- শংকর লাহিড়ী
(কবি স্বদেশ সেনের কবিতা নিয়ে এই আলোচনা কৌরব-১১৪, অগস্ট ২০১২ থেকে উদ্ধৃত)
কৌরবে আশির দশকের শুরুর দিকে আমরা যখন স্বদেশদাকে নিয়ে কবিতার ক্যাম্পগুলোয় মেতে রয়েছি, আমাদের সেইসব শিক্ষামূলক ভ্রমণে ছিল কবিতার আকাশপাতাল নিয়ে কতো কথা, -সেইসব দিনগুলোতেই উনি লিখেছিলেন ওঁর বিখ্যাত কবিতাগুলো। তাঁকে, তাঁর দৈনন্দিন জীবনকে, তাঁর কবিতা রচনাকে, অনেকটা কাছ থেকে দেখার সুযোগ ও সৌভাগ্য আমার হয়েছিলো। মনে আছে, সেটা ছিলো ১৯৮০ সালের ফেব্রুয়ারি। চাঁদিপুর সমুদ্রতীরে ঝাউবনে জলরেখার কাছে আমরা তিনজন বসে আছি, দেখছি সমুদ্রের নীল সীমানার দিক থেকে পুঞ্জ পুঞ্জ মেঘ ঠেলে আসছে মেনল্যান্ডে, তীরভূমির দিকে। আমি বললাম, স্বদেশদা, দেখুন দূরে সমুদ্রের ভেতরে ওইখানে মেঘ তৈরির কারখানা, যেখান থেকে মেঘ বেরিয়ে আসছে। সেই ক্যাম্প থেকে ফিরে উনি লিখেছিলেন, ‘এসেছি জলের কাছে’ কবিতাটা। লিখেছিলেন, ‘মেঘের জন্মের ছবি বানানো দেখেছি আমি অনেক ভেতরে’। সাপ্তাহিক সন্ধ্যেবেলায় ওঁর শিসম রোডের কোয়ার্টারে বসে মুগ্ধ হয়ে শুনেছি সদ্য লেখা তাঁর সেই কবিতাগুলো । সেই রোমাঞ্চ আজও মনে পড়ে।
রবীন্দ্রোত্তর যুগে জীবনানন্দ, সুধীন দত্ত, ও বিষ্ণু দের পরে কবিতার উচ্চারণটাই পাল্টে দেওয়া দরকার বলেছিলেন তিনি। নতুন শব্দের জোরাজুরি নয়, শব্দ ভাঙ্গার পাগল-হাসানো-ধস্তাধস্তি নয়, বরং কথ্য, আকাঁড়া ও অপ্রচলিত শব্দের অসামান্য ‘নতুন ও অন্য ব্যবহার’, -এটাই ছিল তাঁর সামনে কবিতাভাষার ‘নবীকরণের’ জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ । লিখেছেন, ‘নতুন ও অন্য ব্যবহারে / ভরা চুলে করবীর মতো / দেখা হবে’ (-দেখা হবে বাদাম) ।
কখনো আমার মনে হয়েছে, ওঁর কবিতাকে যেমন সংসারজীবনের ওঠাপড়ার শতেক অনুভবের ওপর গড়ে তুলেছেন, তেমনি তার সমান্তরাল আরেকটা প্রেক্ষিতও রয়েছে, -সেটা বাংলা কবিতার সহজ আধুনিকতা থেকে এক অন্য উদ্ভাসের জটিলতার দিকে উত্তরণের চেষ্টার কথা। সেখানে ‘কাজের কথা’র আরেকটা মানে, -পরীক্ষা সাহিত্যের কাজ। আমাদের অনেকবার বলেছেন, বড় কাজ হচ্ছে না কিছু। লিখেছেন, ‘যারা ফাইন আর্টে / মরার মতো আর পাখি এঁকোনা খাঁচা মারা’ (-শেষ ঝর্ণা)। বলেছেন, কবিতা থেকে যারা সব কিছু বাদ দিতে চায় তারা তবে রাখবে টা কী ? বলতেন, আরেকটু সংসারে এসো, আরেকটু দেখো। লিখেছেন, ‘একদিন ভালবাসার গতিময়তা দেখবে’। ‘একটা জীবনময় দেখা / কোনদিন দেখা হয়নি ব’লে না দেখাকে / দেখো’। ‘প্রাইমর্ডিয়াল’, ‘সাবলিমেশান’, –এইসব কথাগুলো দিয়ে বোঝাতে চেয়েছেন কবিতায় অনুভবের জগৎটাকে। - পরবর্তী প্রজন্মের লেখা নিয়ে যেমন খুব আগ্রহ দেখিয়েছেন, তেমনি শিল্পে কবিতায় কোথাও পরীক্ষানিরীক্ষার বহ্বারম্ভ ও হালহকিকত দেখে স্বঘোষিত মহাবীরদের ওপর বীতশ্রদ্ধ হয়েছেন। তার আভাষ রেখেছেন লেখায় : ‘যত মহাবীর তার ইঁদুর শিকার / ...সদা মূর্খের ত ত’ (মামলা-গাছ)। -কবিতায় মূল প্রসঙ্গ যখন মনে হয়েছে অন্য কিছু, তখন হঠাৎ প্রসঙ্গান্তরে এসে এরকম একটু অন্য আভাষ দিয়ে আবার সরে গেছেন। বিষয়কে রেখেছেন স্পষ্ট ও অস্পষ্ট জলের আড়ালে, রহস্যময়তায়।
(কবি স্বদেশ সেনের কবিতা নিয়ে এই আলোচনা কৌরব-১১৪, অগস্ট ২০১২ থেকে উদ্ধৃত)
বৈশাখের এক রুক্ষ বিকেলে বৃষ্টির জন্যে সারা কলকাতা শহর যখন অপেক্ষায়, আমার
মনে পড়লো সিংভূম আর মানভূমের মাটিও তাহলে এতদিনে শুকিয়ে ফেটে
পড়েছে। এই সেই ‘আঙরা জ্বালানো শিমুল পোড়ানো’ দিন। বুকর্যাক থেকে কবি স্বদেশ সেনের
স্বদেশ বইটা নামাতে গিয়ে প্রথমেই মনে এলো অনেক বছর আগে লেখা ওঁর কবিতার সেই লাইন,
“ঐ যে গাই যাচ্ছে মাঠকে মাঠ, ঐ যে ভুখা বলদ চাটছে কুজানদী”। এই ছিলো আমার প্রথম পড়া স্বদেশ সেন ; আমার
বয়স যখন সাতাশ, স্বদেশদার তেতাল্লিশ, যখন আমাদের প্রথম আলাপ হয়েছিলো। আমি তখন সবে কৌরবে যোগ দিয়েছি। সেই থেকে একসাথে
অনেকটা কাল কেটেছে আমাদের। কৌরবের সেই স্বর্ণযুগে কবিতার
নতুন নিয়ে আমাদের অনেক অন্তরঙ্গ সময় কেটেছিলো কথায়, ভাবনায়, আবিস্কারে। তিনজনে একসাথে অনেক আড্ডা ও ভ্রমণ। কমলদা, স্বদেশদা ও আমি। কতবার একসাথে ট্রেনের
জানালায়, খেয়া নৌকোর পাটাতনে, কত হাইওয়ে-ধাবায়। কতবার মহানিম-শিরীষ-অশ্বথের ছায়ায়, নির্জন কালভার্টে, জঙ্গল-জীপে,
নদীর খাঁড়িতে। একবার চাঁদিপুরে,
সমুদ্র-ঝাউয়ের উদ্দাম বাতাসে, টিলার ওপরে গোলঘরে আমাদের প্রথম কবিতার ক্যাম্প
বসেছিল। তার পরে আরও অনেক মাইলস্টোন।
কৌরবে আশির দশকের শুরুর দিকে আমরা যখন স্বদেশদাকে নিয়ে কবিতার ক্যাম্পগুলোয় মেতে রয়েছি, আমাদের সেইসব শিক্ষামূলক ভ্রমণে ছিল কবিতার আকাশপাতাল নিয়ে কতো কথা, -সেইসব দিনগুলোতেই উনি লিখেছিলেন ওঁর বিখ্যাত কবিতাগুলো। তাঁকে, তাঁর দৈনন্দিন জীবনকে, তাঁর কবিতা রচনাকে, অনেকটা কাছ থেকে দেখার সুযোগ ও সৌভাগ্য আমার হয়েছিলো। মনে আছে, সেটা ছিলো ১৯৮০ সালের ফেব্রুয়ারি। চাঁদিপুর সমুদ্রতীরে ঝাউবনে জলরেখার কাছে আমরা তিনজন বসে আছি, দেখছি সমুদ্রের নীল সীমানার দিক থেকে পুঞ্জ পুঞ্জ মেঘ ঠেলে আসছে মেনল্যান্ডে, তীরভূমির দিকে। আমি বললাম, স্বদেশদা, দেখুন দূরে সমুদ্রের ভেতরে ওইখানে মেঘ তৈরির কারখানা, যেখান থেকে মেঘ বেরিয়ে আসছে। সেই ক্যাম্প থেকে ফিরে উনি লিখেছিলেন, ‘এসেছি জলের কাছে’ কবিতাটা। লিখেছিলেন, ‘মেঘের জন্মের ছবি বানানো দেখেছি আমি অনেক ভেতরে’। সাপ্তাহিক সন্ধ্যেবেলায় ওঁর শিসম রোডের কোয়ার্টারে বসে মুগ্ধ হয়ে শুনেছি সদ্য লেখা তাঁর সেই কবিতাগুলো । সেই রোমাঞ্চ আজও মনে পড়ে।
বাংলা কবিতার পাঠক ও সমালোচকদের কাছে কবিরা কেউ
‘মিছিলের’, ‘প্রকৃতির’, ‘বিপ্লবের’, ‘প্রেমের’। কেউ আবার
‘কারখানার’, ‘নৈরাজ্যের’, ‘ভাষাবদলের’। এগুলো সম্ভবত: তাঁদের প্রধান কাব্যকর্ম লক্ষ্য করেই বলা হয়। এভাবে কবিদের জন্য সমালোচকরা নির্মাণ করেন নানান নামের ও আকারের উল্লম্ব আধার বা ভার্টিকাল সাইলো, -তার মধ্যে ভাগ করে রাখা হয় কবিদের কবিতা-ফসল। যেমন অনেকেই জীবনানন্দকে বলে থাকেন ‘নির্জনতার কবি’। তার মানে এই নয় যে তিনি ছিলেন কোনও প্রত্যন্ত প্রদেশে, নির্জনে। আমার কখনো মনে হয়েছে যে একজন প্রকৃত কবির রচনা তো হওয়া উচিত এর সমস্তটা নিয়েই। একই সাথে মিছিলের, প্রকৃতির, কারখানার, নৈরাজ্যের, ধারামুক্তির, মগ্নচৈতন্যের, অন্বেষণের, এবং সর্বোপরি নির্জনতার। সহস্র কাজের ভীড়েও তাঁর সঙ্গী থাকে এক প্রিয় ও অন্তর্লীন নির্জনতা, মনোজগতে যেখানে কবির স্বাধীন নিজস্ব বাসভূমি।
‘মিছিলের’, ‘প্রকৃতির’, ‘বিপ্লবের’, ‘প্রেমের’। কেউ আবার
‘কারখানার’, ‘নৈরাজ্যের’, ‘ভাষাবদলের’। এগুলো সম্ভবত: তাঁদের প্রধান কাব্যকর্ম লক্ষ্য করেই বলা হয়। এভাবে কবিদের জন্য সমালোচকরা নির্মাণ করেন নানান নামের ও আকারের উল্লম্ব আধার বা ভার্টিকাল সাইলো, -তার মধ্যে ভাগ করে রাখা হয় কবিদের কবিতা-ফসল। যেমন অনেকেই জীবনানন্দকে বলে থাকেন ‘নির্জনতার কবি’। তার মানে এই নয় যে তিনি ছিলেন কোনও প্রত্যন্ত প্রদেশে, নির্জনে। আমার কখনো মনে হয়েছে যে একজন প্রকৃত কবির রচনা তো হওয়া উচিত এর সমস্তটা নিয়েই। একই সাথে মিছিলের, প্রকৃতির, কারখানার, নৈরাজ্যের, ধারামুক্তির, মগ্নচৈতন্যের, অন্বেষণের, এবং সর্বোপরি নির্জনতার। সহস্র কাজের ভীড়েও তাঁর সঙ্গী থাকে এক প্রিয় ও অন্তর্লীন নির্জনতা, মনোজগতে যেখানে কবির স্বাধীন নিজস্ব বাসভূমি।
অনেকে কবি স্বদেশ সেনকেও বলে থাকেন নির্জনতার কবি। তার একটা কারণ হয়তো বাংলার
বাইরে প্রবাসে কিছুটা প্রচারবিমুখ ও জনসংযোগহীন তাঁর অবস্থান। আর কিছুটা সম্ভবত:
তাঁর কাব্যভাষা, -বলা যায় ভাষার এক অবিশ্বাস্য ও স্বতন্ত্র ম্যাজিক। আমার মনে পড়ে
যায় তুষার রায়ের সেই লেখা, ‘আমি অঙ্ক কষতে পারি ম্যাজিক, লুকিয়ে চক ও ডাস্টার’। কবি
স্বদেশ সেনের কবিতায় আছে ঐরকমই লুকোনো
হাতের একটা ম্যাজিক। এবং কবিতা পড়ে বোঝা যায় ওই ম্যাজিকের জন্য ভাষাকে কতটা
‘অপ্রচলিত গণিতের দিকে নিয়ে যাওয়া’ (কবিতা: অরুণাংশু) তাঁকে আবিস্কার করতে হয়েছিল।
২
যে মানবিক প্রেক্ষাপট থেকে স্বদেশ সেন দেখেছেন
জীবনকে, তার অবস্থান কিছুটা স্পষ্ট হয়েছে যখন লিখেছেন ‘আমাদের মতন মানুষ’। -তারা কারা ? যারা ‘সহযোগ চায় সহজ বন্ধুর মত’, যারা
‘আবার একটুর জন্যে মরে যায়’, যাদের ‘মুখে ফ্রথ, মৃগীঝাড় দেওয়া শরীর, সাটিনে বমি’ ।
এই কবি লক্ষ্য করেছেন, ‘সভ্যতা ও তার রঙিন
কামিজ ও তার ফাঙ্কিগান’। তাঁর কবিতায় আমরা দেখি উজ্জ্বল চোখের এক প্রেমিক যুবক, যে ‘সমস্ত মৌরির মত অনেক সইতে’ পারে। রুঢ়
বাস্তবের সাথে পাঞ্জা লড়ে জিতে এসে,
যে চায় ‘উরুত বাজিয়ে তরানা গাইতে”। -এই প্রাণশক্তি, এইসব সোজাসুজি ও মৃদুভাষ কথা,
সম্পুর্ণ বাক্যে এনে ধীরে আস্তে বলা এই ডাইরেক্টনেস, এভাবেই সহজ ও সরল হয়েছে পাঠকের সাথে তাঁর কবিতার
কমিউনিকেশান। যখন বলেন, “সমস্ত হারিয়ে আমি
আবার ক’য়ের থেকে শুরু করতে চাই”, তখন মুহূর্তে দেশ-কাল-বয়সের সীমানা পেরিয়ে একটা
সহজ চলাচলের পথ তৈরি হয়ে যায় কবির সাথে। একথা তখন হয়ে যায় হার-না-মানা ঘোর
সাংসারিক, চিরদিনের যাওয়াআসার আর্তি আর ছন্দ বাজে তাতে, -শ্রেণীচেতনার বেড়া টপকিয়ে
এভাবেই ‘আমাদের মতন মানুষ’ হয়ে যায় অনেক
মানুষের কথা।
কিন্তু এই যদি হয় স্বদেশ সেনের কবিতার প্রধান বিষয়, প্রতিপাদ্য, কেন্দ্রিয়
বোধ, তাহলে দৈনন্দিন জীবনের এই সব স্বাভাবিক ও চিরাচরিত টানাপোড়েন, এই সহজ দর্শন
আর পরম্পরাগত ব্যবহারিক প্রজ্ঞানের কথা কবিতার সম্পন্ন পাঠককে আজও মাতিয়ে তুলবে
কেন ? - এর উত্তর ব্যাপ্ত হয়ে ছড়িয়ে রয়েছে তাঁর সমগ্র রচনায়, তাঁর প্রত্যেক
কবিতায়, বিশেষত: ‘রাখা হয়েছে কমলালেবু’ বইয়ে। তাঁর কবিতার বাক্যগঠনে, পদপ্রকরণে,
শব্দচয়নে, উপমায়, যে গুণ শিল্পিত হয়ে আছে
; কবিতায় ফুটে ওঠা কিছু বিমূর্ত হিন্দোল, আর শব্দের ছিলাকাটা সোনালী উদ্ভাস তাঁর
কবিতাকে দিয়েছে যে উজ্জ্বল স্বাতন্ত্র, তা আমাদের মুগ্ধ করে রাখবে অনেক দিন।
রবীন্দ্রনাথের ‘দিনু-দিয়া কবিতা’র পরে বাংলা কাব্যভাষায় জীবনানন্দ যে পরিবর্তন
এনেছিলেন তা পরবর্তীকালে রহস্য হারিয়ে কবিতার সহজে ফিরে গিয়েছিলো, -এমনটাই একবার
বলেছিলেন আমাদের ক্যাম্পে। ‘এক থেকে তিনে
যেতে কতো বালুস্তর পেরলো আমাদের কবিতা’ (-গাছপালার গুণ)! -‘আদুর কঠিন কোমল নীরব ভঙ্গুর দেদার
কবিতা’। আর কবিতায় অন্য একটা লিরিক আনতে চেয়ে লিখেছিলেন, ‘একটু হাসো বিপদে পড়া লিরিক
/ মিশ্রভাবে জমজম করুক মনোভাব’। নতুন একটা অ্যাবস্ট্রাকশানের জন্য, যেন তার রহস্যময়তা ফিরিয়ে আনার জন্যেই গোপনে একটা
চ্যালেঞ্জ ছিলো তাঁর। কারণ, কবিতায় বিষয়ভাবকে বড়ো কোনও বাঁক দেওয়ার প্রসঙ্গে
নিজের সীমাবদ্ধতা সম্ভবতঃ বুঝতে পেরেছিলেন তিনি। আর তাই নজর দিয়েছিলেন ভাষার নতুন
ব্যবহারে। সংসার-জীবনে শব্দের রোমকূপ স্তরকে
গভীর অধ্যয়ন করেছেন, চিনেছেন মানুষ আর প্রকৃতির গায়েজড়ানো সম্পর্ককে। - লিখেছেন,
‘সব গরম ছাড়িয়ে এই ভাতের গরম রোমকূপ / আর ডাকের মেঘই কবির সাহিত্য’ (-ব’ল না জায়গা
নেই)। কবিতায় সেই ডাকের মেঘের
রূপ ‘অতিকায়’, ‘হুমানো’। আকাশে সেই মেঘ,
যা ‘গোবাম’-শব্দে ডাকে। এখানেই তাঁর কবিতার ক্রিস্টাল।
রবীন্দ্রোত্তর যুগে জীবনানন্দ, সুধীন দত্ত, ও বিষ্ণু দের পরে কবিতার উচ্চারণটাই পাল্টে দেওয়া দরকার বলেছিলেন তিনি। নতুন শব্দের জোরাজুরি নয়, শব্দ ভাঙ্গার পাগল-হাসানো-ধস্তাধস্তি নয়, বরং কথ্য, আকাঁড়া ও অপ্রচলিত শব্দের অসামান্য ‘নতুন ও অন্য ব্যবহার’, -এটাই ছিল তাঁর সামনে কবিতাভাষার ‘নবীকরণের’ জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ । লিখেছেন, ‘নতুন ও অন্য ব্যবহারে / ভরা চুলে করবীর মতো / দেখা হবে’ (-দেখা হবে বাদাম) ।
তাঁর কবিতায় বক্তব্য অনেকখানি। অনেক বলার কথা তাঁর। তার কিছুটা যদি দুনিয়াদারী ও সাংসারিক প্রজ্ঞান, তবে
বাকিটা তাঁর নিজস্ব ‘সাজমহলের’ কথা, -তার অন্তর্গত নাট্যরূপ ও চিত্ররূপ। কবিতায় ছড়ানো আছে কিছু অবিশ্বাস্য মোহিনী চিত্রকল্প
যেমন, ‘পায়রা পিছলে যাবে / এমনি হয়েছে আকাশ’ অথবা, ‘রোদ এমন যে কাগজে ছাপানো যায়’
(-অস্থায়ী) । আর এক ধরনের অ্যাবস্ট্রাকশান, -আমরা যাকে ক্রমে ‘চেতনকল্প’ বলতে শুরু
করেছিলাম। চাঁদিপুর ক্যাম্পে কবি কমল
চক্রবর্তীর প্রস্তাবিত এই কয়েনেজ ভালো লেগেছিল আমাদের । মানুষের মনোজগত যা নিজেই রহস্যময়, তার অপার পরিসরে অনেক সময়ে কোনও
চিত্ররূপকে অবলম্বন না করেও, শুধু কয়েকটা শব্দ-চিহ্ন-বাক্যের মিলিত আবেদন পারে এক
নতুন ভাবরহস্য নিয়ে চেতনায় ঝংকৃত হয়ে উঠতে। তাকেই আমরা বলেছিলাম ‘চেতনকল্প’। রচনাকে কবিতা করে তোলার এইসব সুত্রের অঢেল
সাক্ষাৎ পাওয়া যায় স্বদেশ সেনের কবিতায়। যেমন তিনি লিখেছেন, ‘মরা ঘুঘুর একটা দরজা আছে’ অথবা, ‘যা নেই সেই মৃদু জলের শূন্য’
অথবা, ‘রোদে ভরে ওঠে দেখ কমলালেবুর যত কাজ’। -এইরকম আরও টুকরো টুকরো অনেক লাইনে ধরা চেতনকল্প আর চিত্রকল্প, যা সম্পুর্ণ বুঝে ওঠা যায় না, কিন্তু
চেতনায় সেই বিন্যাসের একটা দোলা এসে লাগে।
দুই ধরনের গুণের কথা বোঝা যায় ওঁর কবিতায়, তারা সৃষ্টিগুণ
আর সেবাগুণ । ‘প্রত্যেক বেলার শূন্যে চালু দুহাতের গুণ ভরে’, -এই গুণ হল সৃষ্টিগুণ। আর ‘গুণ
লাগে কমলালেবুর / গায়ে গায়ে সমস্ত শরীরে’ -এই হল সেবাগুণ। এই দুই গুণের সাহায্যেই
জীবন গতিময় হয়ে ওঠে। ওঁর অনেক কবিতার
ভেতরে ভেতরে এই দুই গুণের ইঙ্গিত রয়েছে। তাঁর
কবিতার প্রধান গুণ শব্দচয়ন ও শব্দব্যবহার । প্রত্যেক শব্দকে বাছাই
করে, মেপে, ছিলা কেটে, ওজন ক’রে, গড়িয়ে, বাজিয়ে, তবে তাকে শব্দসারিতে এনে বসানো। সোজা
কথাকেও সোজাসুজি না বলে একটু ঘুরিয়ে বলেন। আর দেখার মধ্যেও থাকে একটা তেরছা ভাব। পাঠকের কাছে কেন্দ্র থেকে একটু সরিয়ে বসান ওঁর
প্রস্তাবনাগুলো। লেখেন, ‘তোমার খাবার ঠিক পাতের মাঝখানে দিতে পারবো না’ (-অক্ষর
নেবে না কিছু)। লেখেন, ‘সেন্টারে কিছুই নেই / আর কোনরূপ ডাকনেওলা’ (-এই বসবাস)। এইসব মিলে মিশে বাক্যে কবিতায় একটা
‘মাতোয়ারা’ তৈরী হয়। স্বদেশ সেন লিখেছেন, ‘ছিন্নভিন্ন ছবিকে ছবি করাই কবিতা’
(আদুর-অবোধ) । -এই তাঁর কবিতার উচ্ছ্বাস বিজ্ঞান,
তাঁর একান্ত নিজস্বতার ট্রেডমার্ক।
আমার মনে পড়ছে, ‘হে অনেক’ নামক কবিতাটা যার প্রথম
লাইনে আছে ‘হে অনেক আমগাছের দেশ’। এইটুকু লাইনের মধ্যে ‘আম’-শব্দে তিনি জড়ো করে এনেছেন বাংলাদেশের বিপুল জনজীবন
প্রকৃতি ইতিহাস ও লোকাচারকে, -তার পলাশীযুদ্ধের আমবাগান, বসন্তদিনের আমের মঞ্জরী,
পূজোর আম-পল্লব, বালকের হাতে আমআঁঠির ভেঁপু, আমজনতা, আমদরবার, ছাঁদনাতলায় আমকাঠের
পিঁড়ি, আমগাছের নীচে গ্রাম-সভা আর বুড়ো শিব মন্দির, খেলাঘরের আমপাতা জোড়াজোড়া, আর ঝড়-বাদলে আম কুড়োনোর দিন ; -এই সব। এইভাবে
তৈরী হয়ে যায় একটা ‘সম্প্রসারিত আমগাছ’,
আর মুহূর্তে তৈরী হয়ে যায় ‘অনেক আমগাছের দেশ’ শব্দবন্ধের অশেষ চিত্রকল্প। এইসব
নানান চিত্রকল্প ও চেতনকল্প, তাদের খন্ড খন্ড টুকরোগুলো নানাভাবে বিন্যস্ত হয়ে,
পারস্পরিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে গড়ে তোলে তাঁর কবিতার শরীর। এইসব শব্দ-ভেস্টিবিউল সাজিয়ে তিনি কবিতাকে খুলে দেন
পাঠকের জন্য, যেখান থেকে তৈরী হয় অনেকটা উন্মুক্ত যাতায়াত-সম্ভাবনা। এবং কবিতায় কোনও বিকল্প পথ নয়,
-অন্য কোনও পথ, যা দিয়ে পৌছনো যাবে কবির
কাঙ্খিত একই গন্তব্যে, তেমনও নয়। কিন্তু এইসব শব্দ-ভেস্টিবিউল খুলে রাখে অনেক পথ,
যা দিয়ে পাঠক তার নিজ নিজ বোধ ও মননের সুত্রে পৌঁছে যেতে পারে মনোজগতে এক অন্য
নতুন চেতনার পুঞ্জ মেঘে। সমস্ত আদৃত কবিতার
ক্ষেত্রেই যা প্রযোজ্য।
৩
একটা সুদূরের টান আছে ওঁর কবিতায়, যাকে ধন্য করে
ফুটে আছে অনেকটা প্রকৃতি। -‘সারা রাস্তা সোনার তারের মতো শব্দ’, আর ‘ধন্য ধন্য
বাতাসের চারকোণায় চারটে শিশির’ (-অত্যন্ত ভাস্কর)। -প্রথম পাঠেই রোমাঞ্চ জাগে। কখনো
মনে হয় সুররিয়ালিস্ট, নানা ইমেজ আসে, মনে হয় চারদিক থেকে যেন অনেক মাখন রঙের বেনারসী সুতো,
যাদের আরেক প্রান্ত টান দিয়ে বাঁধা আছে শূন্যে, সুদূর আকাশের হাওয়াবাতাসে কোথাও,
যেখান থেকে শিশির ঝরে পড়ছে। পুরো কবিতাটা পড়া হলে ফিরে এসে আবার অন্যভাবে থমকে
দাঁড়াতে হয় ওই লাইনটার সামনে।
ওঁর কবিতায় অনেক শূন্যতা-মেঘ-কুয়াশা-হাওয়া-জল-পাখি। যাদের নিয়েই তৈরী হয়েছে জীবনের অমোঘ ফ্রেম। কখনো
জীবনানন্দের কথা মনে আসে, মিলিয়ে যায়। আবার পড়ি, ‘এই শূন্য একা নয় দ্রুতি আর ঢিল
দিয়ে রাখা’ (-স্বচ্ছ সুবাগুলি)। এবং, ‘লম্বা
ক্ষীণ ইতস্তত পাখি’ যারা ‘ওয়াক শব্দে উড়ে যায়’ ওই শূন্যে! -এই
উড়ে যাওয়া, আর ঝরে পড়ার জীবনময় দেখা নিয়েই তাঁর সব কবিতা। সেই কবিতায় আছে একটা সংহত জীবন ও তার টানাপোড়েনের ছোট
ছোট আদর ও সেবা। আছে জীবনের জন্য জীবন
থেকে পাওয়া দুএক কাহন সরল ব্যবহারিক প্রজ্ঞান, যা ছড়িয়ে আছে সংসারে, নিকনো উঠোনে, অঙ্কিত
হয়ে আছে মাটিতে দাগ টেনে, আলপনার মতো। আছে
সংসারে অনেকখানি অঙ্গাঙ্গী জড়িয়ে থাকা, -যাকে ঘিরে আছে একটা অর্জিত ডিট্যাচমেন্ট, আর
যেভাবে শান্ত চোখে ‘সকল ও সুদূর এসে লাগে’, -সেই নির্জনতা। লিখেছেন, ‘ওর ঝাঁজ
মেজাজ বুঝতে সময় লাগে এক নিরালার মতো, যে সময়ে আলো নেই সেই এমন সময়’।
বরিশালের বারোইকরণ গ্রাম, ঝালোকাঠি নদীবন্দর, আর পোনাবালিয়ার খালেবিলে ভরা শ্যামল
বাংলায় শৈশবের দিনগুলো। -ওঁর ছোটবেলার একদিনের কথা
বলেছিলেন আমায়। দুপুরবেলা বাড়ি থেকে বেরিয়ে একা একা সাহস করে চলতে চলতে গ্রাম
পেরিয়ে, খাল পেরিয়ে, সাঁকো পেরিয়ে, তালবন ঝাউবন পেরিয়ে একদিন হঠাৎ দেখেছিলেন
সামনেই এক বিশাল নদী। ঘাবড়ে গিয়ে রোমাঞ্চে অবিশ্বাসে ঠায় দাঁড়িয়ে ছিলেন অনেকক্ষণ। ভয়
পেয়ে অনেকটা পথ দৌড়ে বাড়ি ফিরেছিলেন। আজ অনেক বছর পরে সেই কাহিনীর স্মৃতি খুঁজে
পেলাম ওঁর একটা কবিতায় : ‘আমার নানারকম শঙ্কা যে সেই ছিলো বিশাল আসল পদ্মা / এমনও
মনে হয় কখনো সেই পরম পারে দাঁড়িয়ে ভেবেছি / তাহ’লে আমি কি ঠায় দাঁড়িয়ে আছি / যখন
বয়ে যাচ্ছে বিশাল আসল পদ্মা ?’ (- খোঁজ)। -
বাল্যের একটা স্মৃতিচিত্রর রহস্যবীজকে শুধু ওই ‘বিশাল আসল’ আর ‘পরম পারে’ শব্দ
দুটো দিয়ে কবিতায় নি:শব্দে এক অবিশ্বাস্য চেতনকল্প তৈরি করেছেন তিনি, যার গভীর
সৌন্দর্য আমায় মুগ্ধ করে। -এবং কীভাবে জানিনা, অবচেতনের কোন সুত্রযোগে, কোন সবুজ
পোল পেরিয়ে, বুঝিবা ওই ‘পরম পারে’ শব্দ থেকেই আমার মনে ভেসে আসে বাড়ির পাশে এক
‘আরশীনগরের’ কথা; লালন শাহ ফকিরের লেখা সেই বিশাল-গান, ‘গেরাম বেড়ে অগাধ পানি / ও তার নাই কিনারা নাই তরণী পারে’। - এভাবে চেতনায় পুঞ্জ পুঞ্জ অনুভবের এক মেঘ থেকে অন্য
মেঘের আবেশে মুহূর্তে নিয়ে যেতে পারে কবিতাই। এইসব অজস্র মেঘে মেঘে গোপনে চলাচল
করে কত শত সঙ্কেত; -পাঠকের মনের উন্মুক্ত আকাশে এভাবেই শুরু হয় কবিতার মেঘায়ন, -যা
এক রকমের ‘ক্লাউড কম্পিউটিং’। কবির
জীবনবোধ, দেখার ব্যাপ্তি ও গভীরতা, নির্মাণশৈলী, ভাষাব্যবহার, আর উপস্থাপনার গুণে
কবিতায় যে উদ্ভাস আসে, -পাঠকের চেতনায় তা-ই সৃষ্টি করে ঐসব মেঘের আয়ন। ওই পুঞ্জ
মেঘে গচ্ছিত থাকে আমাদের অনেক খানি রং-তুলি, কালি-কলম, আলো-কাচ আর অপ্রচলিত গণিত।
বরিশালের সেই শৈশব, উনি যাকে ‘টায়ার ছেলেবেলা’ বলেছেন, সেখান থেকে শুরু করে এপার-যৌবনের
সিংভূম অবধি বিস্তৃত যে রোমান্টিক নিসর্গ। যেখানে পাহাড়ের নাম দলমা। নদীরও অনেক নাম,
-ঔরঙ্গা, কোয়েল, কারো। খড়কাই, কুজু, সুবর্ণরেখা। আর দূরে এক ‘প্যানোরমিক
গ্রাম ত্রিয়াং’ (-জলপ্রপাত)।
স্বদেশ সেনের প্রথম দিকের কবিতায় যে রোমান্টিক নিসর্গ, যার কিছুটা লিখেছিলেন সত্তরের
দশকে, -তাতে আশ্চর্যভাবে মিশে গেছে রূপসীবাংলার সবুজ বর্ষাবন, আর সিংভূমের আরণ্যক
পত্রমোচী বনের ছবি। সেই ছবি কোনও অ্যাক্রাইলিকে আঁকা উজ্জ্বল ক্যানভাস
নয়; বরং পটের ওপর তুলিতে আঁকা, অথবা যেন পুরু হ্যান্ডমেড পেপারে জল রঙে আঁকা ছবি।
তার রঙও যেমন ভেষজ, যেন তারা মাটি ফুল ও পাতার নির্যাস; -কাঁচাহলুদ, এলামাটি, শাহীজাফরান
ঘাস ও মেহেদিফুলের সব রঙ। কখনো ঝরা পাতায় আগুন
লাগানো দিন । এইসব আঙরা মাটি, ভারীজল, মহুল ও মাঝিন নিয়েই কথা। -একবার
‘পরাণকথা’ নামে একটা প্রবন্ধে নিসর্গ-প্রকৃতি নিয়ে উনি লিখেছিলেন, ‘প্রাকৃতিকতা আমাদের
দৃশ্যসুখ শব্দসুখের মধ্য দিয়ে আর কিছুই দেয় না, শুধু একটা অনুরণন দিয়ে যায়। এই
অনুরণনই সমস্ত শিল্পের জন্মদুধ।’ এই অনুরণনটুকু কাজে লাগিয়ে কবিকেই নির্মাণ করতে
হয় তাঁর কবিতা : ‘ফোটালে তবে না ঘর দরজা ফুটবে । বাজালে তবে না বাজবে তারা,
তারা’।
স্বদেশ সেনের
কবিতা নিয়ে আলোচনায় প্রবীণ কবি ও সমালোচক সমীর রায়চৌধুরী একবার মন্তব্য করেছিলেন,
দাঙ্গা ও দুর্ভিক্ষের সাথে এই কবির বোবা-কালা সম্পর্ক। আমার বরং মনে হয়েছে,
-দুর্ভিক্ষ, বন্যা ও দাঙ্গার কথা সরাসরি কবিতায় না এনে, তার বিপ্রতীপে জীবনে বেঁচে
ওঠার সপক্ষে, সুন্দরের সপক্ষে, একটা বড় প্রেরণা হিসেবে কবিতাকে গড়ে তুলতে চেয়েছেন
স্বদেশ সেন। এটাই তাঁর কবিতার এলান্ ভাইটাল । এর পরিচয় আছে ‘কালা জনম’ ও আরও অনেক কবিতায়। জীবনের দস্যুময় মরুভূমির দিক থেকে
যে গভীর পিপাসার সৃষ্টি হয়, -যেখানে ‘এমন নিসর্গ যার জল নেই, সুন্দর জোড়াই হয়ে
নেই’, -সেখানেই তাঁর ‘মৃৎভাণ্ডের মত ডাক’। সেখানেই ‘সমস্ত কবিতা দিয়ে এবারের নীল
ধরা পিপাসার জল’। -এই পিপাসার স্বরূপ সম্বন্ধে লিখেছেন, ‘যা পারি না সেইতো পিপাসা’। তিনি লক্ষ্য করেন মানুষের ‘হেরে
যাওয়ার স্টাইল’। বিশ্বাস করেন, ‘যে নদীর পরে নদী সাঁতরে যায় সে যে হারে না এ
জীবনে’। এবং অনুভব করেন, ‘খর
বন্যার চেয়ে আরো দ্রুত আজ মনোরথ’। মনে প্রশ্ন আসে, এই ‘দ্রুত মনোরথ’ কি একটা
পজিটিভ ফোর্স যা জীবনকে ভাঙন থেকে বাঁচায় ? অন্যভাবে দেখলে, হয়তো সে গোপনে নিজেই
ডেকে আনে কোনও দ্রুততর ক্ষতি। দুরকম ভাবেই প্রকাশিত হয় এই বাক্যবন্ধ, আর কবিতায়
তার দোলাটুকু লেগে থাকে।
৪
অনেক রকম প্রশ্ন আছে তাঁর কবিতায়, আমি লক্ষ্য করি। সেইসব সরল-জটিল প্রশ্নের
স্বরূপও ভিন্ন ভিন্ন, সবাই তারা প্রকৃত প্রস্তাবে প্রশ্নবোধকও নয়। শব্দার্থের সহজ
যুক্তির সীমানা পেরিয়ে কখনো তারা এক ভিন্ন বোধের জন্ম দিতে পারে ।
সেইরকম কয়েকটা প্রশ্ন, যা উন্মুক্ত করে দেখায় তাঁর
ভেতরের অস্থিরতাকে :
১) ‘বড় বেলা হল বুঝি সমস্ত হারিয়ে, / ময়না রে, ওই কি
সুখের পাখি ?’
২) ‘আমি কি শেষ পর্যন্ত জ্বলতে জ্বলতে দু’চোখের চামড়া খুইয়ে তোমাদের অন্দরে ঢুকে পড়বো ?
৩) ‘এভাবে সমস্ত যদি মর্মবাদ মর্মর, বানানো / সঠিক নিজের হাতে কে ঘটাবে সুন্দর ডিজাইন ?
৪) ‘মৌমাছি ভরসা ফুল তো আমি কার ভরসায় ?’
৫) ‘নতুন কোথায় থাকে, নতুনের কোনও দুঃখ নেই ?’
৬) ‘কেউ যে বিবাহপত্র লেখে / কি ভাবে উদয় হলে লেখে ?’
৭) ‘আমরা কি সেই আখ মাড়িয়ে স্রোতের দেখা পাবো’
৮) ‘আরও কি জ্বালানো যায় আমাদের রাত্রির আলোটা ?’
৯) ‘তা হলে বড় ক’রে হ’লনা -ভালো ক’রে হ’লনা কিছু ? ’
১০) ‘কেউ আমাকে ঠেকাতে পারবে এই ভোরবেলায় ?’
২) ‘আমি কি শেষ পর্যন্ত জ্বলতে জ্বলতে দু’চোখের চামড়া খুইয়ে তোমাদের অন্দরে ঢুকে পড়বো ?
৩) ‘এভাবে সমস্ত যদি মর্মবাদ মর্মর, বানানো / সঠিক নিজের হাতে কে ঘটাবে সুন্দর ডিজাইন ?
৪) ‘মৌমাছি ভরসা ফুল তো আমি কার ভরসায় ?’
৫) ‘নতুন কোথায় থাকে, নতুনের কোনও দুঃখ নেই ?’
৬) ‘কেউ যে বিবাহপত্র লেখে / কি ভাবে উদয় হলে লেখে ?’
৭) ‘আমরা কি সেই আখ মাড়িয়ে স্রোতের দেখা পাবো’
৮) ‘আরও কি জ্বালানো যায় আমাদের রাত্রির আলোটা ?’
৯) ‘তা হলে বড় ক’রে হ’লনা -ভালো ক’রে হ’লনা কিছু ? ’
১০) ‘কেউ আমাকে ঠেকাতে পারবে এই ভোরবেলায় ?’
তাঁর কবিতার প্রাণকেন্দ্রে আছে সাংসারিক মানুষ আর প্রকৃতি। খুব মনোযোগ দিয়ে
তিনি তাঁর আশেপাশের জীবনকে প্রকৃতিকে নিরীক্ষণ করেছেন, অধ্যয়ন করেছেন মানুষকে। এই
দেখার মধ্যেও রয়েছে তার নতুন। দেখেছেন,
‘প্রত্যেকের আলাদা ফুল তো আলাদা প্রজাপতি / লুঙ্গিতে নিজের নিজের চামড়ার দাগ’।
অনুভব করেছেন ‘উনুনে সামান্য ওঠাপড়া’।
নজরে এসেছে, কোথায় রয়েছে ‘নিচের পাতায় বিষ পিঁপড়ে আর লাল পিঁপড়ে’। এইসব অন্তরঙ্গ অধ্যয়ন, -ভিন্ন ভিন্ন প্রসঙ্গে তারা কবিতায় এসেছে, অদ্ভুত
দৃষ্টিকোণ আর বাক্যবন্ধে প্রকাশিত হয়ে। ‘বামপন্থী সাহিত্যের’ চাপাচাপি থেকে মুক্ত
হতে স্বদেশ সেন তৈরি করেছিলেন তাঁর নতুন কলম। তাঁর কবিতার সেই পালাবদল ঘটেছিলো ’৭০-’৮০র দশকে, কৌরবের
দিনগুলোর পাশাপাশি। কাস্তেতে শান দেওয়ার কথা না ব’লে, ভিয়েতনাম বলিভিয়া
কিউবা সাংহাই আফ্রিকার কথা না ব’লে, কবিতায় জীবনের আলোর সপক্ষে তাঁর উচ্চারণ :
‘জন্ম-পঙক্তি থেকে একটা লাইন পড় / সারা সৃষ্টিতে এই প্রথম একবার কাজ / পড় এমন করে,
এমন অসাধারণভাবে পড় / যা মৃত্যুচিৎকার থেকে বড় ও সমানে ছড়িয়ে যায়’ (-কোথায় এক
পরিবর্তন)। আর অন্ধকারের কথায়
লিখেছেন : ‘গোটা আলগা কয়েকটা বিশ্বাসের কাছে সাধু ইতর সব ভাবনাকে বলি, যখন
অন্ধকার, অন্ধকারে গণ-সঙ্গীত ধরে গাও’।
মায়াময় জীবন ও প্রকৃতিতে ‘মানুষ ও লীলা মধ্যে যে হাইফেন’, তা-ই তাঁর কবিতার
উৎস। সেখানে ‘কোন এক নীরব ও নিয়ত কথা আছে’, এবং ‘এই সব অন্তর্ভুক্ত কথা জেনে যে নিতেই হবে জীবনে’। জীবনের চঞ্চল ও অস্থির
আবহ থেকে উদ্ধার পেয়ে তৈরি হয়ে আছে একটা বাসযোগ্য শান্ত পরিসর, -যা ‘দড়াম শব্দের
থেকে দূরে’।
-সেখানে ‘মৃদু শুদ্ধ উচ্চারণ’, আর ‘গুঞ্জন’ শব্দ, -সেখানে
‘ধীরে আস্তে বাঁক নেয় বন্ধনী’। লিখছেন, ‘এখন এখানে থেমে আস্তে এসে
চুপ করে আছি’। -এই হল কবিতার স্পীকার। তার জীবাত্মা। ‘হদ্দ
হাটুরের মতো’ জীবনকে নিকেলে তামায় কেনাবেচা হতে দিয়ে স্বপ্নে কেঁদে ওঠা কবিতার
যুবক। যে ভয় পায় ঝড়ে। সূর্য ডুবে গেলে যে থাকে চাঁদের
অপেক্ষায়, আর চাঁদ ডুবে গেলে খোঁজে এককণা খনিজ তারা। যে বাঁধা পড়ে আছে সম্পর্কের অজস্র বাঁধনে, অথচ
চায় একা ও নির্ভার হতে। লিখেছেন, -‘কাউলের নিঃসঙ্গ ঘোড়া যেমন নেফা থেকে / তাকলামাকানের
দিকে একা ও নির্ভার’ (উপত্যকা থেকে নেমে)। আমার মনে পড়ে যায় ১৯৬২ সালের ইন্দো-চীন
যুদ্ধে উত্তর-পুর্ব ভারতের নেফা সেক্টরে আর্মি
কমান্ডার ব্রিজ মোহন কাউলের কথা। আর চীন দেশের তাক্লামাকান মরুভুমির মৃত্যু- উপত্যকা,
যার বহু দূরে দূরে দুএকটা মরুদ্যান, যার দুপাশ দিয়ে চলে গিয়েছিলো সিল্ক রুট। -ওইটুকুই
ইতিহাস ও ভূগোল, কিন্তু তার সাথে কী অদ্ভুতভাবে স্বদেশ সেন জুড়ে দিয়েছেন নিঃসঙ্গ ঘোড়ার ইমেজ, - যে একা ও নির্ভার !
রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে, কালপ্রবাহে, কীভাবে নিসর্গের চিত্রকল্প ধীরে ধীরে
বদলে গিয়েছে, আমি লক্ষ্য করি। শরৎকালের রোদ-সকালের বর্ণনায় রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন,
‘ধানের ক্ষেতে রৌদ্র ছায়ায় লুকোচুরি খেলা’। যেমন জীবনানন্দে আছে, ‘শুয়েছে ভোরের
রোদ ধানের ওপরে মাথা পেতে / অলস গেঁয়োর মতো’। আর স্বদেশ সেনের আঁকা ছবিতে এসে আমি
দেখছি আকাশে কার থাবার বন্য চিহ্ন, -‘নীল
রবারের থাবা পড়ে গেছে এইসব আকাশের গায়ে’ ! এই রাবারের ইমেজ আমি কমল চক্রবর্তীর কবিতাতেও দেখেছি, ‘রাবার সেদ্ধ
হয়ে ফুলে ফুলে উঠেছে একবার এমন ফাঁকা আকাশ’। কবিতার ক্যাম্পে স্বদেশ সেন একবার
আমাদের বলেছিলেন পঞ্চাশের দশকে ওঁর পছন্দের এক কবির কথা, যাঁর নাম মণীন্দ্র গুপ্ত।
বলেছিলেন, -কেউ চিনিয়ে দেয়নি, আমি আবিস্কার করেছি ওঁকে, ওঁর কবিতাকে। কখনো আমার
মনে হয়েছে, পঞ্চাশের কবিদের মধ্যে সম্ভবত মণীন্দ্র গুপ্তের সাথেই স্বদেশ সেনের
কবিতার বীজের কিছুটা নৈকট্য রয়েছে ; সেই পরিবেশ, মেজাজ, অনুষঙ্গ ও শব্দচয়নের
কিছুটা আভাষ পাওয়া যায় মণীন্দ্র গুপ্তের ‘হুল’, ‘শিলচরের গল্প’ ও ‘শেষ অন্ধকারে’
কবিতায়।
৫
কৌরবে আশির দশকের সেই দিনগুলোতে এমন অনেকসময়
হয়েছে, আমি আর কমলদা সাপ্তাহিক সন্ধ্যেবেলা ওঁকে বাড়িতে না পেয়ে হাজির হয়েছি
মাইলখানেক দূরে বার্মামাইন্সে, ওঁর নিজের
স্টীলের আলমারী বানানোর কারখানায়। সেখানে টিনশেডে কাঠের বেঞ্চিতে বসে অনেকটা
অপেক্ষার পর আবার ওঁর বাড়িতে ফিরে ভাগ্যক্রমে পেয়ে গেছি ওনাকে। এত টান ছিলো, এত
কথা ছিলো আমাদের মধ্যে। সেইসব আলমারীর শীটমেটাল হিঞ্জ-জয়েন্ট আর পেন্টের প্রসঙ্গ এড়িয়ে
আমরা সরাসরি চলে আসতাম কবিতার শব্দরূপে উপমায় অ্যাবস্ট্রাকশানে। স্বদেশ সেনের কবিতায়
যে কথা বলে সে একজন সহজ বন্ধু, প্রেমিক যুবক, স্নেহময় পিতা, দায়িত্বশীল প্রতিবেশী,
গ্রামীণ মুখিয়া । গৃহস্থজীবন ও সংসারের চিরায়ত প্রেম আহ্লাদ সেবা উদ্বেগ ও
শুশ্রূষার আয়োজনে পাঠকের সাথে সোজাসুজি কথা বলে কবিতার ‘আমি’। সেই ‘আমি’ সুখ পেতে চেয়ে সুখের সন্ধানে জীবনপাত করে। আবার যখন ‘চরিতার্থ হতে গিয়ে’ ফিরে আসে
হতাশ হয়ে, তখন ‘গাছের মতন খুব কম্প ওঠে ভেতরে ভেতরে’, আর ‘একা একা কাঁপ আসে’। এই
ভেতরে কাঁপনই সেই সবুজ পোল, যেটা দিয়ে আমরা কবিতার ভেতরে আসি যাই। পাঠকের তখন কবিকে খুব আপন মনে হয়। গ্রীষ্মদিনে
তৃষ্ণার শীতল জলের মতো ওঁর কবিতা, -আমাকে জানিয়েছিলেন জামশেদপুরে স্বদেশ সেনের
কবিতার এক তরুণ পাঠক।
একটা অর্জিত ডিট্যাচমেন্ট, -যার কথা আগেই বলেছি, যেজন্য
কবিতায় তাঁর অবস্থান কিছুটা দর্শকের মত, মহৎ কথাশিল্পীর মত। আবার কিছুটা আছে হাড়েমাসে
অন্তর্ভুক্ত হয়ে থাকা। এই দ্বৈত অবস্থান ও বিশ্বাসের মধ্যে তাই সংঘাতও হয়। যৌবনে
বামপন্থি সাহিত্য মতাদর্শের অনুরাগী ছিলেন তিনি। ঈশ্বরের অস্তিত্বে কোনও বিশ্বাস নেই আমার, -বলেছিলেন। জীবনে আমি শুধু মাথা নত করি একটা
সুন্দর যুক্তির কাছে, -বলেছেন। তবুও তাঁর কবিতায় এসে যায় দেবতা, ঈশ্বর, ভগবান :
১) ‘চা পান – সুন্দর কাপ – আজ বড় দেবতার হাত ।’
২) ‘ভগবান করুক যেন হাতগুলো খালি না থাকে’
৩) ‘আমি থাকি, পড়ে থাকে আমার টায়ার ছেলেবেলা / ভারতবর্ষের মাঠে হিমালয় হয়ে পড়ে থাকে / গঙ্গাজলে, বরফে ও দেবতায় ; দেবী পদতলে ।’
২) ‘ভগবান করুক যেন হাতগুলো খালি না থাকে’
৩) ‘আমি থাকি, পড়ে থাকে আমার টায়ার ছেলেবেলা / ভারতবর্ষের মাঠে হিমালয় হয়ে পড়ে থাকে / গঙ্গাজলে, বরফে ও দেবতায় ; দেবী পদতলে ।’
বোঝা যায় এই ঈশ্বরের অবস্থান তাঁর ব্যক্তিগত বিশ্বাসে
নেই, কিন্তু তা রয়ে গেছে আরো অনেক মানুষের
মধ্যে ও গ্রামীণ জীবনের মূলে ; ভারতবর্ষের মাঠে হিমালয়ের মতো সেই
সার্বিক বোধের তিনিও অংশীদার । -সংসারের বৃহৎ ভিত্তিতে ধরা আছে যে
ঈশ্বরের ধারণা, তাকে তিনি লক্ষ্য করেন এক
দর্শকের মতো, কথাশিল্পীর মতো। সেভাবেই তাঁর কবিতায় এসেছে
ঈশ্বরের প্রসঙ্গ, কেননা ‘আমার বিষয় ব’লতে তোমার বিষয়’ -এই তাঁর অকপট যুক্তি।
কখনো মনে হয়েছে ঈশ্বরবোধ রয়েছে তাঁর মগ্নচেতনায় (buried self), আর অবিশ্বাস রয়েছে তাঁর অর্জিত জ্ঞানে (acquired self) । লিখছেন, ‘রিনরিনে লাল পিঁপড়ে খোঁজে
/ যা খোঁজে তাই কি শিব / ঈশ্বর কি খোঁড়লে
থাকেন’। মনোজগতে আস্তিক/নাস্তিক -এই দুই সত্তার বোঝাপড়া-খেলায় ক্রমে একটা উন্মোচন
হয়, যা তাঁর মেধায় নিয়ে আসে প্রেমের প্রস্তাব । লেখেন, ‘নাস্তিক্য আজ কবীরের প্রেম হোক’ (জল-বিজ্ঞান)। -তখন বোঝা
যায়, সংঘাত এড়িয়ে এই হ’ল তবে ন্যাশ-ইকুইলিব্রিয়াম। আজকের অনেক লেখকের ‘আমি নাস্তিক’, –এই সোচ্চার ঘোষণায়
ক্রমে জানা যায় যে বাঘছাল-ডমরু-ত্রিশূল শোভিত মাদকসেবী শিবঠাকুর ও দশহাতি দুর্গার বসতবাড়ি
যে কৈলাসে নেই, কখনো ছিলো না, তার অকাট্য
প্রমাণ তারা হিমালয় দর্শন করেই পেয়ে গেছে। কিন্তু কবির দর্শন অন্যভাবে গড়ে ওঠে, সমস্ত
অন্বেষণের প্রান্তে এসে সময়প্রবাহের ভাঁজে ভাঁজে তিনি অনুভব করেন প্রেমের
সর্বব্যাপী শক্তির চঞ্চল উপস্থিতিকে। হয়তো সেই প্রেম থেকে চেতনায় তৈরী হয় ‘পরম’-এর বোধ। সেই আলোয় তিনি নতুন করে
দেখেন সংসারে তাঁর চারপাশকে। তখন তিনি কবিতায় ওই ‘বিশাল আসল’ জলরাশির সামনে ঠায় দাঁড়িয়ে
লেখেন ‘পরম পারে’ শব্দটা ।
স্বদেশ সেনের কবিতা পড়ে আমার মনে হয়েছে, লালনের গানের
মতো লোকগীতিতে ও সুফি-ভাবনায় যে নিবেদন ও গূঢ় রহস্যময়তা আছে তা ওঁর অনুভবকে
মজিয়েছিলো। এবং কবীরের দোঁহাগুলো, -সেখানে দু-লাইনের মধ্যে আধৃত যে বাচনভঙ্গি, তার
সাথে কোথাও কখনও মিল আছে স্বদেশ সেনের
কবিতার উচ্চারণে।
কবীর : ‘বড়া হুয়া তো কেয়া হুয়া / য্যায়সে পেড় খজুর
পন্থি কো ছায়া নহি / ফল লাগে অতিদূর’
পন্থি কো ছায়া নহি / ফল লাগে অতিদূর’
স্বদেশ : ‘আম-গৌরবটুকুই আম গাছ / মৌ মরিয়ম হ’য়ে ফেরে
ক্ষেত পাতা অন্নরূপ হয় / সুপুরীগাছ শান্তি-কল্যাণ ।’
ক্ষেত পাতা অন্নরূপ হয় / সুপুরীগাছ শান্তি-কল্যাণ ।’
আমার মনে হয়েছে, যে যুক্তির কাছে তিনি ‘মাথা নত করেন’ তা নিতান্ত কার্য-কারণের
যুক্তি নয়, আইনের যুক্তি নয়। তা আসলে জীবনের সপক্ষে তাঁর অর্জিত দর্শন। বোঝা যায় প্রচলিত
‘যুক্তি’-শব্দের মধ্যেও একটা ‘প্রচল থেকে
অন্য’ যুক্তির আশ্রয় আছে, যা একরৈখিক নয়, আইনসিদ্ধ নয়। সেই যুক্তির ওপরেই
প্রতিষ্ঠিত তাঁর প্রজ্ঞা। নিজস্ব বোধের জগতে তিনি
আবিস্কার করেন মানুষ ও প্রকৃতি মিলে কীরকম একটা পূর্ণতার মায়া সৃষ্টি হয়ে থাকে
সংসারে, চরাচরে। সেভাবেই গড়ে উঠেছে তাঁর কবিতার যুক্তি। লিখেছেন, ‘যে হাওয়ায়
চরাচরের ধুলো আর পট্টবাস উড়ে যায় / সে হাওয়ায় কি কোথাও কিছু কম ?’ -এই রাবীন্দ্রিক
ও অদ্ভুত অ্যাবস্ট্রাকশানের সামনে দাঁড়িয়ে মনে হয়েছে, প্রশ্ন নয়, এক পূর্ণতার কথাই
বোধ হয় বলেছেন তিনি।
স্বদেশ সেনের কবিতায় এক একটা টুকরো লাইনের মধ্যে রয়েছে এমন সব চেতনকল্প, ভাব,
অ্যাবস্ট্রাকশান, যে থমকে যেতে হয়। কয়েকটা লাইন এখানে দেওয়া যাক।
১) ‘তুমি এখন বুঝবে / কি করে আখের আঁশ ভিজে যায় কাবেরীর
জলে’
২) ‘আকাশে আপেলটা শুধু জেগে উঠে আবার ঘুমায় !’
৩) ‘যে বিন্দু নদীর বিন্দু সেই বিন্দু ঝরে পড়ে যায়’
কোথাও আছে কর্তা ও কর্মের জাক্সটাপোজিশান ক’রে ঘুরিয়ে দেখা, যেমন : ‘নতুন
ব্যারেলে জল, আলো-করা বিদ্যুৎ ফুটেছে’ । এখানে আলো ফুটেছে না বলে বিদ্যুৎ ফুটেছে
বলা হোল । অথবা যেমন, ‘পৃথিবীকে
ভোজন করেছে যে আখ তার শিহরিত রসে’। -এইরকম অদ্ভুত ঘুরিয়ে
দেখা আমি দেখেছি উৎপলকুমার বসুর কবিতাতেও : ‘মৃত্যুই তোমার ঘরে বসন্তের অদ্ভুত
স্ফুলিঙ্গ জ্বালায় বারংবার’।
এর পাশে উপমার ব্যবহারও আছে অনেক ও অদ্ভুত, লাইনে লাইনে, মিলেমিশে, রূপবান
হয়ে।
১ ) ‘রাতমোচনের মতো উবু হয়ে বনবিড়াল সেই সব খুঁটে
খায়’
২) ‘মৃৎভান্ডের মতো আমি ডাক দিই, সামনে স্লেট পাথর টিলা’
৩) ‘ফিরে আসি চরিত্র হারিয়ে একা লবঙ্গের মতো’
৪) ‘লঘু অঞ্জনের মতো জ্বলে
ওঠো গোলাপের মতন জ্যামিতি’
এর সাথে আছে সাংসারিক জীবনের কিছু অনুভব
ও প্রজ্ঞানের কথা :
১) ‘মানুষের কত রূপ ও অনুকম্পিত ভাব আছে’
২) ‘কি যেন সমস্ত ছিল গতি আর বলের ভেতরে’
৩) ‘রেশমকীটের মতো আত্মপ্রতিকৃতি ভাঙো’
৪) ‘কিছু কিছু ভোলা চাই, পরিষ্কার ক্ষমা চাই মনে’
৫) ‘আগামী ও অবশ্যম্ভাবীর জন্য সুন্দর হও’
৬
স্বদেশ সেনের কবিতা প্রসঙ্গে প্রবীণ কবি ও
সমালোচক সমীর রায়চৌধুরি বলেছেন : ১) একরৈখিক যুক্তি, ২) বিবৃতির দিকে ঝোঁক, ৩)
চেনা শব্দকে অচেনা পরিসরে নিয়ে যাওয়া, ৪) ভাষা বদল ও আন্তর্বৈষিকতার বিশেষ সন্ধান
নেই। -এছাড়াও, পরীক্ষা নিরীক্ষার মেজাজ, এবং অভিনবত্বের
আহ্লাদের উল্লেখ করেছেন তিনি।
আমার মনে হয়েছে, স্বদেশ সেনের কবিতায় কি কি নেই সেই নিয়ে হয়তো দীর্ঘ লিস্ট
তৈরী করাই যায়। কিন্তু তাঁর কবিতায় যা
আছে, যেমন ভাবে আছে, -তার বিপুল সম্ভার আড়াল করে রেখেছে যা নেই, তার অনেকটাকে।
বক্তব্যপ্রধান কবিতার দিন কি একদিন শেষ হয়ে যাবে ? আমি ঠিক জানিনা । তবে মানুষের সাংসারিক জীবনের সাথে যতদিন যুক্ত হয়ে থাকবে প্রকৃতি,
যতদিন ‘নদীর পাড়, গোধূলি, জেলে নৌকোর জাল -এই উচ্ছ্বাস বিজ্ঞান’, আর যতদিন এই
অস্থায়ী জীবনে থাকবে ‘লঘু অঞ্জনের মতো জ্বলে ওঠার’ প্রয়োজন, ততদিন বাঙালি পাঠককে
ফিরে ফিরে আসতে হবে তাঁর শব্দলোভী বাক্যের কাছে, কবিতার সৌন্দর্য ও রহস্যময়তার কাছে।
এই কবির কাছে জীবনে কষ্ট আছে পরিশ্রম আছে, আছে যতটুকু কাজ ততটুকু মজুরির কথা। এবং জীবন কোনও
অন্ধকার কর্কশ কলুর ঘানি নয় যেখানে সর্ষে মাড়াই করে তেল বেরোয়। জীবন যেন দিনের
আলোয় দেখা এক আখ মাড়াই কল, আর তার মিষ্টি রসের স্রোত। লিখেছেন, ‘আমরা কি সেই আখ মাড়িয়ে স্রোতের
দেখা পাবো ?’ -বিশ্বাস হয় যে একদিন পাবো সেই স্রোতের স্বাদ ; আবার কখনো সন্দেহ হয়,
-‘কী বিশ্বাসে কে বলছে কারে, ভালো হবে দিনকে দিন, দিনকে দিন’। -লৌকিক জীবনের এই
টানাপোড়েন, তার প্রাণের উল্লাস ও শৃঙ্গার, আর বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচলের কথা রূপময়
হয়েছে তাঁর কবিতায়। তবে সমস্তটাই বাঁধা আছে একটা অন্তর্গত রহস্য-বিষাদের সুরে। ‘এই
আমি ভেতরে তৈরী হলাম বরং নীল বরং দুঃখী’। -এটাই ওঁর কবিতার বোধ ও বাঁধুনির সুতো। এর
ভেতরেই ধরা আছে সমগ্র কবিতার ইন্টিগ্রিটি।
এই বিষাদ আমরা দেখেছিলাম জীবনানন্দে। দুজনেই নদীমাতৃক রূপসীবাংলার বরিশালের
মাটি জল বাতাস থেকে এসেছেন। জিওপোয়েটিক্সের গুণে দুজনের কবিতা রচনায় তাই কিছু কিছু
মিল আছে, -যার মধ্যে দেশজ শব্দ এবং আলটপকা ইংরিজী শব্দের অদ্ভুত ব্যবহার তো আছেই। স্বদেশ
সেন লিখেছেন এক ‘মরিয়া-ম্লান-মায়াচুর’ জীবনের সৌন্দর্য ও রহস্যের কথা। আর
জীবনানন্দ লিখেছেন, ‘পৃথিবীকে মায়াবীর
নদীর পারের দেশ ব’লে মনে হয়’। দুজনের লেখাতেই আছে আকাশ জল হাঁস পাখি কুয়াশা ময়ূর মরুভুমি
ফসল, আর পাড়াগাঁর মেয়ে বউয়ের প্রসঙ্গ । আছে
পিপাসা, প্রেম ও পচনের কথাও। জীবনানন্দের অনুভবে যেমন আছে ‘নষ্ট শসা -পচা চাল
কুমড়ার ছাঁচ’, তেমনি স্বদেশ সেনে আছে, ‘খড়ে পচন’, ‘চালতার পচা’, আর ‘সারারাত রাতের
পচন’। জীবনানন্দে
আছে, ‘সকল লোকের মাঝে ব’সে / আমার নিজের মুদ্রাদোষে / আমি একা হতেছি আলাদা’। তার
প্রতিফলন দেখেছি স্বদেশ সেনের লেখায়, ‘আজ আমার ভিন্ন হৃদয় শত শত হৃদয়ের থেকে
ভিন্ন’ (-তুমি যোগ করেছো )। জীবনানন্দ দাশ আর
স্বদেশ সেন, দুজনের লেখাতেই বারবার এসেছে ঝরে যাওয়ার কথা। জীবনানন্দ : ‘আমি ঝরে
যাবো –তবু জীবন অগাধ’। স্বদেশ সেন : ‘শুধু এই চলে গিয়ে থেমে যাওয়া কোন / সবুজ
পোলের কাছে ; একমনে ঝরে যাওয়া ভালো’। -এই ‘ঝরে যাওয়া’ শব্দবন্ধের মধ্যে সেই বহু
ব্যবহৃত চিত্রকল্প রয়েছে, যা ঝরা পালক, ঝরা পাতা, ঝর্ণা, মেঘ থেকে বৃষ্টি, আর ক্ষত থেকে
রক্ত ঝরার মতো। যা একটা অবসানকে সূচিত করে। যা আমি বিনয় মজুমদারেও পড়েছি : ‘ভয় হয়,
একদিন পালকের মতো ঝরে যাবো’। -ঝরে যাওয়া নিয়ে
তিন কবির এই সব ভিন্ন ভিন্ন অনুভব; যা কখনো নিশ্চয়তা, বাসনা, ভয়। আরেক জায়গায় মিল
দেখেছি স্বদেশ সেনে ; -জীবনানন্দের মতোই হঠাৎ একটা ইংরিজী শব্দকে বেমালুম টেনে এনে
বাক্যের মধ্যে আশ্চর্যভাবে বসিয়ে দেওয়া : ‘কেউ কি হো হো করবে পেছন থেকে / পালিয়ে বাঁচবে ওয়েলকামের মেয়ে’ (-ওপরে)।
দুই কবির মধ্যে অমিলও আছে অনেক। জীবনানন্দ অনুভব করেছেন সময়ের শত শতাব্দীর দীর্ঘ
প্রেক্ষিতে জীবনের সকল রণ-রক্ত-সফলতা ও প্রত্ন-ইতিহাস, যা হৃদয়কে করে ক্লান্ত
বিষাদগ্রস্ত, আহ্বান করে স্থবিরতাকে, আর কামনা করে অনন্ত মৃত্যুর মধ্যে নীল অন্ধকার
ঘুম। অন্যদিকে স্বদেশ সেনের
লেখায় স্থবিরতার বিপক্ষে আছে, ‘যা চলন্ত তাই ভালো / লোকে বলে এই সুখ ভালো’। স্বদেশ
সেন কবিতায় বলেছেন, সংসার ও প্রকৃতির গায়ে জড়ানো আনন্দসম্পর্কের কথা, তার গতিময়
ভালোবাসা ও ভালবাসার গতিময়তার কথা। ‘ওই ভূমিতল, ওই
ঊর্ধ্বগমন, ওই ছুটন্ত ই-মেল’। ওই কাঙ্খিত গতিময়তা থেকেই ফেরত নজরে তৈরী হয় একটা বিষাদ,
যা ছড়িয়ে আছে তাঁর সমস্ত কবিতায়, -তার
কিছুটা যদি ‘রোমান্টিক’, তবে বেশিটা যেন আধুনিক সময়ের পলাতক ছবি লক্ষ্য করে, ঝরে
যাওয়ার অনিবার্যতা উপলব্ধি করে।
জীবনানন্দের প্রচ্ছায়া তার কিছুটা ধূসরতা নিয়ে এসে পড়েছিল কবি উৎপল কুমার বসুর
‘পুরী সিরিজে’, এবং কবি বিনয় মজুমদারের ‘ফিরে এসো চাকা’য়। এঁদের কবিতাতেও রয়েছে এক বিষাদ-বেদনা-ধূসরতা। জীবনানন্দ যেখানে পৃথিবীর
গভীরতর অসুখ জেনে, ক্লান্ত হয়ে, অনেক ঘুরে, লাস কাটা ঘরে ‘শান্তির’ আশ্বাস আছে দেখেছেন,
সেখানে স্বদেশ সেনের বিশ্বাস তাঁকে ধরে রেখেছে গৃহসংসারে ‘সুখের’ খোঁজে, সেখানেই
তাঁর প্রাণের আরাম । বিনয় মজুমদারের কবিতায় ‘বেদনার গাঢ় রসে আপক্ক রক্তিম’ হয় ফল, আর স্বদেশ
সেনের কবিতায় ফল হয় গৃহসুখে পাকা ; -‘পোষা অবতল গাছ যা আমাকে দিয়েছিল ফল গৃহসুখে
পাকা’ (-জল)। এইখানেই স্বদেশ সেনের
দর্শনের স্বতন্ত্রতা চিহ্নিত হয়ে আছে।
৭
স্বদেশ সেনের কবিতায় দর্শনের চেয়ে নির্মাণের
ব্লুপ্রিন্টটাই অনেক বিশেষ অভিনিবেশ দাবী করে। কারণ স্বদেশ সেনের দর্শনকে ছাপিয়ে
উঠেছে ওঁর স্টাইল। বিশেষত ওঁর শব্দচয়ন। কবিতা পড়ে প্রথমেই যা নজরে আসে সেটা ওঁর ওই
ঘুরিয়ে দেখা দৃষ্টিকোণ, এবং বাক্যগঠন। ব্যবহার
করেন অব্যয়ের একটু এক্সট্রা ডোজ : এই এখন এবার কি তবে অতএব যা যদিও এভাবে আরো তা
তবুও যত যেই সেই সমস্ত কখন কার যখন যেন যেভাবে তত সেভাবে ; -এইসব ব্যবহারে ও বাক্যের
পদপ্রকরণে একটু নড়াচড়া এনে, এবং লুকোনো কাঁচা শব্দদের খুঁজে এনে একসারিতে বসিয়ে তাদের
বাজিয়ে দেখেন। আর এভাবেই তৈরী হয়ে ওঠে
বাক্যের মাতোয়ারা। সহজ অনুসরণে তাকে ধরা
যায় না, কারণ সেটাকে পেশ করেন চেতনার সহজ
কেন্দ্র থেকে একটু সরিয়ে। এভাবে তৈরী করেন অবিশ্বাস্য অ্যাবস্ট্রাকশান, -তৈরী হয়
চেতনকল্পের রহস্য। কখনও একসারিতে তিনটে ভিন্ন ভিন্ন প্রকৃতির বিশেষ্য পদকে পর পর
ব্যবহার করেন, যা দিয়ে তৈরী হয় এক নতুন রহস্যময়তা। যেমন, ‘ওই সব আমার সাজমহল দূরে,
দুঃখে, তারায়’ অথবা, ‘ওই কীটপতঙ্গ যারা শব্দ করে – জঙ্গলে, শরতে, মধ্যখানে’। এইরকম
আরো ।
এক একটা কবিতার নির্মাণে ব্যবহার করেন ষোল থেকে কুড়ি-বাইশটা লাইন; কখনো তারা আপাতভাবে হয়তো অসংলগ্ন । এইসব লাইন, যারা নির্ধারিতভাবে পর পর সাজানো, যা নিয়ে
বেড়ে ওঠে কবিতা, তারা ধরা থাকে একটা অন্তর্নিহিত যুক্তির বাঁধনে। এরা যেন সব আলাদা
আলাদা মিউজিক্যাল হান্ডস, যারা বাজিয়ে তুলছে তাদের মিলিত অর্কেস্ট্রা। কখনও আবার এই
লাইনগুলো ধরা থাকে স্তবকে, -যার কয়েকটায়
থাকে কিছু নাটকীয় ঘটনা ও সংলাপ (ক), কয়েকটায় থাকে প্রকৃতি থেকে নেওয়া কিছু
চিত্ররূপ (খ), কয়েকটা অদ্ভুত উপমায় গড়া চিত্রকল্প (গ), কয়েক লাইন অর্জিত প্রজ্ঞান
(ঘ), আর কয়েক লাইনে থাকে অবাক রহস্যময় কিছু চেতনকল্প বা বিমূর্ত উচ্চারণ (ঙ)। কবিতার গঠনের মধ্যে নানারকম বিন্যাসে, আগে-পরে ওপর-নীচে, এইমতো
সাজিয়ে বসান তিনি আলাদা আলাদা স্তবকগুলোকে। কোনও কবিতায় সেই বিন্যাস হয়ে থাকে ক-খ-ঙ-গ-ঘ-ঙ,
আবার কখনো হয়তো সেটা খ-ঘ-গ-খ-ঙ । -এই সব প্যাটার্নের বহুল সফলতা আমি দেখেছি ওঁর
অনেক কবিতায়; বিশেষত: ‘রাখা হয়েছে কমলালেবু’-বইয়ে, ‘সরোদ’, ‘পিছু ডাক’, ‘মনোবাসিনী
দিন’ ও আরও অনেক কবিতায়।
ওঁর পরের দিকের লেখায়, -‘মাটিতে দুধের কাপ’, ও পরে ‘ছায়ায় আসিও’ বইয়ের কবিতায়,
সময়ের সাথে সাথে ওই বিন্যাসের ঢং কিছুটা নড়ে গিয়েছে, হারিয়েছে কিছুটা রহস্যময়তা,
প্রাধান্য পেয়েছে সংলাপ ও প্রজ্ঞান। কিন্তু তবুও ধরা যায় সার্বিক মেজাজটা, আর চিনতে
পারা যায় তাঁর আশ্চর্য সিগনেচার।
এই রকমই একটা কবিতার নাম ‘যাওয়া’, -যা ছিলো অগ্রন্থিত, বইয়ের শেষের দিকে পাওয়া
যায় তাকে। এই ‘যাওয়া’-র প্রসঙ্গ স্বদেশ
সেনের অনেক কবিতায় এসেছে। ‘যাওয়া’র কথায় দেখেছি, কখনো জড়িয়ে রয়েছে একটা নতুন কাজের আহ্লাদ, -একটা
আবিস্কার যা সুন্দরের দিকে, -সেই দিকে যাওয়া। সেই ‘ভালোবাসার গতিময়তা’র দিকে। ‘যাওয়া’
আবার কখনো একটা অনিবার্যতা, যা সময়প্রবাহ
। যাকে জড়িয়ে আছে একটা অন্তর্লীন বিষাদ : ‘শুধু এই চলে গিয়ে থেমে যাওয়া কোন / সবুজ পোলের কাছে ; একমনে ঝরে যাওয়া ভালো’
(-ব্রীজ পার হয়ে)।
‘যাওয়া’ যখন সংসার আর প্রকৃতিতে মিলেমিশে সুন্দর হয়ে ওঠে, যখন সবাই বেরিয়ে যায়
জীবনকে আরো নতুন করে আবিস্কার করতে, যখন আরো
দূরে যেতে গেলে কিছুটা ছেড়ে রেখে নির্ভার হয়ে উঠার প্রয়োজন হয়, তখনি শান্তি ও
সুন্দরের একটা মোহ এসে আবিষ্ট ও অলস করে রাখে।
‘রাজি হয়ে বসে আছি স্বভাবে ধরেছে এসে শীত
চোখ ভরে পড়ে আছে নবীন নরম নীল টান
আসি বলে সেই যাওয়া যখন কোথাও যাওয়া নেই। ’ (-ভেতরে শীত)।
চোখ ভরে পড়ে আছে নবীন নরম নীল টান
আসি বলে সেই যাওয়া যখন কোথাও যাওয়া নেই। ’ (-ভেতরে শীত)।
এই আলস্য ও স্থবিরতার বিপক্ষেও একটা কথা আছে, যাকে নিয়ে গড়ে উঠেছে ‘যাওয়া’
কবিতার প্যানোরামা। অনুভব হয়, একটা ভীষণ
টান আছে সংসারে, আর মায়া আছে প্রকৃতিতে। মন চাইছে জীবনের সেই সমগ্রকে নিয়ে ঝলমলিয়ে উঠতে
:
‘এখন জলের জন্য মাইল হিসেবে যেতে পারি / যদি ডালিমগাছে এই মনকে দেওয়া যায় /
জলশব্দ যতদূর যায় যদি তত দূরের মাইল / বাঁশ বাগানের মাঠে যখন চুন করা নতুন
হাইস্কুল’।
জীবনের ঘাত প্রতিঘাত থেকে, ঝড় বাদল থেকে শিক্ষা নিয়ে যে অভিজ্ঞতা আর বিশ্বাস
জন্মায়, তাই দিয়েই তো তৈরী হয় আরো দূরে যাওয়ার সাধ ও সামর্থ। কিন্তু কবিতায় এর
এক্সপ্রেশানটা ধরা আছে তাঁর ভাষার স্বাতন্ত্রে : ‘থাকতে গিয়ে শিখতে হলো ঝড়ের কাঠ
জাপটে ধরতে .../ জমিয়ে দিলাম কাঁঠাল কাঠে
বিশ্বাস’। আর এখান থেকেই গড়ে
উঠেছে একটা টেনশান। ঝড়-বাদল পেরিয়ে এসে, এগিয়ে যাওয়ার জন্য শক্তি সঞ্চয় করেও হঠাৎ
বোঝা যাচ্ছে সামনে আরো জটিল তান্ডবের মুখোমুখি হতে হবে। তখন অদ্ভুত একটা লাইন তৈরী
করেছেন পর পর কয়েকটা শব্দকে পাশাপাশি বসিয়ে, ‘তুষার তান্ডব লম্বা কুয়াশা
ছিন্নমস্তা আমি কি এবার যাবো’। এখানে কোনও প্রশ্ন চিহ্ন বসানো নেই, কেননা, শুরুতেই
আছে ‘বুকের মধ্যে এখন এমন মাটি মাখানো যাওয়া’। যাওয়ার জন্যে তৈরী হয়েই আছে কবিতার
পুরুষ। তবে এবারের যাওয়া জীবনের
অজানা রহস্যের দিকে, যার মধ্যে ঝুঁকি আছে। যাওয়ার আগে তাই আশেপাশের সবাইকে ‘ভালো থেকো’ বলে যাচ্ছে সে, -ঘরের বাংলা, আদবকায়দা, সন্ধি
সমাস, বাংলা বানান পদ্ধতি, চিলে কোঠায় ধরা মা, -এরা সবাই যেন ভালো থাকে । এই যে বাংলা
বানান, সন্ধি সমাসের সাথে এক সারিতে মাকেও
বসিয়ে দিলেন, - এই সেই গুরুচন্ডালি, যার প্রয়োগ তিনি রহস্যের কথায় বলেছেন।
আর এই সংসার যে কতটা প্রিয় ও মায়াময়, তা
বুঝিয়েছেন কবিতার শেষে, -‘কোথায় এমন
মুনিয়ার ডিম আমার’। -এই শেষ লাইনে এসে আমরা থেমে পড়ি আর হঠাৎই মনে হয়, এই যাওয়া কি
তবে একেবারে যাওয়া, সব কিছু ফেলে রেখে কোনও তীব্র অজানায় চলে যাওয়া ? এইখানে পাঠক
তার নিজের প্রশ্ন চিহ্নটা বসায়।
কৌরবের দিনগুলোতে স্বদেশ সেনের অনেক কবিতাই আমার পড়ার সৌভাগ্য হয়েছিলো
সদ্যলিখিত, অপ্রকাশিত অবস্থায়। কৌরবে ওঁর অনেক কবিতা প্রায়ই কন্ঠস্থ ছিলো আমার। পরে যখন ওঁর সমগ্র
কবিতার বই বেরিয়েছে, কখনো তিনি এডিট করেছেন, বদলে দিয়েছেন লাইন, আর আমি পড়তে গিয়ে
হোঁচট খেয়েছি। যেমন, ‘হাজার দুয়ার’ কবিতায় শুরুতে ছিলো ‘বল্লী বাঁকা, ভরা খোল /
গরম রাশির ওই দিকে’। এই ‘গরম রাশি’-র বিমূর্ততা, –যার অনেক অনেক ‘সিগনিফায়ার’
আছে, -আমায় শিহরিত করেছিল, কিন্তু পরে উনি
সেটাকে কেটে লিখেছেন ‘গরম রোদের ওই দিকে’। এরকম বদলানো আরও কয়েকটা কবিতায় আছে। এবং
প্রতিবার মনে হয়েছে আগেরটাই ভালো ছিলো। জানি
না, কেন বদলে দিয়েছেন এরকম। না করলেই তো ভালো লাগতো আমার।
কখনো আমার মনে হয়েছে, ওঁর কবিতাকে যেমন সংসারজীবনের ওঠাপড়ার শতেক অনুভবের ওপর গড়ে তুলেছেন, তেমনি তার সমান্তরাল আরেকটা প্রেক্ষিতও রয়েছে, -সেটা বাংলা কবিতার সহজ আধুনিকতা থেকে এক অন্য উদ্ভাসের জটিলতার দিকে উত্তরণের চেষ্টার কথা। সেখানে ‘কাজের কথা’র আরেকটা মানে, -পরীক্ষা সাহিত্যের কাজ। আমাদের অনেকবার বলেছেন, বড় কাজ হচ্ছে না কিছু। লিখেছেন, ‘যারা ফাইন আর্টে / মরার মতো আর পাখি এঁকোনা খাঁচা মারা’ (-শেষ ঝর্ণা)। বলেছেন, কবিতা থেকে যারা সব কিছু বাদ দিতে চায় তারা তবে রাখবে টা কী ? বলতেন, আরেকটু সংসারে এসো, আরেকটু দেখো। লিখেছেন, ‘একদিন ভালবাসার গতিময়তা দেখবে’। ‘একটা জীবনময় দেখা / কোনদিন দেখা হয়নি ব’লে না দেখাকে / দেখো’। ‘প্রাইমর্ডিয়াল’, ‘সাবলিমেশান’, –এইসব কথাগুলো দিয়ে বোঝাতে চেয়েছেন কবিতায় অনুভবের জগৎটাকে। - পরবর্তী প্রজন্মের লেখা নিয়ে যেমন খুব আগ্রহ দেখিয়েছেন, তেমনি শিল্পে কবিতায় কোথাও পরীক্ষানিরীক্ষার বহ্বারম্ভ ও হালহকিকত দেখে স্বঘোষিত মহাবীরদের ওপর বীতশ্রদ্ধ হয়েছেন। তার আভাষ রেখেছেন লেখায় : ‘যত মহাবীর তার ইঁদুর শিকার / ...সদা মূর্খের ত ত’ (মামলা-গাছ)। -কবিতায় মূল প্রসঙ্গ যখন মনে হয়েছে অন্য কিছু, তখন হঠাৎ প্রসঙ্গান্তরে এসে এরকম একটু অন্য আভাষ দিয়ে আবার সরে গেছেন। বিষয়কে রেখেছেন স্পষ্ট ও অস্পষ্ট জলের আড়ালে, রহস্যময়তায়।
৮
রহস্য নিয়ে স্বদেশ সেন একবার লিখেছিলেন, ‘শিল্পের এক প্রধান উপাদান রহস্য।
কবিতায় এই রহস্য নানাভাবে আসতে পারে। বিষয়ে, আঙ্গিকে, বাক্যগঠনে, চিত্রকল্পে,
শব্দসংস্থাপনে, নানা গুরুচন্ডালীতে, অথবা কবিতার সামগ্রিক অভিঘাতে। ...রহস্যের
পাখি এমনকি নির্মল হাল্কা হাওয়ার ওপরেও
ডিম পাড়তে পারে। রহস্যের মধ্যে এক রমণীয় অনুসন্ধান থাকে যা দুর্বোধ্যতার মধ্যে
থাকে না’। -এই ‘রমণীয় অনুসন্ধান’ শব্দবন্ধের জন্যই এই উদ্ধৃতি। এর আলোয় ওঁর অনেক
কবিতাকে, তাদের নির্মাণ ব্যবস্থাকে নতুনভাবে নিরীক্ষণ করা যায়, বোঝা যায় ওঁর
পরীক্ষার জায়গাগুলোকে।
স্বদেশ সেনের কবিতায় রমণীয় অনুসন্ধানে এসে আমি খুঁজেছি তাঁর দেখা রমণীদের। পেয়েছি
কিছু অদ্ভুত শান্ত চঞ্চল রহস্যময় ছবি। এবং পেয়েছি ‘মেয়ে মানুষ’ এই শব্দবন্ধও। দেখেছি, কী গভীর উৎসাহে, প্রেমে ও অবলম্বনে তারা অঙ্কিত হয়ে আছে
কবিতায়। যে মায়ের রূপ অগাধ হয়ে জড়িয়ে আছে বিশ্বসংসারে, প্রকৃতিতে, কবিতায় তার
উচ্চারণ : ‘মাগো তুমি নয়া শৈলী, মাগো তুমি বক নদী, মাগো তুমি কি-জানির বিভা’। এই
‘কি-জানির বিভা’ শব্দবন্ধের রহস্যমাধুর্যের সামনে আমি ঠায় দাঁড়িয়ে থাকি, ক্রমে পড়ি
: ‘এই মন বলে তুমি কৃষ্ণস্তন, একবস্ত্রা, বাঙালী জননী’ (-কাবেরী পাখি)।
ভারতবর্ষীয় ক্যানভাসে আঁকা নারী, -যে
সংসারলক্ষ্মী, প্রজনন ও উর্বরতার প্রতীক, যে আছে শৃঙ্গার ও আভূষণের কেন্দ্রে, -কবিতায় স্বদেশ সেন তাকেই বলেছেন, ‘হে ফলন্ত নারী, তুমি আমাদের ফলের নির্বাণ’। আর
একটা অবিশ্বাস্য স্মৃতিচিত্র এঁকেছেন ‘ঘুঙুরতলা’ কবিতায়, টানা গদ্যে, কয়েক লাইনে :
‘একটা সব থেকে বেশী সৌন্দর্য দেখেছিলাম মনে নেই কবে এক ঝিলিকে দেখেছিলাম। চোখে খুব
লেগেছিলো তবু। হ্যাঁ গো লেগেছিলো। দৃশ্যকে বাঁচিয়ে তুলে দু’হাত বাড়িয়ে তবু
দেখেছিলাম সায়া-স্রোত, বেনারসীধারা । এত দূর বড় হয়ে মনে পড়ে, বলা যায়, এক-ধার
কুড়ুল একটা দেখা হ’ল ঘুঙুরতলায়’। -এই রকম আশ্চর্য
দালি-সুলভ চিত্রকল্প বাংলা কবিতা কদাচিৎ দেখেছে।
এমন একটা দারুণ সুন্দর কাজ দেখেছি, ‘ফুলবাগানের কাঁটা’ কবিতায়। একটা রোমান্টিক
ঝলক-লাগা পলাতক আলোআঁধারি মুহূর্ত ও তার যৌনতাকে এমন অদ্ভুত ক্ষিপ্রতায় এঁকেছেন, অথচ
কোথাও উল্লেখ নেই কোনও নারীর ; আছে শুধু ‘কোমরের দাগ’ –কথাটা। ‘অন্ধকারে যদি ফুল
ব’লতে / ফুলের রতি-বোধ জেগে ওঠে / দৌড়ে যায় কোমরের দাগ - / যে সময় জ্যোৎস্নালোক /
চোখের আদর যদি সে-সময়ে / সে-সময়ে গোটা
জানালাই / যদি কিছু ঢং নিয়ে ফেলে / ফোঁটা দুই মদ পড়ে / কাঁচা লোমে / তবু কি বলার
থাকে / এই এতবার ক’রে / হে জনমনিষ্যি’ ।
আরেকটা কবিতা আছে, ‘নতুনের কোন দুঃখ নেই’। এই কবিতাটা অনেকের প্রিয়। এবং
আমারও। অনেক তরুণ কবি, যারা কবিতাকে নতুন করার স্বপ্ন দেখেছে, বহুবার এসে
দাঁড়িয়েছে ওই ‘নতুন কোথায় থাকে’ লাইনটার কাছে। -এখান থেকেই আমি তৈরী করেছিলাম
‘নতুন কবিতা’ কয়েনেজটা, ১৯৮৪ সালে, আমার ‘মুখার্জী কুসুম’ কবিতায়। -মনোযোগ দিলে
বোঝা যায় স্বদেশ সেনের ওই কবিতায় আসলে রয়েছে
পল্লীর এক অপরূপার কথা, যার ‘রাঙা ঠোঁট, মাজা দাঁত, নবনিযুক্ত ডুরে শাড়ি’। হয়তো সম্প্রতি বিয়ে হয়েছে তার, নির্জন অবসরে হয়তো সে
স্বপ্ন দেখছে তার ভবিষ্যত সন্তানের, নাকি কোন উন্মাদের লালসায় নষ্ট হয়ে গিয়েছে তার
গর্ভস্থ বীজ, একা দুঃখিত বসে আছে পল্লীর নতুন বৌটি। -এই কবিতার সৌন্দর্য এর প্রিসিশান। নতুনেরও যে এক রকমের দুঃস্বপ্ন থাকে, দুঃখবিষাদ
থাকে, নির্জনতা থাকে, -সেই আবেদনকে কি ভাবে যেন সর্বজনীন করে তুলতে পেরেছেন ; এমনই
অদ্ভুত সুন্দর রহস্যপথ এইসব কবিতায়। এইসব নিয়েই গড়ে উঠেছে স্বদেশ
সেনের কবিতার সাজমহল ও তার উচ্ছ্বাস-বিজ্ঞান।
কখনো আমার মনে হয়েছে, -কবিতা স্বভাবগতভাবেই অন্তঃস্বারশূন্য। প্রকৃত কবির
হাতেই জন্ম নেয় কবিতার আভ্যন্তরীণ শাঁস ও
তার কীট। কবি আপ্রাণ চেষ্টা করেন ওই শাঁসকে কীটের হাত থেকে বাঁচাতে। কখনো ব্যবহার
করেন প্রাচীন (প্রাইমর্ডিয়াল) নুন। - কবিতার সার্বিক বোধ, বুনোট ও বিন্যাসজাত সেই রহস্যময়
শাঁস সবচেয়ে ভালো ধরা পড়ে একজন কবির কাছে। চলমান চটজলদি পাঠক উল্লসিত হন কবিতায়
মেধার ঘুঙুরের ছম্ বাজানো ঠুমকায়। আর সমালোচক, হাতে যাঁর ভাষাতত্ত্বের ঘন্টা বাজে, খুঁজে ফেরেন
কবিতার সাইনবোর্ড, পাশবই, আর হা-শব্দগুলো।
কবিতার কি কোনও ‘বিষয়’ হয় ? –এই প্রশ্নের উত্তরে আমার মনে হয়েছে, কবির অবিশ্বাসই
তাঁর বিষয়। সেই অন্তর্নিহিত অবিশ্বাসের নেগেটিভ থেকেই তৈরী হয়ে ওঠে শিল্পের রূপবান
ছবিগুলো। অন্যদিকে, পাঠকের কাছে কবির বিশ্বাসই কবিতার
বিষয়, যা সে সম্মুখে দেখতে পাচ্ছে। স্বদেশ
সেনের কবিতায় জন্ম-পঙক্তি থেকে মৃত্যু অব্দি বিস্তৃত যে অভিনিবেশ, ক্রমে সেখানে
‘শুকনো জলের শুকিয়ে ওঠাই এক বিষয়’, -তিনি
তখন মৃত্যুকেই বলেছেন, ‘আমার বিষয়’। লিখেছেন, ‘আমার বিষয় মৃত্যু’ । অথচ পাঠকের মনে
হয়েছে, তাঁর বিষয় তো ছিল গতিময় জীবন, - ‘টাট্টুর বাজারে টাট্টু’। -জীবনপ্রবাহ কি সততই মৃত্যুমুখী, নাকি
সে সর্বদাই নতুনতর জন্মের দিকে চলেছে ? জীবনের
প্রান্তে এসে দেরিদার মনে হয়েছিলো, হয়তো জীবনপ্রবাহে প্রাণের আনন্দশক্তিতে ভেসে
চলা তাঁর শেখা হয়নি কখনো, হয়তো তিনি সম্পুর্ণ পথটা মৃত্যুকে দুহাতে ঠেলতে ঠেলতে
এগিয়ে এসেছেন।
কখনো বিভ্রম হয়, কোনটা সামনের দিক বোঝা যায়না । স্বদেশ সেন লিখেছেন, ‘এখনো কেউ
জানে না কোনটা আপেলের সম্মুখ’। -আমার মনে হয়েছে, যেদিকটায় আমরা দাঁত বসাই, আপেলের
‘সম্মুখ’ সেটাই।
------------------------------------------