ভূমধ্যসাগরে ওদের নৌকাডুবি
হয়েছিল। সিরিয়া থেকে তুরস্ক পেরিয়ে স্থলপথে ইউরোপে, অথবা উত্তাল ইজিয়ান
সমুদ্র পেরিয়ে গ্রীসের সীমান্তে এসে ওরা মার খেয়েছিল পুলিস আর সেনার হাতে। আরব
দেশগুলো মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল আগেই। যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়া থেকে পালিয়ে আসা ওই সব
হাজার হাজার কুর্দিশ শরণার্থী, বিদেশী সেনা যাদের হাতে
পার্মানেন্ট মার্কার দিয়ে নম্বর লিখে দিচ্ছিল, ক্রমশঃ যাদের ছবি ছড়িয়ে পড়ছিল
ইন্টারনেটে, সোশ্যাল মিডিয়ায়।
কৈশোরে জার্মানীর ওপর আমার ছিল অপার বিতৃষ্ণা। কারণ আমি গোগ্রাসে পড়ে ফেলেছিলাম সেই একমুঠো এক ইহুদি বালিকার আত্মজীবনী, যার নাম অ্যান্ ফ্রাঙ্ক। আমস্টার্ডামে ওদের বাড়ির তিনতলায় একটা চোরকুঠুরিতে বছরখানেক লুকিয়ে থাকার পরে কিভাবে একদিন ওরা সপরিবারে ধরা পড়েছিল নাৎসিদের হাতে ।
আমি যখন স্কুলে ক্লাস ফাইভ-সিক্সে পড়ি, তখন আমার এক মামা
জার্মানীতে উচ্চশিক্ষার জন্যে গিয়েছিল; কোচিন বন্দর থেকে ‘লয়েড ত্রিস্তিনো’ জাহাজে চড়ে, উনিশ বছর বয়সে একা একা।
সেখানে সে স্থান পেয়েছিল এক জার্মান পরিবারে পেয়িং গেস্ট হিসেবে। রাস্তায় তাকে ছোট
ছেলের দল কখনো ‘নিগার, নিগার’ বলে পিছু নিলেও জার্মান দম্পতি তাকে স্নেহ করতেন ছেলের মতো। ঘর
গুছিয়ে দিতেন, ছেঁড়া মোজা রিফু করে দিতেন অবসরে। এতসব গল্প শুনেও, কত পিকচার পোস্টকার্ড
পেয়েও, জার্মানির প্রতি আমার মন ফেরেনি।
এর প্রায় চল্লিশ বছর পরে, টাটাস্টীলে চাকরিজীবনে
একবার আমি গিয়েছিলাম জার্মানীর ডুইসবার্গে, থিসেন স্টীল প্ল্যান্টে। সেখানে
কোম্পানীর এক শীর্ষ কর্তার সাথে সৌজন্য সাক্ষাৎ । বিরাট জাঁদরেল চেহারার জার্মান, ডক্টর ফ্রিদ্রিশ, আমরা যাঁকে আড়ালে
ফ্রায়েড রাইস বলতাম। আমাকে দেখে তাঁর কী মনে হোল, ভাবলেন আর্যরক্ত, ভাবলেন সুভাষ চন্দ্রের
দেশের লোক। দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধে পরাজয়ের গ্লানি তখনও তাঁকে কুরে কুরে খাচ্ছে।
বললেন, এতো বোমা ফেলেছিল জানেন, দেশটাকে শেষ করে দিয়েছিল, এখনও কারখানার ওপাশের
জঙ্গলে নিয়ে আপনাকে বোমার দাগগুলো দেখাতে পারি। আমি অন্যমনস্ক হয়ে গেছিলাম, মনে পড়ছিল তার কয়েকদিন
আগেই আমি আমস্টার্ডামে অ্যান ফ্রাঙ্কের বাড়িতে গিয়েছিলাম; ওর ডায়েরীতে লেখা বাবার
বুকশেলফের পেছনের সেই লুকোনো সরু অন্ধকার সিঁড়ি দিয়ে উঠে পৌঁছেছিলাম চিলেকোঠার সেই
ঘরে, যেখান থেকে জানালার পর্দা একটু ফাঁক করে ওরা দেখতো অনেক নীচের
রাস্তা ও সেই চার্চ।
এই গোপন ঘর থেকেই ওদের পরিবারকে নাৎসি সৈন্য একদিন খুঁজে পেয়ে
পাঠিয়ে দিয়েছিল কন্সেন্ট্রেশান ক্যাম্পে।
আমার আরও মনে পড়ছিল, আলেঁ রেনের ‘নাইট অ্যান্ড ফগ’ নামের সেই ভয়ঙ্কর ফরাসী
তথ্যচিত্রটাও, যেখানে দেখানো হয়েছে গ্যাস চেম্বারের মধ্যে সম্পূর্ণ উলঙ্গ কয়েকশো
পুরুষ নারী শিশু ও বৃদ্ধদের কিভাবে মৃত্যুর আগে শাওয়ারের জলে গণ-স্নান করানো হচ্ছে; -তখনও শিশুরা জানে না
কেন এই জলঝর্ণা।
এত বছর পেরিয়ে, সেই জার্মানি আজ হাজার
হাজার কুর্দিশ রিফিউজিকে জাতি ধর্ম বিচার না ক’রে সাদরে আশ্রয় দিচ্ছে ! ভাবা যায়
! মিউনিখ রেল স্টেশনে ফুল নিয়ে দাঁড়িয়ে জার্মান পুলিশ, নাগরিক, দোভাষী, স্বেচ্ছাসেবী। ট্রেন
থেকে নামিয়ে বাচ্চাদের হাতে হাতে দিচ্ছে বেলুন, চকোলেট, খাবারের প্যাকেট, দুধ। বলছে, আমাদের দেশে তোমাদের
সাদর আমন্ত্রণ। ভীত পথশ্রান্ত ক্ষুধার্ত মানুষগুলো ভেবে পাচ্ছে না এত সম্মান আদর, এও কি সম্ভব !! - আজ
বহুদিন পরে জার্মানীকে আমারও সুন্দর মনে হচ্ছে অনেক।