Wednesday 26 February 2020

'আত্মপরিচয়' - কবি বিনয় মজুমদার।




কৈশোর থেকেই আমি কবিতা লিখতে শুরু করি প্রথম কবিতা যখন লিখি তখন আমার বয়স তের বছর নানা কারণে এই ঘটনাটি আমার এখনো স্পষ্ট মনে আছে কবিতাটির বিষয়বস্তু ছিলো এই : এক পালোয়ান বাজি ধরে একটি চলন্ত মোটর গাড়িকে টেনে পেছিয়ে নিয়ে এলো এর পরেও আমি মাঝে মাঝে কবিতা লিখতাম কিন্তু, ষোল সতেরো বছর বয়স পর্যন্ত কী লিখেছিলাম, কবিতাগুলির দশা কী হয়েছিল কিছুই এখন আর মনে নেই তখন কলকাতার স্কুলে পড়ি মাস্টারমশাইরা ঘোষণা করলেন যে স্কুলের একটি মাগাজিন বেরোবে ছাত্রদের কাছে লেখা চাইলেন আমি একটি কবিতা লিখে ফেললাম; তার একটি পঙক্তি এখনো মনে আছেভিজে ভারি হলো বেপথু যুথীর পুষ্পসার মাস্টারমশাই-এর হাতে নিয়ে দিলাম তিনি পড়ে উচ্ছসিত প্রশংসা করলেন কিন্তু, কী জানি কেন, সে ম্যাগাজিন আর শেষ পর্যন্ত বেরোলো না এর পরবর্তী সময়কার কবিতা লেখার ব্যাপার একটু বিশদভাবেই আমার মনে আছে স্কুল ছেড়ে কলেজে এসে ভর্তি হলাম এবং আমার কবিতা লেখার পরিমাণও কিছু বাড়লো আমার একটি খাতা ছিলো ডবল ক্রাউন সাইজের, চামড়ায় বাধানো, কাগজের রঙ ইটের রঙের মতো খাতাটি খুব মোটা আমার সব লেখাই এই খাতায় লিখতাম স্কুলে কবিতা লিখতাম কচিৎ কদাচিৎ কিন্তু কলেজে উঠে নিয়মিত লিখতে শুরু করি লিখতাম বেশ গোপনে গোপনে, যাতে কেউ টের না পায় কারণ আমি কবিতা লিখি-কথা কেউ বললে খুব লজ্জা হতো আমার কলেজের হোস্টেলে থাকতাম ফলে অন্যান্য আবাসিকরা শীঘ্রই জেনে ফেললো যে আমি কবিতা লিখি 

আমার ঘরে দুটি সিট ছিল আমার রুম-মেটই বোধ হয় ফাস করে দিয়েছিলো খবরটা আমাদের রান্নাঘরের দেওয়ালে একটি নোটিশ বোর্ড লাগানো ছিলোহোস্টেল কর্তৃপক্ষের নোটিশগুলি ঐ বোর্ডে আঠা সেঁটে দিয়ে দেওয়া হতো কিছুদিনের ভিতরেই ঐ নোটিস বোর্ডে আমার লেখা কবিতাও সেঁটে দিতে লাগলামসবগুলিরই বিষয়বস্তু হোস্টেলের খাবার-দাবার সম্বন্ধে ছাত্রদের অভিযোগ সবই হোস্টেলের সহকারী সুপারিনটেনডেন্ট সম্পর্কে লেখা ব্যঙ্গ কবিতা পড়ে ছাত্ররা কিংবা সুপারিনটেনডেন্ট যে প্রশংসা করতো তা নয় ডালে কেন ডাল প্রায় থাকেই না, কেবল জল, মাংস কেন ঘন ঘন খেতে দেওয়া হয় নাএই সবই ছিলো নোটিস বোর্ডে সাটা কবিতার বিষয়বস্তু আমার অন্য কবিতা গোপন করে রাখতাম কলেজে একটি দেয়ালপত্রিকা ছিলো খুব সুন্দর হাতের লেখায় শোভিত হয়ে পত্রিকাটি নিয়মিত বেরোতো হস্টেলে আমি ভিন্ন আর কেউ কবিতা লিখতো না, কিন্তু কলেজে লিখতেন অনেকে তাদের লেখা মাঝে মাঝে কলেজের দেয়ালপত্রিকায় প্রকাশিত হতো আমার লেখা কবিতা কিন্তু কখনো এ-দেওয়াল পত্রিকায় প্রকাশিত হয়নি কলেজের একটি ছাপা বার্ষিক সাহিত্য সঙ্কলনও ছিলো তাতেও আমার কবিতা কখনো প্রকাশিত হয়নি সেই সময়ে আমার সব কবিতায় মিল থাকতো মিলগুলি অনায়াসে মন থেকে বেরিয়ে আসতো তার জন্য একটুও ভাবতে হতো না কবিতা যখন লিখতাম তখন মনে হতো আগে থেকে মুখস্থ করা কবিতা লিখে যাচ্ছি, এত দ্রুত গতিতে লিখতে পারতাম এক পয়ার ভিন্ন অন্য সব ছন্দেই লিখতাম কবিতাগুলির বিষয়বস্তুও ছিলো বিচিত্র, প্রায় সবই কাল্পনিক দু-একটা বিষয়বস্তুর অংশ আমার এখনো মনে আছেচিল্কা হ্রদের ধারে এক সঙ্গিনীসহ বসে বসে চারিপাশে নিসর্গকে দেখছি বা এক সঙ্গিনীসহ মোটরগাড়িতে করে খুব দ্রুতবেগে চলেছি, মনে হচ্ছে গাড়িটি পৃথিবীর একটি উপগ্রহবিশেষ বা ট্রেনে করে দৈনিক লক্ষ লক্ষ কেরানি কী ভাবে চাকুরি করতে কলকাতায় আসে ইত্যাদি ইত্যাদি 

সেই সময়ে লেখা কবিতাগুলি খুব দীর্ঘ হতো ছোটাে কবিতা আমি প্রায় লিখতে পারতাম না এবার একটু আগের কথা লিখে নিই আমি যখন দশম শ্রেণীতে পড়ি, মনে হচ্ছে, তখনি সিগনেট বুকশপ নামক দোকানটি সবে খুললো আমি তখন দৈনিকই বিকালবেলায় ঐ দোকানের সামনে দিয়ে হেঁটে যেতাম তখন দোকানের মালিক দিলীপবাবু নিজেই দোকানে বসে বই বিক্রি করতেন কী করে যে তার সঙ্গে আলাপ হয়ে গেলো ঠিক মনে নেই বোধ হয় বই কিনতে গিয়েই আলাপটা হয়েছিলো আমি প্রায় দৈনিক একখানা করে কবিতার বই তার কাছ থেকে কিনতাম রবীন্দ্রোত্তর যুগের বাছা বাছা কবিদের বই অনেক কিনে ফেললাম, পড়েও ফেললাম সব অথচ কোনো কারণে, সে বইগুলি মনে বিশেষ সাড়া জাগাতো না বয়স কম ব'লেই হয়তো অমন হতো যাই হোক, ইংরাজি ক্ল্যাসিক্যাল কবিদের বই আমি প্রায়শই লাইব্রেরি থেকে এনে পড়তাম সেই বয়সে তাদের কবিতা আমার ততো ভালো লাগতো না আবার মনে হচ্ছে, বয়স কম বলে অমন হতোএকথা বোধহয় ঠিক লিখিনি কারণ তখন রবীন্দ্রনাথের কাব্যগুলির মধ্যে আমার ভালো লেগেছিলোপ্রাত্তিকনামক ছোটো বইখানি এখনো আমার ঐ বইখানিই সবচেয়ে ভালো লাগে বয়স বাড়ার ফলে আমার সে অল্প বয়সের ভালো লাগা পাল্টায়নি 

যা হোক, আমি নিজে কী লিখতাম সেইটেই এ প্রবন্ধের বিষয়বস্তু বিষয়বস্তুলিখেই মনে পড়লো কবিতা লেখার অন্যতম প্রধান ব্যাপার হচ্ছে একটি ভালো বিষয়বস্তু মনে আসা তখনকার বিষয়বস্তু ছিলো অধিকাংশ কাল্পনিক একথা আগেই লিখেছি শহরের দৃশ্যাবলীপথ ঘাট মাঠ বাড়ি-সকল আমার কবিতার বিষয়বস্তুতে আসতো না মাঝে মাঝে গ্রামে আসতাম গ্রামের দৃশ্যাবলীও আমার বিষয়বস্তু হতো না অর্থাৎ কেবল বর্ণনামূলক কবিতা আমি সেই বয়সেই লিখতে পারতাম না এতদিন পরে এখন কিছু কিছু লিখতে পারি -প্রসঙ্গে পরে আবার আসবো ইতিমধ্যে কলেজ পালটে অন্য এক কলেজে চলে যেতে হলো সেখানে বিজ্ঞান বিষয়ে পড়াশুনা করতে হতো সেখানে কলেজের পড়াশুনায় এত বেশি সময় দিতে হতো যে অন্য কোনো বিষয়ে মনোনিবেশ করার সময় পাওয়া যেতো না ফলে বছর দুয়েক আমার কবিতা লেখা বন্ধ থাকলো গঙ্গার ধারে কলেজ, পাশেই বোটানিক গার্ডেন নদীর পাড়ে বিরাট এক কাঠগোলা আন্দামান থেকে জলপথে নিয়ে আসা বিশাল বিশাল সব কাঠের গুড়িতে নদীর পাড় ঢাকা সেখান থেকে গঙ্গার দৃশ্য অপূর্ব 

কিন্তু কেবল বর্ণনামূলক কবিতা আমি তখনো লিখতে শিখিনি ফলে সেই কলেজে থাকাটা আমার কাব্যচর্চার ভিতরে বিশেষ স্থান পায়নি সেই কলেজে ছিলাম চার বছর ছাত্রাবাসে তার প্রথম দু-বছর কবিতা লেখার সময়ই পাইনি শেষ দু-বছর কিছু কিছু সময় পেতাম এবং মাঝে মাঝে লিখতাম কাপড়ে বাধানো রয়াল সাইজের একটা প্রকান্ড ডায়েরি আমি যোগাড় করেছিলাম মিল দিতে বিশেষ বেগ পেতে হতো ন মিল যেন আপনিই এসে যেতো এই কলেজে আসার পর আমি পয়ারে কবিতা লেখার চেষ্টা করতাম কিন্তু দুঃখের বিষয় নির্ভুল পয়ার আমি একবারও লিখতে পারতাম না কোথায় ভুল হচ্ছে সেটি স্পষ্ট টের পেতাম কিন্তু সে-ভুল শোধরাবার কোনো উপায় খুঁজে পেতাম না তখন থেকে সুরু করে চার বছর লেগেছিলো আমার পয়ার লেখা শিখতেআবিষ্কার করতে লেখাটাই ঠিক ছিলো মনে হচ্ছে এবং ১৯৬০ সালের শুরুতে আমি পয়ার লেখার নিখুঁত পদ্ধতি আবিষ্কার করি তারপর পয়ার ভিন্ন অন্য কোনো ছন্দ লিখিইনি এখন পয়ারই আমার প্রিয়তম ছন্দ শুধু পয়ারই লিখি নানা কারণে এখন আমার মনে হয় কেউ নিখুঁত পয়ার লিখতে পারলেই তাকে কবি বলে স্বীকার করা যায়, স্বীকার করা উচিত 

যাই হোক, সেই বয়সের কথায় ফিরে যাই আমাদের কলেজ থেকে ছাত্রদের সম্পাদনায় একটি বার্ষিক সাহিত্য সঙ্কলন বেরোতো তাতে আমার লেখা কবিতা চেয়ে চেয়ে নিতো গোটা কয়েক কবিতা ছেপেছিলো এই কলেজে পাঠকালে লেখা কবিতায় কাটাকুটি আবির্ভূত হয় আগে কাটাকুটি করার বিশেষ দরকার হতো না এবার দরকার হতে লাগলো কবিতায় অলঙ্কার বলতে আগে দিতাম শুধু উপমা এবার কবিতায় উপমার সঙ্গে-সঙ্গে প্রতীকও ব্যবহার করতে লাগলাম সে-সময়কার কবিতার খাতাগুলি আমি সব হারিয়ে ফেলেছি আমার যতদূর মনে পড়ে ঐ কলেজে চার বছরব্যাপী পড়ার সময় আমি গোটা পঞ্চাশ কবিতা লিখেছিলাম শুধু যে সময়াভাব এর জন্য দায়ী তা নয়, কাব্যিক বিষয়বস্তুর অভাবও এর জন্য দায়ী অনেক পরে আমি যে-কোনো বিষয়বস্তু নিয়ে কবিতা লেখার পদ্ধতি আবিষ্কার করি অনেক পরে শক্তি চট্টোপাধ্যায় আমার বইয়ের এক সমালোচনায় লিখেছিলো যে আমি যে-কোনো বিষয় নিয়ে কবিতা লিখতে পারি, এমন কিগু গোবরনিয়েও আমি সার্থক কবিতা লিখতে পারি কিন্তু তখনো অবস্থা এমন হয়নি 

সেই কলেজে পাঠকাল ভাবতাম কিছু বিষয়বস্তু কাব্যিক, আর কিছু বিষয়বস্তু কাব্যিক নয় এখন আমার মনে হয় ব্যাপারটা তেমন নয় সব বিষয়বস্তুই কাব্যিক এবং যার দৃষ্টিতে এই কাব্যিকতা ধরা পড়ে, তিনিই কবি এমন কি, চিত্তা করার নির্দিষ্ট পদ্ধতি আছে যে-পদ্ধতিতে ভাবলে কাব্যিকতা বেরিয়ে আসতে বাধ্য হয় বিষয়বস্তুর মধ্যে কাব্যিকতা লুকিয়ে থাকে, তাকে বের করার জন্য চিন্তার সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি আছে -সব কথা আমি টের পাই, বুঝতে পারি ১৯৬০ খৃস্টাব্দের গোড়া থেকে তার আগে জানতাম না যাই হোক, ১৯৫৭ সালও শেষ হলো, আমার কলেজ পড়াও শেষ হলো পাঠদ্দশা শেষ হয়ে গেলো কলেজের ছাত্রাবাস ত্যাগ করে আমি শেষ অবধি কলকাতায় চলে এলাম 

এই সময় কুশল মিত্র নামক এক কবির সঙ্গে আমার আলাপ হয় তার প্রথম কবিতার বই তখন সবে বেরিয়েছে যেদিন বেরোলো সে-দিন তিনি বললেন, চলুন মিষ্টির দোকানে, আপনাকে মিষ্টি খাওয়াই এর বইয়ের প্রকাশক দেবকুমার বসুর সঙ্গে আমার আলাপ করিয়ে দিলেন অধুনালুপ্তগ্রন্থজগৎ দোকানটি ছিলো দেবকুমার বসুর আমি মাঝে মাঝে দেবকুমারবাবুর দোকানে গিয়ে বসে থাকতাম আমি স্থির করলাম আমারো একখানি বই প্রকাশ করা দরকার কলকাতায় তখন নিজেকে একেবারে নবাগত বলে মনে হতে লাগলো কফির আসরে, আড্ডাখানাগুলিতে আমি যেতাম আমার অফিস ছুটি হলে পর দেখতাম আলোচনার বিষয় সর্বত্রই সাহিত্য এবং রাজনীতি অথচ বাংলা সাহিত্যের খবর আমি তখন তেমন রাখতাম না রাখার সুযোগই হয়নি ইতিপূর্বে ফলে আলোচনায় যোগদান করা আমার হতো না চুপচাপ বসে শুনতাম কে কী বলে তারপর ভাবলাম আর কিছু না হোক লোকজনের সঙ্গে মেশার জন্যই তখনকার আধুনিক কাব্য সাহিত্য কিছু পড়া ভালো কোথায় কে কী লিখছে তার একটু খোজ রাখা ভালো ফলে কিছু পড়াশুনা শুরু করলাম 

এই সময়ে দিগদর্শননামে একটি পত্রিকার সম্পাদক-এর সঙ্গে আমার জানাশোনা হয় তিনি আমার কাছ থেকে কিছু অনুবাদ চেয়ে নিয়ে তার পত্রিকায় প্রকাশ করলেন অনুবাদগুলি কবিতার নয়, গদ্যের এই সময়ে মোহিত চট্টোপাধ্যায় ও অমিতাভ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে আমার আলাপ হয় ওঁরা তখন কবিরূপে অল্প পরিচিত মোহিতবাবু তখন এম. . পড়তেন আমি তখন সাহিত্য বিষয়ে আলোচনায় মোটামুটি যোগদান করতে শিখেছি আমার কোনো কবিতা আমি কোনো পত্রিকায় পাঠাতাম না আপন মনে লিখে খাতাতেই রেখে দিতাম দেবকুমার বসু আমার কবিতার বই প্রকাশ করতে রাজি হলেন আমি তখন আমার পুরানো কবিতার খাতা ফের পড়তে লাগলাম পড়ে মনে হলো, গোটা পঞ্চাশ কবিতার মধ্যে কবিতাপদবাচ্য বলা যায় গোটা পাঁচেককে মনটা খুব দমে গেলো তখন নতুন কিছু কবিতা লিখতে গেলাম সব পয়ারে বাছাই ইত্যাদি করে অতি ছোটাে একখানি পুস্তিকা প্রকাশ করা যায় বলে দেখা গেলো দেবকুমারবাবু অতি সজ্জন তিনি বললেন, চলুন দেবুদার কাছে, মলাট একে নিয়ে আসি চললাম তার সঙ্গে দেবব্রত মুখোপাধ্যায়ের বাড়িতে, বেলেঘাটায় কাচা লঙ্কা দিয়ে মুড়ি খেতে খেতে তিনি একটা ছবি এঁকে দিলেন অতি সুন্দর হলো দেখতে বই ছাপা হয়ে বেরোলো মোটা ষাট পাউন্ড এ্যান্টিক কাগজে ছাপা জানা-শোনা লোকদের কয়েকজনকে দিলাম পড়তে কিন্তু কেউ আমার কবিতা সম্বন্ধে উচ্চবাচ্য সুরু করলো না, প্রশংসাও করলো না দেবকুমারবাবু নিশ্চয়ই বিভিন্ন সাময়িক পত্রিকায়ও দিয়েছিলেন কেউ ভালো করে রিভিউও করলো না সব চুপচাপ, যেন আমার বই প্রকাশিত হয়নি এ বইয়ের নাম নক্ষত্রের আলোয় দেবকুমারবাবুর মাধ্যমে আমার বহু তরুণ কবির সঙ্গে আলাপ হয় তারাও আমার বই সম্বন্ধে কোনো আলোচনা করতেন না তবে এটা ঠিক যে লক্ষ্য করে পড়ে দেখতাম অন্যান্য তরুণ কবির লেখা থেকে আমার কবিতা ভিন্ন প্রকারের, এক রকম নয় আমার কবিতা বেশ পুরোনো ধাঁচের, সেগুলিকে ঠিক আধুনিক কবিতা বলা চলে না। 

এই সময় কবি বিষ্ণু দের সঙ্গে আমার আলাপ হয় কী করে হয়েছিলো এখন আর তা মনে নেই মোট কথা, মাঝে মাঝে সন্ধ্যার সময়ে তার বাড়িতে যেতাম কোনোদিন সঙ্গে কবিতার খাতা নিতাম তিনি খাতা পড়ার জন্য রেখে দিতেন তৎকালে সাহিত্যপত্রনামক একটি পত্রিকা বেরোতো বিষ্ণুবাবুর তত্ত্বাবধানে ঐ সাহিত্যপত্রে আমার একটি কি দুটি কবিতা তিনি ছেপে দিয়েছিলেননক্ষত্রের আলোয়বইখানা পাঠক-সমালোচক মহলে সমাদৃত না-হলে আমি খুব ভাবিত হয়ে পড়লাম অন্যান্য তরুণ কবির ঢঙে লেখা তো আর চাইলেই হয়ে ওঠে না ফলে এরূপ চিন্তা আমি করতাম না কলকাতার কোনো লিটল ম্যাগাজিনের সঙ্গে আমার যোগ তো দূরের কথা, জানাশোনাই ছিলো না আমার বয়স তখন তেইশ চব্বিশ, ১৯৫৮ খৃস্টাব্দ এ যাবৎ লেখা আমার কবিতার অধিকাংশ বর্জন করে মন খুব বিষণ্ণ এইভাবে ১৯৫৮ খৃস্টাব্দ চলে গেলো 

১৯৫৯ খৃস্টাব্দটি কোনো চাকুরি না করে শুয়ে শুয়েই কাটিয়ে দিলাম এই সময়ে প্রচুর বিদেশী সাহিত্য পাঠ করি ধীরে ধীরে আমার মনে কবিতা রচনার একটা নির্দিষ্ট পদ্ধতি আবির্ভূত হয় এই ১৯৫৯ সালে আমায় বেশ কিছু অনুবাদ করতে হয় পাইকপাড়া থেকে বক্তব্যনামে একটি পত্রিকা প্রকাশিত হতো সম্পাদক ছিলেন বিমান সিংহ আমি থাকতাম গ্রামে ; আমার গ্রামের ঠিকানায় তিনি প্রায়শই চিঠি দিতেন অনুবাদ কবিতা প্রার্থনা করে আমি অনুবাদ করে পাঠাতাম এটা ঠিক কিন্তু তিনি আমার নিজের লেখা কবিতা কেন চান নাএ ক্ষোভ আমার মনে মনে থাকতো কিছু বিরক্তও বোধ করতাম আমি যে কবিতা লিখি তা সে সম্পাদক জানতেন, নক্ষত্রের আলোয় তিনি পড়েছিলেন তবু কখনো আমার নিজের লেখা কবিতা চাইতেন না এরপর ১৯৬০ খৃস্টাব্দের একেবারে গোড়ার দিকে আমি স্থির করলাম সর্বান্তকরণে কবিতাই লিখি চাকুরি আপাতত থাক গ্রাম ছেড়ে কলকাতায় চলে গেলাম সকালে জাগরণ থেকে শয়ন পর্যন্ত সারাক্ষণ কবিতাই ভাবতাম আশেপাশে শহরের যে দৃশ্যাবলী দেখতাম তার কোনো কিছু কাব্যিক মনে হলে তখনি নোট বুকে টুকে রাখতাম ছোটো আকারের কবিতার নোট বই সর্বদাই প্যান্টের পকেটে রাখতাম ! সৃষ্টির মূল যে সূত্রগুলি তা জড়ের মধ্যে প্রকাশিত, উদ্ভিদের মধ্যে প্রকাশিত, মানুষের মধ্যেও প্রকাশিত এদের ভিতরে সূত্রগুলি পৃথক নয় একই সূত্র তিনের ভিতরে বিদ্যমান এই সার সত্য সম্বল করে ভেবে দেখলাম জড়ের জীবনে যা সত্য, মানুষের জীবনেও তাই সত্য, উদ্ভিদের জীবনে যা সত্য মানুষের জীবনেও তাই সত্য অতএব জড় এবং উদ্ভিদের জীবন অত্যন্ত মনোযোগ দিয়ে লক্ষ্য করতে লাগলাম আমি এবং তাদের জীবনের ঘটনাকে মানুষের জীবনের ঘটনা বলেই চালাতে লাগলাম এইভাবে শুরু হলো কবিতার জগতে আমার পথযাত্রা, আমার নিজস্বতা এইভাবে সৃষ্টি হলোগায়ত্রীকে’, ‘ফিরে এসো, চাকা

১৯৬০ সাল আমি এইভাবে লিখেই কাটালাম এবং দেবকুমার বসু মহশয়কে ধরলাম প্রকাশ করার জন্য এক ফর্মার একখানা পুস্তিকা প্রকাশ করা হবে বলে স্থির হলো ইতিমধ্যে আরো যা যা ঘটেছিলো তা লেখা ভালো জনকয়েক অতি তরুণ কবির সঙ্গে তখন দৈনিকই আড্ডা দিতাম এদের ভিতরে মোহিত চট্টোপাধ্যায় একজন যতদূর মনে পড়ছে শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গেও এই সময়ে আলাপ হয়েছে, তারহে প্রেম হে নৈঃশব্দ আমাকে উপহার দিয়েছিলো একখানা সেখানা আমি পড়েছিলাম মনোযোগ দিয়ে তখনআরো কবিতা পড়ুননামক আন্দোলন খুব জোর চলেছে মাঝে মাঝে রাস্তা দিয়ে ছোটাে মিছিল যেতো শ্লোগান দিতো আরো কবিতা পড়ুন, হাতে থাকতো ফেস্টুন যতদূর মনে পড়ে তখনকার সিনেট হলের সিঁড়িতে দাড়িয়ে তরুণ কবিরা বক্তৃতাও দিতো, পথচারীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতো দেখেশুনে আমি বলতাম, আমি এখন যা লিখছি সে হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যপুস্তক তার মানে ভবিষ্যতে আমার কবিতা ছাত্রছাত্রীরা পড়তে বাধ্য হবে সেহেতু এখন আমার কোনো পাঠক না থাকলেও চলে এবং কবিবন্ধুদের বললাম যে মিছিল করে কিছু হবে না আসল কথা হচ্ছে ভালো লেখা দরকার যখন কবিতার বই ছেপে খাটের নিচে রেখে দেবে, কারো কাছে বেচতে যাবে না, তা সত্ত্বেও পাঠকেরা এসে খাটের নিচের থেকে টেনে নিয়ে গিয়ে পড়বে তখনই বুঝবে কবিতা ঠিক লেখা হচ্ছে আমার এ-মন্তব্য কিন্তু কবিবন্ধুদের ভালো লাগেনি 


অবশেষে সেই এক ফর্ম পুস্তিকা প্রকাশিত হলো নামগায়ত্রীকে চোদ্দটি কবিতা ছিলো তাতে মোট ষোলো পৃষ্ঠার বই আগেই ভেবেছিলাম যে দ্বিতীয় সংস্করণে আরো অনেক কবিতা যুক্ত করে পুস্তিকাখনিকে একখানি পূর্ণাঙ্গ বই করে ফেলবো ফলে আমি লিখে চললাম ইতিমধ্যে দুর্গাপুরে একটি চাকরি পেয়ে আমি কলকাতা ছেড়ে দুর্গাপুরে যাই সেখানে তিন শিফটে কাজ করতে হতো সকালের শিফট, সন্ধ্যার শিফট এবং রাতের শিফট ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে এই তিন শিফটেই কাজ করতে হতো কাজের ফাঁকে ফাঁকে আমি কবিতা লিখতাম মাস আড়াই কাজ করার পর আমিগায়ত্রীকেপুস্তিকাকে পরিবর্ধনের ব্যাপার শেষ করে ফেলি সাতাত্তরটি কবিতা সম্বলিত পাণ্ডুলিপি আমি দেবকুমারবাবুকে দিয়ে গেলাম বইয়ের নাম দিলাম ফিরে এসো, চাকা 

এর মধ্যে অবশ্য অন্য ব্যাপারও ঘটে গেছে হাওড়া থেকে প্রকাশিত অশোক চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত সম্প্রতিনামক পত্রিকায়গায়ত্রীকের সমালোচনা প্রকাশিত হয়েছে শক্তি চট্টোপাধ্যায় লিখেছিলো অতি উচ্ছসিত প্রশংসা করেছিলো শক্তি লিখেছিলো যে আমি যে-কোনো বস্তু নিয়ে সার্থক কবিতা লিখতে পারি এবং, আশ্চর্যের বিষয়, সমালোচনায় শক্তি লিখলো যে হাংরি জেনারেশননামে একটি কবিগোষ্ঠী গঠিত হয়েছে, আমিই তার জনক ইত্যাদি ইত্যাদি আসল কথা হচ্ছে ঐ সমালোচনা পড়েই আমি ঐ জেনারেশনের কথা জানলাম, তার আগে জানতাম না জেনারেশনের অন্তর্ভুক্ত কারো সঙ্গেই তখন আমার আলাপ ছিলো না দুর্গাপুরে কর্মরত থাকার ফলে কোনো দল গঠন ছিলো আমার পক্ষে অসম্ভব আসল কথা দল গঠন করে দিয়েছিলো শক্তি তার নিজের কৃতিত্ব আমার ঘাড়ে চাপাতে চেয়েছিলো কেন কে জানে শক্তির এই সমালোচনা প্রকাশিত হওয়া পর্যন্ত কোনো পত্রিকাতে আমার কবিতা কেউ চেয়ে নিতো না সম্পাদকেরা চাইতো না এবং আমিও দিতাম না ফলে এখন যদি কেউ আমার লেখার সন্ধানে পুরোনো পত্রিকা ঘাটেন তবে হতাশ হবেন কবিতার জগতে আমার প্রবেশ পত্রিকায় কবিতা ছেপে নয়, বই ছেপে কলকাতায় আর কোনো কবির জীবনে এরূপ হয়েছে কিনা জানি না 

 


শক্তির সমালোচনা প্রকাশিত হওয়ার পর অবশ্য অবস্থা পরিবর্তিত হলো, লিটল ম্যাগাজিনের সম্পাদকেরা আমার কবিতা চেয়ে নিয়ে ছাপতে লাগলেন তবে সে অল্প সংখ্যক পত্রিকা এর পরই বেরোলো ফিরে এসো, চাকা তখন আমি দুর্গাপুরের চাকরি ছেড়ে কলকাতায় ফিরে এসেছি ফিরে এসো, চাকাকলকাতায় ফেরার আগেই ছাপা হয়ে গেছলো ফলে আমি প্রুফ দেখতে পারিনি অনেক ছাপার ভুল রয়ে গেছলো যেমনশুভ্র গানএর জায়গায় ছাপা হয় শুভ গান অনেক জায়গায় শব্দও বাদ চলে গেছলো আর, কবিতায় শব্দ বাদ যাওয়া মানেই তো ছন্দপতন শক্তিকে ফিরে এসো, চাকা একখানা উপহার দিয়ে বললাম একটা সমালোচনা করতে ও বলল, ‘হ্যা, নিশ্চয় করবো তবে তোর বই কি কলকাতায় বসে পড়া যায় রে অন্য পরিবেশ লাগে তাই বাসায় গিয়ে পড়বো তোর বই তারপর লিখবোশক্তি আমাকে তখন তুই বলতো সম্প্রতি দেখলাম তুই পালটে তুমি বলতে শুরু করেছেগায়ত্রীকে প্রকাশের সময় এবং ফিরে এসো, চাকাপ্রকাশের সময়ের মাঝখানে খুব অল্প কটি কবিতা পত্রিকায় বেরিয়েছিলো সবই লিটল ম্যাগাজিনে এসব হচ্ছে ১৯৬২ সালের নভেম্বর-ডিসেম্বরের ঘটনা এরপর ১৯৬৩ সালের নভেম্বর পর্যন্ত একবছর আমি কোনো কবিতা লিখিনি গ্রামে থাকতাম 

শক্তি তার প্রতিশ্রুতি রেখেছিলো বেশ দীর্ঘ একটি সমালোচনা লিখেছিলো ফিরে, এসো, চাকা ১৯৬৩ সালে ওর সমালোচনার ফলে হৈ-চৈ পড়ে গেলো কলকাতায় ১৯৬৩ সালের নভেম্বর কি ডিসেম্বরে আমি ফিরে গেলাম কলকাতায় শক্তি একদিন একখানি চটি পত্রিকা টেবিলে রেখে বললো, এই হলো কৃত্তিবাস তোর কবিতা দে, কৃত্তিবাসে ছাপবো তার আগে কৃত্তিবাস আমি কোনোদিন চোখে দেখিনি, নাম শুনেছিলাম অবশ্য আমি বললাম, আমি তো কবিতা লেখা ছেড়ে দিয়েছি ফলে দেবার উপায় নেই উত্তরে শক্তি বললো, তুই না-লিখলে কৃত্তিবাসবারই করবো না আর, বন্ধ করে দেবো তুই তাড়াতাড়ি কবিতা লিখে দেচাপে পড়ে আমি রাজি হলাম লিখতে এইভাবে ১৯৬৪ সালে কৃত্তিবাস’-এর সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ি 

১৯৬৪ সালের গোড়াতেই লক্ষ্য করলাম যে আমি কলকাতায় পরিচিত হয়ে গেছি, বিশেষত পত্রিকার সম্পাদক মহলে অমৃত পত্রিকার কমল চৌধুরী মশায়ের সঙ্গে আলাপ হলো ঐ সময় তিনি বললেন, ‘কবিতা দেবেন আমাদের পত্রিকায় আপনার কবিতা নিশ্চয় ছাপাবো' অল্প কিছুকাল পরেদেশ সম্পাদক সাগরময় ঘোষ মহাশয়ের সঙ্গেও আলাপ হয়েছিলো তিনি বলেছিলেন কবিতা দিতে বিভিন্ন কবি সম্মেলনে যাবার জন্য নিমন্ত্রণ আসতে লাগলো এমন কি ইউসিস-এ আয়োজিত আমেরিকানদের এক সাহিত্য সম্মেলনে নিমন্ত্রণ করে বসলো গেলাম সে সম্মেলনে সেখানে প্রধানত আমেরিকান কবিদের কবিতা শোনানো হলো অর্ধেক সময় অতিবাহিত হবার পর পিছনে তাকিয়ে দেখি শক্তিও কখন এসে আমার পিছনেই চুপচাপ বসে আছে উক্ত সম্মেলনে আমেরিকান কবিতার বঙ্গানুবাদও পড়ে শোনানো হলো পড়লেন স্বয়ং অনুবাদকগণ অর্থাৎ বাঙলার খ্যাতনামা বৃদ্ধ কবিরা কলকাতার অধিকাংশ তরুণ কবির সঙ্গে তখন আমার আলাপ হয়ে গেলো আলাপ হলো উৎপল বসুর সঙ্গে উৎপল বসু আলাপ করিয়ে দিলেন তারাপদ রায়ের সঙ্গে তারাপদবাবুর বাড়িতে তখন সন্ধ্যাবেলা দক্ষিণ কলকাতার তরুণ কবিদের একটি সান্ধ্য-বৈঠক হতো যতদূর মনে পড়ে উক্ত বৈঠকেই শংকর চট্টোপাধ্যায় এবং সুধেন্দু মল্লিকের সঙ্গে আমার আলাপ হয় 

আমি মাঝে মাঝে রাত্রিবেলা তারাপদবাবুর বাড়িতেই শুয়ে থাকতাম একদিন তারাপদবাবু বললেন, ‘আমার এক বন্ধু আপনার সঙ্গে আলাপ করতে চায় যাবেন তার কাছে? কাছেই থাকে সে, বালিগঞ্জে আমি হেঁটেই যাইপ্রথম দিন বোধ হয় আমি যেতে রাজি হইনি পরে আরেকদিন তিনি যখন বললেন তখন রাজি হলাম হাজরা রোড ধ'রে সিধে পূর্বদিকে হাঁটতে লাগলাম দুজনে তারাপদবাবুর কাছে ছোটা আর হাঁটা প্রায় একই ব্যাপার ফলে অল্প সময়েই পৌছে গেলাম পরিচয় হলো জ্যোর্তিময় দত্তর সঙ্গে জ্যোতিবাবু বললেন, আপনার কবিতা সম্বন্ধে আমি একটি প্রবন্ধ লিখেছি সে-জন্য আপনার সঙ্গে পরিচয় হওয়া দরকার হয়ে পড়েছিলো প্রবন্ধটি ছাপায় আপনার অমত নেইএই কথাটি আপনাকে লিখে দিতে হবে-কথা আমি লিখে দিয়েছিলাম, তবে প্রথম সাক্ষাতের দিনে নয়, পরে একদিন প্রবন্ধটি যাতে দেশপত্রিকায় প্রকাশিত হয় সেই চেষ্টাই করছিলেন জ্যোতিবাবু কিন্তু অত দীর্ঘ প্রবন্ধ ছাপতে হলে ক্রমশ করে ছাপতে হবে, এই হেতু সাগরময় ঘোষ মহাশয় ছাপতে রাজি হননি -প্রবন্ধ অনেক পরে কৃত্তিবাস পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিলো 

১৯৬৪ খৃস্টাব্দে, বোধ হয়, মে মাসেস্টেটসম্যানপত্রিকায় আমার সম্বন্ধে কিছু লিখেছিলো জ্যোতিবাবুই বলেছিলেন, কাল স্টেটসম্যান-এ আপনার সম্বন্ধে লেখা বেরোবে পরের দিন দেখলাম সত্য-সত্যই লেখা বেরিয়েছে তাতে লিখেছিলো যে বিনয় মজুমদার বাংলা কবিতার রাজ্যে একটি চিরস্থায়ী নাম আমি খুব উৎসাহিত বোধ করলাম তখন আমি আদিরসাত্মক কবিতা লিখতে সুরু করেছি তখন মনে হতো খুব দ্রুত গতিতে লিখছি কিন্তু এখন বুঝতে পারি যে আস্তে আস্তেই লিখছিলাম আসলে সাতচল্লিশটি কবিতা লিখতে মাস ছয়েক লেগেছিলো তখনকার উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হচ্ছিলো এই যে আমি যা-ই লিখতাম তা-, অন্তত আমার কাছে, রসোত্তীর্ণ কবিতা বলে মনে হতো কোনো কবিতাই আমি বর্জন করতে পারতাম না এটা হতো লেখার একটি বিশেষ উপায়ের জন্য যাকে লেখার শৈলী বলা যায় 

এই সময় একটি হিন্দী পত্রিকায় আমার কবিতার হিন্দী অনুবাদ প্রকাশিত হয় কবি পরিচিতিতে লিখেছিলো যে আমি বর্তমানে বাংলার শ্রেষ্ঠ কবি পত্রিকাটির নাম এখন আর মনে নেই মিরালনামে হিন্দী পত্রিকাটি বোধ হয় নয় অন্য কোনো পত্রিকা হবে খুবই অল্প সময়ের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের অধিকাংশ তরুণ বুদ্ধিজীবীর সঙ্গে আমার জানাশোনা হয়ে যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে আলাপ হয় অনেক বিদেশী ব্যক্তির সঙ্গেও আলাপ হয় বিখ্যাত বঙ্গভাষা প্রেমিক আমেরিকান অধ্যাপক ডিমক-এর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ পরিচয় হয় তার সঙ্গে ঘন ঘন দেখা হতো ১৯৬৪ খৃস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে ঈশ্বরীর নামক কবিতাগ্রন্থখানি ছাপা হয়ে বেরোয় -বইয়ের প্রায় সব কবিতাই আদিরসাত্মক কিন্তু ঐ বই পাঠকমহলে বিশেষ সাড়া জাগাতে পারেনি এখন পর্যন্ত একই অবস্থা চলছে এর পরে বেশ কিছুকাল আমি কবিতা লিখিনি ঈশ্বরীর বইখানির কবিতাগুলি ছন্দ এবং ধ্বনিমাধুর্যে খুব ভালো-কথা আমি তখনি বুঝতাম, এখনো বুঝতে পারি 

আমার কবিতা সম্বন্ধে ছোটোবড়ো আলোচনা তখন নানা পত্রিকায় বেরোতে শুরু করে এরপরে আলাপ হয় বাসুদেব চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে উত্তরঙ্গনামক একটি পত্রিকা তিনি সম্পাদনা করছিলেন পত্রিকাটির কয়েক সংখ্যা সবে বেরিয়েছে আমাকে এক সংখ্যা পত্রিকা উপহার দিয়ে তিনি বললেন, আপনার কবিতা চাই আমি ছাপবোউত্তরে আমি বললাম যে কবিতা লেখা ছেড়েই দিয়েছি, আর লিখি না লেখার বিশেষ ইচ্ছাও নেই তিনি শুনলেন না বারবার অনুরোধ করতে লাগলেন শেষ পর্যন্ত আমি বললাম, আচ্ছা, লেখার চেষ্টা করে দেখি’ 

মাঝে মাঝে কবিতা লেখা যে বন্ধ থাকতো তার প্রধান কারণ হলো বিষয়বস্তুর অভাব বিষয়বস্তু খুঁজে পেতাম না আমি চারিপাশে যে সকল দৃশ্য দেখি, আমরা সকলেই দেখি, তার হুবহু বর্ণনা লিখলে কবিতা হয় না সেই দৃশ্য আদৌ কেন আছে, কী কারণে বিশ্বে তার থাকার প্রয়োজন হয়ে পড়েছে, বিশ্বের নিয়মাবলী ও গঠন প্রকৃতি ঐ দৃশ্যে কতটুকু প্রকাশিত হয়েছেএইসব বর্ণনার সঙ্গে যুক্ত করে না দিলে আধুনিক কবিতা হয় না কিন্তু যুক্ত করতে হলে ঐ-সব জানা থাকা দরকার! এইসব দার্শনিক বিষয় ভাবতে ভাবতে আমার সময় চলে যেতো মাসের পর মাস এখনো আমি ভেবেই চলেছি এই দর্শনের উপস্থিতি কবিতায় একেবারে প্রত্যক্ষ না-হলেও চলে, হয়তো তার আভাস-মাত্র থাকলেই হয় কিন্তু আভাসই হোক আর যাই হোক, উপস্থিতি অবশ্যই প্রয়োজন এই উপস্থিতিই পাঠকের মনকে ভাবাবেগে আন্দোলিত করে, রসাপ্লুত করে, কবিতাকে চিরস্থায়ী করে যেমন ধরা যাক উপমা উপমা দেওয়া মানেও দর্শনকে হাজির করা আমার নিজের কবিতা থেকেই উদ্ধৃতি দিই অথচ তীক্ষতা আছে, অভিজ্ঞতাগুলি সূচিমুখ, ফুলের কাটার মতো কিংবা অতি দূর নক্ষত্রের পরিধির মতো তীক্ষ, নাগালের অনেক বাহিরেঅভিজ্ঞতার সঙ্গে তুলনা দিতে এ-স্থলে ফুল এবং নক্ষত্র আনা হয়েছে ফুল এবং নক্ষত্র দুই-ই খুব সুন্দর, তার মানে অভিজ্ঞতাগুলিও সুন্দর কিন্তু ফুলের সৌন্দর্যের সঙ্গে কাটা থাকে, তার মানে সুন্দর অভিজ্ঞতা হতে গিয়ে নির্মম বাধা আসে-হয়তো এক নিয়ম এই দার্শনিক তত্ত্বের জন্য তুলনায় ফুল এসে পড়ে কিন্তু এ এক নিয়ম না হলে ? তাহলে, অন্ততপক্ষে, কাটা আছে বলে প্রতীয়মান হতে থাকে যেমন নক্ষত্রের বেলা হয় কাটা নক্ষত্রে নেই, কিন্তু আছে বলে মনে হতে থাকে এই হেতু উপমায় নক্ষত্র এসে পড়েসৌন্দর্যাভিসারের বেলায়ও এইরূপ মনে হতে থাকে এটি বিশ্বের একটি নিয়ম অর্থাৎ উপমা দেওয়া মানে খানিকটা দর্শন এনে হাজির করা এই দর্শনই পাঠককে আহ্লাদিত করে, দর্শনকে লেখার ভঙ্গীটি তাকে আরো বেশি আহুদিত করে দর্শন হয়তো পুরোনো, কিন্তু তা লেখার প্রসঙ্গ ও ভঙ্গীটি নতুন এই প্রসঙ্গে যে এই দর্শন ক্রিয়াশীল তা দেখে পাঠক চমৎকৃত হয় 

অভিজ্ঞতা হতো আমার নানা রকমের, কিন্তু সে-গুলিকে দর্শনসিক্ত করে তার বিশ্বজনীনতা ফোটাতে পারতাম না সব সময় অন্তত আমার তাই মনে হতো এমন হলে আমি লেখা বন্ধ করে বসে থাকতাম যাই হোক, বাসুদেব চট্টোপাধ্যায় মশায়কে আমি কবিতা লিখে দিয়েছিলাম তিনি সানন্দে ছেপেছিলেন এইভাবে আমার পরবর্তী পুস্তিকা অধিকন্তু লেখা শুরু হয় অধিকন্তু লেখার সময়ে মনে হতোএর কোনো তুলনা হয় না, এত বিশ্বজনীন অবশ্য এখন মনে হয়, যে-কোনো বই লেখার সময়েই কবি এই রকম ভাবে এবং এইরকম ভাবে বলেই লিখে শেষ করতে পারে অধিকন্তুর প্রথম কবিতাটি উত্তরঙ্গে ছাপা হয়েছিলো -অবধি আমি কোনোদিন নিসর্গবর্ণনামূলক কবিতা লিখিনি অধিকাংশই ঘটনার বিবৃতি লিখেছি অতঃপর আমায় কলকাতার শহরতলীতে থাকতে হয় যাকে প্রায় গ্রাম বলা যায় চারিদিকে নানা গাছপালা লতাপাতা ছিলো, ছোটোবড়ো পুকুর ছিলো ভাবলাম প্রকৃতির বর্ণনা লেখার চেষ্টা করা যাক এক মাসের ভিতরে খুব দীর্ঘ ছটি কবিতা লিখলাম হিসাবে করে দেখলাম, বই আকরে ছাপলে এই ছটি কবিতা ৪৮ পৃষ্ঠার বেশি জায়গা নেবে ফলে আর বেশি লিখলাম না বইয়ের নাম দিলামঅঘ্রানের অনুভূতিমালাএবং কবিতাগুলির কোনো নাম না-দিয়ে সংখ্যা দিয়ে চিহ্নিত করলাম, , , , ৫ ও ৬ একবার ভাবলাম কায়দা করে ছটি কবিতাকে জোড়া লাগিয়ে একটা কবিতা করি, ৪৮ পৃষ্ঠা লম্বা একটি কবিতা কিন্তু এত দীর্ঘ কবিতা পত্রিকায় ছাপার অসুবিধা হবে ভেবে শেষ পর্যন্ত আলাদা আলাদা ছটি কবিতাই রাখলাম এর প্রথম কবিতাটি ছাপতে নিলেনঅনুভবপত্রিকার সম্পাদক গৌরাঙ্গ ভৌমিক, দ্বিতীয় কবিতাটি ছাপতে নিলেনএক্ষণপত্রিকার সম্পাদক নির্মাল্য আচার্য, তৃতীয় কবিতাটির তখন কী হয়েছিলো তা গোপন রাখতে চাই, চতুর্থ ও পঞ্চম কবিতা দুটি ছাপতে নিলেন কৃত্তিবাস পত্রিকার সম্পাদক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এবং ষষ্ঠ কবিতাটি ছাপতে নিলেন দৈনিক কবিতাপত্রিকার সম্পাদক বিমল রায়চৌধুরী সকলেই যথাসময়ে ছেপে বার করলেন পড়ে সকলেই খুব প্রশংসা করলেন 

পৃথ্বীশ গঙ্গোপাধ্যায় বললেন, “অঘ্রানের অনুভূতিমালাবইখানা আমি ছেপে বার করবো কবিতার সঙ্গে ইলাষ্ট্রেশন দেবো অমিতাভ দাশগুপ্ত বললো, “তোর অঘ্রানের অনুভূতিমালার সমালোচনা লিখবো আমি বই হয়ে বেরোবার আগেইকিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে দেখা গেলো তাদের কথা প্রশংসাবাক্য মাত্র পৃথ্বীশও বই ছাপলেন না, অমিতাভও সমালোচনা লিখলো না অঘ্রানের অনুভূতিমালার তৃতীয় কবিতাটি ছাপা হয়েছে জ্যোতির্ময় দত্ত সম্পাদিত কলকাতাপত্রিকায়, ১৯৭০ সালে এই একই প্রকারের কবিতা আমি আরো লিখে যেতে পারতাম কিন্তু পড়তে একঘেয়ে হয়ে যাবে এই আশঙ্কায় আর লিখিনি এর পরে কবিতা লেখার গতি খুব মন্দ হয়ে আসে ১৯৬৭, ১৯৬৮ ও ১৯৬৯ এই তিন বছরে আমি গোটা পচিশেক কবিতা লিখেছি তাও আবার খুব ছোট আকারের পাঁচের দশকের প্রধান কবিদের কবিতা নিয়ে শংকর চট্টোপাধ্যায় এই দশকের কবিতানামক একখানা বইএসব ঘটনার কিছু আগেই, বার করেছিলেন তাতে আমার গোটা কয়েক কবিতা তিনি ছেপেছিলেন


---------------০---------------