয়োজনীয়তার কথাও লিখেছি। এই কাজ কৌরব থেকেই যত্ন নিয়ে করা উচিত ছিল। বারীনদার প্রায় সমস্ত বই-ই অযত্নে এবং দৃশ্যতঃ অসুন্দর প্রচ্ছদে এতকাল ছাপা হয়েছে। 

কিন্তু এই সব ছাপিয়ে, বারীনদার সকল সাহিত্যকর্মের আলোচনা সরিয়ে রেখে আজ বড় হয়ে উঠেছে তার আশ্রয়ে  আর প্রশংসায় কে কতভাবে লালিত ও সজ্জিত হয়েছে তারই সেলফি-শোভিত, আবেগাশ্রিত, স্বার্থপর কাহিনী। তার স্মরণসভায় আলোচনা আর বিদ্বেষের নমুনা দেখে বিস্মিত হয়ে কেউ কেউ মন্তব্য করেছেন যে, এ জিনিষ কি তার স্মৃতির প্রতি অসম্মান নয় ? –আসলে, এসব বোঝার মতো শিক্ষা ও মানসিকতার আজ খুব অভাব। এইরকম অন্ধ আবেগ চিরকালের। পৃথিবীতে আমাদের প্রত্যেকের নিজের নিজের পাওনার হিসেবটাই সবচেয়ে জরুরী, আর তার মহার্ঘতম অনুভবই হোল প্রেম ভালোবাসা। কিন্তু ক্ষুদ্র স্বার্থের বাইরেও জায়গা থাকা উচিত শিল্প-সাহিত্য-সঙ্গীত-চিত্রকলা নিয়ে স্বাধীন, পরিণত, নির্ভীক ও যুক্তিগ্রাহ্য আলোচনার। সাহিত্যচর্চার আঙিনা আজ রাজনীতির ময়দানের চেয়েও বেশি কলুষিত। বরং আমি যে কর্পোরেট দুনিয়ায় এতকাল কাজ করে এসেছি, তুলনায় সেখানে আজও অনেক বেশি মেধা, শ্রম, শিক্ষা, সৃজনশীলতা আর সৌজন্যের পরিবেশ রয়েছে।   
       
বারীনদার কবিতা-পথ নিয়ে আমার ওই লেখাটার একটা বড় অংশ জুড়ে আছে নতুন প্যারাডাইমের কথা, যা আমি তরুণ প্রজন্মকে জানাতে চেয়েছিলাম, যার জন্যে লেখাটা বেশি মূল্যবান হয়েছে বলে জানিয়েছেন কয়েকজন। বাংলা সাহিত্যে আজ অব্দি এইসব বিষয়ে কেউ কোথাও কখনো লিখেছেন বলে আমি জানি না। পড়িনি কোথাও। আমি এই নিয়ে ‘কবিতার এরিনা’ নামে লিখতে শুরু করেছিলাম কুড়ি বছর আগে, সেই কাজটা ক্রমে সম্পূর্ণ করতে চেয়েছিলাম। তবে আজ আর সেই প্রয়োজন নেই ; বাংলা কবিতার এইসব মানুষের জন্য আমি আর কখনো কোনও বড় মাপের আলোচনায় যাবো না। কোনও কবিকে ঘিরে আজকের মতন এমন একটা অসহিষ্ণু চূড়ান্ত পরিমন্ডল গড়ে উঠলে সাহিত্যের অমর্যাদা হয়, শ্বাসরুদ্ধ হয় কবি ও কবিতা। এইজন্যই কবির প্রয়োজন হয় পরিত্রাণ, নির্বাসন ; প্রয়োজন হয় মধুর একাকীত্ব। এইখানে বারীনদা ও আমি ছিলাম প্রকৃতই দুই মেরুর, আমাদের গন্তব্য এবং পথ, দুটোই ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। কখনো কোনও বিষয়েই তাকে ঈর্ষা করা আমার পক্ষে সম্ভব ছিলো না ; যারা প্রকৃতই কৌরব, শুধু তাঁরাই হয়তো এটা বোঝেন। 

আজ এটাও বলা দরকার যে, আমাদের ‘কৌরব’ কখনোই মহাভারতের কৌরব ছিলোনা। আমরা কখনোই জমি হড়প করার পক্ষে, পাশা খেলায় চোট্টামির পক্ষে, বা নারীর বস্ত্রহরণের পক্ষে ছিলাম না। এসব না জেনেবুঝেই শুধু ক্ষীর খাওয়ার লোভে অনেক মানুষজন ঢুকে পড়েছিলেন পত্রিকার চৌহদ্দিতে !! কৌরব আসলে ছিল একটা মগ্ন, নতুন জীবনযাপনের আইডিয়া, কফিহাউস ও খালাসীটোলা থেকে দূরে সাহিত্যচর্চার একটা নতুন ল্যান্ডস্কেপ, একটা উজ্জ্বল ব্যতিক্রমী মাল্টিডিসিপ্লিনারি কনসেপ্ট, যাকে আমরা আশির দশকে এসে ক্রমে পরিস্ফুট করেছি, পেয়েছি শ্রেষ্ঠত্বের পুরস্কার-তবে আমার অসীম মুর্খতা যে, আমি চাকরি-জীবনে অবসরের পরে ফেসবুকে এসে স্বাধীন সাহিত্যচর্চার পরিসর খুঁজেছিলাম। আমার চৈতন্য হয়নি, আরও সাধনার প্রয়োজন আছে। আমি তাই ফিরে যাচ্ছি। আজকের এই চতুর সাহিত্য-বাজার, এই অশ্লীল কুৎসিত আবর্জনার পাহাড়, এই ডেথ্‌ ভ্যালি-- এ আমার বাসভূমি হতে পারে না। আমার চাই নির্বাসন, পরিত্রাণ।       

              
          
 বারীনদার সাথে আমার সম্পর্ক দীর্ঘকালের ; সেই ১৯৭৭ সাল থেকে, যখন তার আশেপাশে আজকের এই ভীড় ছিলোনা। কতবছরের কতদিনের কথা, অজস্র নীরব স্মৃতি, আজও তারা মনের গভীরে ভালোবাসায়, বিষাদে, স্পন্দিত। কিন্তু দীর্ঘদিনের কিছু কিছু ঘটনায় আমিও কখনো তার প্রতি শ্রদ্ধা হারিয়েছি ; আমার প্রতিবাদ ছিল তার ঐ বইয়ে নিজের কবিতাকেই ‘শ্রেষ্ঠ ও একমাত্র পথ’ ও ‘বিশ্বে এমনই এখন লেখা হচ্ছে’ বলার মতো অসঙ্গত আত্মপ্রচার, এবং  কৌরবের ‘কবিতার ক্যাম্প’ নিয়ে পরবর্তীকালে লাগাতার মিথ্যাচারের বিরুদ্ধেও। ইদানিং কমলদাও হয়তো পুরোনো স্মৃতি হাতড়ে অনেক কিছু বুঝতে পেরেছিল। কয়েক মাস আগেও আমাকে ফোনে বলেছে- ‘তুমি সেসব মনে রেখে কষ্ট পেয়োনা, তোমার ওপর দিয়ে অনেকদিন ধ’রে অনেক কিছু গেছে, একদিন তোমার ভালো হবে, শত্রুরাও বুঝতে পারবে ...কাউকে তুমি অভিশাপ দিয়ো না’ মাত্র দু’মাস আগে সে আমায় বলেছিল।  
               
আমি জানতাম কবিতার ক্যাম্পগুলোয় দীর্ঘদিন বারীনদার যেতে না পারার গোপন দুঃখ, কিন্তু মুদ্রিত কৌরবে সেইসব ক্যাম্পের রিপোর্টে সে নিজের নাম ঢুকিয়েছিল, অন্যের মুখের সংলাপ বসিয়েছিল নিজের মুখে, যা এতকাল সত্য বলে তরুণদের মধ্যে প্রচারিত হয়ে চলেছিল। এভাবে মিথ্যার আশ্রয় নেওয়াকে অনেকেই বিভ্রান্তিকর ও অশ্রদ্ধেয় বলেছেন। এইসব প্রচারের কথা আমি প্রথম জেনেছিলাম একজন শ্রদ্ধেয় প্রবীণ কবির আমাকে হঠাৎ পাঠানো একটি আড্ডার ভিডিও ক্লিপ দেখে। ‘কবিতার ক্যাম্প’ নিয়ে তথ্য সহযোগে আমি কবিসম্মেলনেও লিখেছি ; সেটা বিদ্বেষবশতঃ নয়, সত্যকে জানানোর জন্যই কারণ বারীনদা এর বিপরীত সাক্ষাৎকার দিয়ে চলেছিল ! (এ এক আশ্চর্য পরিবেশ। মিথ্যাচার এখানে দোষণীয় নয়, বরং সেটাকে ধরিয়ে দেওয়াকেই বলা হয় ‘বিদ্বেষপ্রসূত’! -আমার কোনও প্রিয় মানুষ এভাবে অসুস্থ আত্মপ্রতিকৃতি গড়তে চাইলে আমার  শ্রদ্ধা ভেঙ্গে বেদনা হয়। আমি চুপ করে বসে থাকি, আর মনে পড়ে স্বদেশ সেনের কবিতার সেই লাইন- “আত্মপ্রতিকৃতি ভাঙ্গো আর সুস্থ হও”।)     
     
‘কবিতার ক্যাম্পের’ পরবর্তীকালে ব্যবস্থা হয়েছিল কৌরবের সপরিবারে বৌ-বাচ্চা নিয়ে চাঁদিপুর আর বেথলা ভ্রমণের। চারজন পুরুষ, কমল-বারীন-দেবজ্যোতি আর আমি। তিনজন মহিলা, কল্পনা-কৃষ্ণা-কণিকা। আর দুই শিশু কন্যাকমলদা তখনও ব্যাচিলর। সেইসব প্রমোদ-ভ্রমণেরও অনেক সুখস্মৃতি আছে, ছবি আছে বলা যাবে না, এমন অনেক মেয়েলি ঝাল-মিষ্টি গল্পও আছে। আমি জানি, আশির দশকের অনেকগুলো বছর জুড়ে কত রকমের সাংসারিক টানাপোড়েনে দিন কেটেছে বারীনদারদীর্ঘকাল ধরে তার স্ত্রী কল্পনা নানা রকমের অসুস্থতায় কতবার হাসপাতালে, জামশেদপুরে, দিল্লীতে মনে আছে, মৃত্যুর কিছুকাল আগে সে আমার চার-বছরের মেয়েকে দেখতে চেয়ে খবর পাঠিয়েছিল ; আমি তাকে তার জেঠীর কাছে নিয়ে গেছিলাম। অনেক পারিবারিক সুখদুঃখের গল্প আছে, ছবি আছেসেসব কি আর আজকের ফেসবুকে এই চীৎকৃত জনতার সামনে ছবিসহ পোস্ট দেওয়ার ? সেগুলো খুবই ব্যক্তিগত। তার আবেদনও স্বতন্ত্র।  

     
            
৫। আজ দেখা গেল, বারীনদার কবিত্ব কেড়ে নিয়ে তাকে প্রায় ধর্মগুরুর মতো করে পরিবেশন করে চলেছে তার কিছু ভক্তজন ফলতঃ আবেগ ও অশ্রুর সাথে অনায়াসে মিশে যাচ্ছে বিধর্মীদের 'শয়তান' আখ্যা দেওয়ার মতো মৌলবাদী গর্জন আর হিংসাও আজ যাঁরা কৌরবের কিছুই জানেন না, বারীনদার সম্বন্ধে তাঁরা লিখছেন- ‘এই মানুষটা পঞ্চাশ বছরের কৌরব পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা-সম্পাদক’! -না, বারীনদা কখনোই কৌরব পত্রিকার সম্পাদক ছিলো না। এমনকি আজ স্বদেশ সেনের কবিতার লাইনকেও (‘পায়রা পিছলে যাবে এমনি হয়েছে আকাশ’) বারীনদার লেখা বলে চালানো হচ্ছে ! আমারই তোলা একটা সাদাকালো ছবিতে বারীনদার পাশে বসা সুশ্বেতাকে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হচ্ছে ‘বারীনদার স্ত্রী’ বলেও ! এঁরা কৌরবের ইতিহাস মুখে মুখে নতুন করে তৈরী করছেন, এবং নানাভাবে অজ্ঞানতার প্রমাণ দিচ্ছেন প্রতিদিন কিন্তু এভাবে তো বারীনদাকে সম্মানিত করা হচ্ছে না। এঁরা কারা ? এঁরা সত্যিই পরিণত সাহিত্যপ্রেমিক হলে, এসময়ে আরও অনেক কিছু আন্তরিকভাবে জানার, বোঝার, পড়ার, খুঁজে দেখার কাজে নীরবে মগ্ন থাকতেন। যেভাবে শিক্ষিত সমাজে একজন সাহিত্যিকের কাজ নিয়ে অনুসন্ধিৎসু হয়ে থাকে আন্তরিক পাঠক ও গবেষক। আজকের লিটিল ম্যাগাজিনের অনেকটাই কি তবে ক্রমশঃ শিক্ষিত সমাজের বাইরে ? বারীনদার সৌভাগ্য যে, এই নগ্ন উন্মোচন তাকে দেখতে হলো না।    
    
আমি কখনো কবিদের ঈশ্বরের অবতার মনে করিনি; আমার কাছে তারাও রক্তমাংসের মানুষ, রিপুতাড়িত, ইন্দ্রিয়াশ্রিত, সত্যবাদী, মিথ্যাচারী, সরল, চতুর, কুটিল, লোভী, সুন্দর, অসুন্দর, হোমো স্যাপিয়েন স্যাপিয়েন আমার মনে পড়ছে, কবিতার ক্যাম্পে স্বদেশ সেনের উক্তি : “কেউ কবিতা লিখছে বলে কি মহাত্মা হয়ে গেছে ? শিল্পে সাহিত্যেও বিভূতির এই চল আমার খুব বাজে মনে হয় যতটুকু কাজ দেবে ততটুকুই মজুরী আইরে বাইরে আর কিছু পাওনা নেই

স্বদেশদারও সৌভাগ্য যে আজ তিনি বেঁচে নেই, এসব দেখতে পাচ্ছেন না বছর তিনেক আগে স্বদেশদার মৃত্যুর পরে আমি, রাজর্ষি আর বাবলা (অরিন্দম গুপ্ত) মিলে জীবনানন্দ সভাঘরে তাঁর স্মরণসভার আয়োজন করেছিলাম মিলিত উদ্যোগে কমলদা এসেছিল সেই সভায়, আর কিছু আন্তরিক কবি ও পাঠক আজকের মতো এইরকম স্মরণসভার মাহোল আগে কখনো হয়নি, যেখানে শুধু শত্রুদের নামে বিষোদ্গার হচ্ছে দেখে শ্রোতাদেরই কেউ কেউ বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। 
  
স্বদেশ সেনের মৃত্যুর পরে, ‘নতুন কবিতার পথ’ নিয়ে তাঁর সকল মতামতকে উপেক্ষা করে, শুধু আত্মপ্রচারের জন্য তাঁর সাথে পারিবারিক সখ্যতার কথা প্রচার করে গেছেন, তাঁর বই প্রকাশ করতে চেয়ে (সাথে বারীনদার নামকেও জড়িয়ে দিয়ে) কবির পরিবারের সাথে নানা মিথ্যাচার করেছেন, এবং তার জন্যে স্বদেশ সেনের পরিবার যাকে লিখিতভাবে ভর্ৎসনা করেছেন (সেই চিঠি আছে আমার কাছে), এমন একজন পত্রিকা-সম্পাদককেও দেখলাম জামশেদপুরে বারীনদার স্মরণসভায় আমাদের নামে বিদ্বেষ ছড়াচ্ছেন এবং সবাই মুখ বুজে তা শুনছেন! এঁরা কি সত্যিই সাহিত্যসেবী?    
                    
যেকোনও কবিকেই তার পরিবার, প্রতিবেশী, সহকর্মী, পাঠক, সম্পাদক ও বন্ধুরা একেকজন একেকরকম ভাবে দেখেন, চেনেনভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে সবটা নিয়েই তার পরিচয়। কেউই এককভাবে কোনও কবির সম্পূর্ণ অস্তিত্বের লিপিকার নন, আর স্বত্বাধিকারী তো নয়ই। সভ্য শিক্ষিত পরিশীলিত সমাজে এই সমস্তটাকেই স্বীকার করা হয়, সম্মান জানানো হয় সকল মতামতকে। আজকের লিটিল-ম্যাগ বাজারের এক বিরাট অন্ধকার অংশে, এই বোধ, সৌজন্য ও সহিষ্ণুতা দুর্লভকিন্তু এর বাইরেও রয়ে গেছেন অনেক সুস্থ, নির্ভীক, আদর্শবান ও মেধাবী কবি-সম্পাদক-পাঠক, যাঁদের পাশে আরও অনেকের এগিয়ে আসা প্রয়োজন। বইমেলার স্থান নির্বাচনের জন্য আন্দোলন গড়ে তোলার চেয়েও, এটা অনেক বেশি স্বাস্থ্যকর ও জরুরী। মনে পড়ছে, স্বদেশদার একটা কবিতার শেষ দুটো লাইন: “বলবো বলবো ক'রে বলার মতো বলি / ছোট পত্রিকাকে একদিন বড় ক'রো” -এই ‘বড়’ মানে আগ্রাসী মনোভাব আর দলবদ্ধ আয়তনে বড় নয়। এটা হোল, সৎ, নির্ভীক, সৃজনশীল ও সাহিত্যগুণে বড় হয়ে ওঠা।  

আজ আমি কবি স্বদেশ সেনকেও খুব মিস করি। ‘অতিচেতনার কথা’ নিয়ে আমার আজকের এই বিশ্লেষণ ও মূল্যায়ন করার দায়িত্ব তিনিই আমায় নিতে বলেছিলেন। বলেছিলেন, বাংলা কবিতাকে বাঁচাতে এইসব ভ্রান্ত পথকে কারো উঠে দাঁড়িয়ে রুখে দেওয়া অনেক আগেই প্রয়োজন ছিল-আমার বিশ্বাস, বারীনদাও ক্রমে ভ্রান্তিগুলো বুঝতে পেরে তার পথ পরিবর্তন করেছিল, যে কথা আমি উল্লেখ করেছি আমার ওই দীর্ঘ আলোচনায়বারীনদার সমগ্র সাহিত্যকর্মকে আমি নিজে তো কোথাও অবহেলা বা অশ্রদ্ধা করিনি, -তাই এভাবে সেটাকে প্রজেক্ট করার পেছনে, আমাকে আক্রমণের পেছনে, কার কী কী অভিসন্ধি থাকতে পারে তা এখন স্পষ্ট হয়ে উঠেছে অনেকের কাছেই।  

                    
                           
৬। আজকে আমায় যারা ব্যক্তিগত আক্রমণ করেছে তাদের জানার কথা নয় কৌরবের গত চল্লিশ বছরের কথা। তারা জানেওনা, বারীনদা আমাকে আন্তরিক কতটা ভালোবাসতো ; বিশেষতঃ আমার সমস্ত কাজ, আমার গদ্য-পদ্য-প্রবন্ধের সবটুকু। আমার সততা ও নিরপেক্ষতা নিয়ে কোনোদিন তার সন্দেহ ছিল না, সেই সুযোগ আমি দিইনিএবং কাজের বাইরে তো আর কোনও কথা নেই। স্বদেশদাও বলতেন, ‘বড় কাজ ছাড়া আমি আর কিছু বুঝি না’। -কিন্তু সেই বারীনদাও একবার সম্যক না বুঝে, না জেনে, আমাকে হতচকিত করে, বাড়িতে এসে আমার ও আমার স্ত্রীর বিরুদ্ধে এক অশালীন ও সর্বৈব মিথ্যা অভিযোগ এনেছিল ; সেটা ছিল জামশেদপুরে, তখন ১৯৮৬ সাল। এবং তার তীব্রতায় প্রায় দেড় বছর আমি কৌরব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে, শোকে, বিষাদে, বিহ্বল হয়ে দিন কাটিয়েছি। কৌরবে তখন পরপর চারটে সংখ্যায় (৪৬ থেকে ৪৯) আমার লেখা ছিলো না। -এতখানি দায়িত্বজ্ঞানহীন ছিল তার সেই আচরণ। এর পরের বছর, ১৯৮৭-সালে, কমলদা বুঝতে পেরেছিল যে ভীষণ ভুল হয়ে গেছে ; কিন্তু ততদিনে আমাদের মন ভেঙ্গে গেছিল ভুল বুঝতে পেরে বারীনদাও নাকি পরে অনুতাপ করেছিল, বলেছিল ‘আমি শংকরের জুতো বইতেও রাজি আছি’। কিন্তু সামনে এসে ক্ষমা চায়নি। ক্রমে, সময়ের সাথে সাথে, আমরাও এইসবই ভুলে গিয়েছিলাম ; কল্পনার মৃত্যুর পরে কত কতবার বারীনদাকে বাড়িতে ডিনারে নিমন্ত্রণ করেছি। অনেক গল্প হয়েছে। বরাবরই সে বলতো, আমাকে ডাকলে কমলকে ডাকবিনা। কেন এমন বলতো জানিনা, অবাক লাগতো অবশ্যই। আসলে, আমাদের সম্পূর্ণ মনোযোগটা বারীনদা একা পেতে চাইতো। কমলদা কিন্তু কখনো এমন বলেনি। আজ অব্দি, এত বছরে, কমলদাকে একবার, মাত্র একবার, বাড়িতে নিমন্ত্রণ করে খাইয়েছি ; কিন্তু কল্পনা মারা যাওয়ার পরে, বারীনদাকে ভালোবেসে, ক্ষমা করে, অজস্রবার।  
          
এর আগে-পরে আছে অনেক কথা। ভেতরে আছে অনেক গোপন ও জটিল মনস্তত্ব, যা আমি গোপনেই রেখে দেব। সেসব আলোচনা কাম্য নয়। যা পরিষ্কার করে বলা যাবে না, তা নিয়ে নীরব থাকাই ভালো। আজ এই কথাটুকুও এখানে লিখতাম না, কিন্তু জানা গেল এই নোংরা সময়ে সবচেয়ে অশ্লীল ও ঘৃণ্যভাবে যে আমার পারিবারিক কুৎসা করতে লাফিয়ে নেমেছে, সেই তরুণ সম্পাদকটি কিছু না জেনে, আমাদের কখনো না দেখেও, কিছু কল্পিত মিথ্যা কাহিনী জনে জনে ফোন করে কুৎসা করে চলেছে ; একথা আমাকে ফোন ক’রে জানিয়েছেন একটি নামী পত্রিকার সম্পাদক, যাঁর সাথে আগে আমার কখনো আলাপ ছিলো না
  
আমার বয়স এখন সাতষট্টি পেরিয়েছে, আজকের কুৎসাকারীদের অনেকে সম্ভবতঃ বয়সে আমার সন্তানের চেয়েও ছোট। এই পর্বের সমস্ত অশ্লীল পোস্টগুলো আমি সেভ করে রেখেছি। অনেকেই বলেছেন প্রশাসনিক ও আইনতঃ কঠিন ব্যবস্থা নেওয়ার কথা। এর জন্য জেল, জরিমানা, ও মানহানির জন্য গুরুতর ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা আছে আইনে। বিশেষতঃ যখন মিথ্যা অপবাদ দিয়ে চরিত্রহনন, আর স্টোনম্যান দিয়ে মেরে ফেলার হুমকিও দেওয়া আছে, শরীরী ভাষায় জবাব দেওয়ার কথা আছে। -তবু আমি হয়তো একদিন এইসব মানুষদেরও ক্ষমা করে দিতে পারি, যদি জানতে পারি তারা আন্তরিক অনুতাপ করেছে।   
  
তবে আমি আইনের দ্বারস্থ হচ্ছি জানতে পেরেই বোধহয়, সেই তীব্র অশ্লীল আক্রমণকারী এক সম্পাদক এখন সহসা ব্যাকফুটে ; আমাকে সে ক্রমাগত মেসেজ করে চলেছে। লিখেছে—‘আমি তার কাছে দেবদূতের মতো। আমার ‘মুখার্জী কুসুম’ যেন এক গ্রহান্তরের লেখা। আমি যে আনফ্রেন্ড করেছি, এই দুঃখ তাকে এখন কাঁটার মতো বিঁধছে। আমি কেন তাকে লেখা দিই না। আমার মত মেধাকে সাথে পেলে তার ‘বাক’ পত্রিকা দারুণ উপকৃত হতো। নেহাৎ গ্রাম্যতার বশে সে নাকি তার কিছু ক্ষোভ উগরে দিয়েছিল, এখন যা নাকি তার কাছে অলীক মনে হচ্ছে’ !! --মানুষের এই রকম অবিশ্বাস্য রং-বদল আমাকে বিস্মিত করেআমার ‘উত্তরমালা’ সিনেমায় ন’জন কবিকে নির্বাচন করা নিয়েও অশ্লীল মন্তব্য করেছিল সে। কিন্তু আমি জানি, আমার নির্বাচনে কোনও ভুল ছিলো না। -একসময়ে এগুলোকে ধিক্কার জানানোর ভাষা খুঁজেছি। কিন্তু এখন মনে হয়, প্রকৃতির নিয়মেই তো প্রত্যেক ঋতুতে কত অবিশ্বাস্য রং-বদল হয়। কত পতঙ্গ, উদ্ভিদ, জলচর। গভীর সমুদ্রে কত রঙের প্রাণী, যারা পরিবেশ দেখে রঙ বদলায় ! -আজ তাই এসব দেখে খুব বিচলিত হই না। 
                
মাত্র কয়েক বছর আগে, আমার একটা কবিতা (‘প্রাগৈতিহাসিক’) ও তার ইংরিজী অনুবাদ বারীনদাকে মুগ্ধ করেছিল। বারীনদা ভালোবাসতো দাদাগিরি। আমি দাদাগিরি (টিভি শো) বিশেষ দেখতাম না তখনো। বারীনদা লিখেছিল, দাদাগিরি দেখিস? এই কবিতাটা একদম ‘বাপী বাড়ি যা’ (অর্থাৎ ছক্কা) হয়েছেবিশেষত কবিতাটার ইংরিজী অনুবাদ পড়ে সে উচ্ছ্বসিত হয়েছিল। পরে কবিতাটা ছাপা হয়েছিল ‘নতুন কবিতা’ পত্রিকায়। ‘নতুন কবিতা’ আমার প্রতি অনেকবার অশোভন অশ্লীল আক্রমণ করেছে, -আমি তবুও সেখানে লেখা দিয়েছি, কয়েক বছর আগেও। সেগুলো হেলাফেলা লেখা নয়, কারণ কবিতা নিয়ে তাদের দীর্ঘদিনের আন্তরিক চর্চাকে আমি শ্রদ্ধা করতাম। ভুল বোঝাবুঝি, বিচ্ছিন্নতা, চাইতাম না। কিন্তু তাদের আক্রমণ আজও থামেনি। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ব্যতিক্রম, কবি অলোক বিশ্বাস এবং অ্যাশট্রে পত্রিকার কবিরাও, যারা আমায় আক্রমণ করেনি  
  
                          

১৯৮৬-৮৭ সালে কৌরবের সাথে ক্ষণিক বিচ্ছেদের সেই ভয়ানক দিনগুলো শেষ হলে, আমরা অনেকে একসাথে থলকোবাদ গিয়েছিলাম। বারীনদা পরে কৌরবে লিখেছিল, “শংকর যদি লেখালিখি ছেড়ে না দিত, তবে ওকেই আমরা আশির দশকের শ্রেষ্ঠ কবি বলতে পারতাম”। -ক্রমে আমি আবার ফিরে আসি লেখায়। এর দশ বছর পরে, ১৯৯৮ সালে, জামশেদপুরে এক স্মরণীয় অনুষ্ঠানে, বারীনদা আমার পরিচয় দিতে গিয়ে তার ভাষণে বলেছিল, ‘এই শংকর না হলে কৌরবে আমি বা কমল কেউই সম্পূর্ণ হতে পারতাম না ; শংকর কৌরবকে অনেকখানি এগিয়ে দিয়েছে’। সেটা ছিল কর্মজীবনে আমার ব্যস্ততম সময়, যে সময়ে কৌরবের সাথে দৈনিক যোগাযোগ ততো সম্ভব ছিলো না। কিন্তু আমার যা কিছু লেখালিখি, কবিতা-গদ্য-প্রবন্ধের যেটুকু উল্লেখযোগ্য, তার ৯০ ভাগই রচিত হয়েছিল আমার চাকরিজীবনে, টাটাস্টীলে, বিপুল কর্মব্যস্ততার মধ্যেই। 'ভালোপাহাড়'-এ আমাকে শুরুতেই ভাইস প্রেসিডেন্ট করা হয়েছিল ; আমি জানতে পেরেই সেটা নাকচ করে দিয়েছিলাম, কিন্তু বাইরে থেকে সাহায্য করেছি। কখনও ওইসব পদের প্রতি আমার মোহ ছিল না।          
                   
আরও দশ বছর পরে, ২০০৮ সালে কর্মসুত্রে জামশেদপুর ছেড়ে আমি কলকাতায় টাটাসেন্টারে চলে এলে, বারীনদা খুব আক্ষেপ করে আমায় চিঠি লিখেছিল ; বলেছিল--‘তোকে মিস করি’বছর পাঁচেক আগেও বারীনদা আমাকে লিখেছে—‘যে যাই বলুক, এই হলি তুই, একদম তোর মতো’। একবার লিখেছিল, ‘বিপদে পড়লে শংকরাকে ডাকি’। এর সম্যক অর্থ অবশ্য আমি বুঝিনি ; কিন্তু তার মনোজগতে আমার অস্তিত্ব যে একটা বড় জায়গা জুড়ে ছিল, নানা সময়ে, নানাভাবে তার আভাস পেয়েছি। যখনই তার কোনও কর্মকান্ডে বা মতবাদে আমার সমর্থন দিতে পারিনি, তখনি সে গোপনে আহত হয়েছে বুঝতে পারতাম, যার প্রকাশ নানাভাবে দেখতে হয়েছে কখনো ব্যথিত, অপমানিতও বোধ করেছি আমি, কিন্তু আপস করিনি। হয়তো এইখান থেকে বারীনদার ভেতরে তৈরী হয়েছিল দীর্ঘদিনের এক বিষাদ। ভেতরে ভেতরে সে একা মনে করতো। কি যেন হারিয়েছি, মনে হোত তার। অথচ নতুন কবিতার পথে তার সাথে তো জুটেছিল অনেক অনেক তরুণ কবি। হ্যামেলিনের বাঁশিওয়ালার মতোই প্রবল ছিল তার অনুগমন। 
      
তবে এইসব নিয়ে আমি কখনো তাকে ঈর্ষা করিনি ; বরং অনেকবারই মনে হয়েছে যে, আমাকে নিয়ে নানা কারণে বারীনদার ভেতরে প্রশংসার পাশাপাশি হয়তো একটা গোপন ঈর্ষারও জন্ম হয়েছিল। দীর্ঘকাল ধরে সারা বাংলা সে চষে বেড়িয়েছে, ভালোবেসে প্রশংসা করে গেছে কতো স্বল্প-পরিচিত তরুণদেরওঅনেক আলিঙ্গন, সেলফি, ইমেইল, -সবাই পেয়েছে তার কাছ থেকে দুহাত ভরে। কিন্তু সেই কোলাহল তার অন্তরকে ভরিয়ে তোলেনি। হয়তো এর কোনও কিছুই তাকে সিঞ্চিত করতে, শান্তি দিতে পারেনি। ভেতরের হিম নির্জনতায় সে ক্রমশঃ একা হয়ে পড়েছিল, -এমনটা মনে হয়েছে আমার। আমি তাকে দীর্ঘদিন ধরে কাছ থেকে, দূর থেকে, অনেক আহ্লাদে প্রেমে অপমানে লক্ষ্য করে গেছি। স্ত্রীকে হারানোর পরে, বারীনদার মনের গভীরে, নীরবে, একান্তে যে গোপন জায়গাটা---রূপকথার প্রাণভ্রমরের মতোই---সেখানে স্পষ্ট-অস্পষ্ট মাত্র দুতিনজনের নাম আমি পড়তে পেরেছিলাম, যাদের মন সে ‘জয়’ করতে চেয়েছিলআজ যারা আমাকে তীব্র আক্রমণ আর অশ্লীল কুৎসা করে চলেছে, এমনকি স্মরণসভাতেও আমার প্রতি বিদ্বেষ ছড়িয়ে চলেছে, তাদের কারো নামই সেখানে কখনো ছিলো না। বছর ছয়েক আগে রাজর্ষিদের কাগজে যখন আমার কবিতা-জীবন নিয়ে একটা বড় লেখা ধারাবাহিকভাবে বেরোচ্ছিল, যেটা এবার বই হয়ে বেরোবে, বারীনদা জানিয়েছিল তার প্রশংসা ; রাজর্ষিকে লিখেছিল ‘শংকরকে তোরা কখনো ছাড়িস নাওকে ধ’রে রাখিস’এর কিছু পরে একদিন বারীনদাও নিজের আত্মজীবনী লেখা শুরু করে। হারাতে হারাতে একা—যা এক অন্য মার্গের নীরব বেদনা, যে বেদনার অনেকটাই হয়তো অপ্রকাশ্য 

কৌরবে আমার প্রত্যেক লেখালিখিকে যে মানুষটা সবচেয়ে খুঁটিয়ে পড়ে এসেছে এতবছর ধরে, এবং মনে রেখেছে, সে স্বদেশ-কমল-দেবজ্যোতি-সুভাষ নয়, তার নাম বারীন ঘোষালঅরুণ আইন-কে এর মধ্যে ধরছি না, কারণ সে আমাকে পড়েনি, চিনতোও না, এবং কমলদার মতে ১৯৭২ সালের পর থেকে সে আর কৌরবে ছিলও না কখনো তাকে নিয়ে বারীনদার লেখায় আছে (কৌরব-৫১, ১৯৮৮) : “কৌরব-৬ বেরোনোর পর অরুণ কোলকাতা চলে গেল।...এরপর অরুণের লেখা আর কৌরবে দেখা যায়নি। কোলকাতায় গিয়ে দ্রুত নাগরিক উন্নাসিকতায় অভ্যস্ত হয়ে উঠল। কৌরবকে ঘিরে আমাদের আবেগ ওর কাছে হাস্যকর মনে হত। শুদ্ধ সাহিত্যচর্চার বিরুদ্ধে বিষোদ্গার আমরা এত দূরে বসেও শুনতে পেতুম। অরুণকে অবাঞ্ছিত বলে স্বীকার করার সময় আমি আর কমল যে কষ্ট পেয়েছি সেইরকম আর কখনো হয়নি।...অরুণের দেওয়া ক্ষত শুকোতে বহুবছর লাগল”। -তবুও আমার ‘রাখা হয়েছে কমলালেবু’ ছবির চিত্রনাট্যে আমি সসম্মানে অরুণদাকে রেখেছিলাম, আজকের প্রজন্মের কাছে তাকে পরিচিত করানোর জন্যে, যা আমার কর্তব্য মনে হয়েছিল। 

বারীনদার সাথে আমার ছিল দীর্ঘদিনের গভীর ও পারস্পরিক শ্রদ্ধার সম্পর্ক। কিন্তু আমি কখনোই তাকে আমার গুরু মনে করিনি। কে যেন লিখেছেন---অরুণ চক্রবর্তী---যে আমি বারীন ঘোষালের হাত ধরে কৌরবে উঠেছি ?  না, এটা অসত্য। শুরুর দিকে যারা আমায় প্রভাবিত করেছে, সঙ্গ দিয়েছে, যাদের সাথে অনেক ক্যাম্প করেছি, তারা স্বদেশ সেন ও কমল চক্রবর্তী। আমার আগামী বইয়ে এইসব প্রসঙ্গের উল্লেখ আছেঅরুণবাবু বর্ষীয়ান মানুষ, আমার সাহিত্যকর্ম নিয়ে কিছুদিন আগেও প্রশংসা করেছেন ফেসবুকে। তবুও কোনও বিষয় না জেনে না বুঝে অনেকেই তো অত্যন্ত অপমানকর মন্তব্য করার সুযোগ ছাড়েন না, দেখেছি। ওঁর প্রতি আমার ক্ষোভ আমি তাই এবারও লুকিয়ে রাখলাম, কারণ বহির্বঙ্গের সাহিত্যকর্ম নিয়ে ওঁর অজ্ঞতা ও রুচির পরিচয় উনি নিজেই দিয়েছেন আমার বয়সটাও হয়তো উনি জানেন না। এ পৃথিবীর যত কথা প্রকাশ্যে, তার চেয়েও ঢের ঢের বেশি চিরকাল গোপনে থেকে যাবে, -আমি এমনটাই জানি তবুও এত আক্রমণ, ফতোয়া, নির্দয় অশ্লীলতা ! আজ সর্বত্রই এসবের বিরুদ্ধে ধিক্কার জানানোর, প্রতিবাদ করার মতো নির্ভীক লোক খুব বেশি নেই ! 

    

কয়েকদিন আগে কমলদা ফোনে বললো : ‘তোমার লেখাটা নিয়ে এইরকম আক্রমণ হচ্ছে? এমন সব কুৎসিত কথা বলা যায়? এ তো সাঙ্ঘাতিক সাইবার ক্রাইম, শাস্তিযোগ্য, এ নিয়ে তো কেস করা যায়’ আমি বললাম, লেখাটা আমার আগামী বই থেকে তুলে নেব। কমলদা বললো : ‘তুলবে কেন ? কক্ষনো তুলবে না। ওটা অবশ্যই একদিন লোকে বুঝবে। তুমি এদের মাঝে এতদিন ধরে রয়েছ কেন? বেরিয়ে এসো। একমনে নিজের মতো কাজ করে যাও, কতো কাজই তো করেছ তুমি।... এরা কেউ কোনও বড় কাজ করলে আমি বুঝতুম ; কিন্তু শুধু বাতকম্মো করে গেছে চারদিকে। এইসব গুয়ের দিকে ঢিল ছুঁড়তেও নেই, নিজেরই গায়ে এসে ছিটকে লাগবে। বছরখানেক আগে আর্যনীল আমাকে একটা কুৎসিত চিঠি লিখেছিল। তুমি ভাবতে পারবে না। একটা অসামাজিক লোক। আমি এবার বড়ো কাগজে একটা লেখা লিখবো, সেখানে ছাপাবো ওর চিঠিটা, আমি যত্ন করে রেখে দিয়েছি এতদিন। তুমি এসব নিয়ে একদম মনখারাপ কোরো না, নিজের মতো কাজ করে যাও’ -কমলদা জানালো।  
                 
টেলিফোনে কমলদার কথায়, তাকে লেখা আর্যনীলের কুৎসিত চিঠির প্রসঙ্গে, আজ আমার মনে পড়ছে, আর্যনীল যেদিন প্রথমবার অপমান করে মেইল করেছিল কৌরবদের সিনিয়রদের। সেটা ২০১০ সাল। আমি তীব্র প্রতিবাদ করায় বলেছিল, এগুলো আমি দেবজ্যোতির উদ্দেশে লিখেছি। শুনে আমি ভীষণ বিস্মিত ও ক্ষুব্ধ হয়েছিলাম। কিন্তু এর পরেও পত্রিকার কাজে কতভাবে তাকে সাহায্য করে গেছি। কেউ তার কাজের নিন্দে করলে আমি মধ্যস্থতা করেছি, বুঝিয়েছি। কতবার সে কৌরবের সম্পাদনার দায়িত্ব আমার হাতে তুলে দিতে চেয়ে চিঠি লিখেছিল। কিন্তু দেবজ্যোতিকে আক্রমণের পরে, সম্প্রতি কৌরব-প্রধান খোদ কমল চক্রবর্তীকেই সে লিখেছে কুৎসিত চিঠি ! প্রতিবার ফোনে কমলদা আমার কাছে সেই দুঃখে ক্ষোভে হায় হায় করে। এবং সব শেষে, আজ বারীনদার মৃত্যুর পরে, ফেসবুকে আমার নামে এই কুৎসিত আক্রমণ শুরু হয়েছে তারই নেতৃত্বে !! আজ এতদিনে তার সাথে ‘প্রবীণ ও প্রকৃত’ কৌরবদের সকল সম্পর্ক তাহলে ছিন্ন হোল !  
       
আরও একটা কথা এখানে জানানো দরকার। আমরা যখন ১৯৮০-তে চাঁদিপুর ক্যাম্পের রিপোর্ট কৌরবে প্রকাশ করে কলকাতায় হইচই ফেলে দিয়েছি, সে সময়ে আর্যনীল ছিল নিতান্তই স্কুলবয়। বয়সে এতটাই ছোট। আজ তার কান্ডজ্ঞান নেই যে, কার সম্বন্ধে সে কী লিখছে, কী ভাষায়, -এটা অনেককেই তীব্র ক্ষুব্ধ ও বিস্মিত করেছে। প্রবীর রায়ের পোস্টে আমার সম্বন্ধে তার কুৎসিত সব মন্তব্যের রেকর্ড রাখা আছে অনেকের কাছেই ! এই তীব্র আক্রমণ ও মিথ্যাচারের পেছনে সম্ভবতঃ আছে তার মনের ভেতরের কিছু গভীর হতাশা। নিজের একটা থ্রিলার-চিত্রনাট্য নিয়ে অনেক স্টার, সেলিব্রিটি ও বড়ো প্রোডিউসার ধরেও এত বছরেও কোনও সিনেমা না হওয়াটা হয়তো তার মধ্যে অন্যতম। আমি তাকে বলেছিলাম, কবিতাকে আশ্রয় করে সম্পূর্ণ নিজের শ্রমে, শিক্ষায় ও মেধায় একটা পূর্ণদৈর্ঘ্যের মূল্যবান ছবি বানিয়ে দেখাতে, যা দর্শকরা ‘মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে’ দেখবে। হয়তো সেই না-পারা থেকেই তার বিদ্বেষ। হয়তো আরও অনেক কিছু হতাশা তাকে এমন করেছে, যা অনেকেই আন্দাজ করেছেন। 

ফেসবুকে শ্রীমান আর্যনীল লিখেছে, তার কাছে নাকি ২০১০ সাল থেকে আমার লেখা ছ-সাত বছরের চিঠিতে বারীনদার প্রতি ঈর্ষা ও বিদ্বেষের ঢের পরিচয় আছে, যা তার চেয়ে নাকি আর কেউ বেশি জানে না, কারণ সে আমার কবিতার বইয়ের একটা রিভিঊ লিখেছিল-তার এইমতো মেধাবী যুক্তিতে আমি বিস্মিত। তার কিশোরপুত্রকে তো আমি সুযোগ দিয়েছিলাম আমার প্রথম ছবিতে সঙ্গীত রচনায়, যে কাজ সে খুব সুন্দর করেছিল। কিন্তু আমি কি তাই নিয়ে পালটা কোনও নির্বোধ যুক্তি দেব ? 
           
শ্রীমান আর্যনীলের কথায় আজ আমি সত্যিই ধর্মসংকটে পড়ে গেছি, কীভাবে এর উত্তর দেব। আমাদের মধ্যের সব ব্যক্তিগত চিঠিগুলো আমি প্রকাশ করে দিলে, তাকেই তো অনেকটা এক্সপোজ করে দেওয়া হবে। তা কি উচিত হবে? আমি কি আমার সব কাজ ফেলে লোকসমক্ষে তার সাথে এই অশ্লীল সঙ্গতে অংশ নেব ? এভাবে জবাব দেব তার লাগাতার ধৃষ্টতার ? আমার তো কোনো চিঠি লুকোনোর নেই, কখনো ছিল না। কিন্তু বহুবার তার অনুরোধ ছিল, তার চিঠিগুলো যেন কদাপি অন্য কারও সাথে আমি শেয়ার না করি। আমি সেই গোপনীয়তার শপথকে এতদিন রক্ষা করেছিআমার সেই সৌজন্যবোধকে সে আজ আমারই বিরুদ্ধে হাতিয়ার করতে চাইছে, অবিশ্বাস্য !! এই প্রজন্মের কৌরব-সম্পাদক হিসেবে আর্যনীলের ভূমিকা বহুবার সমালোচিত হয়েছে, কিন্তু আমি অনেকবার তার পাশে দাঁড়িয়ে তাকে সমর্থনও করেছি। একবার তার আর্জেন্ট মেইল এসেছিল- ‘শংকরদা, আমায় বাঁচাও, আমার বিরুদ্ধে (নতুন কবিতার দিক থেকে) ঝড় উঠেছে’! বোধহয় সেটা ছিল বার্নস্টেইনকে দেওয়া কোনও অদ্ভুত সাক্ষাৎকার, কিম্বা অন্য কোনও বিষয়ে।                         
তবে, প্রথমে ১-৭-২০১০ তারিখে আমাকে তার রোমান হরফে লেখা চিঠি থেকে মাত্র কয়েকটা লাইনের মর্ম আমি এখানে উদ্ধৃত করতে চাই, যাতে তার স্মরণে আসেবারীনদার টেলকোর বাড়ির আড্ডা সম্বন্ধে এই চিঠিতে সে উল্লেখ করেছিল বারীনদার 'পরনিন্দা পরচর্চা' আর 'ভয়ংকরী অল্পবিদ্যা'র কথা :     
       
‘১৯৯৮-এর পরে, তোমাদের (স্বদেশ-কমল-শংকরের) অনুপস্থিতিতে, ১৫/৩ টেলকোর সেই টেবিলে কৌরবের আড্ডা ক্রমে বারীনদা-কেন্দ্রিক হয়ে যায়, এবং সেখানে কেবল পরনিন্দা পরচর্চাই হোত। সেই থেকে আমি তাই আর জামশেদপুরে যাই না। ...বাংলা সাহিত্যে অল্পবিদ্যা ভয়ংকরী। খুব অল্প পড়ে লোকে কনক্লুশানে চলে যায়। এবং এই ব্যাপারে বারীনদা এক নম্বর’    
             
শ্রীমান আর্যনীলের সাথে আমার দীর্ঘ ছয়-সাত বছরের অনেক মেইলগুলোর কপি রাখা আছে। আমি সেগুলো দিয়ে একটা ৪-৫ ফর্মার বই অনায়াসে বের করতে পারি, অথবা ধারাবাহিক প্রকাশ করতে পারি আমার নিজের ব্লগেও ; হয়তো এটা এবার প্রয়োজন। এতে যেমন অনেক সুন্দর মূল্যবান কথা আর আলোচনা আছে আমাদের মধ্যে, তেমনি আছে কৌরবের অন্দরমহলের গোপনীয় অনেক কিছু, যাকে স্বচ্ছতার প্রয়োজনে সর্বসমক্ষে নিয়ে আসা যেতেও পারেকারণ, আমার কোনো লুকোনো এজেন্ডার দরকার হয়না। সভাসমিতি, মঞ্চ, সেলিব্রিটি, প্রতিষ্ঠানের আনুকূল্য, রেজিমেন্টেশান, ‘আমার-পোস্ট-শেয়ার-কর-নয়তো-মর’, -এসবের দরকার হয় না। সাহিত্যের কাজে কৌরবে গত চল্লিশ বছর ধরে আমার একান্ত জীবনযাপন সম্পূর্ণ অন্যরকম। আমার প্রত্যেকটা কাজের মধ্যেই আমার পরিচয়। বারীনদার জনপ্রিয়তাকে ঈর্ষা করার কোনও প্রশ্নই নেই, আমি ওইরকম সভাসমিতি, রেজিমেন্টেশান ও জনসংযোগের অতিসক্রিয় জীবনযাপন থেকে বহুদূরে সন্তর্পণে চল্লিশ বছর নিজেকে সরিয়ে রেখেছি। আমি ওইসবকে ঈর্ষা করবো কেন ? -যারা অন্ধ ও কূপমণ্ডূক, কৌরবের কিছুই জানে না, শুধু তারাই এভাবে ভাবতে পারে  
  
৯। আমার আগামী বই থেকে 'বিতর্কিত' লেখাটা তুলে নিতে বারণ করেছে কমলদা। তাকে আমি পুরো লেখাটা পড়াতে চেয়েছি। এ ছাড়াও প্রবীণ ও তরুণরা অনেকেই রয়েছেন, যাঁরা আমায় এই নিয়ে লিখেছেন (এখানে কারো নামোল্লেখ করবো না) :  
     
i) “অতিচেতনার নামে শব্দ প্রতিযোগিতায় থাকছিল না জীবনের বৃহত্তর যোগ। কথাগুলো কোনও সিনিয়রের বলা জরুরি ছিল, আপনি বললেন। কবিতায় জীবন, মৃত্যু ও ঈশ্বরের থাকা বা না থাকার মত চিরায়ত জিনিষগুলির কথা ওঠার জায়গাটা সংকুচিত হয়ে গেছে এই ('অতিচেতনার কথা') বইটার জন্য। সবকিছু সামলে কবিতা লেখাই আজ কঠিন”। 

ii) “আমার স্টেটাসটা কিন্তু আপনার লেখার পরিপ্রেক্ষিতে নয় শংকরদা। ...আপনার লেখাটি আমি পড়েছি। ‘অতিচেতনার কথা’-ও পড়েছি। অতিচেতনার কথার বিষয়ে আমারও কিছু মতপার্থক্য রয়েছে, এবং তার কিছু উল্লেখ আপনি আপনার লেখাতেও করেছেন। ফলে, আপনার লেখা নিয়ে, তার তাত্ত্বিক বা নান্দনিক অবস্থান নিয়ে, আমার ব্যক্তিগতভাবে কোনো আপত্তি নেই। কৌরবের আভ্যন্তরীণ রেষারেষি বা মনোমালিন্য সম্পর্কে আমার সামান্যতম ধারণাও নেই। ফলে, আমি ‘অতিচেতনার কথা’ এবং আপনার প্রতিক্রিয়া দুটোকেই বিশুদ্ধ কাব্যালোচনার চোখে দেখেছি। আপনি ভুল বুঝবেন না”। 
     
iii) “ওদের ক্ষমতায় আঁটে না আপনাকে, আপনার কাজকে সম্মান করা, তাই অক্ষমের জায়গা থেকে কাদা ছোঁড়ে। তবে এই স্বচ্ছতার প্রয়োজন ছিলো”।   

iv) “এখন ফ্যাসিবাদী একটা চাপ রোধ করছি। আমি সাইলেন্স দিয়ে লড়ছি। আই ডোন্ট ডিসার্ভ টু বি ট্রিটেড অ্যাজ অ্যান ইমোশনাল স্লেভ”।
  
v) “কী বলব জানি না... যত দেখছি স্তব্ধ হয়ে যাচ্ছি। কেউ একবারও লেখাটায় যে যুক্তিক্রম আছে, সেটা নিয়ে কিছু বলল না। প্লিজ পুরো লেখাটা বাদ কেন দেবেন। এত জরুরি একটা লেখাইতিহাস ঠিকই বুঝবে এই কাজকে। আজ বুঝতে পারছে না। কিন্তু আগামীতে বুঝবে। বুঝবেই। নতুন কাজ, জটিল কাজ, বুঝতে সময় লাগে”। 
  
vi) “আমি জানি অপরিসীম যন্ত্রণার। আপনি তো আমার চেয়ে বয়সে অনেক বড়, আপনি কি জানেন না, ‘বাংলা সাহিত্য’ পরিসরে যারা ‘সাহিত্য করে’ তারা কি পরিমাণ মৌলবাদী, তারা নিজেদের অশিক্ষা, বোধহীনতা চাপা দিতে চায় চীৎকার দিয়ে। আপনি আপনার বোধ ও ভালোবাসা হেতুই সব করেছেন। প্লিজ কিছু আশা করবেন না। কাজ থাকবে, আমার মত কিছু বোকা খালি কাজ দেখে ভালোবাসবে, সমালোচনা করবে। আশীর্বাদ করুন যাতে চালাক না হয়ে উঠি ও ‘সাহিত্য’ না-করি। প্রণাম নেবেন”।  

vii) “এই আক্রমণগুলির আয়ু মুহূর্তের কম। কিন্তু শংকর লাহিড়ী আপ্রলয় অবধি থাকবেন, তাঁর ভাবনা, তাঁর নিজস্বতা, তাঁর সাহস, তাঁর কলম, সব নিয়ে”।   
     
এইরকম মেসেজগুলোই আমাকে শক্তি যুগিয়েছে এই ক’দিন ; অনেক ট্রমাটিক বিনিদ্র রাতে, অনেক যন্ত্রণায়। কৌরব ও প্রকাশনী আবার নতুন করে করার প্রস্তাব আমাকে দিয়েছে কমলদা। আমি এখনও সিদ্ধান্তে আসিনি। আমার বেশি চিন্তা হয়েছে রাজর্ষিকে নিয়ে, যে লেখাটি ছাপতে নিয়েছিল তার আন্তর্জাল পত্রিকায়। অনেক অভিযোগ এসেছে তার নামেও। অসহ্য শারীরিক ও মানসিক কষ্টে দিন কেটেছে তার।



১০।  আমার সম্পাদনায় স্বদেশ সেনের কবিতাসমগ্র ‘আপেল ঘুমিয়ে আছে’ শীঘ্রই প্রকাশিত হবে, প্রকাশক কবি কমল চক্রবর্তী। এছাড়া, বারীনদার স্মৃতির প্রতি একটা ব্যক্তিগত ট্রিবিউট, একটা তিরিশ মিনিটের ছবি বানানোর ইচ্ছে আছেবারীনদারই একটা কবিতার নামে ছবির নাম। -কতদিন লাগবে, কত বিনিদ্র রাত ভোর হবে, জানিনা। সমীরদা বলেছিলেন, ‘তুমি আমাকে ভাবনার জায়গাটায় বারবার পৌঁছে দিতে পেরেছ’।  
    
শিল্প-সাহিত্য-কবিতার জগতে কোথাও কোনও শেষ কথা নেই, স্থির সিদ্ধান্ত নেই যা কিছু সিদ্ধান্ত, সবই একদিন পৃথিবীর বড় গোল পেটের ভেতরে সেদ্ধ হবে। শিল্পীমাত্রেই উচিত হয় এক বৃত্ত থেকে অন্য বৃত্তে, কক্ষ থেকে কক্ষান্তরে যাতায়াত, অন্বেষণ এক এক দৃষ্টিকোণ থেকে সময়ের বাঁকে বাঁকে এক এক রকমের যুক্তি বিচার উপলব্ধি। এসব হৃদয়ঙ্গম করার জন্যে চাই সততা, মেধা ও দূরত্বের নির্জনতা। সকল কুশ্রীতা থেকে তাই বাইরে, দূরে, স্বেচ্ছানির্বাসনে, এবার আমি স্বাধীন ; আমার নিজস্ব বাসভূমিতে, নিজের মতো কাজে। আমার দরকার ছিল মাত্র পনেরোজন পাঠক, যার বেশি আমি পেয়েছিএই নির্জন নীলাভ স্ট্র্যাটোস্ফিয়ার একান্ত আমার। কোনও বায়ুদূষণ, হতাশার কালিমা এখানে স্পর্শ করবে না। এই পৃথিবী অনেক বড়, অনেক সুন্দর, অনেক রহস্য ও অজানায় ভরা, আজও। আছে তারা আমারই আবিষ্কারের অপেক্ষায়। কত ছবি আছে, সুর আছে, রঙ আছে, সুগন্ধ আছে। আছেন কত উজ্জ্বল অমলীন মানুষ। কত তাদের অজানা নতুন কাজ ! কত কাজ বাকি আছে।  আমাকে যেতে হবে সেখানেই।  

 শংকর লাহিড়ী   
২৯ নভেম্বর, ২০১৭ 

[*এর ঠিক দু’মাস পরে, ২০১৮ সালের জানুয়ারী মাসের শেষে, আমি বারীন ঘোষালের স্মৃতির প্রতি প্রস্তাবিত ছবিটা নির্মাণ করি। কৌরব নিবেদিত এটা আমার তৃতীয় ছবি। বারীন ঘোষালের একটা কবিতা-বইয়ের নামানুসারে এই ছবির নাম ‘মায়াবী সীমূম’। ছবির দৈর্ঘ্য ৬৫-মিনিট।      




কলকাতা বইমেলায় কৌরবের স্টল থেকে অনেকেই এর ডিভিডি সংগ্রহ করেছিলেন। ছবিটা দেখে কয়েকজন আমায় জানিয়েছেন তাঁদের মুগ্ধতার কথাও। -কৌরবের সাথে দীর্ঘ চল্লিশ বছর (১৯৭৭-২০১৭) যুক্ত থাকার পর, এই ছবিটাই কৌরবে আমার শেষ কাজ। -১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৮]                                  

Sunday 14 May 2017

কমলালেবুর বাগানে এক বছর

[ কবি স্বদেশ সেনের জীবন, সময় ও কৌরবের কবিতার ক্যাম্প নিয়ে নির্মিত আমার প্রথম ছবি 'রাখা হয়েছে কমলালেবু'-র প্রথম প্রদর্শনী হয়েছিল কলকাতার নন্দন-৩ প্রেক্ষাগৃহে, ২০১৫ সালের ১৩ মে। তরুণদের প্রতি উৎসর্গ করা এই ছবি দর্শকদের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা পাওয়ার পরে কেউ কেউ আমায় অনুরোধ করেছিলেন এই ছবির মেকিং, অর্থাৎ নির্মাণকাহিনী নিয়ে লিখতে। সেই বিষয়েই আমার এই লেখা-- 'কমলালেবুর বাগানে এক বছর' সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে 'কবিসম্মেলন' পত্রিকার মার্চ-২০১৭ সংখ্যায়। যাঁদের কাছে ঐ পত্রিকাটি পড়ার সুযোগ নেই, তাঁদের অনুরোধে এখানে আমার ব্লগেও রাখা হল লেখাটা। আজকের তরুণ কবিরা, যাঁরা কবিতা নিয়ে সিনেমা তৈরীর ইচ্ছা রাখেন, বা ভবিষ্যতে করবেন, তাঁদের এই লেখাটা উপকারে লাগতেও পারে। ]  

--------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
কমলালেবুর বাগানে একবছর  ঃ  শংকর লাহিড়ী
------------------------------------------------------------------------------

১  রাখা হয়েছে কমলালেবু
 

ভিক্টর য়্যুগো নাকি বলেছিলেন কথাটা, কিন্তু তারও অনেক আগে পতঞ্জলি যোগশাস্ত্রেও লেখা আছে  অনেকটা এরকমই-- ‘যখন কোনও পরিকল্পনা বা ধারণার সপক্ষে উপযুক্ত সময় এসে উপস্থিত হয়, তখন ভেঙ্গে যায় সব বাধা, কোনও শক্তিই আর তার বাস্তবায়নকে আটকে রাখতে পারে না’কবি স্বদেশ সেন ও সমকালীন কৌরবকে নিয়ে আমার প্রথম তথ্যচিত্র নির্মাণের পরিকল্পনাটাও সম্ভব হয়েছিল অনেকটা এভাবেই  

স্বদেশ সেনের ‘রাখা হয়েছে কমলালেবু’ বইয়ের কবিতাগুলো লেখা হয়েছিল প্রধানতঃ আশির দশকের  গোড়ায়, কৌরবের ‘কবিতার ক্যাম্প’-এর দিনগুলোয়। পাহাড়-জঙ্গলে, সমুদ্রসৈকতে, হাইওয়ে ধাবায়, ওঁর  সাথে অনেক অন্তরঙ্গ গল্পে কবিতায় আড্ডায় সময় কেটেছে আমার। ওঁর সাহিত্যকর্মের সবচেয়ে মূল্যবান অংশই ওই পিরিয়ডে লেখা। তখন কি আর ভেবেছিলাম, বত্রিশ বছর পেরিয়ে, ২০১৪ সালে স্বদেশ সেনের মৃত্যুর পরে, একদিন এইসব নিয়েই, -তাঁর সময়, জীবন, কবিতাভাবনা ও কৌরবের কবিতার ক্যাম্প নিয়ে, দুঘন্টার একটা তথ্যচিত্র বানাতে হবে আমায় ? না, কখনোই ভাবিনি   
  
কবিতার ক্যাম্পে স্বদেশদা ছিলেন রেকর্ডিং ব্যাপারে সর্বদাই দ্বিধায়অনেক সময় তাঁর নজর এড়িয়ে আমায় টেপ চালু করতে হোত, কখনো বিতর্কে প্ররোচিত ক’রে, কথাবার্তায় ছেদ না ফেলে, সতর্ক হয়ে এতগুলো বছর পেরিয়েও আমার সাথে থেকে গেছিল সেই সব দিনের অজস্র স্মৃতি, আমার নিজস্ব ডায়েরির নোটস, ক্যাম্পের কিছু কিছু অডিও ক্যাসেট্‌স আর সেলুলয়ডে তোলা ছবির নেগেটিভগুলো। সেসময়ে ছবি তুলতাম আমার প্রথম এসেলার ফিল্ম ক্যামেরা ক্যানন FTQL দিয়ে। আর ক্যাম্পের রেকর্ডিং ছিল সোনি বা টিডিকে-র অডিও ক্যাসেটে। সহজেই জট পাকিয়ে যাওয়া সেইসব সরু ফিনফিনে ম্যাগনেটিক ফিতে থেকে প্রয়োজনীয় অংশগুলো তিরিশ বছর পরে উদ্ধার করে ডিজিটাইজ করা সহজ ছিল না।


স্বদেশ সেনকে নিয়ে এত অজস্র তথ্য দৃশ্য ঘটনা কবিতা আর ভ্রমণের স্মৃতি জড়ো হয়েছিল মাথায়, কিভাবে কোথা দিয়ে শুরু করবো ছবিটা ভেবে উঠতে সময় লেগেছিল। মনে পড়ছে, বেথলা ক্যাম্পে যাওয়ার পথে আমরা তিনজনে- স্বদেশদা, কমলদা ও আমি।  ডালটনগঞ্জ স্টেশানে ট্রেন থেকে নেমে, শেষ রাতের অন্ধকারে, প্ল্যাটফর্ম যেখানে ঢালু হয়ে মাটিতে নেমেছে তার কাছেই এক মহানিম গাছের নির্জনে, আমরা রাকস্যাক থেকে হুইস্কির বোতল বের করে  ছিপিতে ঢেলে সরাসরি গলায় কয়েক রাউন্ড। ভোরের আধো আলোয় শিরশিরে হাওয়া আর পাতায় পাতায় খশখশ শব্দের মধ্যে গান- ‘ওগো শেফালি বনের মনের কামনা’। -তখন কে আর অর্বাচীনের মতো ক্যামেরা বার করে ? এরকম অনেক কিছুরই কোনও প্রিন্ট নেই, শুধু স্মৃতিতেই ধরা আছে তারা, এত বছর পেরিয়ে ছিন্ন বিবর্ণ পিঙ্গল। স্বদেশ সেন একবার লিখেছিলেন, ‘ছিন্ন ভিন্ন ছবিকে ছবি করে তোলাই কবিতা’। এতদিন পরে সিনেমা করতে এসে মনে হোল আমিও তো সেই পথেই চলেছি।  
       

চাঁদিপুর সমুদ্রসৈকতে দুই কবি, স্বদেশ সেন ও কমল চক্রবর্তী         

মনে পড়ে, চাঁদিপুর ক্যাম্পে টিলার ওপরে সেই এক দিকশূন্য গোলঘরে আমরা তিনজন। ভোরবেলা ঘুম ভেঙ্গে দরজার বাইরে দেখেছিলাম একটা ঘুঘুপাখি মরে পড়ে আছে। স্বদেশ সেন সেই স্মৃতিতে পরে কবিতায় লিখেছিলেন, “মরা ঘুঘুর একটা দরজা আছে”। -এমন অনেক ছিল। চাঁদিপুরে সকালবেলায় দেখা (১৬ ফেব্রুয়ারী, ১৯৮০) শতাব্দীর সেই প্রথম ও অবিস্মরণীয় পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণ (যার ছবি আমি তুলতে পারিনি, পরে হায়দ্রাবাদ থেকে মহাকাশ-বিজ্ঞানীদের তোলা ছবি ব্যবহার করেছিলাম), অথবা বেথলার জঙ্গলে রাতের অন্ধকারে যেদিন হাতির হানা। আমরা তখন জিপসিতে। মাথার ওপরে নক্ষত্রখচিত আকাশ, ভ্যান গঘের ‘স্টারি নাইট্‌স’ ছবিটার মতোরাতের আকাশ থেকে তখন তারা খসে পড়তে দেখেছি সিনেমায় সেই দ্রুতগতিতে তারা খসে পড়া দেখাতে গিয়ে কম্পিউটার সিমুলেশানের সাহায্য লেগেছিল। ব্যাঙ্গালোর অ্যাস্ট্রোনমিকাল সোসাইটির গুগল গ্রুপের মেম্বার ছিলাম আমি। আমার ল্যাপটপে ছিল একটা গোটা প্ল্যানেটোরিয়াম, সেখান থেকে পেয়েছিলাম ‘অরিওনিড মিটিওর শাওয়ার’-এর দৃশ্য। সেখান থেকেই আইডিয়া আসে। কিন্তু ছবিতে ওই শটটার জন্যে তিন সেকেন্ডের বেশি সময় বরাদ্দ করা যাবেনা জেনে আমি শাওয়ারের বদলে শুধু একটা তারাকেই খসে পড়তে দেখিয়েছিলাম।  

আরও অজস্র দৃশ্যের স্মৃতি জমা হয়েছিল, প্রকৃতই সিনেমাটিক, যা আমি বাংলা কোনও ছবিতে কখনো দেখিনি জামসেদপুরের রাতের আকাশটা যেমন মাঝে মাঝে রক্তিম ও উজ্জ্বল হয়ে উঠতো স্ল্যাগ-পাহাড় থেকে গড়িয়ে নামা তপ্ত গলিত স্ল্যাগের আলোয়। আমার তো ভিডিও ছিল না, স্টিল ছবি দিয়েই পরে এডিটিং টেবিলে নানাভাবে মুভির এফেক্ট এনেছি, কিভাবে আকাশ দৃশ্যতঃ হঠাৎই লাল হয়ে ওঠেঅথবা, স্বদেশের শ্বশুরবাড়ি বাদামপাহাড় আর নোয়ামুন্ডির লাল লোহাপাথরের খনিগুলো, ইতস্ততঃ অজস্র আতা গাছ, আর মাইল মাইল কনভেয়র। অথবা, বুড়িবালাম নদীর মোহানায় যখন রটন-মাছ বালুতে পুঁতে নুন দিয়ে নোনা করা হচ্ছে, তখন জেলে ডিঙ্গিতে সওয়ার আমরা তিনজন সেলুলয়েডে ধরা আছে এমন অনেক স্মৃতিচিত্র।    

একদিন সন্ধায়, তখন ১৯৯৪ সাল, জামসেদপুরে স্বদেশদার বাড়িতে বসে আমি একা ওঁর মুখোমুখি। সেদিন শোনা হয়েছিল ওঁর ছেলেবেলা আর যুদ্ধের দিনগুলোতে জন্মভূমি বরিশালে ফিরে যাওয়ার গল্প। ঝালোকাঠি নদীবন্দর পেরিয়ে, পোনাবালিয়ার খাল দিয়ে ঢুকে, গ্রামের নাম বারোইকরণ। মাটির বাড়িতে প্রদীপের আলোয় পিসিমা রাতে পড়ে শোনাতেন দুর্গেশনন্দিনী। -একদিন ছুটির দুপুরে খালের ওপর বাঁশের সাঁকোগুলো পেরিয়ে ছুটতে ছুটতে স্বদেশ হঠাৎ এক বিশাল নদীর মুখোমুখিশিহরিত বালক ভেবেছিল ওই বুঝি বিশাল আসল পদ্মা! সেই স্মৃতি পরে ওঁর কবিতাতেও এসেছে : "কখনও সেই পরম পারে দাঁড়িয়ে ভেবেছি / তাহ'লে আমি কি ঠায় দাঁড়িয়ে আছি / যখন 'য়ে যাচ্ছে বিশাল আসল পদ্মা?” -পদ্মানদীর ছবি আমার ছিল না। এই দৃশ্যে তাই সুন্দরবন সফরে তোলা অনেক ছবি থেকে একটাকে বেছে নিয়েছিলাম। -দুর্গাদোয়ানি নদীতে গোসাবার কাছে তখন বেলা পড়ে আসছে অস্তসূর্যের কুচিকুচি কমলা আলো ঝলসে উঠছে বিস্তৃত নদীজলে লঞ্চের রেলিং ধরে একমনে সেই শিহরিত শোভা দেখছে রাজু নামের একটি বালক, যে ছিল লঞ্চেরই স্টাফ, -আমাদের খাবার পরিবেশন করতো, যাকে আমি সিল্যুয়েটে ধরেছি এভাবেই ছবিতে এসেছে বালকের দেখা সেই বিশাল আসল পদ্মা 
                   
যুদ্ধের বিপদ শেষ হলে স্বদেশ এদেশে ফিরে কলকাতায় আড়িয়াদহের কালাচাঁদ স্কুলে পড়াশোনা করেছেন; এক আত্মীয়ের বাড়ির চিলেকোঠার ঘরে সারাদিন গাঙ্গেয় হাওয়া আর মনে মনে নৌকো ভাসানো। ক্রমে সেই স্কুলজীবনেই জড়িয়ে পড়েছেন ছাত্র আন্দোলনে, কম্যুনিস্ট পার্টির কার্ডহোল্ডার হয়েছেন। এর পরে বাবার মৃত্যু, ম্যাট্রিক পাস করে জামসেদপুরে ফিরে এসে চাকরির ইন্টারভিউ। -ওঁর মুখে শোনা এই জীবনকথা সেদিন রেকর্ড করা হয়নি। তবে প্রায় মুখস্থ করে অনেক রাতে বাড়ি ফিরে এসেই ডায়েরীতে লিখে ফেলেছিলাম, পরে যেটা  কৌরব পত্রিকার ৬৯ সংখ্যায় (১৯৯৪) প্রকাশিত হয়েছিল আজ মনে হয়, ভাগ্যিস সেদিন একলা ঘরে ওঁর সাথে আড্ডার মাঝে জেনে নিয়েছিলাম ওঁর শৈশব কৈশোর যৌবনের অনেক জরুরী তথ্য। কিন্তু তখন তো ভাবিইনি যে ওঁকে নিয়ে একদিন ছবি করবো  


২  ধরেই নিয়েছি আর অক্ষর নেবে না কিছু

স্বদেশ সেনের মৃত্যুর তিন বছর আগে, ২০১১ সাল নাগাদ আমি ‘ঢের হয়েছে কবিতা, এবার ভালো কিছু সিনেমা দেখা যাক’ ভেবে, পরিচিত এক সিনেক্লাবের সাথে যোগাযোগ করি। বছরখানেকের মধ্যেই আমার নিজস্ব লাইব্রেরীতে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ পরিচালকদের প্রায় দেড়শো ছবির সুনির্বাচিত কালেকশানবেশ কৃপণের মতো নির্বাচন করতে হয়েছিল, যেটুকু না দেখলেই নয়। আমাকে একাজে সাহায্য করেছিলেন ফিল্ম রিসার্চ সংস্থা ‘দৃশ্য’। আসলে, ছবি বানানোর সাধ থাকলেও প্রথাগত কোনও স্কুলিং আমার ছিলো না। ইচ্ছে ছিল কোনও ভাল পরিচালকের কাজকে আমি কাছ থেকে দেখবো। কিন্তু সেই সুযোগ আজ অব্দি হয়নি। এরপর দুবছর ধরে ধীরে ধীরে দেখা হয় বিশ্বখ্যাত সেইসব ছবি, পড়া হয় তার রিভিউ। তারকোভস্কি, কুরোশাওয়া, বুনুয়েল, ত্রুফো, ওয়ের্নার হারযোগ, বের্তোলুচ্চি, রোমার, ব্রেসঁ, গদার, ফেলিনি, ডি সিকা, বার্গম্যান, জানভ, জিরি মেঞ্জিল, কুব্রিক, এঞ্জেলোপুলুস, পাওলো পাসোলিনি, ঋত্বিক, সত্যজিৎ, মৃণাল এবং আরও ; সিনেমা করবো বলে নয়, ভালো লাগছিল দেখতে, তাই। অনেক বছর আগে আমি কিছু সাউন্ডস্কেপ কম্পোজিশান গদ্যে লিখেছিলাম। ‘সিম্ফনি কবিতা’ নামে সেগুলো প্রকাশিত হয় (১৯৮৯) কৌরব-৫৩ তে। অক্ষরে লিখিত কবিতা সেসময় আমাকে একটা সীমানায় এনে দাঁড় করিয়েছিলস্বদেশ সেনও কবিতায় লিখেছেন, ‘ধরেই নিয়েছি আর অক্ষর নেবে না কিছু’।   

বরিশালে পোনাবালিয়ার খালের ওপর বাঁশের সাঁকো   

স্বদেশ সেনের মৃত্যুর (৫ মার্চ ২০১৪) পরে যখন লিটিল ম্যাগাজিনের অনেকেই কে তাঁর কাছে কত প্রিয় এই নিয়ে নিজ নিজ দাবী পেশ করছেন, কার কার লেখালিখি ওঁর প্রশংসায় ধন্য হয়েছে এই নিয়ে আসর তোলপাড় করছেন, তখন, ঠিক তখনই আমি বিস্ময়ে লক্ষ্য করি, কৌরবের কবিতার ক্যাম্প নিয়েও অনেক চতুর তথ্যবিকৃতি ইতিমধ্যেই গ্রাস করেছে আজকের তরুণ লেখকদের একটা বড় অংশকে। এই সময়েই আমার মনে ছবি করার ইচ্ছা আসে। কবি স্বদেশ সেনের জীবন, সময় ও কবিতাভাবনা নিয়ে রচিত এই ছবির নাম দিই ‘রাখা হয়েছে কমলালেবু’, -ওঁরই প্রথম কবিতার বইয়ের নাম অনুসারে, যে বইয়ের প্রচ্ছদ করেছিলাম আমি।  

প্রথমেই দুটো চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয় আমাকে চিন্তা হয়, একটা পূর্ণ দৈর্ঘ্যের ছবি বানানোর খরচ নিয়ে। সেই সময়ে মৃণাল সেনের একটা ইন্টারভিউয়ে পড়েছিলাম যে পৃথিবীর অনেক ভালো ছবিই তৈরী হয়েছে সাধারণ ক্যামেরায়, নামমাত্র বাজেটে। এইটা ছিল আমার কনফিডেন্স বুস্টারসেসময় এক বন্ধুর কাছ থেকে খবর পাই, তাদের একটা মাদকবিরোধী একঘন্টার ছবি করতে খরচ হয়েছে প্রায় সাত আট লাখ টাকা। সেই হিসেবে দুঘন্টার ছবির খরচ হতে পারে অন্তত দশ বা বারো লাখ, -যা আমার সাধ্যের বাইরেঅনেক ভেবেচিন্তে আমি স্ত্রীকে জানালাম যে, আমি এক লাখের মধ্যে ছবিটা শেষ করবো। চোখে তার বিস্ময়, বললো, ‘তুমি পারবে ? কখনো তো করোনি, দেখ যা ভাল বোঝ’। -অর্থাৎ সম্মতি। কিন্তু কিভাবে ওই বাজেটে ছবি হবে, খরচের বহর কেমন, রেকর্ডিং ও এডিটিং স্টুডিয়োগুলোই বা কত নেবে, কোথায় তারা, কিছুই জানতাম না। মনে রয়ে গেল সেই সপ্রশ্ন চাহনি, “তুমি পারবে ?” 

এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে আমার মনে হল সত্যজিৎ রায়ের বিখ্যাত তথ্যচিত্রগুলো দেখা দরকার। পরপর কয়েকদিনে দেখা হোল ওঁর ‘সিকিম’, ‘সুকুমার রায়’, ‘বালা  সরস্বতী’ এবং দৃষ্টিহীন চিত্রকর বিনোদবিহারীকে নিয়ে করা ‘ইনার আই’  ছবিটাবিশেষতঃ শেষ দুটো ছবি।  বারবার দেখে দেখে, কি জানি, অশিক্ষিত হওয়ার এটাই হয়তো আমার সুবিধে, মনে হ’ল এই যদি সেসময়ে সত্যজিতের কাজ হয় তবে এখন, এই নেট্‌ওয়ার্কড্‌ পৃথিবীতে, এর চেয়েও ভালো তথ্যচিত্র আমি অবশ্যই বানাতে পারবো। এই কনফিডেন্সে ভর করে, স্বদেশ সেনের মৃত্যুর আড়াই মাস পরে, ১৮ মে ২০১৪, ফেসবুকে আমি প্রথম ঘোষণা করে দিই ছবির। 

“শুরু করলাম এই কাজ। স্বদেশ সেনের ওপর তথ্যচিত্র । তাঁর কবিতা ও ভাবনা নিয়ে । বরিশালের নদীতীরের গ্রাম, সিংভূমের পত্রমোচী বন, আর কৌরবের কবিতার ক্যাম্পের সেই অপার দিনগুলো জুড়ে যেভাবে তিনি কবিতায় ক্রমে প্রকাশিত হয়েছিলেন।”

উদ্দেশ্য, নিজের ওপর চাপ সৃষ্টি করা, যাতে পিছিয়ে যেতে না পারি। তখন অনেক অভিনন্দন আসতে থাকে। শুভেচ্ছাসহ অনেকেই লিখে জানান যে অত্যন্ত জরুরী ও সময়োচিত কাজ হবে এই ছবি      
     
এর পরেই আমাকে ডুব দিতে হয় এতবছরের সঞ্চিত নিজস্ব আর্কাইভে। ব্যক্তিগত সেই লাইব্রেরীতে তখন হাজারখানেক স্টিলছবির প্রিন্ট, তাদের নেগেটিভের ওয়ালেটগুলো, কালার স্লাইড, কন্টাক্ট প্রিন্ট, হ্যান্ডিক্যামের ভিডিও, একরাশ অডিও ক্যাসেট। এসবের মধ্যে কৌরবের ক্যাম্পের ছবি ছাড়াও ছিল ব্যক্তিগত ভ্রমণ বা টাটাস্টীলে কর্মজীবনে বিদেশে তোলা ছবিও। এই সব থেকে বেছে বেছে যেগুলো ব্যবহার করতে চাইবো তার একটা ক্যাটালগ তৈরী করলাম ল্যাপটপে। আর সেখান থেকেই ধীরে ধীরে একটা আভাস দেখা দিল চিত্রনাট্যের কাঠামোর। এই ব্যাপারটা ছিল খুব মজার। প্রিয় জিনিষ যা কিছু পাচ্ছি, সেটাকেই কীভাবে ছবিতে ব্যবহার করা যায় সেইসব ফন্দি। কয়েকমাস পরে, কমলালেবু-র চিত্রনাট্য নির্মাণ যখন শেষ পর্যায়ে, তখন কৌরবের একটা বিশেষ সংখ্যায় (১১৫) প্রকাশিত একটি লেখা একদিন আমার নজরে পড়ে। সেটা ছিল একজন অ্যামেরিকান মহিলা ফিল্মমেকার ‘আবিগেইল চাইল্ড’-এর সাক্ষাৎকার, -নিয়েছিলেন কবি ‘চার্লস বার্নস্টেইন’। আবিগেইল ‘ইয়েল স্কুল অফ আর্ট’-এর স্নাতক, নিজেও কবি, তিরিশেরও বেশি ফিল্মের নির্মাতা এবং চলচ্চিত্র বিষয়ে পড়াশোনা করেছেন ‘গুগেনহেইম স্কলারশিপ’ নিয়েলেখাটা আমায় খুব কনফিডেন্স দিয়েছিল, কারণ আমি তো ঠিক ওভাবেই ছবি বানানোর কথা ভেবেছিলাম ; নিজের সংগ্রহে যা কিছু ব্যক্তিগত দৃশ্য ও শ্রাব্য জমা হয়ে উঠেছে দীর্ঘকাল ধরে, সেগুলো নানাভাবে ব্যবহার করেই ছবি বানানোর পরিকল্পনা শুরু করা, -যেমনটা আবিগেইল ওই সাক্ষাৎকারে বলেছেন
       
কিন্তু চিত্রনাট্য কিভাবে লিখতে হয় আমি জানিনা। সত্যজিৎ রায় তাঁর ছবির চিত্রনাট্যের খাতায় কিছু কিছু স্কেচও আঁকতেন, কিন্তু সেগুলো তো কাহিনীচিত্র। আর আমার ছবির অন্ততঃ আশিভাগই স্থিরচিত্রএবং  ‘লক্ষ্মণের শক্তিশেল’-এর মতো কোনও অভিনীত অংশও রাখা হবে না, যেমনটা সুকুমার রায়ের ওপর তথ্যচিত্রে সত্যজিৎ রেখেছিলেন আর স্বদেশ সেন প্রয়াত, তাই তাঁকে নিয়ে নতুন করে কিছু শ্যুট করারও সুযোগ নেই। -এটা আমায় চিন্তায় ফেলেছিল।       
   
সেসময় ইন্টারনেট ঘেঁটে কিছু সফ্‌টওয়ার অ্যাপ্লিকেশান আমি পেয়েছিলাম যা ছবির চিত্রনাট্য, শ্যুটিং প্ল্যান ইত্যাদিতে ব্যবহার হয়। কিন্তু অচিরেই সেগুলোকে গার্বেজ মনে ক’রে আমি সরাসরি ল্যাপটপে, এক্সেল-শীটে নিজস্ব ফর্ম্যাট ডিজাইন করে, পুরো চিত্রনাট্য লিখতে শুরু করি (আর কেউ এভাবে করেছেন কিনা জানি না।) পাশাপাশি, ফ্রেম-বাই-ফ্রেম, লেখা হোল শট নং, ছবি, শব্দ, মুভি, টেক্সট ইন্সার্ট, আবহসঙ্গীত, ধারাভাষ্য ইত্যাদি, এবং কোন ফ্রেম কত সেকেন্ডের, সেইসব। ছবিকে পার্ট বাই পার্ট ভাগ করে আলাদা আলাদা শীটে কাজ শুরু হোল। এতে ছবির মোট দৈর্ঘ্যের ওপরেও সর্বদা চোখ রাখা গেল। লিখতে বসে পরবর্তী চ্যালেঞ্জ ছিল ছবিটার সম্পূর্ণ আর্কিটেকচার। কিভাবে সেই কালখন্ডের তথ্যফ্রেমের মধ্যে থেকে বাজিয়ে তোলা হবে তাঁর সময় ও কবিতার সামগ্রিক আর্তিটুকু।    

সরাসরি ল্যাপটপে এক্সেল-শীটে লেখা হয়েছিল পুরো চিত্রনাট্য  


৩  নতুন গভীর জটিলতার জন্য   

আমি চেয়েছিলাম এটা কোনও প্রথাগত তথ্যচিত্র হবে না। কলকাতার কফিহাউস ও খালাসিটোলার বিপরীতে সিংভূমের পাহাড়-নদী-জঙ্গল, আদিবাসী গ্রাম, আর ইস্পাত-কারখানাকে ঘিরে যে জীবনসংস্কৃতি, যা কৌরবের সাহিত্যচর্চাকে ভিন্নতা দিয়েছে এবং যোগ করেছে অনেক নতুন শব্দ-বর্ণ-ঘ্রাণ, তাই হবে ছবির আধার কৌরবের সূচনাপর্ব থেকে ক্রমে তার এগিয়ে চলা এবং পাশাপাশি কবি স্বদেশ সেন যেভাবে জন্মভূমি বরিশালের রূপসী ক্যানভাস থেকে উঠে এসে এদেশে সিংভূমের লাল মাটিতে অনেক টানা-পোড়েনের মধ্য দিয়ে এগিয়ে গিয়েছেন। -আমার নিজের কৈশোরের প্রিয় স্মৃতিতেও আছে বাংলার গাঙ্গেয় জনপদ, কালচে এঁটেল মাটি, মাইল মাইল নারকেল-সুপুরী-খেজুর-তালগাছ, আম-জাম-জামরুল-ফলসা-পেয়ারার বাগান, শরবন হোগলাবন, পানের বরজ, খাল-বিল-দীঘি, ডাহুক-জলপিপি-দাঁড়কাক, মাছরাঙা-ফিঙে, ঢাকের বাদ্যি, কীর্তন আর তরজা গান নিয়ে যে সম্পূর্ণ আবহকিন্তু তার চেয়েও গভীরে, মনের আলোছায়াময় স্তর জুড়ে ছড়িয়ে আছে সিংভূমের লালমাটি আর পত্রমোচী বন, জঙ্গল-পাহাড়, কালো পাথরের স্তুপ, চিত্রিত দেওয়াল, পাহাড়ী টিলা, ডুংরি, ঝর্ণা, শাল-সেগুন-শিরীষ-সজনে, নিম-কুসুম-আমলকি-পলাশ, সরষেক্ষেত, ভুট্টাক্ষেত, বনমোরগ, জংলি টিয়া-ময়না, মদ-মহুয়া-মাদল, ডুবাং নাচ, টুসু-গান, দেবতা মারাংবুরু 
           
কিভাবে মননে এই দুই উৎসস্রোত সঙ্গমস্থলে মিশে ক্রমে বিবর্তিত হয়, রচিত হয় কবিতা, কাব্য ভাবনা, নতুন অ্যাবস্ট্রাকশান, -তাই হবে ছবিটার চালিকাশক্তি পাশাপাশি আলোয় দেখা স্বদেশ সেনের ব্যক্তিজীবন ও কৌরব পত্রিকার উজ্জীবনকোথা থেকে এসেছে ওঁর কবিতা ? কীভাবে নির্মিত হয়েছে তার আশ্চর্য স্বতন্ত্র শব্দ-শরীর? জন্মভূমি বরিশালের খাল-বিল-নদী, নাকি কর্মভূমি সিংভূমের পত্রমোচী বন? ভারতবর্ষীয় প্রবচন, না ইউরোপীয় অ্যাবস্ট্রাকশান? 

দলমা পাহাড়ের পথে, জঙ্গলের গভীরে   

এই ছবির আর্কিটেকচার তাই যেন একটা ডাব্‌ল হেলিক্স, যা সময়সরণী ধরে এগিয়ে যাবে এবং যার পাকে পাকে যুক্ত হবে সুন্দর ও রহস্যময় নানা কুঁড়ি-ফুল-পাতা ও কবিতার নিজস্ব অভ্রান্ত ঘ্রাণ। তথ্যচিত্রের প্রচলিত সীমানাকে ভেঙ্গে, শিল্পসাধনার বহুমাত্রিকতায়, নিজেই যেন একটা নতুন ও সম্পূর্ণ সৃষ্টি হয়ে উঠতে পারে ছবিটা, এমনটাই চেয়েছিলামএটা হবে একটা নতুন জঁর‍্যা, যাকে আমি বলেছি ‘তন্ত্রচিত্র’।   
        
স্বদেশ সেন একটা গদ্যে লিখেছেন, "প্রাকৃতিকতা আমাদের দৃশ্যসুখ শব্দসুখের মধ্য দিয়ে আর কিছুই দেয় না, শুধু একটা অনুরণন দিয়ে যায় এই অনুরণনই সমস্ত শিল্পের জন্মদুধকবিতার ক্যাম্পও এক নতুন অনুরণন জাগিয়ে তুলেছিল আমাদের চেতনায়, ভাবনায়, লিখনভঙ্গিমায়। ছবির একটা বড় অংশ জুড়ে তাই রয়েছে কবিতার ক্যাম্পের অডিও ভিশ্যুয়ালস চাঁদিপুর, মুকুটমণিপুর, শিমলিপাল, চান্ডিল, বেথলা, বরাইবুরুর সেই অপার ক্যাম্পগুলো যা সমকালীন সাহিত্যচর্চায় আলোড়ন তুলেছিল।
    
২০১৪-র জুন মাসে চিত্রনাট্য লেখা শুরু করার পরে আমি একদিন স্বদেশদার মেয়ে নবীনাকে ফোন করে  জানতে পারি, স্বদেশদার স্ত্রী সবে এসেছেন কলকাতায় তাদের বাড়িতে, এবং কয়েকদিন পরেই উড়ে   যাবেন আমেরিকার টেক্সাসে বড় ছেলের কাছে, ফিরবেন ছমাস পরে খ্রীস্টমাসের সময়। শুনে আমি সব  কাজ থামিয়ে দৌড়ে গিয়ে দেখা করি। সঙ্গে ক্যামেরা, রেকর্ডার ইত্যাদি। ওই বাড়িতে বেশ কিছু ছবি তোলা  হয়, আর শ্যুট করা হয় ওঁদের সাথে সাক্ষাৎকার। ওঁরা ছবির জন্যে কিছু অর্থ সাহায্যও দিতে চেয়েছিলেন,  কিন্তু আমি রাজি হইনি। আসলে আমি সম্পূর্ণ নিজের খরচে নিজের মতো করে ছবিটা করতে চেয়েছিলাম। ওঁরা সেদিন আমার হাতে তুলে দেন পারিবারিক অ্যালবাম থেকে কিছু ছবি আর স্বদেশদার কিছু চিঠি, অনেকগুলো ডায়েরী, কবিতার খাতা ইত্যাদি(ছবির কাজ শেষ হলে তার প্রত্যেকটি আমি লিস্ট মিলিয়ে ফেরত দিয়েছিলাম) এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছিল ওঁদের বিবাহিত জীবনের একদম শুরুতে, ওঁর স্ত্রী বুলা যখন কিছুদিনের জন্য বাপের বাড়ি নোয়ামুন্ডিতে গিয়েছিলেন, সেই বিরহকালে তাঁকে লেখা কবির একটি অতি ব্যক্তিগত প্রেমপত্রস্বদেশ সেনের অন্তর্লোকে অনেকটা আলো-ফেলা এই মূল্যবান চিঠিটার কিছু অংশ আমি সিনেমায় ব্যবহার করেছি। ধারাভাষ্যে পাঠ করে শুনিয়েছি চিঠিটা, আর সঙ্গে রাখতে হয়েছে প্রয়োজনীয় ভিশ্যুয়াল্‌স। এই চিঠিরই এক জায়গায় ব্যবহার করেছি আমার খুব প্রিয় ‘ওফেলিয়া’ (১৮৫২) ছবিটি। হ্যামলেটে বর্ণিত ওফেলিয়ার এই মৃত্যু দৃশ্যটিকে নাকি বলা হয় সাহিত্যের সবচেয়ে কাব্যিক মৃত্যুদৃশ্য, যা ক্যানভাসে তেলরঙে এঁকেছেন ব্রিটিশ চিত্রকর স্যার জন মিল্যে (John Millais)
   
এই সময়ে প্রাথমিক ও জরুরী দুটো কাজের একটা ছিল কবিতার ক্যাম্পের দীর্ঘদিনের পুরোনো অডিও টেপগুলোকে উদ্ধার করা। যাদবপুরের ‘স্টুডিও ইনফ্রেম’, যেখানে আমার ভয়েস-ওভার রেকর্ডিং করা হয়েছিল, তারাই করে দিয়েছিল পুরোনো ক্যাসেট থেকে উদ্ধারের কাজটা, যতটুকু সম্ভব তবে অনেক কিছুই আর ব্যবহারযোগ্য ছিল না। আরও একটা অসুবিধে হোল, আশির দশকে কৌরবের কবিতার ক্যাম্পগুলোয় যখন আমি রেকর্ডিং চালু করে দিতাম, তখন কিছু কথা যন্ত্রে পরিস্কার ধরেনি। বিশেষতঃ কমলদার তরুণ বয়সের তড়বড়ে বাচনভঙ্গির জন্যে। এই সমস্যার সমাধান করতে ছবির অনেক জায়গায় বাংলায় কথাবলার সাথে তার অনুলিখনকেও সাবটাইটেলে দেওয়া জরুরী হয়েছিল।        
      
দ্বিতীয় কাজটা ছিল স্বদেশ সেনের কবিতাসমগ্র বইটার সমস্ত কবিতা পড়ে ফেলা কোন কোন কবিতা, কখন কোথায় কিভাবে ব্যবহার করবো, তার একটা সম্পূর্ণ পরিকল্পনা। আমি এগারোটা কবিতা বেছে নিয়েছিলাম। ওঁর রোগশয্যা পর্ব শুরু হওয়ার মাত্র কয়েকমাস আগে, হঠাৎ কি মনে করে, আমি কলকাতা থেকে অফিসের কাজে জামসেদপুরে গিয়ে, এক গ্রীষ্মের ঘর্মাক্ত সন্ধ্যেবেলা ওঁর স্বকন্ঠে কবিতাপাঠ রেকর্ড করে এনেছিলাম। কন্ঠস্বর পরিস্কার নয়, তবু সেটাই কাজে লেগে গেছে।  আজ মনে হয়, ভাগ্যিস ওটা করা হয়েছিল। আসলে আশির দশকে কৌরবের সেই স্বর্ণযুগে, যার মধ্যে ছিল কৌরবের কবিতার ক্যাম্প এবং স্বদেশ সেনের মতো মহৎ কবির সাহচর্য, -আমার সবসময় মনে হোত এই সময়কাল জুড়ে তার সকল কর্মকান্ড ও তথ্যকে যতটা পারি প্রামাণ্য ও সংরক্ষিত করে রাখি, শব্দে-বর্ণে-চিত্রকলায়, রেকর্ডে, সেলুলয়েডে, আগামী কালের কোনও এক সময়ের প্রয়োজনে, কোনও এক আন্তরিক পাঠকের বা কোনও গবেষকের জন্যেও।             


৪  ফাইনাল কাট্‌ প্রো   
  
আলিপুরের স্টুডিও ‘ইমেজক্র্যাফট’-এ ছবির এডিটিং হয়েছিল ‘ফাইনাল কাট্‌ প্রো’ সফটওয়ারে, যাতে হলিউড বলিউডের বড় ছবিগুলোও করা হয়। একটা থাম্ব-রুল আছে যে, একঘন্টার সাধারণ ছবির জন্যে দেড়শো ঘন্টা লাগে এডিটিং টেবিলে। অর্থাৎ সোয়া দুঘন্টার ছবির লাগতে পারে প্রায় সাড়ে তিনশো ঘন্টা। সেই জায়গায় আমার পুরো ছবিটার জন্য স্টুডিও ভাড়া লেগেছিল মাত্র একশো বারো ঘন্টা। এর কারণ আমার বিশেষভাবে লেখা চিত্রনাট্য। এখানেই খরচ অনেকটা কমে গিয়েছিল। সমস্ত কম্পিউটার গ্রাফিক্স, ভিশ্যুয়াল আর্ট, এবং পরে ছবি-প্রদর্শনীর জন্য যাবতীয় পোস্টার, বিলবোর্ড ডিসপ্লে এবং ডিভিডি অ্যালবামের কভার, -সবই নিজে কম্পিউটারে ডিজাইন করেছিলাম
       
দৃশ্য-পরিকল্পনা করতে গিয়ে দেখা গেল, আরও অনেক ভিশ্যুয়ালস, স্টিল ছবির প্রয়োজন। নিজের ট্রাভেল অ্যালবাম থেকে তখন খুঁজে খুঁজে অনেক ছবি আর মুভিক্লিপ আমি বেছে নিয়েছিগোয়ালন্দে স্টীমারের ছবিটা আসলে সুন্দরবনের সজনেখালিতে রাতে লঞ্চ থেকে আমারই তোলা; সার্চলাইটের আলো কাঁপছে জলে। -এছাড়াও বেথলার জঙ্গলে রাতে হাতীর দাপাদাপি শুনে আমরা যখন জীপ নিয়ে বনপথে ঢুকেছিলাম, তখন সেই বিপুল হৈচৈয়ে আমার টেপ রেকর্ডার চালু থাকলেও চলন্ত জীপ থেকে অন্ধকারে ছবি তোলা যায়নি কিছুইসেই এপিসোডে তাই দিনের বেলায় তোলা জঙ্গলপথের ছবিকেই এডিট করে রাতের দৃশ্য তৈরী করা হয়েছিল। ভরদুপুরে তোলা ছবিকেও আমি এডিট করে জ্যোৎস্নারাতের এফেক্ট এনেছিলাম।    

এরকমই মজার ব্যাপার ছিল আরও অনেক জায়গায়। ক্যাম্পে একবার কথা হচ্ছিল বাংলা কবিতায় ইউরোপীয় কাব্য আন্দোলনের প্রভাব নিয়ে। ছিল ‘ওয়েস্টল্যান্ড’ কবিতার ‘লন্ডন ব্রীজ ইজ ফলিং ডাউন’ লাইনটাও। ঐখানে আমি লন্ডন ব্রীজের যে ছবিটা ব্যবহার করেছি সেটাও আমার ট্রাভেল অ্যালবামের।  

আমার প্রথম দেখা অনেক রাতের নির্জন লন্ডন ব্রীজ    

টাটাস্টীল যখন ইউরোপের ‘কোরাস’-কে অধিগ্রহণ করে, তার কিছু পরে কোরাসের সাথে একটা জরুরী রুদ্ধদ্বার মিটিংয়ে আমাকে লন্ডন যেতে হয়। মনে আছে, হিথরো এয়ারপোর্টের পাশেই একটা হোটেলে আস্তানা ছিল আমাদের। তিনদিন টানা মিটিংয়ের পরে ওখান থেকে বেরিয়ে, লন্ডন শহর না দেখেই দেশে ফেরার প্লেন ধরতে হবে ভেবে, আমার খুব মনখারাপ হয়েছিল। তাই  অনেক রাতে বন্ধুর গাড়িতে চেপে শহরের এক ঝলক দেখতে বেরিয়েছিলামবাকিংহ্যাম প্যালেসের পাশ দিয়ে টেম্‌্‌ নদীর ওপর দিয়ে বিখ্যাত টাওয়ার  ব্রীজ পার হওয়া ! অত রাতের নির্জন লন্ডন ব্রীজের সেই ভয়ার্ত ছবিটাই আমি রেখেছি সিনেমার ওই পর্বে         

কবিতার ক্যাম্পে যেসব যুক্তিতর্কের ছবি তোলা ছিল তাতে ক্যামেরার পেছনে আমি, আর বেশিটাই ছিল টেবিলে রাখা পানীয়ের গ্লাসের ছবি এবং প্লেটে কখনো ভাজা মাংস, সাথে গ্রিন স্যালাড। দীর্ঘ আলোচনার মধ্যে খাবারের প্লেট ক্রমশঃ খালি হয়ে উঠছে দেখানোর জন্যে আমাকে ওইসব স্টিলছবি থেকে ধীরে ধীরে কিছু মাংস ও স্যালাডকে স্রেফ ইরেজ করে দেখাতে হয়েছিল। এরকম ইরেজ করতে হয়েছিল চাঁদিপুর ক্যাম্পের একটা জায়গাতেও, যেখানে ভোরবেলা গোলঘরের দরজা খুলে বেরিয়ে এসে স্বদেশ সেন পায়ের কাছে একটা ঘুঘুপাখি ঘাড় গুঁজে মরে পড়ে আছে দেখেছিলেন। সেই দৃশ্যের কোনও ছবি তোলা ছিল না। এর অনেক বছর পরে, জামসেদপুরে, আমারই বাংলোর বাগানের ঘাসে মাঝেমাঝেই দুপুরের দিকে কয়েকটা ঘুঘু এসে বসতো। সেই ঘুঘুর ছবি থেকে পাখির মাথাটুকু জাস্ট ইরেজ করে মুছে দিয়ে চাঁদিপুর এপিসোডে মরা ঘুঘুর দৃশ্যে ব্যবহার করেছি। এগুলো না বলে দিলে ধরা যাবে না। 
                
তবে সবচেয়ে সমস্যায় পড়েছিলাম আমি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দিনগুলোতে বালক স্বদেশের সেই বরিশালের পর্বটা নিয়ে, যখন তিনি বাবা-মায়ের সাথে কিছুদিনের জন্যে ফিরে গিয়েছেন জন্মভূমি বারোইকরণ গ্রামে, যার গল্প শুনিয়েছিলেন আমায়। কিন্তু ঐ সময়ের কোনও ছবি ওঁদের পারিবারিক অ্যালবামে খুঁজে পাইনি -সেই পোনাবালিয়ার খালে কত নৌকো, জোয়ারে ঢেউ উঠতো বড় বড়। আর সরু সুতিখালগুলোয় একটার পর একটা সবুজ বাঁশের সাঁকো, সেই তালপুকুরের পাশে এক পরিত্যক্ত বুড়ির বাড়ি, এত অন্ধকার যে দিনের বেলাতেও ঝিঁঝিঁ ডাকতো। -আমি যদি তখন ভিসা পাসপোর্ট নিয়ে বাংলাদেশের গভীরে ছবি তুলতে যেতাম তবে ছবির খরচ বাজেট পেরিয়ে যেত, আর সময়ও লাগতো অনেক। সেই সময়ে অনুজ কবিবন্ধু রাজর্ষি চট্টোপাধ্যায় তার ব্যক্তিগত যোগাযোগে ওপার বাংলার এক বন্ধুকে দিয়ে এক ডজন স্টিলছবি আনিয়ে দেয়। বাংলাদেশ টিভির একটা টিম নাকি বরিশালের ওই অঞ্চলে তখন কাজ করছিল। আমাকে ফেসবুকে জানাতে হয়েছিল কোন কোন বস্তু বা কী ধরণের দৃশ্য আমার প্রয়োজনপরে আমাকে শুধু যোগ করতে হয়েছে জলের শব্দ, হাওয়ার শব্দ, ঝিঁঝিঁর ডাক। একটা গল্প ছিল, স্বদেশের বাল্যসাথী কমলাদির সাথে জঙ্গলে বনেবাদাড়ে ঘুরে বেড়ানোর কাহিনী, যে কমলাদি হঠাৎ একদিন রাত পোহালে কলেরায় মারা গিয়েছিল। এইসব দৃশ্য ও আবহ রচনা করতে গিয়ে কলকাতায় নরেন্দ্রপুরে আমার বাড়ির কাছেই ‘চিন্তামণি কর পাখিরালয়’-এ (কয়ালের বাগান) কিছু ভিডিও শ্যুট করেছিলাম; এভাবেই এসেছে বনবাদাড়ে কমলাদির সাথে হঠাৎ দেখা লাল জবা ফুল আর কাঠঠোকরা পাখিটা।  
                  
আরও ছিল। বরিশালের গ্রামের বাড়িতে সেই বালবিধবা পিসিমা, বালক স্বদেশ যাঁর কাছে রাতে রামায়ণ, মহাভারত আর দুর্গেশনন্দিনীর গল্প শুনতো। ছবিতে আমি যে দুর্গেশনন্দিনী বইটাকেই বেছে নিয়েছিলাম তারও একটা কারণ ছিল। বছর কয়েক আগে ডুয়ার্সে ঘুরতে ঘুরতে একদিন ময়নাগুড়িতে এসে গাড়ির ড্রাইভার বললো, চলুন আপনাদের জল্পেশ্বর শিবমন্দির দেখিয়ে আনি। তো সেই প্রাচীন নিরালা মন্দিরে পুরোহিতের উদাত্ত সুললিত কন্ঠে মন্ত্রোচ্চারণ উঁচু গম্বুজের ভিতরে ইকো ও রিভার্বের মিশ্রণে গমগম করে উঠেছিল, আমি সেটা রেকর্ড করে রেখেছিলাম ভবিষ্যতে কখনো কাজে লাগতেও পারে ভেবে। চিত্রনাট্য  লিখতে গিয়ে আমার মনে হোল, পিসিমার মুখে গল্প শোনার মধ্যেই ঢোকাতে হবে ওই মন্ত্রপাঠকিন্তু কীভাবে? 

আমি তখন বুকসেলফ থেকে দুর্গেশনন্দিনী নামিয়ে এনে খুঁজছি কোন প্রসঙ্গে আসতে পারে শিবস্তোত্রবইটার শেষ পাতা থেকে মন্দিরের সন্ধানে দ্রুত চোখ বুলিয়ে চলেছি ক্রমে সামনের দিকে। মাঝপথে প্রায় হাল ছেড়ে দিয়ে, বইয়ের শুরুতে। এবং রোমাঞ্চিত, শুরুতেই তো পেয়ে গেলাম গড় মান্দারণের পথে জঙ্গলের গভীরে শৈলেশ্বর শিবমন্দির, যেখানে প্রবল ঝড়বৃষ্টির সন্ধ্যায় পূজো দিতে এসে আটকে পড়েছে এক সুন্দরী কামিনী তার সহচরী  সহসা আগুয়ান দীর্ঘকায় এক অশ্বারোহী। - ওঃ, দারুণ, দুর্দান্ত ড্রামাটিক হতে পারে এর চিত্রায়ন! কিন্তু আমার হাতে তো শুধুই স্টিলছবি! হ্যাঁ, তাই  দিয়েও করা যায় অনেক কিছু, সেটাই একটা চ্যালেঞ্জ।     
              
কিছু কিছু ছবি আমি ব্যবহার করেছি যার ঐতিহাসিক মূল্য রয়েছে । যেমন, সেকালে জামসেদপুরে রাতের আকাশ ইস্পাত কারখানার গলিত স্ল্যাগের আলোয় আলোকিত হয়ে উঠতোএখন টেকনোলজি উন্নত হয়েছে, পৃথিবীতে আর কোথাও ইস্পাত কারখানায় আকাশ আলো-করা ‘বেসিমার কনভার্টার’ নেই, আর গলিত স্ল্যাগও সামান্যই ঢেলে ফেলা হয়। -সেরকমই আছে ঘাটশিলায় সুবর্ণরেখা নদীর খাঁড়িতে জেলেপাড়ার মেয়ে-বৌদের কাদাজল চেলে চেলে সোনা বের করে আনার ছবি। আছে কলকাতার সূর্য্য সেন স্ট্রীটে কৃষ্ণগোপাল মল্লিকদের ঐতিহাসিক বাড়িটা, আর জামসেদপুরের সাকচিতে ডাক্তার বিষ্ণু প্রসাদ ও পূরবী মুখোপাধ্যায়দের ঐতিহ্যময় দোতলা বাড়িও, যেখানে কলকাতা থেকে আসা অজস্র গুণীজন, সঙ্গীতের মহা মহা উস্তাদ, বিখ্যাত সব গায়ক, নাট্যকার, এবং প্রথম সারির কবি, সাহিত্যিক ও সম্পাদকের আড্ডার নানা কাহিনী আছে। এছাড়াও ছবিতে দেখা গেছে অলচিকি লিপির জনক পন্ডিত রঘুনাথ মুর্মুকে, তাঁর রায়রংপুরের বসত বাড়িতে আমরা যখন গিয়েছিলাম
  

৫  এই আকাশ সিংভূমের     
  
ছবির চিত্রনাট্য যখন অনেকটাই আয়ত্তের মধ্যে তখনও চিন্তা ছিল ওপেনিং টাইটেলগুলো কীভাবে দেখাবোসেখানে ঢুকিয়েছি বেথলার মিউজিয়ামে বাঘের স্কেলিটনের সামনে আমাদের বিস্মিত কথাবার্তার কিছু টুকরো। 


এছাড়া চিন্তা ছিল ছবির শুরু আর শেষ কীভাবে করা হবে, কারণ এর ওপরেই সম্পূর্ণ ছবিটার সৌন্দর্য ও আবেদন অনেকটা নির্ভর করবে ধারাভাষ্য নিয়েও কিছু চিন্তা ছিল। দীর্ঘ ছবিকে ধরে রেখেছে আমারই কন্ঠের ধারাভাষ্য, যার শুরুতেই আছে : “এই আকাশ সিংভূমের। এই পাহাড় নদী শাল-মহুলের জঙ্গল, এই রম্যভূমি কবিতার” -তো, প্রথমে ‘আকাশ’ শব্দের বদলে ছিল ‘লাল মাটি’। আমার ইচ্ছে ছিল, হাওড়া স্টেশান থেকে দুপুরের গীতাঞ্জলী এক্সপ্রেসে চেপে, ধলভূমগড় স্টেশান পেরিয়ে মুভিতে ধরবো, জানালার বাইরে বেলাশেষের আলোয় লালমাটির কার্পেটে মোড়া ছুটন্ত প্রান্তর আর  শালজঙ্গলের প্যানোরামা। সেই সাথে শুরু হবে ধারাভাষ্য। কিন্তু তার মানে তো যাতায়াতে বাড়তি বেশ কিছু খরচ ও ধকল, সবটাই একা একা। 

প্ল্যান বদলে নিয়ে আমি তখন ফিরে গেলাম ল্যাপটপে, আমার এতদিনের সঞ্চিত ট্রাভেল অ্যালবামের ভান্ডারে। হঠাৎই পেয়ে গেলাম আমারই হ্যান্ডিক্যামে তোলা কিছু মুভি, বছর দশেক আগে হেলিকপ্টার থেকে নেওয়া, সিংভূমের পাহাড়-নদী-জঙ্গলের ওপর দিয়ে জামশেদপুরের আকাশে আমি যখন ঢুকছি। টাটাস্টীলের ‘লজিস্টিক্স ও ইনফ্রাস্ট্রাকচার’ প্ল্যানিংয়ের দায়িত্ব নিয়ে বেশ কয়েকবার এরিয়াল সর্টিতে যেতে হয়েছে, নতুন কারখানার স্থান নির্বাচন অথবা কোথা দিয়ে নতুন রেলপথ বা সড়ক যোগাযোগ সম্ভব, সেইসব ঠিক করতে আকাশপথে চান্ডিল, রাজখরসোয়ান, চিরিয়া, গুয়া, মনোহরপুরের দুর্গম পাহাড়-জঙ্গলে নীচে ফরেস্ট-ফায়ারের ধোঁয়া। পাইলট ছিলেন এয়ার ফোর্সের এক রিটায়ার্ড স্কোয়াড্রন লিডার। আমার হাতে হ্যান্ডিক্যাম, ফ্লাইট প্ল্যান, নোটবুক। সেরকমই একটা ট্রিপে, ফেরার সময় হাতের ক্যামেরা একবার নিজেরই মুখের দিকে ঘুরিয়ে ধরেছিলাম। কেন জানিনা, এমনিই। সেই ছবিই আজ কাজে লেগে গেল। ধারাভাষ্যে ‘এই লাল মাটির দেশ’ সরিয়ে তখন লেখা হোল ‘এই আকাশ সিংভূমের, এই পাহাড় নদী শাল-মহুলের জঙ্গল...’।              

আশির দশকে কৌরবের কবিতার ক্যাম্পগুলোয় সাহিত্য, কবিতা, গান, চিত্রকলার কথায় মাঝে মাঝেই এসে পড়তো তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ, আর নিউক্লিয়ার ওয়ারফেয়ার নিয়ে আতঙ্কের কথা। বরাইবুরু ক্যাম্পে  আমাদের কথাবার্তায় আছে অ্যাটম বোমার প্রসঙ্গসিনেমায় ওই অংশটাকে একটু ড্রামাটাইজ করার জন্যে আমাকে একটা ১৪ সেকেন্ডের ভিশ্যুয়াল তৈরী করতে হয়েছিল, ওই অ্যাটম বম্ব বিস্ফোরণের। ইন্টারনেট ঘেঁটে পেয়েছিলাম বিস্ফোরণের পরে তোলা ‘মাশরুম ক্লাউড’-এর একটা  স্টিল ছবি, যেটা কপিরাইট ফ্রি বিখ্যাত জাপানী পরিচালক ‘ইমামুরা’  তাঁর  ‘ব্ল্যাক রেন’ সিনেমাতেও দেখিয়েছেন সেই দৃশ্য, তবে সেটা ছিল সাদাকালো ছবি 

এছাড়াও আমার পড়াছিল আমেরিকার ‘লস আলামোস’ প্রোজেক্টের শেষভাগে ‘ট্রিনিটি টেস্ট’-এর একমাত্র প্রত্যক্ষদর্শী বিজ্ঞানী ডিক ফেইন্‌ম্যানের লেখা বিবরণ।  হিরোশিমার আগে সেই ছিল প্রথম পরীক্ষামূলক অ্যাটম বম্বের বিস্ফোরণ। উনি সেই ‘টেস্ট এক্সপ্লোশান’ দেখেছিলেন কুড়ি মাইল দূর থেকে, সচক্ষে। ওঁর বিবরণে আছে, এক দিগন্তজোড়া উজ্জ্বল সাদা আলোর তীব্র ঝলক, যা ক্রমে হলুদ থেকে কমলা রঙে টার্ন করে বিরাট কুন্ডলি পাকিয়ে ব্যাঙের ছাতার চেহারা নিয়ে ধীরে বহুদূর আকাশে উঠে যাচ্ছে। এর প্রায় দেড় মিনিট পরে সহসা ভয়ঙ্কর সেই লাউড ব্যাং, ক্রমে যা গুড়গুড় রাম্বলিং শব্দে আলোড়িত হয়েছিল - এই মতো আমি প্রথমে পর পর তিনটে ক্রমান্বয়ে সাদা-কালো-সাদা ফ্রেমকে এক ঝলকে রেখে, তার পরেই আমার  স্টকের সেই সাদাকালো ছবির ঊর্দ্ধভাগে কমলা রঙ রেখে, তার ওপর ক্যামেরাকে নীচে থেকে ভার্টিক্যালি স্লো টিল্ট-আপ ক’রে, ক্লোজ-আপে ধরলাম। তবে ওই তীব্র লাউড ভয়ঙ্কর আওয়াজের বদলে সাউন্ড ট্র্যাকে এনেছিলাম বজ্র-বিদ্যুতের সময় নিজেরই টেপ করা একটা দীর্ঘ রাম্বলিং সাউন্ড। সব মিলিয়ে চোদ্দ সেকেন্ডের একটা অডিও-ভিশ্যুয়াল এফেক্ট ।   
         
কবিতার ক্যাম্পের এক জায়গায় স্বদেশ সেন ও আমি আলোচনা করেছিলাম যে বাংলা কবিতা নষ্ট হয়েছে সহজ হতে গিয়েআমরা চেয়েছিলাম কবিতায় ফিরিয়ে আনতে তার রহস্যময়তা। এই বিশাল বিশ্ব-প্রকৃতির গভীর স্তরে স্তরে যেমন লুকিয়ে আছে তার অসীম জটিলতার সৌন্দর্য কবিতাকেও চলে যেতে হবে এক নতুন ও গভীর জটিলতার দিকে। চিত্রনাট্যের এইখানে আমি দেখাতে চেয়েছি প্রকৃতির সেই জটিল সৌন্দর্যের এক ঝলক। পনেরোটা বিভিন্ন দৈর্ঘ্যের পেন্ডুলামকে পাশাপাশি দুলিয়ে দিয়ে দেখা, -কীভাবে ক্ষণে ক্ষণে রচিত হয় বিশৃঙ্খলা, কেওস ক্রমে সেখান থেকেই পুনরায় নির্মিত হয়ে ওঠে এক ছন্দিত নতুন সুন্দর -এমনটা তো হতে পারে কবিতাতেও এই ল্যাবরেটরি এক্সপেরিমেন্টটা আসলে   তৈরী করেছিল আমেরিকায় হার্ভার্ড সায়েন্স ল্যাব। আমার কাছে ছিল তার মুভি ক্লিপ। আমি ওঁদের চিঠি লিখে ছবিতে এটা ব্যবহারের অনুমতি চাইলে, Dr.Wolfgang Rueckner আমায় সানন্দে সম্মতি জানিয়ে চিঠি দিয়েছিলেন  

                        
৬  মুনলাইট সোনাটা    
    
শব্দেরও একটা বড় ভূমিকা রাখতে চেয়েছিলাম এই ছবিতে। একটা সাউন্ডস্কেপ, যার বেশিটাই প্রাকৃতিক শব্দমালা। সিংভূমে নদীরও অনেক নাম-- খরকাই, কারো, কোয়েল, সুবর্ণরেখা। তার জলের শব্দ। পত্রমোচী বনের গভীরে উদভ্রান্ত হাওয়ায় যে মর্মরধ্বনিআদিবাসী গ্রামে ভোরের মোরগের ডাক। পাখির কলতানে মুখর ভোরবেলা। অরণ্যপথ দিয়ে চলে যাওয়া ট্রেনের বাঁশির শব্দসারা ট্রেন জুড়ে আদিবাসী রমণীকন্ঠের উদ্দাম কোরাস। আর একদিন পূর্ণিমা-রাতে যেমন বেজে উঠেছিল বিঠোফেনের ‘মুনলাইট সোনাটা’।       
                
যাদবপুরের স্টুডিওয় ধারাভাষ্য রেকর্ডিঙের আগে আমার দুটো চিন্তা ছিল মন জুড়ে। তার এক নম্বরে ছিল,   নীচের একটা দাঁত পড়ে যাওয়া এবং পাশে দ্বিতীয় দাঁতটাও নড়তে শুরু করেছে, এই দন্তহীনতা নিয়ে আমি স্পষ্ট উচ্চারণ করবো কীভাবে ? দ্বিতীয় প্রশ্ন হোল, এই টানা ধারাভাষ্যে আমার গলার স্বরের স্কেল কী হবে ? স্কেলের এক প্রান্তে আছে ন্যাট-জিওতে যে ভাবে চাপা হাস্কি ভয়েস চলে, আর অপর প্রান্তে আছে সেকালের আকাশবাণীতে যেভাবে সংবাদপাঠক দেবদুলাল পেশ করতেন তাঁর কন্ঠকে। অনেক ভেবে একটা মাঝামাঝি জায়গায় রাখা হোল ভয়েস। স্টুডিওতে রেকর্ডিঙের সময় সঙ্গে ছিল নাট্যকার বন্ধু অরিন্দম গুপ্ত (বাবলা), এবং কি আশ্চর্য, সামান্য ভয়েস টেস্টিঙয়ের পর, দুয়েকটা কারেকশান ছাড়া, অত দীর্ঘ ধারাভাষ্য, টানা এক টেকেই সম্পূর্ণটা OK.  
     
আর আশ্চর্য বাঁশি বাজাতো বাবলা। মাত্র একদিনের নোটিশে ধুলোটুলো ঝেড়ে তার পুরোনো আড় বাঁশিটা নিয়ে সটান স্টুডিওতে। কথামতো পর পর তিনটে পিস বাজিয়ে গেল সে, রাগ পাহাড়ি, পিলু আর ইমন। এগুলোকেই আমি ছবির নানা অংশে ব্যবহার করেছি। এর সাথে প্রয়োজন ছিল ভায়োলিন, গীটার আর পিয়ানোতে কিছু কাজ বাবলা বললো আকাশবাণীর ‘এ’-গ্রেড আর্টিস্ট পাওয়া যেতে পারে, কিন্তু পয়সা লাগবে। আমি বললাম, এমন একটা ছবিতে যারা বিনা পয়সায় কাজ করবে শুধু তাদের কথাই ভাবতে চাইফেসবুক থেকে যোগাযোগ করলাম আমেরিকার পীটসবার্গে আশিক খুদাবক্স-এর সাথে। আশিক সফটওয়্যার  ইঞ্জিনীয়ার, সিঙ্গার, মিউজিশিয়ান। ছবির মুড বোঝাতে আমি একটা ছবি পাঠিয়েছিলাম, -প্রাচীন কাঠের ফুটব্রিজের নীচে কুলকুল শব্দে বয়ে চলেছে একটা পাহাড়ী স্রোতা— মালঙ্গী ঝোরা, ডুয়ার্সএকটা ছন্দিত উত্তেজনা। -তিনমাস পরে ও আমাকে মেইল করে পাঠিয়েছিল ভায়োলিনে বাজানো একটা পিস। 

এভাবেই পিয়ানোর জন্যে লিখেছিলাম সিনিসিনাটিতে আর্যনীলকে। শুনেছিলাম ওর কিশোর ছেলে (ঋক) তখন পিয়ানো শিখছে। আমি একটা ছোট পিস, একটা সোনাটিনা, চাইছিলাম কবিতার ক্যাম্পে ব্যবহারের জন্য ; সেই পর্বের মুডকে বোঝাতে লিখেছিলাম :
 

 "খুব ভোরে যখন লাল সূর্য উঠছে সমুদ্রের ওপরে, তখন সৈকতে ঠান্ডা বালির ওপরে আস্তে আস্তে ধীর লয়ে ছোট ছোট ঢেউ এসে ভেঙ্গে পড়ছে; সেই শান্ত আলোকিত সেটিং- দাঁড়িয়ে পিয়ানিস্ট নিজের মনে তৈরী করে বাজিয়ে তুলছে একটা শান্ত কম্পোজিশান; সে যেন আবাহন করছে একটা নতুন দিনকে।  এই কম্পোজিশানটা উন্মুক্ত অর্থাৎ ওপেন-এন্ডেড হবে, যাতে এটাকে লুপিং করে ক্রমান্বয়ে দীর্ঘ করা যায় প্রয়োজন হলে।”   

এরকমই মাত্র একদিনের নোটিশে কয়েকটা দারুণ সুন্দর পিস গীটারে বাজিয়ে পাঠিয়েছিল আমার অনেক দিনের পুরোনো বন্ধু প্রদীপ চট্টোপাধ্যায়, -বিখ্যাত বাংলা ব্যান্ড ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’-র বুলা। আমি শুধু টেলিফোনে ওকে সিচুয়েশানটার একটু আউটলাইন দিয়েছিলাম। ছবির শেষে, একদম শেষ পর্বে, যেখানে একটা কাব্যিক মন্তাজ তৈরী করা হয়েছে পরপর স্টিলছবি ও কবিতার লাইন দিয়ে, সেখানে আবহসঙ্গীতে দারুণ মেজাজ এনেছিল বুলার গীটারের ওই কর্ডগুলো। 


প্রায় চারশো স্টিলছবি, ফটোগ্রাফ এবং স্কেচ, ব্যবহৃত হয়েছে এই ছবিতে। কিছুটা মুভিও। এই সমস্ত ছবির প্রত্যেকটার পেছনেই লুকিয়ে আছে এক একটা নিজস্ব গল্প। সেসব লিখতে গেলে একটা গোটা বই হয়ে যেতে পারে
কিছু কিছু ট্রিক শটও তৈরী করতে হয়েছে কম্পিউটারে। যেমন, কবিতায় যেখানে আছে ‘শুকনো জলের শুকিয়ে আসাই এক বিষয়’, সেখানে এক ঝলকে দেখানো হয়েছে ভরন্ত গঙ্গানদী কিভাবে শুকিয়ে জলশূন্য হয়ে পড়ে আছে। আর এক জায়গায়, কবিতার ক্যাম্পে ভোর হওয়ার দৃশ্যে দেখানো হয়েছে, যেন মহাকাশ থেকে দেখা যাচ্ছে, ঘুর্ণায়মান পৃথিবীর দিগন্তরেখায় কিভাবে সূর্যোদয় হচ্ছে। তার সাথে স্বদেশ সেনের কবিতাপাঠ, “ফুটকি নয়, এই বেশ, এই আমাদের সূর্য...”। আমার ল্যাপটপে সম্পূর্ণ সৌরমন্ডলের যে মডেল আছে সেখানে সিমুলেট করে তৈরী করেছিলাম ওই দৃশ্যটা। 

     
৭  দীপমালা, ঘণ্টাধ্বনি ও সমুদ্রঢেউ

স্বদেশ সেনের প্রথম কবিতা বেরিয়েছিল পরিচয় পত্রিকায়, কিন্তু সেটা ওঁর জামসেদপুরের বাড়িতে খুঁজে পাওয়া যায়নিযেমন পাওয়া যায়নি ননী ভৌমিক কৃত রাশিয়ান ভাষায় স্বদেশের কবিতার অনুবাদগুলোতবে এস্পানিওল ভাষায় ওঁর কিছু কবিতা অনুবাদ করেছে তরুণ কবি শুভ্র বন্দোপাধ্যায়, যা স্পেনের ‘লা পারেদ দ্য আগুয়া’-নামক একটি সংকলনে প্রকাশিত হয়। শুভ্রর কন্ঠে তারই একটা কবিতাপাঠ আমি রেখেছি এই ছবিতে। আমার অনুরোধে, মাত্র দুদিনের মধ্যে দিল্লী থেকে শুভ্র সেই কবিতাপাঠ রেকর্ড করে পাঠিয়েছিল। ‘লা মানজানা এস্তা দুর্মিয়েন্দো’, -‘আপেল ঘুমিয়ে আছে’। পরে অনেকে প্রশংসা করেছেন বাংলা ছবিতে বিদেশী ভাষায় অনুবাদ পাঠ শোনানোর এই পরিকল্পনা, স্বয়ং অনুবাদকের কন্ঠে।   

আপেল ঘুমিয়ে আছে (লা মানজানা এস্তা দুর্মিয়েন্দো)        

তবে চিত্রনাট্যকে অনেক সময়েই চালিত করেছে আমারই সংগ্রহে থাকা নানা সময়ের অডিও ক্লিপ ছবির একেবারে দুই প্রান্তে, শুরুতে ও শেষে, যেমন ব্যবহার করেছি। একদম শুরুতেই আছে একটা বুদ্ধবিহারের সুরেলা স্তবগান। খুব সুন্দর সেই চ্যান্ট, আমি তার অর্থ বুঝিনি, রেকর্ড করেছিলাম বারাণসীর সারনাথ-এ, মহাবোধি বুদ্ধমন্দিরে। সিনেমায় সেই আবহসঙ্গীতের সাথে দৃশ্যে ধরা আছে হৃষিকেশ-এ প্রবাহিত গঙ্গার   ছবি, যে হৃষিকেশ নিয়ে কবিতায় স্বদেশ লিখেছিলেন “স্বচ্ছ নদী অসি হেন ধারা, মূলে মধ্যে জল রতি রতি...”। সেই দিয়েই ছবির শুরু।   
           
আর ছবির একদম শেষ দৃশ্যে কবির মৃত্যুসংবাদের পরে, দৃশ্য-কাব্য-সুরের মন্তাজ পেরিয়ে, বরিশালের খালের ওপর সবুজ বাঁশের পোল পেরিয়ে-- যেমন ওঁর কবিতায় আছে “শুধু এই চলে গিয়ে থেমে যাওয়া কোন / সবুজ পোলের কাছে”-- সেখানে দিনশেষের আঁধারে একটা প্রদীপশিখা ক্রমে উজ্জ্বল শত শত প্রদীপ হয়ে উঠলে তার ওপর খুব ধীরে টিল্ট করে এগিয়ে গিয়েছে ক্যামেরাআবহে একটা টিবেটান ঘন্টাধ্বনির অনুরণন আর সমুদ্রের ঢেউ এসে ভেঙ্গে পড়ছে সৈকতে, -সেই শব্দমালাঠিক তখনি শুরু  হচ্ছে একটা কবিতাপাঠ, যার প্রত্যেক লাইন প্রথমে এক পুরুষকন্ঠে এবং পুনরায় সেটাই বলছে এক শিশুও,  -“রেখো মা দাসেরে মনে, এ মিনতি করি পদে...”এই পিসটা আমার পাঁচ বছরের শিশু কন্যাকে সাথে নিয়ে নেহাৎই খেলাচ্ছলে রেকর্ড করেছিলাম প্রায় তিরিশ বছর আগে ; আজ এতদিন পরে সেটা কাজে লেগে গেল। এডিটিং স্টুডিওতে ছবির এই শেষ অংশে কাজ করতে গিয়ে রোমাঞ্চিত হয়েছিলেন সম্পাদকও। আর আমিও কিছুটা স্বস্তি পেলাম যে, যাক, ছবির শেষটা তাহলে সত্যিই শেষ করা গেল।    
          
সেন্সর বোর্ডে রাখা হয়েছে কমলালেবু ছবি স্ক্রিনিং-এর দিন পুরো ছবিটা দেখার পরে বোর্ডের সদস্যরা খুব প্রশংসা করেছিলেন। বলেছিলেন, প্রিমিয়ার বা কোনও প্রদর্শনীতে আরেকবার ছবিটা দেখার ইচ্ছা রয়েছে ছবির সেন্সর সার্টিফিকেট পাওয়া গিয়েছিল ৪-মার্চ ২০১৫তে, অর্থাৎ ছবি শুরুর কথা ঘোষণা করার (১৮ মে ২০১৪) দশ মাস পরে। আর ছবি তৈরী, সেন্সর, এবং নন্দনে প্রদর্শনী, সব মিলিয়ে খরচ পড়েছিল বাজেটের এক লাখের চেয়েও কম, -মোট পঁচাত্তর হাজার টাকা।        

নন্দনে ছবির প্রিমিয়ার হয়েছিল বুধবার ১৩ মে, ২০১৫। ছবি শেষ হলে দেখেছিলাম দর্শকের স্বতঃস্ফুর্ত হাততালি আর উচ্ছ্বাস, এবং প্রিন্ট মিডিয়াতেও, -অপূর্ব ছবি, বাকরুদ্ধ, মন্ত্রমুগ্ধ, ইত্যাদি। আর্যনীল মুখোপাধ্যায় চিঠিতে লিখেছিল, ‘ভীষণ সুন্দর ধারাভাষ্য’ এবং ‘শব্দের দারুণ কাব্যিক ব্যবহার’। এছাড়া অনেক তরুণ আমায় পরে লিখে জানিয়েছে যে, কৌরব নিয়ে অনেক ভুল ধারণা ভেঙ্গে গেছে এই ছবি দেখে। ছবিটা দেখার পরে কবি ও প্রাবন্ধিক সমীর রায়চৌধুরী বলেছিলেন :  ‘নগর কলকাতার কবিদের চিরাচরিত আর্বানিটির বাইরে, এই প্রথম একটা রুরাল ব্যাপার, একটা প্রান্তিক ব্যাপার তুমি দেখাতে পেরেছো। এই যে পুরো সিংভূমকে জড়িয়ে, সমস্ত পরিবেশটাকে নিয়ে, কবি ও কবিতাকে সম্পর্কিত করে দেখানোর কাজটা করেছো তুমি, যা শুধু অক্ষরের মধ্যে সীমিত নয়, এটা একটা  বিশাল ব্যাপার। এটা অন্য কারো পক্ষে করা সম্ভব নয়’।
  
কমলালেবুর বাগানে এভাবেই কেটে গিয়েছে আমার একটা বছর ; রোমাঞ্চে, শিহরণে, শ্রমে, শিক্ষায় । কতবার ক্ষোভে হতাশায় ভেঙ্গে পড়েও উঠে দাঁড়িয়েছি। মনে পড়েছে সেই মহৎ উপদেশ, -‘অ্যাপার্ট ফ্রম মেনি আদার কোয়ালিটিস, এ ফিল্ম ডাইরেক্টর মাস্ট হ্যাভ টন্‌স অফ পেসেন্স’।   



                             -------------------------------------