শংকর লাহিড়ী
যেসব পাতা খুব সুন্দর দেখতে, যেমন রিমির প্রিয় অশ্বত্থ, আমার প্রিয় বট।
কিংবা যখন প্রাকবসন্তে গাছে গাছে সহসা ফুটে ওঠে তামা রঙের অজস্র কচি পাতা। মনে পড়ে
পালামৌয়ের জঙ্গলে, শাল-সেগুনের রাশি রাশি ঝরাপাতা মাড়িয়ে আমি গান গেয়েছিলাম- বসন্ত
জাগ্রত দ্বারে। হয়তো তাকে, সেই অরণ্যভূমিকে, বিড়ম্বিতই করেছি।
কিন্তু মেপল পাতার সৌন্দর্য অন্য রকম। তাকে প্রথম
দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম আমেরিকার মিশিগানে। তার আকার, তার ঝরে পড়া, তার ফ্লাইট। মৃদু বাতাসে ঘুরে
ঘুরে মাটিতে নেমে আসা। ক্যানভাস জুড়ে তার কত আয়োজন ; চক, প্যাস্টেল,
অয়েল। কমলা, হলুদ, বাদামি, লাল, বেইজ,
মভ, পার্পল, সিয়েনা,
হানি। মাইল মাইল ল্যান্ডস্কেপকে একবার এমনই ঝংকৃত হয়ে উঠতে
দেখেছিলাম, আকাশ থেকে নীচে তাকিয়ে, ডেট্রয়েট এয়ারপোর্টে
নামার আগে লুফ্ৎহান্সার ফ্লাইটে। সেই ছিল একটি আন্তর্জাতিক সভায় পেপার পেশ করতে
আমার প্রথম আমেরিকা যাত্রা। মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের বিস্তীর্ণ উদ্যানের সবুজ
ঘাসের নির্জন জাজিমে কত রঙের মেপল পাতা ঝরে পড়ে আছে। প্রত্যেকটি পাতা যেন এক একটি রঙের
কবিতা, আর সমগ্র বনাঞ্চল এক কাব্যগ্রন্থ।
এই মেপল পাতা নিয়ে পাশ্চাত্য দেশে অনেক কবিই কবিতা
লিখেছেন। আমাদের উত্তরাখন্ডের কুমাউনে অথবা দার্জিলিং ও সিকিমে যেমন রডোডেনড্রন
গাছের রস থেকে পানীয় প্রস্তুত হয়, তেমনই ওদেশে পাওয়া যায় মেপল
গাছের সিরাপ। সম্প্রতি আমার বোন এই অতিমারির মধ্যেই নিউইয়র্ক থেকে ঘুরে এসে আমাকে
এনে দিয়েছে ওই মেপল সিরাপের এক লিটারের একটা বোতল। সন্ধেবেলা তারই এক সিপ মুখে
নিয়ে মনে হোল, মধু + নলেন গুড় + ভারী কাঠের হালকা গন্ধ
বুঝি মিলেমিশে আছে। সেই তরলের রং রক্তিম প্রবালের মতো (নীচের ছবিতে)।
তবে আজকের এই পোস্ট শুধুই মেপল সিরাপের বর্ণ-গন্ধ-স্বাদ
নিয়ে নয়। সিরাপের সুত্র ধরে, এখান থেকেই আমি কবেকার এক
আমেরিকান ইমেজিস্ট কবির কাছে পৌঁছে গেলাম। মহিলার নাম এমি লোয়েল (১৮৭৪-১৯২৫)।
বাংলার তরুণ কবিরা, যাঁরা ইংরেজি সাহিত্য ও কাব্য আন্দোলন
নিয়ে অনেক পড়াশোনা করেছেন, নিশ্চয়ই পড়েছেন এমিকেও। আমি তো
পড়িনি আগে, আজ নিজেই তাঁকে, তাঁর
মেপল পাতার কবিতাকে, আবিষ্কার করলাম। আমেরিকার উত্তরপূর্ব কোণে,
আটলান্টিক সাগরের উপকূলে সিডার আর মেপল গাছে ছাওয়া কয়েকটি রাজ্যজুড়ে সপ্তদশ শতকের ব্রিটিশ
ইমিগ্রান্টদের নিয়ে গঠিত যে নিউ ইংল্যান্ড অঞ্চল, যার মধ্যে আছে ম্যাসাচুসেটস,
বোস্টন ইত্যাদি, এমি ছিলেন সেই নিউ ইংল্যান্ড অ্যারিস্ট্রোক্র্যাট সমাজের একজন।
প্রভূত ধনসম্পদ, সৌখিন, স্পষ্টবক্তা, চুরুট খেতেন খুব। বিছানায় নাকি ষোলোটা বালিশ নিয়ে শুতেন। অভিনেত্রী এডা রাসেলের সাথে
তাঁর সমকামী সম্পর্ক, তাঁকে নিয়ে এমি লিখেছিলেন অনেক প্রেমের
কবিতা।
১৯১৫ সালে ইমেজিস্ট কবিতার আন্দোলনের প্রচারে তিনি
লন্ডনে এসেছিলেন। এজরা পাউন্ড ভেবেছিলেন, এমি বোধহয় তাঁদের
কাব্য-আন্দোলনকে হাইজ্যাক করতে এসেছেন। লন্ডনের রাজপথে দুইজন সুসজ্জিত শোফার নিয়ে
ঝলমলে পোশাকে মালবেরি রঙের গাড়ি হাঁকিয়ে চলেছেন এমি ;
ঠোঁটে তার প্রিয় সিগার, ধূমায়িত। ডি এইচ লরেন্সের কবিতার
স্বপক্ষে ছিলেন এমি, কিন্তু এজরা পাউন্ডের অকারণ দাদাগিরির বিরুদ্ধ্বে মতপ্রকাশের
স্বাধীনতা চেয়েছিলেন। এইনিয়ে মতান্তর হলে পাউন্ড তাঁর প্রতি বিরূপ হয়ে পড়েন। তাঁর
আন্দোলনকে ‘এমি-জিসম’ (Amy-gism) বলে ব্যঙ্গ করতে শুরু করেন। এইসব নিয়ে সারাজীবন,
এমনকি মৃত্যুর পরেও এমিকে নিয়ে নিন্দুকেরা
হাসিমস্করা করে গেছে। এমি দুঃখ করে লিখেছিলেন- যদি কেউ ব্যতিক্রমী হয়, তবে সে
প্রতিভাবান হলেও অবিবেচক পৃথিবীর কাছে মূল্য চোকাতে হয় তাকে। ‘The stigma of
oddness is the price a myopic world always exacts of genius’। যথেষ্ঠ পৃথুলা
বলে, কবিরা কেউ কেউ তাঁকে আড়ালে ‘হিপোপোয়েটেস’ (Hippopoetess) বলতেন।
বড়মাপের কবি না হলেও কবিতার জন্য ১৯২৬ সালে
মরণোত্তর পুলিৎজার পুরস্কার পেয়েছিলেন এমি লোয়েল। এমির কবিতায় ছিল জাপানী কবিতার প্রভাব
; বিশেষতঃ খুব ছোট দুতিন লাইনের কবিতাগুলো।
খুব কম কবিই জাপানী কবিতার সৌন্দর্যকে এভাবে ইংরিজি কবিতার সাথে যুক্ত করতে
পেরেছিলেন। এই বিষয়ে এমির খুবই প্রশংসা করেছিলেন পোয়েট্রি ম্যাগাজিনের প্রতিষ্ঠাতা
হ্যারিয়েট মনরো। বলেছিলেন, বারবার পড়তে হয় ওঁর ছোট কবিতাগুলো। যত ছোট তারা, ততই
সুন্দর।
এখানে আমি উদ্ধৃত করলাম ওঁর লেখা প্রিয় কয়েকটি ছোট
কবিতা। একশো বছর আগে, মেপল গাছের ছায়ায় বসে লেখা। নিউ
ইংল্যান্ডের সেইসব ঝরাপাতার রঙ, মেপল সিরাপের গন্ধ, স্বাদ।
1
Upon the maple leaves
The dew shines red,
But on the lotus blossom
It has the pale transparence of
tears.
মেপলপাতার ওপরে
শিশিরবিন্দুরা যেমন উজ্জ্বল রক্তিম,
অথচ তারাই পদ্মপাতায়
স্বচ্ছ বিবর্ণ কয়েক অশ্রুবিন্দু যেন।
2
As I crossed over the bridge of Ariwarano
Narihira,
I saw that the waters were purple
With the floating leaves of maple.
আরিওয়ারানো সেতু পার হয়ে আমি দেখেছি
ভাসমান মেপলপাতায় জলের রঙ
কেমন নীলাভ রক্তিম।
3
Golden peacocks
Under blossoming chery-trees,
But on all the wide sea
There is no boat.
কুসুমিত চেরি-গাছের নীচে সোনালি ময়ূরেরা,
অথচ বিপুল সমুদ্রজুড়ে
একটাও নৌকো কোথাও নেই।
4
Beyond the porcelain fence of the pleasure
garden,
I hear the frogs in the blue-green rice-fields;
But the sword-shaped moon
Has cut my heart in two.
প্রমোদ-কাননের নিরেট প্রাচীরের ওপারে,
সবুজ-নীল ধানজমিতে আমি শুনি
ব্যাঙেরা ডাকছে ;
কিন্তু ওই কৃপাণের মতো বাঁকা চাঁদ
দ্বিখন্ডিত করেছে আমার হৃদয়।
5
On the floor of the empty palanquin
The plum petals constantly increase.
আরোহীহীন পালকির পাটাতনে
অবিরাম জমে উঠছে প্লাম ফুলের পাপড়িগুলো।
6
Coming to you along the Nihon Embankment
Suddenly the road was darkened
By a flock of wild geese
Crossing the moon.
নিহনের বাঁধ ধরে আমি আসছিলাম তোমার কাছে
সহসা অন্ধকারে ঢেকে গেল পথ
যখন এক ঝাঁক বুনো হাঁস
চাঁদকে আড়াল করে উড়ে গেল।
7
When I hear your runners shouting:
“Get down! Get down!”
Then I dress my hair
With the little chrysanthemums.
যখন শুনি তোমার পদাতিকরা চেঁচিয়ে বলছে :
‘নেমে যাও, নেমে যাও”
তখন আমি ছোট ছোট চন্দ্রমল্লিকা ফুল দিয়ে
আমার কবরী সাজাই।
8
If I could catch the green lantern of the
firefly
I could see to write you a letter.
যদি জোনাকির সবুজ লন্ঠনটিকে ধরতে পেতাম আমি
হয়তো একটা চিঠি লিখতে চাইতাম তোমাকে।
9
Like black ice
Scrolled over with unintelligible patterns
by an ignorant skater
Is the dulled surface of my heart.
কাচের মতো স্বচ্ছ বরফের ওপর
যেমন অর্থহীন আঁকাবাঁকা দাগ কেটে যায়
কোনও আনকোরা স্কেটার,
আমার অবসন্ন হৃদয় ঠিক তেমনই।
10
When I am alone,
The wind in the pine-trees
Is like the shuffling of waves
Upon the wooden sides of a boat.
যখন আমি একান্ত একা,
পাইনবনে হাওয়া ওঠে,
যেন তারা কাঠের নৌকোর গায়ে
আছড়ে পড়া এলোমেলো ঢেউ।
প্রায় একশো বছর কেটে গেছে। এমি লোয়েল রয়ে গেছেন
একান্তে একাকি, চিরবিশ্রামে ; ম্যাসাচুসেটসের কেম্ব্রিজে, মাউন্ট অবার্ন সেমেটারির
মাটির নীচে, কবরে। আমি আজ তাঁর কবিতার অনুবাদ করছি, আর একান্তে স্বাদ নিচ্ছি
প্রবালের মতো রক্তিম মেপল সিরাপের। মনে পড়ছে মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘাসের ওপর আমাকে
ঘিরে ঘিরে একদিন ঝরে পড়েছিল কত রঙের মেপল পাতারা। কমলা, হলুদ, বাদামি, লাল,
বেইজ, মভ, পার্পল,
সিয়েনা, হানি।
[First published in the web journal 'Irabotee' in October 2020]