Sunday 14 May 2017

কমলালেবুর বাগানে এক বছর

[ কবি স্বদেশ সেনের জীবন, সময় ও কৌরবের কবিতার ক্যাম্প নিয়ে নির্মিত আমার প্রথম ছবি 'রাখা হয়েছে কমলালেবু'-র প্রথম প্রদর্শনী হয়েছিল কলকাতার নন্দন-৩ প্রেক্ষাগৃহে, ২০১৫ সালের ১৩ মে। তরুণদের প্রতি উৎসর্গ করা এই ছবি দর্শকদের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা পাওয়ার পরে কেউ কেউ আমায় অনুরোধ করেছিলেন এই ছবির মেকিং, অর্থাৎ নির্মাণকাহিনী নিয়ে লিখতে। সেই বিষয়েই আমার এই লেখা-- 'কমলালেবুর বাগানে এক বছর' সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে 'কবিসম্মেলন' পত্রিকার মার্চ-২০১৭ সংখ্যায়। যাঁদের কাছে ঐ পত্রিকাটি পড়ার সুযোগ নেই, তাঁদের অনুরোধে এখানে আমার ব্লগেও রাখা হল লেখাটা। আজকের তরুণ কবিরা, যাঁরা কবিতা নিয়ে সিনেমা তৈরীর ইচ্ছা রাখেন, বা ভবিষ্যতে করবেন, তাঁদের এই লেখাটা উপকারে লাগতেও পারে। ]  

--------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
কমলালেবুর বাগানে একবছর  ঃ  শংকর লাহিড়ী
------------------------------------------------------------------------------

১  রাখা হয়েছে কমলালেবু
 

ভিক্টর য়্যুগো নাকি বলেছিলেন কথাটা, কিন্তু তারও অনেক আগে পতঞ্জলি যোগশাস্ত্রেও লেখা আছে  অনেকটা এরকমই-- ‘যখন কোনও পরিকল্পনা বা ধারণার সপক্ষে উপযুক্ত সময় এসে উপস্থিত হয়, তখন ভেঙ্গে যায় সব বাধা, কোনও শক্তিই আর তার বাস্তবায়নকে আটকে রাখতে পারে না’কবি স্বদেশ সেন ও সমকালীন কৌরবকে নিয়ে আমার প্রথম তথ্যচিত্র নির্মাণের পরিকল্পনাটাও সম্ভব হয়েছিল অনেকটা এভাবেই  

স্বদেশ সেনের ‘রাখা হয়েছে কমলালেবু’ বইয়ের কবিতাগুলো লেখা হয়েছিল প্রধানতঃ আশির দশকের  গোড়ায়, কৌরবের ‘কবিতার ক্যাম্প’-এর দিনগুলোয়। পাহাড়-জঙ্গলে, সমুদ্রসৈকতে, হাইওয়ে ধাবায়, ওঁর  সাথে অনেক অন্তরঙ্গ গল্পে কবিতায় আড্ডায় সময় কেটেছে আমার। ওঁর সাহিত্যকর্মের সবচেয়ে মূল্যবান অংশই ওই পিরিয়ডে লেখা। তখন কি আর ভেবেছিলাম, বত্রিশ বছর পেরিয়ে, ২০১৪ সালে স্বদেশ সেনের মৃত্যুর পরে, একদিন এইসব নিয়েই, -তাঁর সময়, জীবন, কবিতাভাবনা ও কৌরবের কবিতার ক্যাম্প নিয়ে, দুঘন্টার একটা তথ্যচিত্র বানাতে হবে আমায় ? না, কখনোই ভাবিনি   
  
কবিতার ক্যাম্পে স্বদেশদা ছিলেন রেকর্ডিং ব্যাপারে সর্বদাই দ্বিধায়অনেক সময় তাঁর নজর এড়িয়ে আমায় টেপ চালু করতে হোত, কখনো বিতর্কে প্ররোচিত ক’রে, কথাবার্তায় ছেদ না ফেলে, সতর্ক হয়ে এতগুলো বছর পেরিয়েও আমার সাথে থেকে গেছিল সেই সব দিনের অজস্র স্মৃতি, আমার নিজস্ব ডায়েরির নোটস, ক্যাম্পের কিছু কিছু অডিও ক্যাসেট্‌স আর সেলুলয়ডে তোলা ছবির নেগেটিভগুলো। সেসময়ে ছবি তুলতাম আমার প্রথম এসেলার ফিল্ম ক্যামেরা ক্যানন FTQL দিয়ে। আর ক্যাম্পের রেকর্ডিং ছিল সোনি বা টিডিকে-র অডিও ক্যাসেটে। সহজেই জট পাকিয়ে যাওয়া সেইসব সরু ফিনফিনে ম্যাগনেটিক ফিতে থেকে প্রয়োজনীয় অংশগুলো তিরিশ বছর পরে উদ্ধার করে ডিজিটাইজ করা সহজ ছিল না।


স্বদেশ সেনকে নিয়ে এত অজস্র তথ্য দৃশ্য ঘটনা কবিতা আর ভ্রমণের স্মৃতি জড়ো হয়েছিল মাথায়, কিভাবে কোথা দিয়ে শুরু করবো ছবিটা ভেবে উঠতে সময় লেগেছিল। মনে পড়ছে, বেথলা ক্যাম্পে যাওয়ার পথে আমরা তিনজনে- স্বদেশদা, কমলদা ও আমি।  ডালটনগঞ্জ স্টেশানে ট্রেন থেকে নেমে, শেষ রাতের অন্ধকারে, প্ল্যাটফর্ম যেখানে ঢালু হয়ে মাটিতে নেমেছে তার কাছেই এক মহানিম গাছের নির্জনে, আমরা রাকস্যাক থেকে হুইস্কির বোতল বের করে  ছিপিতে ঢেলে সরাসরি গলায় কয়েক রাউন্ড। ভোরের আধো আলোয় শিরশিরে হাওয়া আর পাতায় পাতায় খশখশ শব্দের মধ্যে গান- ‘ওগো শেফালি বনের মনের কামনা’। -তখন কে আর অর্বাচীনের মতো ক্যামেরা বার করে ? এরকম অনেক কিছুরই কোনও প্রিন্ট নেই, শুধু স্মৃতিতেই ধরা আছে তারা, এত বছর পেরিয়ে ছিন্ন বিবর্ণ পিঙ্গল। স্বদেশ সেন একবার লিখেছিলেন, ‘ছিন্ন ভিন্ন ছবিকে ছবি করে তোলাই কবিতা’। এতদিন পরে সিনেমা করতে এসে মনে হোল আমিও তো সেই পথেই চলেছি।  
       

চাঁদিপুর সমুদ্রসৈকতে দুই কবি, স্বদেশ সেন ও কমল চক্রবর্তী         

মনে পড়ে, চাঁদিপুর ক্যাম্পে টিলার ওপরে সেই এক দিকশূন্য গোলঘরে আমরা তিনজন। ভোরবেলা ঘুম ভেঙ্গে দরজার বাইরে দেখেছিলাম একটা ঘুঘুপাখি মরে পড়ে আছে। স্বদেশ সেন সেই স্মৃতিতে পরে কবিতায় লিখেছিলেন, “মরা ঘুঘুর একটা দরজা আছে”। -এমন অনেক ছিল। চাঁদিপুরে সকালবেলায় দেখা (১৬ ফেব্রুয়ারী, ১৯৮০) শতাব্দীর সেই প্রথম ও অবিস্মরণীয় পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণ (যার ছবি আমি তুলতে পারিনি, পরে হায়দ্রাবাদ থেকে মহাকাশ-বিজ্ঞানীদের তোলা ছবি ব্যবহার করেছিলাম), অথবা বেথলার জঙ্গলে রাতের অন্ধকারে যেদিন হাতির হানা। আমরা তখন জিপসিতে। মাথার ওপরে নক্ষত্রখচিত আকাশ, ভ্যান গঘের ‘স্টারি নাইট্‌স’ ছবিটার মতোরাতের আকাশ থেকে তখন তারা খসে পড়তে দেখেছি সিনেমায় সেই দ্রুতগতিতে তারা খসে পড়া দেখাতে গিয়ে কম্পিউটার সিমুলেশানের সাহায্য লেগেছিল। ব্যাঙ্গালোর অ্যাস্ট্রোনমিকাল সোসাইটির গুগল গ্রুপের মেম্বার ছিলাম আমি। আমার ল্যাপটপে ছিল একটা গোটা প্ল্যানেটোরিয়াম, সেখান থেকে পেয়েছিলাম ‘অরিওনিড মিটিওর শাওয়ার’-এর দৃশ্য। সেখান থেকেই আইডিয়া আসে। কিন্তু ছবিতে ওই শটটার জন্যে তিন সেকেন্ডের বেশি সময় বরাদ্দ করা যাবেনা জেনে আমি শাওয়ারের বদলে শুধু একটা তারাকেই খসে পড়তে দেখিয়েছিলাম।  

আরও অজস্র দৃশ্যের স্মৃতি জমা হয়েছিল, প্রকৃতই সিনেমাটিক, যা আমি বাংলা কোনও ছবিতে কখনো দেখিনি জামসেদপুরের রাতের আকাশটা যেমন মাঝে মাঝে রক্তিম ও উজ্জ্বল হয়ে উঠতো স্ল্যাগ-পাহাড় থেকে গড়িয়ে নামা তপ্ত গলিত স্ল্যাগের আলোয়। আমার তো ভিডিও ছিল না, স্টিল ছবি দিয়েই পরে এডিটিং টেবিলে নানাভাবে মুভির এফেক্ট এনেছি, কিভাবে আকাশ দৃশ্যতঃ হঠাৎই লাল হয়ে ওঠেঅথবা, স্বদেশের শ্বশুরবাড়ি বাদামপাহাড় আর নোয়ামুন্ডির লাল লোহাপাথরের খনিগুলো, ইতস্ততঃ অজস্র আতা গাছ, আর মাইল মাইল কনভেয়র। অথবা, বুড়িবালাম নদীর মোহানায় যখন রটন-মাছ বালুতে পুঁতে নুন দিয়ে নোনা করা হচ্ছে, তখন জেলে ডিঙ্গিতে সওয়ার আমরা তিনজন সেলুলয়েডে ধরা আছে এমন অনেক স্মৃতিচিত্র।    

একদিন সন্ধায়, তখন ১৯৯৪ সাল, জামসেদপুরে স্বদেশদার বাড়িতে বসে আমি একা ওঁর মুখোমুখি। সেদিন শোনা হয়েছিল ওঁর ছেলেবেলা আর যুদ্ধের দিনগুলোতে জন্মভূমি বরিশালে ফিরে যাওয়ার গল্প। ঝালোকাঠি নদীবন্দর পেরিয়ে, পোনাবালিয়ার খাল দিয়ে ঢুকে, গ্রামের নাম বারোইকরণ। মাটির বাড়িতে প্রদীপের আলোয় পিসিমা রাতে পড়ে শোনাতেন দুর্গেশনন্দিনী। -একদিন ছুটির দুপুরে খালের ওপর বাঁশের সাঁকোগুলো পেরিয়ে ছুটতে ছুটতে স্বদেশ হঠাৎ এক বিশাল নদীর মুখোমুখিশিহরিত বালক ভেবেছিল ওই বুঝি বিশাল আসল পদ্মা! সেই স্মৃতি পরে ওঁর কবিতাতেও এসেছে : "কখনও সেই পরম পারে দাঁড়িয়ে ভেবেছি / তাহ'লে আমি কি ঠায় দাঁড়িয়ে আছি / যখন 'য়ে যাচ্ছে বিশাল আসল পদ্মা?” -পদ্মানদীর ছবি আমার ছিল না। এই দৃশ্যে তাই সুন্দরবন সফরে তোলা অনেক ছবি থেকে একটাকে বেছে নিয়েছিলাম। -দুর্গাদোয়ানি নদীতে গোসাবার কাছে তখন বেলা পড়ে আসছে অস্তসূর্যের কুচিকুচি কমলা আলো ঝলসে উঠছে বিস্তৃত নদীজলে লঞ্চের রেলিং ধরে একমনে সেই শিহরিত শোভা দেখছে রাজু নামের একটি বালক, যে ছিল লঞ্চেরই স্টাফ, -আমাদের খাবার পরিবেশন করতো, যাকে আমি সিল্যুয়েটে ধরেছি এভাবেই ছবিতে এসেছে বালকের দেখা সেই বিশাল আসল পদ্মা 
                   
যুদ্ধের বিপদ শেষ হলে স্বদেশ এদেশে ফিরে কলকাতায় আড়িয়াদহের কালাচাঁদ স্কুলে পড়াশোনা করেছেন; এক আত্মীয়ের বাড়ির চিলেকোঠার ঘরে সারাদিন গাঙ্গেয় হাওয়া আর মনে মনে নৌকো ভাসানো। ক্রমে সেই স্কুলজীবনেই জড়িয়ে পড়েছেন ছাত্র আন্দোলনে, কম্যুনিস্ট পার্টির কার্ডহোল্ডার হয়েছেন। এর পরে বাবার মৃত্যু, ম্যাট্রিক পাস করে জামসেদপুরে ফিরে এসে চাকরির ইন্টারভিউ। -ওঁর মুখে শোনা এই জীবনকথা সেদিন রেকর্ড করা হয়নি। তবে প্রায় মুখস্থ করে অনেক রাতে বাড়ি ফিরে এসেই ডায়েরীতে লিখে ফেলেছিলাম, পরে যেটা  কৌরব পত্রিকার ৬৯ সংখ্যায় (১৯৯৪) প্রকাশিত হয়েছিল আজ মনে হয়, ভাগ্যিস সেদিন একলা ঘরে ওঁর সাথে আড্ডার মাঝে জেনে নিয়েছিলাম ওঁর শৈশব কৈশোর যৌবনের অনেক জরুরী তথ্য। কিন্তু তখন তো ভাবিইনি যে ওঁকে নিয়ে একদিন ছবি করবো  


২  ধরেই নিয়েছি আর অক্ষর নেবে না কিছু

স্বদেশ সেনের মৃত্যুর তিন বছর আগে, ২০১১ সাল নাগাদ আমি ‘ঢের হয়েছে কবিতা, এবার ভালো কিছু সিনেমা দেখা যাক’ ভেবে, পরিচিত এক সিনেক্লাবের সাথে যোগাযোগ করি। বছরখানেকের মধ্যেই আমার নিজস্ব লাইব্রেরীতে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ পরিচালকদের প্রায় দেড়শো ছবির সুনির্বাচিত কালেকশানবেশ কৃপণের মতো নির্বাচন করতে হয়েছিল, যেটুকু না দেখলেই নয়। আমাকে একাজে সাহায্য করেছিলেন ফিল্ম রিসার্চ সংস্থা ‘দৃশ্য’। আসলে, ছবি বানানোর সাধ থাকলেও প্রথাগত কোনও স্কুলিং আমার ছিলো না। ইচ্ছে ছিল কোনও ভাল পরিচালকের কাজকে আমি কাছ থেকে দেখবো। কিন্তু সেই সুযোগ আজ অব্দি হয়নি। এরপর দুবছর ধরে ধীরে ধীরে দেখা হয় বিশ্বখ্যাত সেইসব ছবি, পড়া হয় তার রিভিউ। তারকোভস্কি, কুরোশাওয়া, বুনুয়েল, ত্রুফো, ওয়ের্নার হারযোগ, বের্তোলুচ্চি, রোমার, ব্রেসঁ, গদার, ফেলিনি, ডি সিকা, বার্গম্যান, জানভ, জিরি মেঞ্জিল, কুব্রিক, এঞ্জেলোপুলুস, পাওলো পাসোলিনি, ঋত্বিক, সত্যজিৎ, মৃণাল এবং আরও ; সিনেমা করবো বলে নয়, ভালো লাগছিল দেখতে, তাই। অনেক বছর আগে আমি কিছু সাউন্ডস্কেপ কম্পোজিশান গদ্যে লিখেছিলাম। ‘সিম্ফনি কবিতা’ নামে সেগুলো প্রকাশিত হয় (১৯৮৯) কৌরব-৫৩ তে। অক্ষরে লিখিত কবিতা সেসময় আমাকে একটা সীমানায় এনে দাঁড় করিয়েছিলস্বদেশ সেনও কবিতায় লিখেছেন, ‘ধরেই নিয়েছি আর অক্ষর নেবে না কিছু’।   

বরিশালে পোনাবালিয়ার খালের ওপর বাঁশের সাঁকো   

স্বদেশ সেনের মৃত্যুর (৫ মার্চ ২০১৪) পরে যখন লিটিল ম্যাগাজিনের অনেকেই কে তাঁর কাছে কত প্রিয় এই নিয়ে নিজ নিজ দাবী পেশ করছেন, কার কার লেখালিখি ওঁর প্রশংসায় ধন্য হয়েছে এই নিয়ে আসর তোলপাড় করছেন, তখন, ঠিক তখনই আমি বিস্ময়ে লক্ষ্য করি, কৌরবের কবিতার ক্যাম্প নিয়েও অনেক চতুর তথ্যবিকৃতি ইতিমধ্যেই গ্রাস করেছে আজকের তরুণ লেখকদের একটা বড় অংশকে। এই সময়েই আমার মনে ছবি করার ইচ্ছা আসে। কবি স্বদেশ সেনের জীবন, সময় ও কবিতাভাবনা নিয়ে রচিত এই ছবির নাম দিই ‘রাখা হয়েছে কমলালেবু’, -ওঁরই প্রথম কবিতার বইয়ের নাম অনুসারে, যে বইয়ের প্রচ্ছদ করেছিলাম আমি।  

প্রথমেই দুটো চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয় আমাকে চিন্তা হয়, একটা পূর্ণ দৈর্ঘ্যের ছবি বানানোর খরচ নিয়ে। সেই সময়ে মৃণাল সেনের একটা ইন্টারভিউয়ে পড়েছিলাম যে পৃথিবীর অনেক ভালো ছবিই তৈরী হয়েছে সাধারণ ক্যামেরায়, নামমাত্র বাজেটে। এইটা ছিল আমার কনফিডেন্স বুস্টারসেসময় এক বন্ধুর কাছ থেকে খবর পাই, তাদের একটা মাদকবিরোধী একঘন্টার ছবি করতে খরচ হয়েছে প্রায় সাত আট লাখ টাকা। সেই হিসেবে দুঘন্টার ছবির খরচ হতে পারে অন্তত দশ বা বারো লাখ, -যা আমার সাধ্যের বাইরেঅনেক ভেবেচিন্তে আমি স্ত্রীকে জানালাম যে, আমি এক লাখের মধ্যে ছবিটা শেষ করবো। চোখে তার বিস্ময়, বললো, ‘তুমি পারবে ? কখনো তো করোনি, দেখ যা ভাল বোঝ’। -অর্থাৎ সম্মতি। কিন্তু কিভাবে ওই বাজেটে ছবি হবে, খরচের বহর কেমন, রেকর্ডিং ও এডিটিং স্টুডিয়োগুলোই বা কত নেবে, কোথায় তারা, কিছুই জানতাম না। মনে রয়ে গেল সেই সপ্রশ্ন চাহনি, “তুমি পারবে ?” 

এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে আমার মনে হল সত্যজিৎ রায়ের বিখ্যাত তথ্যচিত্রগুলো দেখা দরকার। পরপর কয়েকদিনে দেখা হোল ওঁর ‘সিকিম’, ‘সুকুমার রায়’, ‘বালা  সরস্বতী’ এবং দৃষ্টিহীন চিত্রকর বিনোদবিহারীকে নিয়ে করা ‘ইনার আই’  ছবিটাবিশেষতঃ শেষ দুটো ছবি।  বারবার দেখে দেখে, কি জানি, অশিক্ষিত হওয়ার এটাই হয়তো আমার সুবিধে, মনে হ’ল এই যদি সেসময়ে সত্যজিতের কাজ হয় তবে এখন, এই নেট্‌ওয়ার্কড্‌ পৃথিবীতে, এর চেয়েও ভালো তথ্যচিত্র আমি অবশ্যই বানাতে পারবো। এই কনফিডেন্সে ভর করে, স্বদেশ সেনের মৃত্যুর আড়াই মাস পরে, ১৮ মে ২০১৪, ফেসবুকে আমি প্রথম ঘোষণা করে দিই ছবির। 

“শুরু করলাম এই কাজ। স্বদেশ সেনের ওপর তথ্যচিত্র । তাঁর কবিতা ও ভাবনা নিয়ে । বরিশালের নদীতীরের গ্রাম, সিংভূমের পত্রমোচী বন, আর কৌরবের কবিতার ক্যাম্পের সেই অপার দিনগুলো জুড়ে যেভাবে তিনি কবিতায় ক্রমে প্রকাশিত হয়েছিলেন।”

উদ্দেশ্য, নিজের ওপর চাপ সৃষ্টি করা, যাতে পিছিয়ে যেতে না পারি। তখন অনেক অভিনন্দন আসতে থাকে। শুভেচ্ছাসহ অনেকেই লিখে জানান যে অত্যন্ত জরুরী ও সময়োচিত কাজ হবে এই ছবি      
     
এর পরেই আমাকে ডুব দিতে হয় এতবছরের সঞ্চিত নিজস্ব আর্কাইভে। ব্যক্তিগত সেই লাইব্রেরীতে তখন হাজারখানেক স্টিলছবির প্রিন্ট, তাদের নেগেটিভের ওয়ালেটগুলো, কালার স্লাইড, কন্টাক্ট প্রিন্ট, হ্যান্ডিক্যামের ভিডিও, একরাশ অডিও ক্যাসেট। এসবের মধ্যে কৌরবের ক্যাম্পের ছবি ছাড়াও ছিল ব্যক্তিগত ভ্রমণ বা টাটাস্টীলে কর্মজীবনে বিদেশে তোলা ছবিও। এই সব থেকে বেছে বেছে যেগুলো ব্যবহার করতে চাইবো তার একটা ক্যাটালগ তৈরী করলাম ল্যাপটপে। আর সেখান থেকেই ধীরে ধীরে একটা আভাস দেখা দিল চিত্রনাট্যের কাঠামোর। এই ব্যাপারটা ছিল খুব মজার। প্রিয় জিনিষ যা কিছু পাচ্ছি, সেটাকেই কীভাবে ছবিতে ব্যবহার করা যায় সেইসব ফন্দি। কয়েকমাস পরে, কমলালেবু-র চিত্রনাট্য নির্মাণ যখন শেষ পর্যায়ে, তখন কৌরবের একটা বিশেষ সংখ্যায় (১১৫) প্রকাশিত একটি লেখা একদিন আমার নজরে পড়ে। সেটা ছিল একজন অ্যামেরিকান মহিলা ফিল্মমেকার ‘আবিগেইল চাইল্ড’-এর সাক্ষাৎকার, -নিয়েছিলেন কবি ‘চার্লস বার্নস্টেইন’। আবিগেইল ‘ইয়েল স্কুল অফ আর্ট’-এর স্নাতক, নিজেও কবি, তিরিশেরও বেশি ফিল্মের নির্মাতা এবং চলচ্চিত্র বিষয়ে পড়াশোনা করেছেন ‘গুগেনহেইম স্কলারশিপ’ নিয়েলেখাটা আমায় খুব কনফিডেন্স দিয়েছিল, কারণ আমি তো ঠিক ওভাবেই ছবি বানানোর কথা ভেবেছিলাম ; নিজের সংগ্রহে যা কিছু ব্যক্তিগত দৃশ্য ও শ্রাব্য জমা হয়ে উঠেছে দীর্ঘকাল ধরে, সেগুলো নানাভাবে ব্যবহার করেই ছবি বানানোর পরিকল্পনা শুরু করা, -যেমনটা আবিগেইল ওই সাক্ষাৎকারে বলেছেন
       
কিন্তু চিত্রনাট্য কিভাবে লিখতে হয় আমি জানিনা। সত্যজিৎ রায় তাঁর ছবির চিত্রনাট্যের খাতায় কিছু কিছু স্কেচও আঁকতেন, কিন্তু সেগুলো তো কাহিনীচিত্র। আর আমার ছবির অন্ততঃ আশিভাগই স্থিরচিত্রএবং  ‘লক্ষ্মণের শক্তিশেল’-এর মতো কোনও অভিনীত অংশও রাখা হবে না, যেমনটা সুকুমার রায়ের ওপর তথ্যচিত্রে সত্যজিৎ রেখেছিলেন আর স্বদেশ সেন প্রয়াত, তাই তাঁকে নিয়ে নতুন করে কিছু শ্যুট করারও সুযোগ নেই। -এটা আমায় চিন্তায় ফেলেছিল।       
   
সেসময় ইন্টারনেট ঘেঁটে কিছু সফ্‌টওয়ার অ্যাপ্লিকেশান আমি পেয়েছিলাম যা ছবির চিত্রনাট্য, শ্যুটিং প্ল্যান ইত্যাদিতে ব্যবহার হয়। কিন্তু অচিরেই সেগুলোকে গার্বেজ মনে ক’রে আমি সরাসরি ল্যাপটপে, এক্সেল-শীটে নিজস্ব ফর্ম্যাট ডিজাইন করে, পুরো চিত্রনাট্য লিখতে শুরু করি (আর কেউ এভাবে করেছেন কিনা জানি না।) পাশাপাশি, ফ্রেম-বাই-ফ্রেম, লেখা হোল শট নং, ছবি, শব্দ, মুভি, টেক্সট ইন্সার্ট, আবহসঙ্গীত, ধারাভাষ্য ইত্যাদি, এবং কোন ফ্রেম কত সেকেন্ডের, সেইসব। ছবিকে পার্ট বাই পার্ট ভাগ করে আলাদা আলাদা শীটে কাজ শুরু হোল। এতে ছবির মোট দৈর্ঘ্যের ওপরেও সর্বদা চোখ রাখা গেল। লিখতে বসে পরবর্তী চ্যালেঞ্জ ছিল ছবিটার সম্পূর্ণ আর্কিটেকচার। কিভাবে সেই কালখন্ডের তথ্যফ্রেমের মধ্যে থেকে বাজিয়ে তোলা হবে তাঁর সময় ও কবিতার সামগ্রিক আর্তিটুকু।    

সরাসরি ল্যাপটপে এক্সেল-শীটে লেখা হয়েছিল পুরো চিত্রনাট্য  


৩  নতুন গভীর জটিলতার জন্য   

আমি চেয়েছিলাম এটা কোনও প্রথাগত তথ্যচিত্র হবে না। কলকাতার কফিহাউস ও খালাসিটোলার বিপরীতে সিংভূমের পাহাড়-নদী-জঙ্গল, আদিবাসী গ্রাম, আর ইস্পাত-কারখানাকে ঘিরে যে জীবনসংস্কৃতি, যা কৌরবের সাহিত্যচর্চাকে ভিন্নতা দিয়েছে এবং যোগ করেছে অনেক নতুন শব্দ-বর্ণ-ঘ্রাণ, তাই হবে ছবির আধার কৌরবের সূচনাপর্ব থেকে ক্রমে তার এগিয়ে চলা এবং পাশাপাশি কবি স্বদেশ সেন যেভাবে জন্মভূমি বরিশালের রূপসী ক্যানভাস থেকে উঠে এসে এদেশে সিংভূমের লাল মাটিতে অনেক টানা-পোড়েনের মধ্য দিয়ে এগিয়ে গিয়েছেন। -আমার নিজের কৈশোরের প্রিয় স্মৃতিতেও আছে বাংলার গাঙ্গেয় জনপদ, কালচে এঁটেল মাটি, মাইল মাইল নারকেল-সুপুরী-খেজুর-তালগাছ, আম-জাম-জামরুল-ফলসা-পেয়ারার বাগান, শরবন হোগলাবন, পানের বরজ, খাল-বিল-দীঘি, ডাহুক-জলপিপি-দাঁড়কাক, মাছরাঙা-ফিঙে, ঢাকের বাদ্যি, কীর্তন আর তরজা গান নিয়ে যে সম্পূর্ণ আবহকিন্তু তার চেয়েও গভীরে, মনের আলোছায়াময় স্তর জুড়ে ছড়িয়ে আছে সিংভূমের লালমাটি আর পত্রমোচী বন, জঙ্গল-পাহাড়, কালো পাথরের স্তুপ, চিত্রিত দেওয়াল, পাহাড়ী টিলা, ডুংরি, ঝর্ণা, শাল-সেগুন-শিরীষ-সজনে, নিম-কুসুম-আমলকি-পলাশ, সরষেক্ষেত, ভুট্টাক্ষেত, বনমোরগ, জংলি টিয়া-ময়না, মদ-মহুয়া-মাদল, ডুবাং নাচ, টুসু-গান, দেবতা মারাংবুরু 
           
কিভাবে মননে এই দুই উৎসস্রোত সঙ্গমস্থলে মিশে ক্রমে বিবর্তিত হয়, রচিত হয় কবিতা, কাব্য ভাবনা, নতুন অ্যাবস্ট্রাকশান, -তাই হবে ছবিটার চালিকাশক্তি পাশাপাশি আলোয় দেখা স্বদেশ সেনের ব্যক্তিজীবন ও কৌরব পত্রিকার উজ্জীবনকোথা থেকে এসেছে ওঁর কবিতা ? কীভাবে নির্মিত হয়েছে তার আশ্চর্য স্বতন্ত্র শব্দ-শরীর? জন্মভূমি বরিশালের খাল-বিল-নদী, নাকি কর্মভূমি সিংভূমের পত্রমোচী বন? ভারতবর্ষীয় প্রবচন, না ইউরোপীয় অ্যাবস্ট্রাকশান? 

দলমা পাহাড়ের পথে, জঙ্গলের গভীরে   

এই ছবির আর্কিটেকচার তাই যেন একটা ডাব্‌ল হেলিক্স, যা সময়সরণী ধরে এগিয়ে যাবে এবং যার পাকে পাকে যুক্ত হবে সুন্দর ও রহস্যময় নানা কুঁড়ি-ফুল-পাতা ও কবিতার নিজস্ব অভ্রান্ত ঘ্রাণ। তথ্যচিত্রের প্রচলিত সীমানাকে ভেঙ্গে, শিল্পসাধনার বহুমাত্রিকতায়, নিজেই যেন একটা নতুন ও সম্পূর্ণ সৃষ্টি হয়ে উঠতে পারে ছবিটা, এমনটাই চেয়েছিলামএটা হবে একটা নতুন জঁর‍্যা, যাকে আমি বলেছি ‘তন্ত্রচিত্র’।   
        
স্বদেশ সেন একটা গদ্যে লিখেছেন, "প্রাকৃতিকতা আমাদের দৃশ্যসুখ শব্দসুখের মধ্য দিয়ে আর কিছুই দেয় না, শুধু একটা অনুরণন দিয়ে যায় এই অনুরণনই সমস্ত শিল্পের জন্মদুধকবিতার ক্যাম্পও এক নতুন অনুরণন জাগিয়ে তুলেছিল আমাদের চেতনায়, ভাবনায়, লিখনভঙ্গিমায়। ছবির একটা বড় অংশ জুড়ে তাই রয়েছে কবিতার ক্যাম্পের অডিও ভিশ্যুয়ালস চাঁদিপুর, মুকুটমণিপুর, শিমলিপাল, চান্ডিল, বেথলা, বরাইবুরুর সেই অপার ক্যাম্পগুলো যা সমকালীন সাহিত্যচর্চায় আলোড়ন তুলেছিল।
    
২০১৪-র জুন মাসে চিত্রনাট্য লেখা শুরু করার পরে আমি একদিন স্বদেশদার মেয়ে নবীনাকে ফোন করে  জানতে পারি, স্বদেশদার স্ত্রী সবে এসেছেন কলকাতায় তাদের বাড়িতে, এবং কয়েকদিন পরেই উড়ে   যাবেন আমেরিকার টেক্সাসে বড় ছেলের কাছে, ফিরবেন ছমাস পরে খ্রীস্টমাসের সময়। শুনে আমি সব  কাজ থামিয়ে দৌড়ে গিয়ে দেখা করি। সঙ্গে ক্যামেরা, রেকর্ডার ইত্যাদি। ওই বাড়িতে বেশ কিছু ছবি তোলা  হয়, আর শ্যুট করা হয় ওঁদের সাথে সাক্ষাৎকার। ওঁরা ছবির জন্যে কিছু অর্থ সাহায্যও দিতে চেয়েছিলেন,  কিন্তু আমি রাজি হইনি। আসলে আমি সম্পূর্ণ নিজের খরচে নিজের মতো করে ছবিটা করতে চেয়েছিলাম। ওঁরা সেদিন আমার হাতে তুলে দেন পারিবারিক অ্যালবাম থেকে কিছু ছবি আর স্বদেশদার কিছু চিঠি, অনেকগুলো ডায়েরী, কবিতার খাতা ইত্যাদি(ছবির কাজ শেষ হলে তার প্রত্যেকটি আমি লিস্ট মিলিয়ে ফেরত দিয়েছিলাম) এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছিল ওঁদের বিবাহিত জীবনের একদম শুরুতে, ওঁর স্ত্রী বুলা যখন কিছুদিনের জন্য বাপের বাড়ি নোয়ামুন্ডিতে গিয়েছিলেন, সেই বিরহকালে তাঁকে লেখা কবির একটি অতি ব্যক্তিগত প্রেমপত্রস্বদেশ সেনের অন্তর্লোকে অনেকটা আলো-ফেলা এই মূল্যবান চিঠিটার কিছু অংশ আমি সিনেমায় ব্যবহার করেছি। ধারাভাষ্যে পাঠ করে শুনিয়েছি চিঠিটা, আর সঙ্গে রাখতে হয়েছে প্রয়োজনীয় ভিশ্যুয়াল্‌স। এই চিঠিরই এক জায়গায় ব্যবহার করেছি আমার খুব প্রিয় ‘ওফেলিয়া’ (১৮৫২) ছবিটি। হ্যামলেটে বর্ণিত ওফেলিয়ার এই মৃত্যু দৃশ্যটিকে নাকি বলা হয় সাহিত্যের সবচেয়ে কাব্যিক মৃত্যুদৃশ্য, যা ক্যানভাসে তেলরঙে এঁকেছেন ব্রিটিশ চিত্রকর স্যার জন মিল্যে (John Millais)
   
এই সময়ে প্রাথমিক ও জরুরী দুটো কাজের একটা ছিল কবিতার ক্যাম্পের দীর্ঘদিনের পুরোনো অডিও টেপগুলোকে উদ্ধার করা। যাদবপুরের ‘স্টুডিও ইনফ্রেম’, যেখানে আমার ভয়েস-ওভার রেকর্ডিং করা হয়েছিল, তারাই করে দিয়েছিল পুরোনো ক্যাসেট থেকে উদ্ধারের কাজটা, যতটুকু সম্ভব তবে অনেক কিছুই আর ব্যবহারযোগ্য ছিল না। আরও একটা অসুবিধে হোল, আশির দশকে কৌরবের কবিতার ক্যাম্পগুলোয় যখন আমি রেকর্ডিং চালু করে দিতাম, তখন কিছু কথা যন্ত্রে পরিস্কার ধরেনি। বিশেষতঃ কমলদার তরুণ বয়সের তড়বড়ে বাচনভঙ্গির জন্যে। এই সমস্যার সমাধান করতে ছবির অনেক জায়গায় বাংলায় কথাবলার সাথে তার অনুলিখনকেও সাবটাইটেলে দেওয়া জরুরী হয়েছিল।        
      
দ্বিতীয় কাজটা ছিল স্বদেশ সেনের কবিতাসমগ্র বইটার সমস্ত কবিতা পড়ে ফেলা কোন কোন কবিতা, কখন কোথায় কিভাবে ব্যবহার করবো, তার একটা সম্পূর্ণ পরিকল্পনা। আমি এগারোটা কবিতা বেছে নিয়েছিলাম। ওঁর রোগশয্যা পর্ব শুরু হওয়ার মাত্র কয়েকমাস আগে, হঠাৎ কি মনে করে, আমি কলকাতা থেকে অফিসের কাজে জামসেদপুরে গিয়ে, এক গ্রীষ্মের ঘর্মাক্ত সন্ধ্যেবেলা ওঁর স্বকন্ঠে কবিতাপাঠ রেকর্ড করে এনেছিলাম। কন্ঠস্বর পরিস্কার নয়, তবু সেটাই কাজে লেগে গেছে।  আজ মনে হয়, ভাগ্যিস ওটা করা হয়েছিল। আসলে আশির দশকে কৌরবের সেই স্বর্ণযুগে, যার মধ্যে ছিল কৌরবের কবিতার ক্যাম্প এবং স্বদেশ সেনের মতো মহৎ কবির সাহচর্য, -আমার সবসময় মনে হোত এই সময়কাল জুড়ে তার সকল কর্মকান্ড ও তথ্যকে যতটা পারি প্রামাণ্য ও সংরক্ষিত করে রাখি, শব্দে-বর্ণে-চিত্রকলায়, রেকর্ডে, সেলুলয়েডে, আগামী কালের কোনও এক সময়ের প্রয়োজনে, কোনও এক আন্তরিক পাঠকের বা কোনও গবেষকের জন্যেও।             


৪  ফাইনাল কাট্‌ প্রো   
  
আলিপুরের স্টুডিও ‘ইমেজক্র্যাফট’-এ ছবির এডিটিং হয়েছিল ‘ফাইনাল কাট্‌ প্রো’ সফটওয়ারে, যাতে হলিউড বলিউডের বড় ছবিগুলোও করা হয়। একটা থাম্ব-রুল আছে যে, একঘন্টার সাধারণ ছবির জন্যে দেড়শো ঘন্টা লাগে এডিটিং টেবিলে। অর্থাৎ সোয়া দুঘন্টার ছবির লাগতে পারে প্রায় সাড়ে তিনশো ঘন্টা। সেই জায়গায় আমার পুরো ছবিটার জন্য স্টুডিও ভাড়া লেগেছিল মাত্র একশো বারো ঘন্টা। এর কারণ আমার বিশেষভাবে লেখা চিত্রনাট্য। এখানেই খরচ অনেকটা কমে গিয়েছিল। সমস্ত কম্পিউটার গ্রাফিক্স, ভিশ্যুয়াল আর্ট, এবং পরে ছবি-প্রদর্শনীর জন্য যাবতীয় পোস্টার, বিলবোর্ড ডিসপ্লে এবং ডিভিডি অ্যালবামের কভার, -সবই নিজে কম্পিউটারে ডিজাইন করেছিলাম
       
দৃশ্য-পরিকল্পনা করতে গিয়ে দেখা গেল, আরও অনেক ভিশ্যুয়ালস, স্টিল ছবির প্রয়োজন। নিজের ট্রাভেল অ্যালবাম থেকে তখন খুঁজে খুঁজে অনেক ছবি আর মুভিক্লিপ আমি বেছে নিয়েছিগোয়ালন্দে স্টীমারের ছবিটা আসলে সুন্দরবনের সজনেখালিতে রাতে লঞ্চ থেকে আমারই তোলা; সার্চলাইটের আলো কাঁপছে জলে। -এছাড়াও বেথলার জঙ্গলে রাতে হাতীর দাপাদাপি শুনে আমরা যখন জীপ নিয়ে বনপথে ঢুকেছিলাম, তখন সেই বিপুল হৈচৈয়ে আমার টেপ রেকর্ডার চালু থাকলেও চলন্ত জীপ থেকে অন্ধকারে ছবি তোলা যায়নি কিছুইসেই এপিসোডে তাই দিনের বেলায় তোলা জঙ্গলপথের ছবিকেই এডিট করে রাতের দৃশ্য তৈরী করা হয়েছিল। ভরদুপুরে তোলা ছবিকেও আমি এডিট করে জ্যোৎস্নারাতের এফেক্ট এনেছিলাম।    

এরকমই মজার ব্যাপার ছিল আরও অনেক জায়গায়। ক্যাম্পে একবার কথা হচ্ছিল বাংলা কবিতায় ইউরোপীয় কাব্য আন্দোলনের প্রভাব নিয়ে। ছিল ‘ওয়েস্টল্যান্ড’ কবিতার ‘লন্ডন ব্রীজ ইজ ফলিং ডাউন’ লাইনটাও। ঐখানে আমি লন্ডন ব্রীজের যে ছবিটা ব্যবহার করেছি সেটাও আমার ট্রাভেল অ্যালবামের।  

আমার প্রথম দেখা অনেক রাতের নির্জন লন্ডন ব্রীজ    

টাটাস্টীল যখন ইউরোপের ‘কোরাস’-কে অধিগ্রহণ করে, তার কিছু পরে কোরাসের সাথে একটা জরুরী রুদ্ধদ্বার মিটিংয়ে আমাকে লন্ডন যেতে হয়। মনে আছে, হিথরো এয়ারপোর্টের পাশেই একটা হোটেলে আস্তানা ছিল আমাদের। তিনদিন টানা মিটিংয়ের পরে ওখান থেকে বেরিয়ে, লন্ডন শহর না দেখেই দেশে ফেরার প্লেন ধরতে হবে ভেবে, আমার খুব মনখারাপ হয়েছিল। তাই  অনেক রাতে বন্ধুর গাড়িতে চেপে শহরের এক ঝলক দেখতে বেরিয়েছিলামবাকিংহ্যাম প্যালেসের পাশ দিয়ে টেম্‌্‌ নদীর ওপর দিয়ে বিখ্যাত টাওয়ার  ব্রীজ পার হওয়া ! অত রাতের নির্জন লন্ডন ব্রীজের সেই ভয়ার্ত ছবিটাই আমি রেখেছি সিনেমার ওই পর্বে         

কবিতার ক্যাম্পে যেসব যুক্তিতর্কের ছবি তোলা ছিল তাতে ক্যামেরার পেছনে আমি, আর বেশিটাই ছিল টেবিলে রাখা পানীয়ের গ্লাসের ছবি এবং প্লেটে কখনো ভাজা মাংস, সাথে গ্রিন স্যালাড। দীর্ঘ আলোচনার মধ্যে খাবারের প্লেট ক্রমশঃ খালি হয়ে উঠছে দেখানোর জন্যে আমাকে ওইসব স্টিলছবি থেকে ধীরে ধীরে কিছু মাংস ও স্যালাডকে স্রেফ ইরেজ করে দেখাতে হয়েছিল। এরকম ইরেজ করতে হয়েছিল চাঁদিপুর ক্যাম্পের একটা জায়গাতেও, যেখানে ভোরবেলা গোলঘরের দরজা খুলে বেরিয়ে এসে স্বদেশ সেন পায়ের কাছে একটা ঘুঘুপাখি ঘাড় গুঁজে মরে পড়ে আছে দেখেছিলেন। সেই দৃশ্যের কোনও ছবি তোলা ছিল না। এর অনেক বছর পরে, জামসেদপুরে, আমারই বাংলোর বাগানের ঘাসে মাঝেমাঝেই দুপুরের দিকে কয়েকটা ঘুঘু এসে বসতো। সেই ঘুঘুর ছবি থেকে পাখির মাথাটুকু জাস্ট ইরেজ করে মুছে দিয়ে চাঁদিপুর এপিসোডে মরা ঘুঘুর দৃশ্যে ব্যবহার করেছি। এগুলো না বলে দিলে ধরা যাবে না। 
                
তবে সবচেয়ে সমস্যায় পড়েছিলাম আমি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দিনগুলোতে বালক স্বদেশের সেই বরিশালের পর্বটা নিয়ে, যখন তিনি বাবা-মায়ের সাথে কিছুদিনের জন্যে ফিরে গিয়েছেন জন্মভূমি বারোইকরণ গ্রামে, যার গল্প শুনিয়েছিলেন আমায়। কিন্তু ঐ সময়ের কোনও ছবি ওঁদের পারিবারিক অ্যালবামে খুঁজে পাইনি -সেই পোনাবালিয়ার খালে কত নৌকো, জোয়ারে ঢেউ উঠতো বড় বড়। আর সরু সুতিখালগুলোয় একটার পর একটা সবুজ বাঁশের সাঁকো, সেই তালপুকুরের পাশে এক পরিত্যক্ত বুড়ির বাড়ি, এত অন্ধকার যে দিনের বেলাতেও ঝিঁঝিঁ ডাকতো। -আমি যদি তখন ভিসা পাসপোর্ট নিয়ে বাংলাদেশের গভীরে ছবি তুলতে যেতাম তবে ছবির খরচ বাজেট পেরিয়ে যেত, আর সময়ও লাগতো অনেক। সেই সময়ে অনুজ কবিবন্ধু রাজর্ষি চট্টোপাধ্যায় তার ব্যক্তিগত যোগাযোগে ওপার বাংলার এক বন্ধুকে দিয়ে এক ডজন স্টিলছবি আনিয়ে দেয়। বাংলাদেশ টিভির একটা টিম নাকি বরিশালের ওই অঞ্চলে তখন কাজ করছিল। আমাকে ফেসবুকে জানাতে হয়েছিল কোন কোন বস্তু বা কী ধরণের দৃশ্য আমার প্রয়োজনপরে আমাকে শুধু যোগ করতে হয়েছে জলের শব্দ, হাওয়ার শব্দ, ঝিঁঝিঁর ডাক। একটা গল্প ছিল, স্বদেশের বাল্যসাথী কমলাদির সাথে জঙ্গলে বনেবাদাড়ে ঘুরে বেড়ানোর কাহিনী, যে কমলাদি হঠাৎ একদিন রাত পোহালে কলেরায় মারা গিয়েছিল। এইসব দৃশ্য ও আবহ রচনা করতে গিয়ে কলকাতায় নরেন্দ্রপুরে আমার বাড়ির কাছেই ‘চিন্তামণি কর পাখিরালয়’-এ (কয়ালের বাগান) কিছু ভিডিও শ্যুট করেছিলাম; এভাবেই এসেছে বনবাদাড়ে কমলাদির সাথে হঠাৎ দেখা লাল জবা ফুল আর কাঠঠোকরা পাখিটা।  
                  
আরও ছিল। বরিশালের গ্রামের বাড়িতে সেই বালবিধবা পিসিমা, বালক স্বদেশ যাঁর কাছে রাতে রামায়ণ, মহাভারত আর দুর্গেশনন্দিনীর গল্প শুনতো। ছবিতে আমি যে দুর্গেশনন্দিনী বইটাকেই বেছে নিয়েছিলাম তারও একটা কারণ ছিল। বছর কয়েক আগে ডুয়ার্সে ঘুরতে ঘুরতে একদিন ময়নাগুড়িতে এসে গাড়ির ড্রাইভার বললো, চলুন আপনাদের জল্পেশ্বর শিবমন্দির দেখিয়ে আনি। তো সেই প্রাচীন নিরালা মন্দিরে পুরোহিতের উদাত্ত সুললিত কন্ঠে মন্ত্রোচ্চারণ উঁচু গম্বুজের ভিতরে ইকো ও রিভার্বের মিশ্রণে গমগম করে উঠেছিল, আমি সেটা রেকর্ড করে রেখেছিলাম ভবিষ্যতে কখনো কাজে লাগতেও পারে ভেবে। চিত্রনাট্য  লিখতে গিয়ে আমার মনে হোল, পিসিমার মুখে গল্প শোনার মধ্যেই ঢোকাতে হবে ওই মন্ত্রপাঠকিন্তু কীভাবে? 

আমি তখন বুকসেলফ থেকে দুর্গেশনন্দিনী নামিয়ে এনে খুঁজছি কোন প্রসঙ্গে আসতে পারে শিবস্তোত্রবইটার শেষ পাতা থেকে মন্দিরের সন্ধানে দ্রুত চোখ বুলিয়ে চলেছি ক্রমে সামনের দিকে। মাঝপথে প্রায় হাল ছেড়ে দিয়ে, বইয়ের শুরুতে। এবং রোমাঞ্চিত, শুরুতেই তো পেয়ে গেলাম গড় মান্দারণের পথে জঙ্গলের গভীরে শৈলেশ্বর শিবমন্দির, যেখানে প্রবল ঝড়বৃষ্টির সন্ধ্যায় পূজো দিতে এসে আটকে পড়েছে এক সুন্দরী কামিনী তার সহচরী  সহসা আগুয়ান দীর্ঘকায় এক অশ্বারোহী। - ওঃ, দারুণ, দুর্দান্ত ড্রামাটিক হতে পারে এর চিত্রায়ন! কিন্তু আমার হাতে তো শুধুই স্টিলছবি! হ্যাঁ, তাই  দিয়েও করা যায় অনেক কিছু, সেটাই একটা চ্যালেঞ্জ।     
              
কিছু কিছু ছবি আমি ব্যবহার করেছি যার ঐতিহাসিক মূল্য রয়েছে । যেমন, সেকালে জামসেদপুরে রাতের আকাশ ইস্পাত কারখানার গলিত স্ল্যাগের আলোয় আলোকিত হয়ে উঠতোএখন টেকনোলজি উন্নত হয়েছে, পৃথিবীতে আর কোথাও ইস্পাত কারখানায় আকাশ আলো-করা ‘বেসিমার কনভার্টার’ নেই, আর গলিত স্ল্যাগও সামান্যই ঢেলে ফেলা হয়। -সেরকমই আছে ঘাটশিলায় সুবর্ণরেখা নদীর খাঁড়িতে জেলেপাড়ার মেয়ে-বৌদের কাদাজল চেলে চেলে সোনা বের করে আনার ছবি। আছে কলকাতার সূর্য্য সেন স্ট্রীটে কৃষ্ণগোপাল মল্লিকদের ঐতিহাসিক বাড়িটা, আর জামসেদপুরের সাকচিতে ডাক্তার বিষ্ণু প্রসাদ ও পূরবী মুখোপাধ্যায়দের ঐতিহ্যময় দোতলা বাড়িও, যেখানে কলকাতা থেকে আসা অজস্র গুণীজন, সঙ্গীতের মহা মহা উস্তাদ, বিখ্যাত সব গায়ক, নাট্যকার, এবং প্রথম সারির কবি, সাহিত্যিক ও সম্পাদকের আড্ডার নানা কাহিনী আছে। এছাড়াও ছবিতে দেখা গেছে অলচিকি লিপির জনক পন্ডিত রঘুনাথ মুর্মুকে, তাঁর রায়রংপুরের বসত বাড়িতে আমরা যখন গিয়েছিলাম
  

৫  এই আকাশ সিংভূমের     
  
ছবির চিত্রনাট্য যখন অনেকটাই আয়ত্তের মধ্যে তখনও চিন্তা ছিল ওপেনিং টাইটেলগুলো কীভাবে দেখাবোসেখানে ঢুকিয়েছি বেথলার মিউজিয়ামে বাঘের স্কেলিটনের সামনে আমাদের বিস্মিত কথাবার্তার কিছু টুকরো। 


এছাড়া চিন্তা ছিল ছবির শুরু আর শেষ কীভাবে করা হবে, কারণ এর ওপরেই সম্পূর্ণ ছবিটার সৌন্দর্য ও আবেদন অনেকটা নির্ভর করবে ধারাভাষ্য নিয়েও কিছু চিন্তা ছিল। দীর্ঘ ছবিকে ধরে রেখেছে আমারই কন্ঠের ধারাভাষ্য, যার শুরুতেই আছে : “এই আকাশ সিংভূমের। এই পাহাড় নদী শাল-মহুলের জঙ্গল, এই রম্যভূমি কবিতার” -তো, প্রথমে ‘আকাশ’ শব্দের বদলে ছিল ‘লাল মাটি’। আমার ইচ্ছে ছিল, হাওড়া স্টেশান থেকে দুপুরের গীতাঞ্জলী এক্সপ্রেসে চেপে, ধলভূমগড় স্টেশান পেরিয়ে মুভিতে ধরবো, জানালার বাইরে বেলাশেষের আলোয় লালমাটির কার্পেটে মোড়া ছুটন্ত প্রান্তর আর  শালজঙ্গলের প্যানোরামা। সেই সাথে শুরু হবে ধারাভাষ্য। কিন্তু তার মানে তো যাতায়াতে বাড়তি বেশ কিছু খরচ ও ধকল, সবটাই একা একা। 

প্ল্যান বদলে নিয়ে আমি তখন ফিরে গেলাম ল্যাপটপে, আমার এতদিনের সঞ্চিত ট্রাভেল অ্যালবামের ভান্ডারে। হঠাৎই পেয়ে গেলাম আমারই হ্যান্ডিক্যামে তোলা কিছু মুভি, বছর দশেক আগে হেলিকপ্টার থেকে নেওয়া, সিংভূমের পাহাড়-নদী-জঙ্গলের ওপর দিয়ে জামশেদপুরের আকাশে আমি যখন ঢুকছি। টাটাস্টীলের ‘লজিস্টিক্স ও ইনফ্রাস্ট্রাকচার’ প্ল্যানিংয়ের দায়িত্ব নিয়ে বেশ কয়েকবার এরিয়াল সর্টিতে যেতে হয়েছে, নতুন কারখানার স্থান নির্বাচন অথবা কোথা দিয়ে নতুন রেলপথ বা সড়ক যোগাযোগ সম্ভব, সেইসব ঠিক করতে আকাশপথে চান্ডিল, রাজখরসোয়ান, চিরিয়া, গুয়া, মনোহরপুরের দুর্গম পাহাড়-জঙ্গলে নীচে ফরেস্ট-ফায়ারের ধোঁয়া। পাইলট ছিলেন এয়ার ফোর্সের এক রিটায়ার্ড স্কোয়াড্রন লিডার। আমার হাতে হ্যান্ডিক্যাম, ফ্লাইট প্ল্যান, নোটবুক। সেরকমই একটা ট্রিপে, ফেরার সময় হাতের ক্যামেরা একবার নিজেরই মুখের দিকে ঘুরিয়ে ধরেছিলাম। কেন জানিনা, এমনিই। সেই ছবিই আজ কাজে লেগে গেল। ধারাভাষ্যে ‘এই লাল মাটির দেশ’ সরিয়ে তখন লেখা হোল ‘এই আকাশ সিংভূমের, এই পাহাড় নদী শাল-মহুলের জঙ্গল...’।              

আশির দশকে কৌরবের কবিতার ক্যাম্পগুলোয় সাহিত্য, কবিতা, গান, চিত্রকলার কথায় মাঝে মাঝেই এসে পড়তো তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ, আর নিউক্লিয়ার ওয়ারফেয়ার নিয়ে আতঙ্কের কথা। বরাইবুরু ক্যাম্পে  আমাদের কথাবার্তায় আছে অ্যাটম বোমার প্রসঙ্গসিনেমায় ওই অংশটাকে একটু ড্রামাটাইজ করার জন্যে আমাকে একটা ১৪ সেকেন্ডের ভিশ্যুয়াল তৈরী করতে হয়েছিল, ওই অ্যাটম বম্ব বিস্ফোরণের। ইন্টারনেট ঘেঁটে পেয়েছিলাম বিস্ফোরণের পরে তোলা ‘মাশরুম ক্লাউড’-এর একটা  স্টিল ছবি, যেটা কপিরাইট ফ্রি বিখ্যাত জাপানী পরিচালক ‘ইমামুরা’  তাঁর  ‘ব্ল্যাক রেন’ সিনেমাতেও দেখিয়েছেন সেই দৃশ্য, তবে সেটা ছিল সাদাকালো ছবি 

এছাড়াও আমার পড়াছিল আমেরিকার ‘লস আলামোস’ প্রোজেক্টের শেষভাগে ‘ট্রিনিটি টেস্ট’-এর একমাত্র প্রত্যক্ষদর্শী বিজ্ঞানী ডিক ফেইন্‌ম্যানের লেখা বিবরণ।  হিরোশিমার আগে সেই ছিল প্রথম পরীক্ষামূলক অ্যাটম বম্বের বিস্ফোরণ। উনি সেই ‘টেস্ট এক্সপ্লোশান’ দেখেছিলেন কুড়ি মাইল দূর থেকে, সচক্ষে। ওঁর বিবরণে আছে, এক দিগন্তজোড়া উজ্জ্বল সাদা আলোর তীব্র ঝলক, যা ক্রমে হলুদ থেকে কমলা রঙে টার্ন করে বিরাট কুন্ডলি পাকিয়ে ব্যাঙের ছাতার চেহারা নিয়ে ধীরে বহুদূর আকাশে উঠে যাচ্ছে। এর প্রায় দেড় মিনিট পরে সহসা ভয়ঙ্কর সেই লাউড ব্যাং, ক্রমে যা গুড়গুড় রাম্বলিং শব্দে আলোড়িত হয়েছিল - এই মতো আমি প্রথমে পর পর তিনটে ক্রমান্বয়ে সাদা-কালো-সাদা ফ্রেমকে এক ঝলকে রেখে, তার পরেই আমার  স্টকের সেই সাদাকালো ছবির ঊর্দ্ধভাগে কমলা রঙ রেখে, তার ওপর ক্যামেরাকে নীচে থেকে ভার্টিক্যালি স্লো টিল্ট-আপ ক’রে, ক্লোজ-আপে ধরলাম। তবে ওই তীব্র লাউড ভয়ঙ্কর আওয়াজের বদলে সাউন্ড ট্র্যাকে এনেছিলাম বজ্র-বিদ্যুতের সময় নিজেরই টেপ করা একটা দীর্ঘ রাম্বলিং সাউন্ড। সব মিলিয়ে চোদ্দ সেকেন্ডের একটা অডিও-ভিশ্যুয়াল এফেক্ট ।   
         
কবিতার ক্যাম্পের এক জায়গায় স্বদেশ সেন ও আমি আলোচনা করেছিলাম যে বাংলা কবিতা নষ্ট হয়েছে সহজ হতে গিয়েআমরা চেয়েছিলাম কবিতায় ফিরিয়ে আনতে তার রহস্যময়তা। এই বিশাল বিশ্ব-প্রকৃতির গভীর স্তরে স্তরে যেমন লুকিয়ে আছে তার অসীম জটিলতার সৌন্দর্য কবিতাকেও চলে যেতে হবে এক নতুন ও গভীর জটিলতার দিকে। চিত্রনাট্যের এইখানে আমি দেখাতে চেয়েছি প্রকৃতির সেই জটিল সৌন্দর্যের এক ঝলক। পনেরোটা বিভিন্ন দৈর্ঘ্যের পেন্ডুলামকে পাশাপাশি দুলিয়ে দিয়ে দেখা, -কীভাবে ক্ষণে ক্ষণে রচিত হয় বিশৃঙ্খলা, কেওস ক্রমে সেখান থেকেই পুনরায় নির্মিত হয়ে ওঠে এক ছন্দিত নতুন সুন্দর -এমনটা তো হতে পারে কবিতাতেও এই ল্যাবরেটরি এক্সপেরিমেন্টটা আসলে   তৈরী করেছিল আমেরিকায় হার্ভার্ড সায়েন্স ল্যাব। আমার কাছে ছিল তার মুভি ক্লিপ। আমি ওঁদের চিঠি লিখে ছবিতে এটা ব্যবহারের অনুমতি চাইলে, Dr.Wolfgang Rueckner আমায় সানন্দে সম্মতি জানিয়ে চিঠি দিয়েছিলেন  

                        
৬  মুনলাইট সোনাটা    
    
শব্দেরও একটা বড় ভূমিকা রাখতে চেয়েছিলাম এই ছবিতে। একটা সাউন্ডস্কেপ, যার বেশিটাই প্রাকৃতিক শব্দমালা। সিংভূমে নদীরও অনেক নাম-- খরকাই, কারো, কোয়েল, সুবর্ণরেখা। তার জলের শব্দ। পত্রমোচী বনের গভীরে উদভ্রান্ত হাওয়ায় যে মর্মরধ্বনিআদিবাসী গ্রামে ভোরের মোরগের ডাক। পাখির কলতানে মুখর ভোরবেলা। অরণ্যপথ দিয়ে চলে যাওয়া ট্রেনের বাঁশির শব্দসারা ট্রেন জুড়ে আদিবাসী রমণীকন্ঠের উদ্দাম কোরাস। আর একদিন পূর্ণিমা-রাতে যেমন বেজে উঠেছিল বিঠোফেনের ‘মুনলাইট সোনাটা’।       
                
যাদবপুরের স্টুডিওয় ধারাভাষ্য রেকর্ডিঙের আগে আমার দুটো চিন্তা ছিল মন জুড়ে। তার এক নম্বরে ছিল,   নীচের একটা দাঁত পড়ে যাওয়া এবং পাশে দ্বিতীয় দাঁতটাও নড়তে শুরু করেছে, এই দন্তহীনতা নিয়ে আমি স্পষ্ট উচ্চারণ করবো কীভাবে ? দ্বিতীয় প্রশ্ন হোল, এই টানা ধারাভাষ্যে আমার গলার স্বরের স্কেল কী হবে ? স্কেলের এক প্রান্তে আছে ন্যাট-জিওতে যে ভাবে চাপা হাস্কি ভয়েস চলে, আর অপর প্রান্তে আছে সেকালের আকাশবাণীতে যেভাবে সংবাদপাঠক দেবদুলাল পেশ করতেন তাঁর কন্ঠকে। অনেক ভেবে একটা মাঝামাঝি জায়গায় রাখা হোল ভয়েস। স্টুডিওতে রেকর্ডিঙের সময় সঙ্গে ছিল নাট্যকার বন্ধু অরিন্দম গুপ্ত (বাবলা), এবং কি আশ্চর্য, সামান্য ভয়েস টেস্টিঙয়ের পর, দুয়েকটা কারেকশান ছাড়া, অত দীর্ঘ ধারাভাষ্য, টানা এক টেকেই সম্পূর্ণটা OK.  
     
আর আশ্চর্য বাঁশি বাজাতো বাবলা। মাত্র একদিনের নোটিশে ধুলোটুলো ঝেড়ে তার পুরোনো আড় বাঁশিটা নিয়ে সটান স্টুডিওতে। কথামতো পর পর তিনটে পিস বাজিয়ে গেল সে, রাগ পাহাড়ি, পিলু আর ইমন। এগুলোকেই আমি ছবির নানা অংশে ব্যবহার করেছি। এর সাথে প্রয়োজন ছিল ভায়োলিন, গীটার আর পিয়ানোতে কিছু কাজ বাবলা বললো আকাশবাণীর ‘এ’-গ্রেড আর্টিস্ট পাওয়া যেতে পারে, কিন্তু পয়সা লাগবে। আমি বললাম, এমন একটা ছবিতে যারা বিনা পয়সায় কাজ করবে শুধু তাদের কথাই ভাবতে চাইফেসবুক থেকে যোগাযোগ করলাম আমেরিকার পীটসবার্গে আশিক খুদাবক্স-এর সাথে। আশিক সফটওয়্যার  ইঞ্জিনীয়ার, সিঙ্গার, মিউজিশিয়ান। ছবির মুড বোঝাতে আমি একটা ছবি পাঠিয়েছিলাম, -প্রাচীন কাঠের ফুটব্রিজের নীচে কুলকুল শব্দে বয়ে চলেছে একটা পাহাড়ী স্রোতা— মালঙ্গী ঝোরা, ডুয়ার্সএকটা ছন্দিত উত্তেজনা। -তিনমাস পরে ও আমাকে মেইল করে পাঠিয়েছিল ভায়োলিনে বাজানো একটা পিস। 

এভাবেই পিয়ানোর জন্যে লিখেছিলাম সিনিসিনাটিতে আর্যনীলকে। শুনেছিলাম ওর কিশোর ছেলে (ঋক) তখন পিয়ানো শিখছে। আমি একটা ছোট পিস, একটা সোনাটিনা, চাইছিলাম কবিতার ক্যাম্পে ব্যবহারের জন্য ; সেই পর্বের মুডকে বোঝাতে লিখেছিলাম :
 

 "খুব ভোরে যখন লাল সূর্য উঠছে সমুদ্রের ওপরে, তখন সৈকতে ঠান্ডা বালির ওপরে আস্তে আস্তে ধীর লয়ে ছোট ছোট ঢেউ এসে ভেঙ্গে পড়ছে; সেই শান্ত আলোকিত সেটিং- দাঁড়িয়ে পিয়ানিস্ট নিজের মনে তৈরী করে বাজিয়ে তুলছে একটা শান্ত কম্পোজিশান; সে যেন আবাহন করছে একটা নতুন দিনকে।  এই কম্পোজিশানটা উন্মুক্ত অর্থাৎ ওপেন-এন্ডেড হবে, যাতে এটাকে লুপিং করে ক্রমান্বয়ে দীর্ঘ করা যায় প্রয়োজন হলে।”   

এরকমই মাত্র একদিনের নোটিশে কয়েকটা দারুণ সুন্দর পিস গীটারে বাজিয়ে পাঠিয়েছিল আমার অনেক দিনের পুরোনো বন্ধু প্রদীপ চট্টোপাধ্যায়, -বিখ্যাত বাংলা ব্যান্ড ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’-র বুলা। আমি শুধু টেলিফোনে ওকে সিচুয়েশানটার একটু আউটলাইন দিয়েছিলাম। ছবির শেষে, একদম শেষ পর্বে, যেখানে একটা কাব্যিক মন্তাজ তৈরী করা হয়েছে পরপর স্টিলছবি ও কবিতার লাইন দিয়ে, সেখানে আবহসঙ্গীতে দারুণ মেজাজ এনেছিল বুলার গীটারের ওই কর্ডগুলো। 


প্রায় চারশো স্টিলছবি, ফটোগ্রাফ এবং স্কেচ, ব্যবহৃত হয়েছে এই ছবিতে। কিছুটা মুভিও। এই সমস্ত ছবির প্রত্যেকটার পেছনেই লুকিয়ে আছে এক একটা নিজস্ব গল্প। সেসব লিখতে গেলে একটা গোটা বই হয়ে যেতে পারে
কিছু কিছু ট্রিক শটও তৈরী করতে হয়েছে কম্পিউটারে। যেমন, কবিতায় যেখানে আছে ‘শুকনো জলের শুকিয়ে আসাই এক বিষয়’, সেখানে এক ঝলকে দেখানো হয়েছে ভরন্ত গঙ্গানদী কিভাবে শুকিয়ে জলশূন্য হয়ে পড়ে আছে। আর এক জায়গায়, কবিতার ক্যাম্পে ভোর হওয়ার দৃশ্যে দেখানো হয়েছে, যেন মহাকাশ থেকে দেখা যাচ্ছে, ঘুর্ণায়মান পৃথিবীর দিগন্তরেখায় কিভাবে সূর্যোদয় হচ্ছে। তার সাথে স্বদেশ সেনের কবিতাপাঠ, “ফুটকি নয়, এই বেশ, এই আমাদের সূর্য...”। আমার ল্যাপটপে সম্পূর্ণ সৌরমন্ডলের যে মডেল আছে সেখানে সিমুলেট করে তৈরী করেছিলাম ওই দৃশ্যটা। 

     
৭  দীপমালা, ঘণ্টাধ্বনি ও সমুদ্রঢেউ

স্বদেশ সেনের প্রথম কবিতা বেরিয়েছিল পরিচয় পত্রিকায়, কিন্তু সেটা ওঁর জামসেদপুরের বাড়িতে খুঁজে পাওয়া যায়নিযেমন পাওয়া যায়নি ননী ভৌমিক কৃত রাশিয়ান ভাষায় স্বদেশের কবিতার অনুবাদগুলোতবে এস্পানিওল ভাষায় ওঁর কিছু কবিতা অনুবাদ করেছে তরুণ কবি শুভ্র বন্দোপাধ্যায়, যা স্পেনের ‘লা পারেদ দ্য আগুয়া’-নামক একটি সংকলনে প্রকাশিত হয়। শুভ্রর কন্ঠে তারই একটা কবিতাপাঠ আমি রেখেছি এই ছবিতে। আমার অনুরোধে, মাত্র দুদিনের মধ্যে দিল্লী থেকে শুভ্র সেই কবিতাপাঠ রেকর্ড করে পাঠিয়েছিল। ‘লা মানজানা এস্তা দুর্মিয়েন্দো’, -‘আপেল ঘুমিয়ে আছে’। পরে অনেকে প্রশংসা করেছেন বাংলা ছবিতে বিদেশী ভাষায় অনুবাদ পাঠ শোনানোর এই পরিকল্পনা, স্বয়ং অনুবাদকের কন্ঠে।   

আপেল ঘুমিয়ে আছে (লা মানজানা এস্তা দুর্মিয়েন্দো)        

তবে চিত্রনাট্যকে অনেক সময়েই চালিত করেছে আমারই সংগ্রহে থাকা নানা সময়ের অডিও ক্লিপ ছবির একেবারে দুই প্রান্তে, শুরুতে ও শেষে, যেমন ব্যবহার করেছি। একদম শুরুতেই আছে একটা বুদ্ধবিহারের সুরেলা স্তবগান। খুব সুন্দর সেই চ্যান্ট, আমি তার অর্থ বুঝিনি, রেকর্ড করেছিলাম বারাণসীর সারনাথ-এ, মহাবোধি বুদ্ধমন্দিরে। সিনেমায় সেই আবহসঙ্গীতের সাথে দৃশ্যে ধরা আছে হৃষিকেশ-এ প্রবাহিত গঙ্গার   ছবি, যে হৃষিকেশ নিয়ে কবিতায় স্বদেশ লিখেছিলেন “স্বচ্ছ নদী অসি হেন ধারা, মূলে মধ্যে জল রতি রতি...”। সেই দিয়েই ছবির শুরু।   
           
আর ছবির একদম শেষ দৃশ্যে কবির মৃত্যুসংবাদের পরে, দৃশ্য-কাব্য-সুরের মন্তাজ পেরিয়ে, বরিশালের খালের ওপর সবুজ বাঁশের পোল পেরিয়ে-- যেমন ওঁর কবিতায় আছে “শুধু এই চলে গিয়ে থেমে যাওয়া কোন / সবুজ পোলের কাছে”-- সেখানে দিনশেষের আঁধারে একটা প্রদীপশিখা ক্রমে উজ্জ্বল শত শত প্রদীপ হয়ে উঠলে তার ওপর খুব ধীরে টিল্ট করে এগিয়ে গিয়েছে ক্যামেরাআবহে একটা টিবেটান ঘন্টাধ্বনির অনুরণন আর সমুদ্রের ঢেউ এসে ভেঙ্গে পড়ছে সৈকতে, -সেই শব্দমালাঠিক তখনি শুরু  হচ্ছে একটা কবিতাপাঠ, যার প্রত্যেক লাইন প্রথমে এক পুরুষকন্ঠে এবং পুনরায় সেটাই বলছে এক শিশুও,  -“রেখো মা দাসেরে মনে, এ মিনতি করি পদে...”এই পিসটা আমার পাঁচ বছরের শিশু কন্যাকে সাথে নিয়ে নেহাৎই খেলাচ্ছলে রেকর্ড করেছিলাম প্রায় তিরিশ বছর আগে ; আজ এতদিন পরে সেটা কাজে লেগে গেল। এডিটিং স্টুডিওতে ছবির এই শেষ অংশে কাজ করতে গিয়ে রোমাঞ্চিত হয়েছিলেন সম্পাদকও। আর আমিও কিছুটা স্বস্তি পেলাম যে, যাক, ছবির শেষটা তাহলে সত্যিই শেষ করা গেল।    
          
সেন্সর বোর্ডে রাখা হয়েছে কমলালেবু ছবি স্ক্রিনিং-এর দিন পুরো ছবিটা দেখার পরে বোর্ডের সদস্যরা খুব প্রশংসা করেছিলেন। বলেছিলেন, প্রিমিয়ার বা কোনও প্রদর্শনীতে আরেকবার ছবিটা দেখার ইচ্ছা রয়েছে ছবির সেন্সর সার্টিফিকেট পাওয়া গিয়েছিল ৪-মার্চ ২০১৫তে, অর্থাৎ ছবি শুরুর কথা ঘোষণা করার (১৮ মে ২০১৪) দশ মাস পরে। আর ছবি তৈরী, সেন্সর, এবং নন্দনে প্রদর্শনী, সব মিলিয়ে খরচ পড়েছিল বাজেটের এক লাখের চেয়েও কম, -মোট পঁচাত্তর হাজার টাকা।        

নন্দনে ছবির প্রিমিয়ার হয়েছিল বুধবার ১৩ মে, ২০১৫। ছবি শেষ হলে দেখেছিলাম দর্শকের স্বতঃস্ফুর্ত হাততালি আর উচ্ছ্বাস, এবং প্রিন্ট মিডিয়াতেও, -অপূর্ব ছবি, বাকরুদ্ধ, মন্ত্রমুগ্ধ, ইত্যাদি। আর্যনীল মুখোপাধ্যায় চিঠিতে লিখেছিল, ‘ভীষণ সুন্দর ধারাভাষ্য’ এবং ‘শব্দের দারুণ কাব্যিক ব্যবহার’। এছাড়া অনেক তরুণ আমায় পরে লিখে জানিয়েছে যে, কৌরব নিয়ে অনেক ভুল ধারণা ভেঙ্গে গেছে এই ছবি দেখে। ছবিটা দেখার পরে কবি ও প্রাবন্ধিক সমীর রায়চৌধুরী বলেছিলেন :  ‘নগর কলকাতার কবিদের চিরাচরিত আর্বানিটির বাইরে, এই প্রথম একটা রুরাল ব্যাপার, একটা প্রান্তিক ব্যাপার তুমি দেখাতে পেরেছো। এই যে পুরো সিংভূমকে জড়িয়ে, সমস্ত পরিবেশটাকে নিয়ে, কবি ও কবিতাকে সম্পর্কিত করে দেখানোর কাজটা করেছো তুমি, যা শুধু অক্ষরের মধ্যে সীমিত নয়, এটা একটা  বিশাল ব্যাপার। এটা অন্য কারো পক্ষে করা সম্ভব নয়’।
  
কমলালেবুর বাগানে এভাবেই কেটে গিয়েছে আমার একটা বছর ; রোমাঞ্চে, শিহরণে, শ্রমে, শিক্ষায় । কতবার ক্ষোভে হতাশায় ভেঙ্গে পড়েও উঠে দাঁড়িয়েছি। মনে পড়েছে সেই মহৎ উপদেশ, -‘অ্যাপার্ট ফ্রম মেনি আদার কোয়ালিটিস, এ ফিল্ম ডাইরেক্টর মাস্ট হ্যাভ টন্‌স অফ পেসেন্স’।   



                             -------------------------------------