[গত ২৩ অক্টোবর ২০১৭-য় রাজর্ষি চট্টোপাধ্যায়ের ‘নয়াদশক’ আন্তর্জাল পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল আমার লেখা ‘রৌদ্রময় সকাল ও জ্বলন্ত হ্যারিকেন’ নামক দীর্ঘ গদ্যটি। এতে আছে নতুন কবিতার পথ নিয়ে ২০০৪ সালে প্রকাশিত কবি বারীন ঘোষালের লেখা তাত্ত্বিক প্রবন্ধের বই ‘অতিচেতনার কথা’ সম্পর্কে আমার পাঠ-প্রতিক্রিয়া, বিশ্লেষণ এবং তাঁর তত্ত্ব ও তথ্যের বিভিন্ন ভ্রান্তিগুলোকে চিহ্নিত করার কাজ। তাঁর মৃত্যুর মাত্র কয়েকদিন আগে প্রকাশিত এই লেখাটি বারীন ঘোষালের পড়া হয়নি। কিন্তু তাঁর কাব্যতত্ত্বের প্রবল অনুগামী, ভক্ত ও অনুজ কবিরা আমার লেখাটি পড়ে একে চূড়ান্ত ঈর্ষা ও বিদ্বেষপ্রসূত সাব্যস্ত করেন এবং ফেসবুকে বিপুল সংখ্যায় আমার প্রতি তীব্র অশ্লীল আক্রমণে কুৎসা ও ছিছিক্কার করেন। এরই পাশাপাশি অনেক তরুণ ও প্রবীণ কবি ও পাঠক এই বিষয়ে আমার প্রতি তাঁদের পূর্ণ সমর্থন জানান এবং আমার লেখাটিকে একটি অতি প্রয়োজনীয় ও জরুরী উন্মোচন বলে ঘোষণা করেন। এই প্রেক্ষিতে সোশ্যাল মিডিয়ায় আমার প্রতি তীব্র আক্রমণকে অনেকেই সাইবার ক্রাইম ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে আইনি ব্যবস্থা নিতেও পরামর্শ দেন। সব আক্রমণ সহ্য করেও দীর্ঘ একমাস নিরুত্তর থাকার পরে, এখানে আমার ব্যক্তিগত ব্লগে নিজের বক্তব্য রাখলাম।]
১। এতগুলো দিন কেটে গেল নীরব
বেদনায়, অপমানে, রক্তপাতে। আজ মনে হোল কিছু কথা, শেষবারের মতো, বলা দরকার। একটা প্রবন্ধ
লেখাকে নিয়ে এই চূড়ান্ত অসহিষ্ণুতা, তীব্র আক্রমণ, এই কুৎসিত চরিত্রহনন! এ কাজ
করেছে কারা? --যারা আমাকে দীর্ঘদিন ধরে দেখে এসেছে, পড়েছে আমার অনেক লেখা, আমি
যাদের এতদিন বন্ধু বলেই জানতাম। কেউ কেউ ব্যক্তিগতভাবে জানিয়েছেন যে, আমার প্রতি এই
রেজিমেন্টেড আক্রমণ শুরুর পেছনে আছে এক চতুর সুযোগসন্ধানী, হয়তো আছে তার কলমের সংকট আর কিছু
অপূর্ণ উচ্চাশা। কিন্তু এর বাইরেও আছে
অনেক পাঠক পাঠিকা, যাদের আমি ফ্রেন্ডলিস্টে আসার অনুমতি দিয়েছিলাম, অথচ আমার কোনও
বই হয়তো তারা কখনো পড়েনি, ব্যক্তিগতভাবে জানে না আমার কিছুই, জানে না কৌরব
পত্রিকার শ্রেষ্ঠত্বের ইতিহাসের এক কণাও। কিন্তু আজ তারাও, হাওয়া ওঠানো হয়েছে দেখে, একই ভাবে আমার
প্রতি কুৎসায় সমর্থন দিয়েছে। মৃত্যুর ওপার থেকে যদি দেখা যেত, তবে কবি বারীন ঘোষাল
নিশ্চয় এখন শিউরে উঠতেন তাঁর সাহিত্যচর্চার উত্তরাধিকারীদের এইমতো কদর্য স্বরূপ
দেখলে। হয়তো লজ্জিত হতেন, হায় হায় করতেন। যাঁরা শুভবুদ্ধির মানুষ, তাঁরা ভাবছেন-
‘অনেক বেশিই সহ্য করা হ’ল চারদিকের এই কদর্য অসহিষ্ণুতা’। সময়ের এই সন্ধিক্ষণে আমারও মনে
পড়ছে শ্রদ্ধেয় অমর্ত্য সেনের সেই কথা-- "We Have
Been too Tolerant, Even of Intolerance"।
আমি তো কিছুই লিখবো না ভেবেছিলাম। কিন্তু অনেকেই এখন বলছেন, আমার প্রতি এইসব
অশ্লীল আক্রমণ অবশ্যই প্রতিবাদযোগ্য। আমিও কি কখনো এদের ক্ষমা করে দিতে পারবো ? –জানিনা,
হয়তো একদিন পারবো। তবে অনেক রকম মানুষের পরিচয় পাওয়া গেল এই অবসরে। এটাও একটা
লার্নিং। এই সব নিয়েই জীবনপ্রবাহ ; এই প্রবাহের কোথাও দেখা হোল বড় নদী, কোথাও শাখানদী,
চোরাবালি, পচাখাল, বাঁওড়, কাঁচা নর্দমা, ভাগাড়। কমলদা বললো, “তুমি দুঃখ পেয়ো না।
দেখো, আমরা ভাষাব্যবহার শিখেছি রবীন্দ্রনাথ বিদ্যাসাগর বঙ্কিম বিবেকানন্দ পড়ে ;
আমরা তো ফাটাকেষ্ট, হাতকাটা দিলীপ বা পেটকাটা গণ্শার কাছে ভাষা শিখিনি”। আমার মনে পড়লো- কথামৃতে ঠাকুর
রামকৃষ্ণ বলেছেন, তোদের চৈতন্য হোক। আমার মতো মানুষদের উদ্দেশেই বলেছিলেন বোধহয়।
২। বারীনদার সাথে আমার দীর্ঘদিনের আন্তরিক
সম্পর্ক ও মাঝের কিছু টানাপোড়েনের কথা আজ একটু জানাতে ইচ্ছে করছে। এর বাইরে আর
কিছুই বলবো না। এসব খুবই ব্যক্তিগত, গোপনে রেখে দেওয়াই ভালো। আমার কাছে নানা
শ্রদ্ধা ভালোবাসা আনন্দ বিস্ময় ক্ষোভ মিলেমিশেই বারীনদার স্মৃতি, যা শুধুই গাজরের
হালুয়া নয়। -মনে পড়ছে,
অনেক বছর আগে জামশেদপুরে আমি তখন টাটা-হাসপাতালে, ভীষণ অসুস্থ, চাপ চাপ রক্তবমি
হচ্ছে। বারীনদা একদিন আমায় দেখতে এসেছিল। দেখে ঘাবড়ে গিয়েছিল, কোনও কথা বলতে
পারেনি। বারীনদার শেষ দিনগুলোতে আমি দেখা
করতে যেতে পারিনি, আমার স্ত্রীর দীর্ঘ অসুস্থতার জন্যে। তাছাড়া, এবারও তো নিশ্চিত
ছিলাম যে ফিরে আসবে, প্রণবকে লিখেছিলাম। প্রণব আজীবন বারীনদার সকল বিপদে পাশে থেকেছে দেখেছি, পাহাড়
থেকে ফিরে এসে আমাকে জানিয়েছে কতবার। বলেছে, ‘এরকম মদ খেলে আর বাঁচবে না, আর কখনও ওকে
নিয়ে যাবো না পাহাড়ে’। এবার কমলদাও ফোনে জানিয়েছে। কিছুদিন আগে বারীনদার বাড়ি থেকে
ফিরে অনেক রাতে কমলদা জানালো—‘খুব খারাপ অবস্থা, একটা ঘোরের মধ্যে আছে, বিশেষ কাউকে
চিনতেও পারছে না, বিছানাতেই অসাড়ে’। সেদিনই রাতে রাজর্ষিদের ব্লগটা যখন বেরোয়, তখন অনেক দেরী
হয়ে গেছে। এর ছ’মাস আগে হলে বারীনদাকে লেখাটা পড়ানো যেত। সেই নিয়ে সে নির্বাক
থাকতো, নাকি নতুন করে ভাবতো, -জানিনা। হয়তো বলতো : ‘আমি নিজেই তো ওই তত্ত্বকে ডিসকার্ড
করেছি’। -- কিন্তু আমাকে অন্তত আক্রমণ করতো না কখনো। তিন-চার মাস আগে, যখন তার বইটার আলোচনা জরুরী বলে ফেসবুকে লিখেছিলাম,
বারীনদা সেটা ‘লাইক’ করেছিল। এর অনেক আগে, ২০১১ সালে, যখন আমার ব্লগে স্বদেশ সেনের
সাক্ষাৎকার প্রকাশ করেছিলাম, (স্বদেশদারই আগ্রহে ও বিশেষ অনুরোধে) বারীনদা নিজে
তাকে সহজভাবে নিয়েছিল ; আমাকে তা লিখে জানিয়েও ছিল, কারণ তার ‘নতুন কবিতার পথ’
নিয়ে কবি স্বদেশ সেনের যথেষ্ট ক্ষোভ ও পর্যবেক্ষণ সম্বন্ধে আগেই স্পষ্ট ধারণা ছিল
তার। তবে স্বদেশ সেনের
কবিতা বারীনদার খুবই প্রিয় ছিল, এবং এই যুক্তিতে বারীনদার কবিতাও স্বদেশ সেনের
কাছে খুব প্রিয় হওয়া উচিত, -বলেছিল সে। সেটা হয়নি বলে, পরে স্বদেশ সেনকেই দোষী
সাব্যস্ত করে লিখেছিল বারীনদা, যা কালিমাটি পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। আমি খুব বিস্মিত হয়েছিলাম বারীনদার এমন অদ্ভুত যুক্তিতে।
আমার ব্লগে স্বদেশ সেনের জীবনের শেষ সাক্ষাৎকারটি, তাঁরই অনুরোধে প্রকাশ
করায়, আমাকে তীব্র আক্রমণ করেছিল রঞ্জন মৈত্র এবং অরুণ চক্রবর্তীর মতো মানুষ। কিন্তু
এর পরে একদিন সেই অরুণবাবুই আমাকে ফেসবুকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছিলেন। কেন,
জানিনা। আমিও তাঁকে সুযোগ দিয়েছিলাম কৌরবকে জানার, আমার কাজগুলোকে জানার। আজ তিনিই আবার প্রশ্ন করেছেন- ‘এই
এক শংকর লাহিড়ী ! তাঁকে কেউ চেনেন ?’ --আসলে আমিই ভুল করেছি। ইনি আমাকে সম্যক না
চিনেই ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছিলেন ! ইনি আমার পাঠক নন, ফ্রেন্ড তো নয়ই। এই নিয়ে বেশি কিছু বলতেও আমার
রুচিতে বাধছে।
কিন্তু যে কথা কেউ জানে না সেটা হোল, শ্রীমান আর্যনীলকেও আমি অতিচেতনা নিয়ে
আমার এই ‘বিতর্কিত’ তিরিশ পাতা লেখাটার ড্রাফট আড়াইমাস আগেই দু’বার মেইল করে পাঠিয়েছিলাম,
অগাস্ট ২০১৭ তে। সৌজন্যবশতঃ জানতে চেয়েছিলাম তার মতামত, যেভাবে শিক্ষাক্ষেত্রে ও শিক্ষিত
সমাজে চাওয়া হয়। এবং কি আশ্চর্য, লেখাটা নিয়ে এতকাল কিছু জানায়নি সে ! আজ
হঠাৎই সুযোগ বুঝে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। আমার লেখাটার যাবতীয় যুক্তি ও তথ্য থেকে পাঠকের মনোযোগ
ফেরাতে এবং পাঠককে ক্ষেপিয়ে তুলতে সে জিগির তুলেছে যে, বারীন ঘোষালের প্রতি অসূয়া,
দ্বেষ ও মর্মান্তিক প্রত্যাখ্যান রয়েছে নাকি আমার লেখায়। এখান থেকেই শুরু হয়েছে
পরবর্তী সব আক্রমণ, এমনকি শরীরী ভাষায় জবাব ও প্রাণনাশের হুমকিও। -কেউ কেউ এইসব আক্রমণকে সরাসরি ফ্যাসিবাদের সাথে তুলনীয় বলেছেন। তবে আইনের চোখে এটা একটা পরিকল্পিত
অপরাধ। এর মধ্য দিয়ে শ্রীমান আর্যনীল তার বোধ-বুদ্ধি-শিক্ষা-সৌজন্যের অনেকগুলো দুর্বল
দিক নিজেই উন্মুক্ত করে প্রকাশ্যে আনলো।
বছর সাতেক আগে সে আমায় ইমেলে জানিয়েছিল (১-৭-২০১০) : বারীনদার এই ‘সৎকার’ ও
অতিচেতনা-কাব্যতত্ত্ব নিয়ে কৌরবের ভেতর থেকেই একটা লেখা তৈরী করা দরকার, আমরাই
লিখবো, কারণ এগুলো কখনোই ‘যাদব দত্তের মতো রটন আকাডেমিয়া'-র কাউকে দিয়ে হবে না’। -তার অনেক চিঠিতে এভাবেই বহু মানুষের নামে উল্লেখ আছে। অনেকের
সাথে তার দীর্ঘদিনের নষ্ট সম্পর্ককে এখন, এই সুযোগে, পুনোরদ্ধার করতে পারা যাবে
ভেবে, প্রধানতঃ তার নেতৃত্বেই আজ এমন বিপজ্জনকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে আমার প্রতি আক্রমণ,
যা নাকি ধমক দিয়ে শেয়ার করতেও বলা হয়েছে। প্রকৃতই
কবিজনোচিত এইসব প্রয়াস !! কৌরবে তার সম্পাদকীয় যোগ্যতা নিয়ে বহুবার প্রবীণ নবীন অনেকেই
প্রশ্ন তুলেছেন, তবু আমি এতদিন আর্যনীলকেই সমর্থন জানিয়ে এসেছি। আমার কি তবে ভুল
হয়েছিল ? আজ এত কুৎসিত আক্রমণের মুখেও আমি বুকর্যাক থেকে পড়বো বলে নামিয়ে এনেছি
তারই বই ‘স্মৃতিলেখা’, যাকে সে একটি ‘সম্পূর্ণ কবিতা’ বলেছে, তাকে পুনরায় ফিরে
দেখতে চেয়ে !
৩। কিছুদিন আগে ফোন ক’রেছিলেন
প্রবীণ কবিদম্পতি ; দেবারতিদি (মিত্র) দীর্ঘ সময় প্রবোধ দিলেন, বললেন—‘এখন সর্বত্র এরকমই। কারো
বই নিয়ে কিছু বলা যায় না। তুমি ভেঙ্গে পোড়োনা, পনেরো দিন ধৈর্য ধরো’। -এসেছে আরও কিছু ফোন, কয়েকজন
সম্পাদক সাক্ষাৎকার চেয়েছেন, লেখা চেয়েছেন, আর আমাকে ব্যক্তিগত সমর্থন জানিয়ে এসেছে
অনেক মেসেজ। অনেকে বলেছেন যে, পরিণত পাঠক লেখাটা পড়ে অবশ্যই ভাববে। ভাববেই। এই
প্রসঙ্গে, আমি আজ প্রাজ্ঞ কবি সমীর রায়চৌধুরীকে খুব মিস করছি। আজকের এইসময়ের অনেক
কবিদের সম্পর্কে তিনি আমায় জানিয়েছিলেন (তাঁর শেষ রেকর্ডেড সাক্ষাৎকার) তাঁর
মোহভঙ্গের কথা ; বলেছিলেন, ‘কবিতায় এদের সব ফরমুলা আমি ধরতে পেরে গেছি। এরা যেখানটায়
ফেল করছে, তুমি কিন্তু সেখানে ফেল করছো না। তোমার কাজে আনন্দ পাচ্ছি, রসদ পাচ্ছি, ভাবছি, কেননা তুমি
ভাবার জায়গাটা অব্দি আমাকে পৌঁছে দিতে পারছো, যেটা ওরা পারছে না’। -আজকের এই অবস্থা দেখলে সমীরদা কী
বলতেন আমার জানতে ইচ্ছে করছে।
আজ প্রবীণদের কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন—একটা তাত্ত্বিক বইয়ের পাঠ-প্রতিক্রিয়া লেখার জবাবে এই অকথ্য কুৎসা করে যাওয়া মানুষরা কি আদৌ সাহিত্যের লোক ? -এখান থেকে, এদের থেকে,
বহু দূরে সরে যাওয়া উচিত, একথা আমাকে
বলছেন অনেকেই। কারণ,
আমি তো বারীন ঘোষালের কবিজীবনের একটা মধ্যবর্তী অধ্যায়ের মাত্র আলোচনা করেছি, যা
ওই ‘অতিচেতনার কথা’ নামক বিতর্কিত ও ভ্রান্ত বইটির জন্ম দিয়েছিল, যা কালো মেঘের
মতো সাময়িক আড়াল করে রেখেছিল তার অন্তরের কাব্যবোধকে। যেখান থেকে সে নিজেই পরবর্তী
কালে সরে আসার কথা জানিয়েছিল। আমি তো একথাও লিখেছি যে, ‘যখনই এইসব তত্ত্ব থেকে সরে এসে
কবিতা লিখেছেন উনি, সেখানেই ওঁর কবিতা উজ্জ্বল হয়েছে’। লিখেছি, ‘কবি বারীন ঘোষালের
অন্তর্লোকের কাব্যবোধকে আমি তাই সম্মান জানাই, কারণ নানাভাবে তাঁর গভীরের প্রতিভার
সন্ধান পেয়েছি’।
যাঁরা এখন আমাকে আক্রমণ করছেন, সম্ভবতঃ তাদের মধ্যে অনেকেই লেখাটা পড়েননি, আবেগে
প্রভাবিত এবং জিগিরে প্ররোচিত হয়ে আমার
বিরুদ্ধে অশ্লীল কুৎসার ঢেউ তুলেছেন। ভেবে দেখেননি, নতুন কবিতা-পথের সন্ধানের আন্তরিকতাকে আমি
তো অভিনন্দন জানিয়েছি, প্রশংসা করেছি ওঁর শ্রমের। আমার ওই লেখাতেই রয়েছে সেইসব
কথা। নতুন কবিতার সন্ধান কৌরবে কিভাবে আমরা শুরু করেছিলাম, আশির দশকের গোড়াতেই,
তাও জানিয়েছি। একুশ
শতকে এসে, স্বদেশ সেনের শেষ সাক্ষাৎকারে আমি বলেছিলাম যে, বারীনদা---ভুল হোক ঠিক
হোক---নতুন কবিতার পথ নিয়ে তরুণদের একটা ঝাঁকানি দিতে পেরেছিল। স্বদেশদার সেই মূল্যবান
সাক্ষাৎকারটা আমার আগামী বইয়ে রয়েছে। বারীনদার গদ্যের মধ্যে ছোট গল্পগুলো আমার প্রিয় ছিল, এ
কথাও আমি আগে অন্যত্র লিখেছি। কবিতায় ওঁর ‘সুখের কালক্রম’, ‘মায়াবী সীমুম’ ও অন্য
আরও কিছু লেখা থেকে যত্ন নিয়ে বেছে একটা কবিতাসংগ্রহের প্রয়োজনীয়তার কথাও লিখেছি।
এই কাজ কৌরব থেকেই যত্ন নিয়ে করা উচিত ছিল। বারীনদার প্রায় সমস্ত বই-ই অযত্নে এবং
দৃশ্যতঃ অসুন্দর প্রচ্ছদে এতকাল ছাপা হয়েছে।
কিন্তু এই সব ছাপিয়ে, বারীনদার সকল সাহিত্যকর্মের আলোচনা সরিয়ে রেখে আজ বড়
হয়ে উঠেছে তার আশ্রয়ে আর প্রশংসায় কে কতভাবে
লালিত ও সজ্জিত হয়েছে তারই সেলফি-শোভিত, আবেগাশ্রিত, স্বার্থপর কাহিনী। তার
স্মরণসভায় আলোচনা আর বিদ্বেষের নমুনা দেখে বিস্মিত হয়ে কেউ কেউ মন্তব্য করেছেন যে,
এ জিনিষ কি তার স্মৃতির প্রতি অসম্মান নয় ? –আসলে, এসব বোঝার মতো শিক্ষা ও মানসিকতার
আজ খুব অভাব। এইরকম অন্ধ আবেগ চিরকালের। পৃথিবীতে আমাদের প্রত্যেকের নিজের নিজের
পাওনার হিসেবটাই সবচেয়ে জরুরী, আর তার মহার্ঘতম অনুভবই হোল প্রেম ভালোবাসা। কিন্তু
ক্ষুদ্র স্বার্থের বাইরেও জায়গা থাকা উচিত শিল্প-সাহিত্য-সঙ্গীত-চিত্রকলা নিয়ে স্বাধীন,
পরিণত, নির্ভীক ও যুক্তিগ্রাহ্য আলোচনার। সাহিত্যচর্চার আঙিনা আজ রাজনীতির ময়দানের চেয়েও বেশি
কলুষিত। বরং আমি যে কর্পোরেট দুনিয়ায় এতকাল কাজ করে এসেছি, তুলনায় সেখানে আজও অনেক
বেশি মেধা, শ্রম, শিক্ষা, সৃজনশীলতা আর সৌজন্যের পরিবেশ রয়েছে।
বারীনদার কবিতা-পথ নিয়ে আমার ওই লেখাটার একটা বড় অংশ জুড়ে আছে নতুন
প্যারাডাইমের কথা, যা আমি তরুণ প্রজন্মকে জানাতে চেয়েছিলাম, যার জন্যে লেখাটা বেশি
মূল্যবান হয়েছে বলে জানিয়েছেন কয়েকজন। বাংলা সাহিত্যে আজ অব্দি এইসব বিষয়ে কেউ
কোথাও কখনো লিখেছেন বলে আমি জানি না। পড়িনি কোথাও। আমি এই নিয়ে ‘কবিতার এরিনা’
নামে লিখতে শুরু করেছিলাম কুড়ি বছর আগে, সেই কাজটা ক্রমে সম্পূর্ণ করতে চেয়েছিলাম।
তবে আজ আর সেই প্রয়োজন নেই ; বাংলা কবিতার এইসব মানুষের জন্য আমি আর কখনো কোনও বড় মাপের
আলোচনায় যাবো না। কোনও কবিকে ঘিরে আজকের মতন এমন একটা অসহিষ্ণু চূড়ান্ত পরিমন্ডল গড়ে
উঠলে সাহিত্যের অমর্যাদা হয়, শ্বাসরুদ্ধ হয় কবি ও কবিতা। এইজন্যই কবির প্রয়োজন হয়
পরিত্রাণ, নির্বাসন ; প্রয়োজন হয় মধুর একাকীত্ব। এইখানে বারীনদা ও আমি ছিলাম
প্রকৃতই দুই মেরুর, আমাদের গন্তব্য এবং পথ, দুটোই ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। কখনো কোনও
বিষয়েই তাকে ঈর্ষা করা আমার পক্ষে সম্ভব ছিলো না ; যারা প্রকৃতই কৌরব, শুধু তাঁরাই
হয়তো এটা বোঝেন।
আজ এটাও বলা দরকার যে, আমাদের ‘কৌরব’ কখনোই মহাভারতের কৌরব ছিলোনা। আমরা
কখনোই জমি হড়প করার পক্ষে, পাশা খেলায় চোট্টামির পক্ষে, বা নারীর বস্ত্রহরণের
পক্ষে ছিলাম না। এসব না জেনেবুঝেই শুধু ক্ষীর খাওয়ার লোভে অনেক মানুষজন ঢুকে
পড়েছিলেন পত্রিকার চৌহদ্দিতে !! কৌরব আসলে ছিল একটা মগ্ন, নতুন জীবনযাপনের আইডিয়া, কফিহাউস
ও খালাসীটোলা থেকে দূরে সাহিত্যচর্চার একটা নতুন ল্যান্ডস্কেপ, একটা উজ্জ্বল
ব্যতিক্রমী মাল্টিডিসিপ্লিনারি কনসেপ্ট, যাকে আমরা আশির দশকে এসে ক্রমে পরিস্ফুট করেছি, পেয়েছি
শ্রেষ্ঠত্বের পুরস্কার। -তবে আমার অসীম মুর্খতা যে, আমি চাকরি-জীবনে অবসরের পরে ফেসবুকে এসে
স্বাধীন সাহিত্যচর্চার পরিসর খুঁজেছিলাম। আমার চৈতন্য হয়নি, আরও সাধনার প্রয়োজন
আছে। আমি তাই ফিরে যাচ্ছি। আজকের এই চতুর সাহিত্য-বাজার, এই অশ্লীল কুৎসিত আবর্জনার
পাহাড়, এই ডেথ্ ভ্যালি-- এ আমার বাসভূমি হতে পারে না। আমার চাই নির্বাসন,
পরিত্রাণ।
৪। বারীনদার সাথে আমার সম্পর্ক দীর্ঘকালের ; সেই ১৯৭৭ সাল
থেকে, যখন তার আশেপাশে আজকের এই ভীড় ছিলোনা। কতবছরের কতদিনের কথা, অজস্র নীরব
স্মৃতি, আজও তারা মনের গভীরে ভালোবাসায়, বিষাদে, স্পন্দিত। কিন্তু দীর্ঘদিনের কিছু
কিছু ঘটনায় আমিও কখনো তার প্রতি শ্রদ্ধা হারিয়েছি ; আমার প্রতিবাদ ছিল তার ঐ বইয়ে নিজের
কবিতাকেই ‘শ্রেষ্ঠ ও একমাত্র পথ’ ও ‘বিশ্বে এমনই এখন লেখা হচ্ছে’ বলার মতো অসঙ্গত
আত্মপ্রচার, এবং কৌরবের ‘কবিতার ক্যাম্প’ নিয়ে পরবর্তীকালে লাগাতার মিথ্যাচারের বিরুদ্ধেও।
ইদানিং কমলদাও হয়তো পুরোনো স্মৃতি হাতড়ে অনেক কিছু বুঝতে পেরেছিল। কয়েক মাস আগেও
আমাকে ফোনে বলেছে- ‘তুমি সেসব মনে রেখে কষ্ট পেয়োনা, তোমার ওপর দিয়ে অনেকদিন ধ’রে
অনেক কিছু গেছে, একদিন তোমার ভালো হবে, শত্রুরাও বুঝতে পারবে। ...কাউকে
তুমি অভিশাপ দিয়ো না’। মাত্র দু’মাস আগে সে আমায় বলেছিল।
আমি জানতাম কবিতার ক্যাম্পগুলোয় দীর্ঘদিন বারীনদার যেতে না পারার গোপন দুঃখ,
কিন্তু মুদ্রিত কৌরবে সেইসব ক্যাম্পের রিপোর্টে সে নিজের নাম ঢুকিয়েছিল, অন্যের
মুখের সংলাপ বসিয়েছিল নিজের মুখে, যা এতকাল সত্য বলে তরুণদের মধ্যে প্রচারিত হয়ে
চলেছিল। এভাবে মিথ্যার আশ্রয় নেওয়াকে অনেকেই বিভ্রান্তিকর ও অশ্রদ্ধেয় বলেছেন। এইসব প্রচারের কথা আমি প্রথম জেনেছিলাম একজন শ্রদ্ধেয় প্রবীণ কবির আমাকে হঠাৎ পাঠানো
একটি আড্ডার ভিডিও ক্লিপ দেখে। ‘কবিতার ক্যাম্প’ নিয়ে তথ্য সহযোগে আমি কবিসম্মেলনেও
লিখেছি ; সেটা বিদ্বেষবশতঃ নয়, সত্যকে জানানোর জন্যই। কারণ বারীনদা এর বিপরীত সাক্ষাৎকার
দিয়ে চলেছিল ! (এ এক আশ্চর্য পরিবেশ। মিথ্যাচার এখানে দোষণীয় নয়, বরং সেটাকে ধরিয়ে
দেওয়াকেই বলা হয় ‘বিদ্বেষপ্রসূত’! -আমার কোনও প্রিয় মানুষ এভাবে অসুস্থ
আত্মপ্রতিকৃতি গড়তে চাইলে আমার শ্রদ্ধা
ভেঙ্গে বেদনা হয়। আমি চুপ করে বসে থাকি, আর মনে পড়ে স্বদেশ সেনের কবিতার সেই লাইন-
“আত্মপ্রতিকৃতি ভাঙ্গো আর সুস্থ হও”।)
‘কবিতার ক্যাম্পের’ পরবর্তীকালে ব্যবস্থা হয়েছিল কৌরবের সপরিবারে বৌ-বাচ্চা
নিয়ে চাঁদিপুর আর বেথলা ভ্রমণের। চারজন পুরুষ, কমল-বারীন-দেবজ্যোতি আর আমি। তিনজন
মহিলা, কল্পনা-কৃষ্ণা-কণিকা। আর দুই শিশু কন্যা। কমলদা তখনও ব্যাচিলর। সেইসব প্রমোদ-ভ্রমণেরও
অনেক সুখস্মৃতি আছে, ছবি আছে। বলা যাবে না,
এমন অনেক মেয়েলি ঝাল-মিষ্টি গল্পও আছে। আমি জানি, আশির দশকের অনেকগুলো বছর জুড়ে কত
রকমের সাংসারিক টানাপোড়েনে দিন কেটেছে বারীনদার। দীর্ঘকাল ধরে তার স্ত্রী কল্পনা নানা
রকমের অসুস্থতায় কতবার হাসপাতালে, জামশেদপুরে, দিল্লীতে। মনে আছে,
মৃত্যুর কিছুকাল আগে সে আমার চার-বছরের মেয়েকে দেখতে চেয়ে খবর পাঠিয়েছিল ; আমি
তাকে তার জেঠীর কাছে নিয়ে গেছিলাম। অনেক পারিবারিক সুখদুঃখের গল্প আছে, ছবি আছে। সেসব কি আর
আজকের ফেসবুকে এই চীৎকৃত জনতার সামনে ছবিসহ পোস্ট দেওয়ার ? সেগুলো খুবই ব্যক্তিগত।
তার আবেদনও স্বতন্ত্র।
৫। আজ দেখা গেল, বারীনদার কবিত্ব কেড়ে নিয়ে তাকে প্রায় ধর্মগুরুর মতো করে
পরিবেশন করে চলেছে তার কিছু ভক্তজন। ফলতঃ আবেগ ও
অশ্রুর সাথে অনায়াসে মিশে যাচ্ছে বিধর্মীদের 'শয়তান' আখ্যা দেওয়ার মতো মৌলবাদী গর্জন
আর হিংসাও। আজ যাঁরা কৌরবের কিছুই জানেন না, বারীনদার
সম্বন্ধে তাঁরা লিখছেন- ‘এই মানুষটা পঞ্চাশ বছরের কৌরব পত্রিকার
প্রতিষ্ঠাতা-সম্পাদক’! -না, বারীনদা কখনোই কৌরব পত্রিকার সম্পাদক ছিলো না। এমনকি আজ
স্বদেশ সেনের কবিতার লাইনকেও (‘পায়রা পিছলে যাবে এমনি হয়েছে আকাশ’) বারীনদার লেখা বলে
চালানো হচ্ছে ! আমারই তোলা একটা সাদাকালো ছবিতে বারীনদার পাশে বসা সুশ্বেতাকে
পরিচয় করিয়ে দেওয়া হচ্ছে ‘বারীনদার স্ত্রী’ বলেও ! এঁরা কৌরবের ইতিহাস মুখে মুখে নতুন
করে তৈরী করছেন, এবং নানাভাবে অজ্ঞানতার
প্রমাণ দিচ্ছেন প্রতিদিন। কিন্তু এভাবে তো বারীনদাকে
সম্মানিত করা হচ্ছে না। এঁরা কারা ? এঁরা সত্যিই পরিণত সাহিত্যপ্রেমিক হলে, এসময়ে
আরও অনেক কিছু আন্তরিকভাবে জানার, বোঝার, পড়ার, খুঁজে দেখার কাজে নীরবে মগ্ন
থাকতেন। যেভাবে শিক্ষিত সমাজে একজন সাহিত্যিকের কাজ নিয়ে অনুসন্ধিৎসু হয়ে থাকে আন্তরিক
পাঠক ও গবেষক। আজকের লিটিল ম্যাগাজিনের অনেকটাই কি তবে ক্রমশঃ শিক্ষিত সমাজের
বাইরে ? বারীনদার সৌভাগ্য যে, এই নগ্ন উন্মোচন তাকে দেখতে হলো না।
আমি কখনো কবিদের ঈশ্বরের অবতার মনে করিনি; আমার কাছে তারাও রক্তমাংসের মানুষ, রিপুতাড়িত,
ইন্দ্রিয়াশ্রিত, সত্যবাদী, মিথ্যাচারী, সরল, চতুর,
কুটিল, লোভী, সুন্দর,
অসুন্দর, হোমো স্যাপিয়েন স্যাপিয়েন। আমার মনে পড়ছে, কবিতার ক্যাম্পে
স্বদেশ সেনের উক্তি : “কেউ কবিতা লিখছে বলে কি মহাত্মা হয়ে
গেছে ? শিল্পে সাহিত্যেও বিভূতির এই চল আমার খুব বাজে মনে
হয়। যতটুকু কাজ দেবে ততটুকুই মজুরী। আইরে বাইরে আর কিছু পাওনা নেই”।
স্বদেশদারও সৌভাগ্য যে আজ তিনি বেঁচে নেই, এসব দেখতে পাচ্ছেন না। বছর তিনেক আগে স্বদেশদার মৃত্যুর পরে আমি, রাজর্ষি আর বাবলা (অরিন্দম গুপ্ত) মিলে জীবনানন্দ সভাঘরে তাঁর স্মরণসভার আয়োজন করেছিলাম। মিলিত উদ্যোগে। কমলদা এসেছিল সেই সভায়, আর কিছু আন্তরিক কবি ও পাঠক। আজকের মতো এইরকম স্মরণসভার মাহোল আগে কখনো হয়নি, যেখানে শুধু ‘শত্রু’দের নামে বিষোদ্গার হচ্ছে দেখে শ্রোতাদেরই কেউ কেউ বিস্ময় প্রকাশ করেছেন।
স্বদেশদারও সৌভাগ্য যে আজ তিনি বেঁচে নেই, এসব দেখতে পাচ্ছেন না। বছর তিনেক আগে স্বদেশদার মৃত্যুর পরে আমি, রাজর্ষি আর বাবলা (অরিন্দম গুপ্ত) মিলে জীবনানন্দ সভাঘরে তাঁর স্মরণসভার আয়োজন করেছিলাম। মিলিত উদ্যোগে। কমলদা এসেছিল সেই সভায়, আর কিছু আন্তরিক কবি ও পাঠক। আজকের মতো এইরকম স্মরণসভার মাহোল আগে কখনো হয়নি, যেখানে শুধু ‘শত্রু’দের নামে বিষোদ্গার হচ্ছে দেখে শ্রোতাদেরই কেউ কেউ বিস্ময় প্রকাশ করেছেন।
স্বদেশ সেনের মৃত্যুর পরে, ‘নতুন কবিতার পথ’ নিয়ে তাঁর সকল মতামতকে উপেক্ষা
করে, শুধু আত্মপ্রচারের জন্য তাঁর সাথে পারিবারিক সখ্যতার কথা প্রচার করে গেছেন,
তাঁর বই প্রকাশ করতে চেয়ে (সাথে বারীনদার নামকেও জড়িয়ে দিয়ে) কবির পরিবারের সাথে নানা মিথ্যাচার
করেছেন, এবং তার জন্যে স্বদেশ সেনের পরিবার যাকে লিখিতভাবে ভর্ৎসনা করেছেন (সেই
চিঠি আছে আমার কাছে), এমন একজন পত্রিকা-সম্পাদককেও দেখলাম জামশেদপুরে বারীনদার স্মরণসভায় আমাদের
নামে বিদ্বেষ ছড়াচ্ছেন এবং সবাই মুখ বুজে তা শুনছেন! এঁরা কি সত্যিই সাহিত্যসেবী?
যেকোনও কবিকেই তার পরিবার, প্রতিবেশী, সহকর্মী, পাঠক, সম্পাদক ও বন্ধুরা একেকজন
একেকরকম ভাবে দেখেন, চেনেন। ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে সবটা নিয়েই তার পরিচয়। কেউই
এককভাবে কোনও কবির সম্পূর্ণ অস্তিত্বের লিপিকার নন, আর স্বত্বাধিকারী তো নয়ই। সভ্য
শিক্ষিত পরিশীলিত সমাজে এই সমস্তটাকেই স্বীকার করা হয়, সম্মান জানানো হয় সকল মতামতকে। আজকের লিটিল-ম্যাগ
বাজারের এক বিরাট অন্ধকার অংশে, এই বোধ, সৌজন্য ও সহিষ্ণুতা দুর্লভ। কিন্তু এর
বাইরেও রয়ে গেছেন অনেক সুস্থ, নির্ভীক, আদর্শবান ও মেধাবী কবি-সম্পাদক-পাঠক,
যাঁদের পাশে আরও অনেকের এগিয়ে আসা প্রয়োজন। বইমেলার স্থান নির্বাচনের জন্য আন্দোলন
গড়ে তোলার চেয়েও, এটা অনেক বেশি স্বাস্থ্যকর ও জরুরী। মনে পড়ছে, স্বদেশদার একটা
কবিতার শেষ দুটো লাইন: “বলবো বলবো ক'রে বলার মতো বলি / ছোট পত্রিকাকে একদিন বড় ক'রো”। -এই ‘বড়’
মানে আগ্রাসী মনোভাব আর দলবদ্ধ আয়তনে বড় নয়। এটা হোল, সৎ, নির্ভীক, সৃজনশীল ও
সাহিত্যগুণে বড় হয়ে ওঠা।
আজ আমি কবি স্বদেশ সেনকেও খুব মিস
করি। ‘অতিচেতনার কথা’ নিয়ে আমার আজকের এই বিশ্লেষণ ও মূল্যায়ন করার দায়িত্ব তিনিই
আমায় নিতে বলেছিলেন। বলেছিলেন, বাংলা কবিতাকে বাঁচাতে এইসব ভ্রান্ত পথকে কারো উঠে
দাঁড়িয়ে রুখে দেওয়া অনেক আগেই প্রয়োজন ছিল। -আমার বিশ্বাস, বারীনদাও ক্রমে ভ্রান্তিগুলো বুঝতে পেরে
তার পথ পরিবর্তন করেছিল, যে কথা আমি উল্লেখ করেছি আমার ওই দীর্ঘ আলোচনায়। বারীনদার
সমগ্র সাহিত্যকর্মকে আমি নিজে তো কোথাও অবহেলা বা অশ্রদ্ধা করিনি, -তাই এভাবে সেটাকে
প্রজেক্ট করার পেছনে, আমাকে আক্রমণের পেছনে, কার কী কী অভিসন্ধি থাকতে পারে তা এখন
স্পষ্ট হয়ে উঠেছে অনেকের কাছেই।
৬। আজকে আমায় যারা ব্যক্তিগত আক্রমণ করেছে তাদের জানার কথা নয় কৌরবের গত
চল্লিশ বছরের কথা। তারা জানেওনা, বারীনদা আমাকে আন্তরিক কতটা ভালোবাসতো ; বিশেষতঃ
আমার সমস্ত কাজ, আমার গদ্য-পদ্য-প্রবন্ধের সবটুকু। আমার সততা ও নিরপেক্ষতা নিয়ে
কোনোদিন তার সন্দেহ ছিল না, সেই সুযোগ আমি দিইনি। এবং কাজের বাইরে তো আর কোনও কথা
নেই। স্বদেশদাও বলতেন, ‘বড় কাজ ছাড়া আমি আর কিছু বুঝি না’। -কিন্তু সেই বারীনদাও একবার
সম্যক না বুঝে, না জেনে, আমাকে হতচকিত করে, বাড়িতে এসে আমার ও আমার স্ত্রীর
বিরুদ্ধে এক অশালীন ও সর্বৈব মিথ্যা অভিযোগ এনেছিল ; সেটা ছিল জামশেদপুরে, তখন ১৯৮৬
সাল। এবং তার তীব্রতায় প্রায় দেড় বছর আমি কৌরব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে, শোকে, বিষাদে,
বিহ্বল হয়ে দিন কাটিয়েছি। কৌরবে তখন পরপর চারটে সংখ্যায় (৪৬ থেকে ৪৯) আমার লেখা
ছিলো না। -এতখানি দায়িত্বজ্ঞানহীন ছিল তার সেই আচরণ। এর পরের বছর, ১৯৮৭-সালে, কমলদা
বুঝতে পেরেছিল যে ভীষণ ভুল হয়ে গেছে ; কিন্তু ততদিনে আমাদের মন ভেঙ্গে গেছিল। ভুল বুঝতে পেরে বারীনদাও নাকি পরে অনুতাপ করেছিল, বলেছিল ‘আমি শংকরের জুতো
বইতেও রাজি আছি’। কিন্তু সামনে এসে ক্ষমা চায়নি। ক্রমে, সময়ের সাথে সাথে, আমরাও
এইসবই ভুলে গিয়েছিলাম ; কল্পনার মৃত্যুর পরে কত কতবার বারীনদাকে বাড়িতে ডিনারে
নিমন্ত্রণ করেছি। অনেক গল্প হয়েছে। বরাবরই সে বলতো, আমাকে ডাকলে কমলকে ডাকবিনা।
কেন এমন বলতো জানিনা, অবাক লাগতো অবশ্যই। আসলে, আমাদের সম্পূর্ণ মনোযোগটা বারীনদা
একা পেতে চাইতো। কমলদা কিন্তু কখনো এমন বলেনি। আজ অব্দি, এত বছরে, কমলদাকে একবার,
মাত্র একবার, বাড়িতে নিমন্ত্রণ করে খাইয়েছি ; কিন্তু কল্পনা মারা যাওয়ার পরে,
বারীনদাকে ভালোবেসে, ক্ষমা করে, অজস্রবার।
এর আগে-পরে আছে অনেক কথা। ভেতরে আছে অনেক গোপন ও জটিল মনস্তত্ব, যা আমি
গোপনেই রেখে দেব। সেসব আলোচনা কাম্য নয়। যা পরিষ্কার করে বলা যাবে না, তা নিয়ে
নীরব থাকাই ভালো। আজ এই কথাটুকুও এখানে লিখতাম না, কিন্তু জানা গেল এই নোংরা সময়ে
সবচেয়ে অশ্লীল ও ঘৃণ্যভাবে যে আমার পারিবারিক কুৎসা করতে লাফিয়ে নেমেছে, সেই তরুণ
সম্পাদকটি কিছু না জেনে, আমাদের কখনো না দেখেও, কিছু কল্পিত মিথ্যা কাহিনী জনে জনে
ফোন করে কুৎসা করে চলেছে ; একথা আমাকে ফোন ক’রে জানিয়েছেন একটি নামী পত্রিকার
সম্পাদক, যাঁর সাথে আগে আমার কখনো আলাপ ছিলো না।
আমার বয়স এখন সাতষট্টি পেরিয়েছে, আজকের কুৎসাকারীদের অনেকে সম্ভবতঃ বয়সে আমার
সন্তানের চেয়েও ছোট। এই পর্বের সমস্ত অশ্লীল পোস্টগুলো আমি সেভ করে রেখেছি। অনেকেই
বলেছেন প্রশাসনিক ও আইনতঃ কঠিন ব্যবস্থা নেওয়ার কথা। এর জন্য জেল, জরিমানা, ও মানহানির জন্য গুরুতর ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা আছে আইনে। বিশেষতঃ যখন মিথ্যা অপবাদ দিয়ে চরিত্রহনন, আর
স্টোনম্যান দিয়ে মেরে ফেলার হুমকিও দেওয়া আছে, শরীরী ভাষায় জবাব দেওয়ার কথা আছে।
-তবু আমি হয়তো একদিন এইসব মানুষদেরও ক্ষমা করে দিতে পারি, যদি জানতে পারি তারা
আন্তরিক অনুতাপ করেছে।
তবে আমি আইনের দ্বারস্থ হচ্ছি জানতে পেরেই বোধহয়, সেই তীব্র অশ্লীল
আক্রমণকারী এক সম্পাদক এখন সহসা ব্যাকফুটে ; আমাকে সে ক্রমাগত মেসেজ করে চলেছে।
লিখেছে—‘আমি তার কাছে দেবদূতের মতো। আমার ‘মুখার্জী কুসুম’ যেন এক গ্রহান্তরের
লেখা। আমি যে আনফ্রেন্ড করেছি, এই দুঃখ তাকে এখন কাঁটার মতো বিঁধছে। আমি কেন তাকে
লেখা দিই না। আমার মত মেধাকে সাথে পেলে তার ‘বাক’ পত্রিকা দারুণ উপকৃত হতো। নেহাৎ
গ্রাম্যতার বশে সে নাকি তার কিছু ক্ষোভ উগরে দিয়েছিল, এখন যা নাকি তার কাছে অলীক
মনে হচ্ছে’ !! --মানুষের এই রকম অবিশ্বাস্য রং-বদল আমাকে বিস্মিত করে। আমার
‘উত্তরমালা’ সিনেমায় ন’জন কবিকে নির্বাচন করা নিয়েও অশ্লীল মন্তব্য করেছিল সে।
কিন্তু আমি জানি, আমার নির্বাচনে কোনও ভুল ছিলো না। -একসময়ে এগুলোকে ধিক্কার
জানানোর ভাষা খুঁজেছি। কিন্তু এখন মনে হয়, প্রকৃতির নিয়মেই তো প্রত্যেক ঋতুতে কত
অবিশ্বাস্য রং-বদল হয়। কত পতঙ্গ, উদ্ভিদ, জলচর। গভীর সমুদ্রে কত রঙের প্রাণী, যারা
পরিবেশ দেখে রঙ বদলায় ! -আজ তাই এসব দেখে খুব বিচলিত হই না।
মাত্র কয়েক বছর আগে, আমার একটা কবিতা (‘প্রাগৈতিহাসিক’) ও তার ইংরিজী
অনুবাদ বারীনদাকে মুগ্ধ করেছিল। বারীনদা ভালোবাসতো দাদাগিরি। আমি দাদাগিরি (টিভি শো) বিশেষ
দেখতাম না তখনো। বারীনদা লিখেছিল, দাদাগিরি দেখিস? এই কবিতাটা একদম ‘বাপী বাড়ি যা’
(অর্থাৎ ছক্কা) হয়েছে। বিশেষত কবিতাটার ইংরিজী অনুবাদ পড়ে সে উচ্ছ্বসিত হয়েছিল। পরে কবিতাটা ছাপা
হয়েছিল ‘নতুন কবিতা’ পত্রিকায়। ‘নতুন কবিতা’ আমার প্রতি অনেকবার অশোভন অশ্লীল আক্রমণ
করেছে, -আমি তবুও সেখানে লেখা দিয়েছি, কয়েক বছর আগেও। সেগুলো হেলাফেলা লেখা নয়,
কারণ কবিতা নিয়ে তাদের দীর্ঘদিনের আন্তরিক চর্চাকে আমি শ্রদ্ধা করতাম। ভুল
বোঝাবুঝি, বিচ্ছিন্নতা, চাইতাম না। কিন্তু তাদের আক্রমণ আজও থামেনি। এদের মধ্যে
উল্লেখযোগ্য ব্যতিক্রম, কবি অলোক বিশ্বাস এবং অ্যাশট্রে পত্রিকার কবিরাও, যারা
আমায় আক্রমণ করেনি।
৭। ১৯৮৬-৮৭ সালে
কৌরবের সাথে ক্ষণিক বিচ্ছেদের সেই ভয়ানক দিনগুলো শেষ হলে, আমরা অনেকে একসাথে
থলকোবাদ গিয়েছিলাম। বারীনদা পরে কৌরবে লিখেছিল, “শংকর যদি লেখালিখি ছেড়ে না দিত,
তবে ওকেই আমরা আশির দশকের শ্রেষ্ঠ কবি বলতে পারতাম”। -ক্রমে আমি আবার ফিরে আসি
লেখায়। এর দশ বছর পরে, ১৯৯৮ সালে, জামশেদপুরে এক স্মরণীয় অনুষ্ঠানে, বারীনদা আমার
পরিচয় দিতে গিয়ে তার ভাষণে বলেছিল, ‘এই শংকর না হলে কৌরবে আমি বা কমল কেউই
সম্পূর্ণ হতে পারতাম না ; শংকর কৌরবকে অনেকখানি এগিয়ে দিয়েছে’। সেটা ছিল কর্মজীবনে
আমার ব্যস্ততম সময়, যে সময়ে কৌরবের সাথে দৈনিক যোগাযোগ ততো সম্ভব ছিলো না। কিন্তু আমার যা
কিছু লেখালিখি, কবিতা-গদ্য-প্রবন্ধের যেটুকু উল্লেখযোগ্য, তার ৯০ ভাগই রচিত হয়েছিল
আমার চাকরিজীবনে, টাটাস্টীলে, বিপুল কর্মব্যস্ততার মধ্যেই। 'ভালোপাহাড়'-এ আমাকে শুরুতেই ভাইস
প্রেসিডেন্ট করা হয়েছিল ; আমি জানতে পেরেই সেটা নাকচ করে দিয়েছিলাম, কিন্তু বাইরে
থেকে সাহায্য করেছি। কখনও ওইসব পদের প্রতি আমার মোহ ছিল না।
আরও দশ বছর পরে, ২০০৮ সালে কর্মসুত্রে জামশেদপুর ছেড়ে আমি কলকাতায় টাটাসেন্টারে চলে
এলে, বারীনদা খুব আক্ষেপ করে আমায় চিঠি লিখেছিল ; বলেছিল--‘তোকে মিস করি’। বছর পাঁচেক আগেও
বারীনদা আমাকে লিখেছে—‘যে যাই বলুক, এই হলি তুই, একদম তোর মতো’। একবার লিখেছিল,
‘বিপদে পড়লে শংকরাকে ডাকি’। এর সম্যক অর্থ অবশ্য আমি বুঝিনি ; কিন্তু তার মনোজগতে
আমার অস্তিত্ব যে একটা বড় জায়গা জুড়ে ছিল, নানা সময়ে, নানাভাবে তার আভাস পেয়েছি।
যখনই তার কোনও কর্মকান্ডে বা মতবাদে আমার সমর্থন দিতে পারিনি, তখনি সে গোপনে আহত
হয়েছে বুঝতে পারতাম, যার প্রকাশ নানাভাবে দেখতে হয়েছে। কখনো ব্যথিত, অপমানিতও বোধ করেছি
আমি, কিন্তু আপস করিনি। হয়তো এইখান থেকে বারীনদার ভেতরে তৈরী হয়েছিল দীর্ঘদিনের এক
বিষাদ। ভেতরে ভেতরে সে একা মনে করতো। কি যেন হারিয়েছি, মনে হোত তার। অথচ নতুন
কবিতার পথে তার সাথে তো জুটেছিল অনেক অনেক তরুণ কবি। হ্যামেলিনের বাঁশিওয়ালার মতোই
প্রবল ছিল তার অনুগমন।
তবে এইসব নিয়ে আমি কখনো তাকে ঈর্ষা করিনি ; বরং অনেকবারই মনে হয়েছে যে,
আমাকে নিয়ে নানা কারণে বারীনদার ভেতরে প্রশংসার পাশাপাশি হয়তো একটা গোপন ঈর্ষারও
জন্ম হয়েছিল। দীর্ঘকাল ধরে সারা বাংলা সে চষে বেড়িয়েছে, ভালোবেসে প্রশংসা করে গেছে
কতো স্বল্প-পরিচিত তরুণদেরও। অনেক আলিঙ্গন, সেলফি, ইমেইল, -সবাই পেয়েছে তার কাছ থেকে
দুহাত ভরে। কিন্তু সেই কোলাহল তার অন্তরকে ভরিয়ে তোলেনি। হয়তো এর কোনও কিছুই তাকে
সিঞ্চিত করতে, শান্তি দিতে পারেনি। ভেতরের হিম নির্জনতায় সে ক্রমশঃ একা হয়ে পড়েছিল,
-এমনটা মনে হয়েছে আমার। আমি তাকে দীর্ঘদিন ধরে কাছ থেকে, দূর থেকে, অনেক আহ্লাদে
প্রেমে অপমানে লক্ষ্য করে গেছি। স্ত্রীকে হারানোর পরে, বারীনদার মনের গভীরে,
নীরবে, একান্তে যে গোপন জায়গাটা---রূপকথার প্রাণভ্রমরের মতোই---সেখানে স্পষ্ট-অস্পষ্ট
মাত্র দুতিনজনের নাম আমি পড়তে পেরেছিলাম, যাদের মন সে ‘জয়’ করতে চেয়েছিল। আজ যারা আমাকে তীব্র
আক্রমণ আর অশ্লীল কুৎসা করে চলেছে, এমনকি স্মরণসভাতেও আমার প্রতি বিদ্বেষ ছড়িয়ে
চলেছে, তাদের কারো নামই সেখানে কখনো ছিলো না। বছর ছয়েক আগে রাজর্ষিদের কাগজে যখন
আমার কবিতা-জীবন নিয়ে একটা বড় লেখা ধারাবাহিকভাবে বেরোচ্ছিল, যেটা এবার বই হয়ে
বেরোবে, বারীনদা জানিয়েছিল তার প্রশংসা ; রাজর্ষিকে লিখেছিল ‘শংকরকে তোরা কখনো
ছাড়িস না। ওকে ধ’রে রাখিস’। এর কিছু পরে একদিন বারীনদাও নিজের আত্মজীবনী লেখা শুরু করে। হারাতে হারাতে
একা—যা এক অন্য মার্গের নীরব বেদনা, যে বেদনার অনেকটাই হয়তো অপ্রকাশ্য।
কৌরবে আমার প্রত্যেক লেখালিখিকে যে মানুষটা সবচেয়ে খুঁটিয়ে পড়ে এসেছে এতবছর
ধরে, এবং মনে রেখেছে, সে স্বদেশ-কমল-দেবজ্যোতি-সুভাষ নয়, তার নাম বারীন ঘোষাল। অরুণ আইন-কে এর
মধ্যে ধরছি না, কারণ সে আমাকে পড়েনি, চিনতোও না, এবং কমলদার মতে ১৯৭২ সালের পর
থেকে সে আর কৌরবে ছিলও না কখনো। তাকে নিয়ে
বারীনদার লেখায় আছে (কৌরব-৫১, ১৯৮৮) : “কৌরব-৬ বেরোনোর পর অরুণ কোলকাতা চলে
গেল।...এরপর অরুণের লেখা আর কৌরবে দেখা যায়নি। কোলকাতায় গিয়ে দ্রুত নাগরিক
উন্নাসিকতায় অভ্যস্ত হয়ে উঠল। কৌরবকে ঘিরে আমাদের আবেগ ওর কাছে হাস্যকর মনে হত।
শুদ্ধ সাহিত্যচর্চার বিরুদ্ধে বিষোদ্গার আমরা এত দূরে বসেও শুনতে পেতুম। অরুণকে
অবাঞ্ছিত বলে স্বীকার করার সময় আমি আর কমল যে কষ্ট পেয়েছি সেইরকম আর কখনো
হয়নি।...অরুণের দেওয়া ক্ষত শুকোতে বহুবছর লাগল”। -তবুও আমার ‘রাখা হয়েছে কমলালেবু’
ছবির চিত্রনাট্যে আমি সসম্মানে অরুণদাকে রেখেছিলাম, আজকের প্রজন্মের কাছে তাকে পরিচিত
করানোর জন্যে, যা আমার কর্তব্য মনে হয়েছিল।
বারীনদার সাথে আমার ছিল দীর্ঘদিনের গভীর ও পারস্পরিক শ্রদ্ধার সম্পর্ক। কিন্তু
আমি কখনোই তাকে আমার গুরু মনে করিনি। কে যেন লিখেছেন---অরুণ চক্রবর্তী---যে আমি বারীন
ঘোষালের হাত ধরে কৌরবে উঠেছি ? না, এটা অসত্য।
শুরুর দিকে যারা আমায় প্রভাবিত করেছে, সঙ্গ দিয়েছে, যাদের সাথে অনেক ক্যাম্প
করেছি, তারা স্বদেশ সেন ও কমল চক্রবর্তী। আমার আগামী বইয়ে এইসব প্রসঙ্গের উল্লেখ আছে। অরুণবাবু
বর্ষীয়ান মানুষ, আমার সাহিত্যকর্ম নিয়ে কিছুদিন আগেও প্রশংসা করেছেন ফেসবুকে। তবুও
কোনও বিষয় না জেনে না বুঝে অনেকেই তো অত্যন্ত অপমানকর মন্তব্য করার সুযোগ ছাড়েন
না, দেখেছি। ওঁর প্রতি আমার ক্ষোভ আমি তাই এবারও লুকিয়ে রাখলাম, কারণ বহির্বঙ্গের
সাহিত্যকর্ম নিয়ে ওঁর অজ্ঞতা ও রুচির পরিচয় উনি নিজেই দিয়েছেন। আমার বয়সটাও
হয়তো উনি জানেন না। এ পৃথিবীর যত কথা প্রকাশ্যে, তার চেয়েও ঢের ঢের বেশি চিরকাল
গোপনে থেকে যাবে, -আমি এমনটাই জানি। তবুও এত আক্রমণ,
ফতোয়া, নির্দয় অশ্লীলতা ! আজ সর্বত্রই এসবের বিরুদ্ধে ধিক্কার জানানোর, প্রতিবাদ
করার মতো নির্ভীক লোক খুব বেশি নেই !
৮। কয়েকদিন আগে কমলদা ফোনে বললো : ‘তোমার লেখাটা নিয়ে এইরকম আক্রমণ হচ্ছে? এমন
সব কুৎসিত কথা বলা যায়? এ তো সাঙ্ঘাতিক সাইবার ক্রাইম, শাস্তিযোগ্য, এ নিয়ে তো কেস
করা যায়’। আমি বললাম, লেখাটা আমার আগামী বই
থেকে তুলে নেব। কমলদা বললো : ‘তুলবে কেন ? কক্ষনো তুলবে না। ওটা অবশ্যই একদিন লোকে
বুঝবে। তুমি এদের মাঝে এতদিন ধরে রয়েছ কেন? বেরিয়ে এসো। একমনে নিজের মতো কাজ করে যাও,
কতো কাজই তো করেছ তুমি।... এরা কেউ কোনও বড় কাজ করলে আমি বুঝতুম ; কিন্তু শুধু
বাতকম্মো করে গেছে চারদিকে। এইসব গুয়ের দিকে ঢিল ছুঁড়তেও নেই, নিজেরই গায়ে এসে ছিটকে
লাগবে। বছরখানেক আগে আর্যনীল আমাকে একটা কুৎসিত চিঠি লিখেছিল। তুমি ভাবতে পারবে
না। একটা অসামাজিক লোক। আমি এবার বড়ো কাগজে একটা লেখা লিখবো, সেখানে ছাপাবো ওর
চিঠিটা, আমি যত্ন করে রেখে দিয়েছি এতদিন। তুমি এসব নিয়ে একদম মনখারাপ কোরো না,
নিজের মতো কাজ করে যাও’। -কমলদা জানালো।
টেলিফোনে কমলদার কথায়, তাকে লেখা আর্যনীলের কুৎসিত চিঠির প্রসঙ্গে, আজ আমার
মনে পড়ছে, আর্যনীল যেদিন প্রথমবার অপমান করে মেইল করেছিল কৌরবদের সিনিয়রদের। সেটা
২০১০ সাল। আমি তীব্র প্রতিবাদ করায় বলেছিল, এগুলো আমি দেবজ্যোতির উদ্দেশে লিখেছি। শুনে
আমি ভীষণ বিস্মিত ও ক্ষুব্ধ হয়েছিলাম। কিন্তু এর পরেও পত্রিকার কাজে কতভাবে তাকে সাহায্য
করে গেছি। কেউ তার কাজের নিন্দে করলে আমি মধ্যস্থতা করেছি, বুঝিয়েছি। কতবার সে
কৌরবের সম্পাদনার দায়িত্ব আমার হাতে তুলে দিতে চেয়ে চিঠি লিখেছিল। কিন্তু
দেবজ্যোতিকে আক্রমণের পরে, সম্প্রতি কৌরব-প্রধান খোদ কমল চক্রবর্তীকেই সে লিখেছে কুৎসিত
চিঠি ! প্রতিবার ফোনে কমলদা আমার কাছে সেই দুঃখে ক্ষোভে হায় হায় করে। এবং সব শেষে,
আজ বারীনদার মৃত্যুর পরে, ফেসবুকে আমার নামে এই কুৎসিত আক্রমণ শুরু হয়েছে তারই
নেতৃত্বে !! আজ এতদিনে তার সাথে ‘প্রবীণ ও প্রকৃত’ কৌরবদের সকল সম্পর্ক তাহলে ছিন্ন
হোল !
আরও একটা কথা এখানে জানানো দরকার। আমরা যখন ১৯৮০-তে চাঁদিপুর ক্যাম্পের
রিপোর্ট কৌরবে প্রকাশ করে কলকাতায় হইচই ফেলে দিয়েছি, সে সময়ে আর্যনীল ছিল নিতান্তই
স্কুলবয়। বয়সে এতটাই ছোট। আজ তার কান্ডজ্ঞান নেই যে, কার সম্বন্ধে সে কী লিখছে, কী
ভাষায়, -এটা অনেককেই তীব্র ক্ষুব্ধ ও বিস্মিত করেছে। প্রবীর রায়ের পোস্টে আমার
সম্বন্ধে তার কুৎসিত সব মন্তব্যের রেকর্ড রাখা আছে অনেকের কাছেই ! এই তীব্র আক্রমণ ও মিথ্যাচারের পেছনে সম্ভবতঃ আছে তার
মনের ভেতরের কিছু গভীর হতাশা। নিজের একটা থ্রিলার-চিত্রনাট্য নিয়ে অনেক স্টার, সেলিব্রিটি
ও বড়ো প্রোডিউসার ধরেও এত বছরেও কোনও সিনেমা না হওয়াটা হয়তো তার মধ্যে অন্যতম। আমি
তাকে বলেছিলাম, কবিতাকে আশ্রয় করে সম্পূর্ণ নিজের শ্রমে, শিক্ষায় ও মেধায় একটা পূর্ণদৈর্ঘ্যের মূল্যবান
ছবি বানিয়ে দেখাতে, যা দর্শকরা ‘মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে’ দেখবে। হয়তো সেই না-পারা থেকেই
তার বিদ্বেষ। হয়তো আরও অনেক কিছু হতাশা তাকে এমন করেছে, যা অনেকেই আন্দাজ করেছেন।
ফেসবুকে শ্রীমান আর্যনীল লিখেছে, তার কাছে নাকি ২০১০ সাল থেকে আমার লেখা ছ-সাত বছরের চিঠিতে বারীনদার প্রতি ঈর্ষা ও বিদ্বেষের ঢের পরিচয় আছে, যা তার চেয়ে নাকি আর কেউ বেশি জানে না, কারণ সে আমার কবিতার বইয়ের একটা রিভিঊ লিখেছিল। -তার এইমতো মেধাবী যুক্তিতে আমি বিস্মিত। তার কিশোরপুত্রকে তো আমি সুযোগ দিয়েছিলাম আমার প্রথম ছবিতে সঙ্গীত রচনায়, যে কাজ সে খুব সুন্দর করেছিল। কিন্তু আমি কি তাই নিয়ে পালটা কোনও নির্বোধ যুক্তি দেব ?
ফেসবুকে শ্রীমান আর্যনীল লিখেছে, তার কাছে নাকি ২০১০ সাল থেকে আমার লেখা ছ-সাত বছরের চিঠিতে বারীনদার প্রতি ঈর্ষা ও বিদ্বেষের ঢের পরিচয় আছে, যা তার চেয়ে নাকি আর কেউ বেশি জানে না, কারণ সে আমার কবিতার বইয়ের একটা রিভিঊ লিখেছিল। -তার এইমতো মেধাবী যুক্তিতে আমি বিস্মিত। তার কিশোরপুত্রকে তো আমি সুযোগ দিয়েছিলাম আমার প্রথম ছবিতে সঙ্গীত রচনায়, যে কাজ সে খুব সুন্দর করেছিল। কিন্তু আমি কি তাই নিয়ে পালটা কোনও নির্বোধ যুক্তি দেব ?
শ্রীমান আর্যনীলের কথায় আজ আমি সত্যিই ধর্মসংকটে পড়ে গেছি, কীভাবে এর উত্তর
দেব। আমাদের মধ্যের সব ব্যক্তিগত চিঠিগুলো আমি প্রকাশ করে দিলে, তাকেই তো অনেকটা
এক্সপোজ করে দেওয়া হবে। তা কি উচিত হবে? আমি কি আমার সব কাজ ফেলে লোকসমক্ষে তার
সাথে এই অশ্লীল সঙ্গতে অংশ নেব ? এভাবে জবাব দেব তার লাগাতার ধৃষ্টতার ? আমার তো
কোনো চিঠি লুকোনোর নেই, কখনো ছিল না। কিন্তু বহুবার তার অনুরোধ ছিল, তার চিঠিগুলো যেন
কদাপি অন্য কারও সাথে আমি শেয়ার না করি। আমি সেই গোপনীয়তার শপথকে এতদিন রক্ষা করেছি। আমার সেই সৌজন্যবোধকে
সে আজ আমারই বিরুদ্ধে হাতিয়ার করতে চাইছে, অবিশ্বাস্য !! এই প্রজন্মের
কৌরব-সম্পাদক হিসেবে আর্যনীলের ভূমিকা বহুবার সমালোচিত হয়েছে, কিন্তু আমি অনেকবার তার পাশে দাঁড়িয়ে তাকে সমর্থনও করেছি। একবার তার আর্জেন্ট মেইল এসেছিল- ‘শংকরদা,
আমায় বাঁচাও, আমার বিরুদ্ধে (নতুন কবিতার দিক থেকে) ঝড় উঠেছে’! বোধহয় সেটা ছিল
বার্নস্টেইনকে দেওয়া কোনও অদ্ভুত সাক্ষাৎকার, কিম্বা অন্য কোনও বিষয়ে।
তবে, প্রথমে ১-৭-২০১০ তারিখে আমাকে তার রোমান হরফে লেখা চিঠি থেকে মাত্র কয়েকটা
লাইনের মর্ম আমি এখানে উদ্ধৃত করতে চাই, যাতে তার স্মরণে আসে। বারীনদার টেলকোর বাড়ির আড্ডা
সম্বন্ধে এই চিঠিতে সে উল্লেখ করেছিল বারীনদার 'পরনিন্দা পরচর্চা' আর 'ভয়ংকরী অল্পবিদ্যা'র
কথা :
‘১৯৯৮-এর পরে, তোমাদের (স্বদেশ-কমল-শংকরের) অনুপস্থিতিতে,
১৫/৩ টেলকোর সেই টেবিলে কৌরবের আড্ডা ক্রমে বারীনদা-কেন্দ্রিক হয়ে যায়, এবং সেখানে
কেবল পরনিন্দা পরচর্চাই হোত। সেই থেকে আমি তাই আর জামশেদপুরে যাই না। ...বাংলা
সাহিত্যে অল্পবিদ্যা ভয়ংকরী। খুব অল্প পড়ে লোকে কনক্লুশানে চলে যায়। এবং এই
ব্যাপারে বারীনদা এক নম্বর’।
শ্রীমান আর্যনীলের সাথে আমার দীর্ঘ ছয়-সাত বছরের অনেক মেইলগুলোর কপি রাখা
আছে। আমি সেগুলো দিয়ে একটা ৪-৫ ফর্মার বই অনায়াসে বের করতে পারি, অথবা ধারাবাহিক প্রকাশ
করতে পারি আমার নিজের ব্লগেও ; হয়তো এটা এবার প্রয়োজন। এতে যেমন অনেক সুন্দর
মূল্যবান কথা আর আলোচনা আছে আমাদের মধ্যে, তেমনি আছে কৌরবের অন্দরমহলের গোপনীয়
অনেক কিছু, যাকে স্বচ্ছতার প্রয়োজনে সর্বসমক্ষে নিয়ে আসা যেতেও পারে। কারণ, আমার কোনো
লুকোনো এজেন্ডার দরকার হয়না। সভাসমিতি, মঞ্চ, সেলিব্রিটি, প্রতিষ্ঠানের আনুকূল্য,
রেজিমেন্টেশান, ‘আমার-পোস্ট-শেয়ার-কর-নয়তো-মর’, -এসবের দরকার হয় না। সাহিত্যের
কাজে কৌরবে গত চল্লিশ বছর ধরে আমার একান্ত জীবনযাপন সম্পূর্ণ অন্যরকম। আমার
প্রত্যেকটা কাজের মধ্যেই আমার পরিচয়। বারীনদার জনপ্রিয়তাকে ঈর্ষা করার কোনও
প্রশ্নই নেই, আমি ওইরকম সভাসমিতি, রেজিমেন্টেশান ও জনসংযোগের অতিসক্রিয় জীবনযাপন
থেকে বহুদূরে সন্তর্পণে চল্লিশ বছর নিজেকে সরিয়ে রেখেছি। আমি ওইসবকে ঈর্ষা করবো
কেন ? -যারা অন্ধ ও কূপমণ্ডূক, কৌরবের কিছুই জানে না, শুধু তারাই এভাবে ভাবতে পারে।
৯। আমার আগামী বই থেকে 'বিতর্কিত' লেখাটা তুলে নিতে বারণ করেছে কমলদা। তাকে আমি পুরো লেখাটা পড়াতে চেয়েছি। এ ছাড়াও প্রবীণ ও তরুণরা
অনেকেই রয়েছেন, যাঁরা আমায় এই নিয়ে লিখেছেন (এখানে কারো নামোল্লেখ করবো না) :
i) “অতিচেতনার নামে শব্দ প্রতিযোগিতায় থাকছিল না জীবনের বৃহত্তর যোগ।
কথাগুলো কোনও সিনিয়রের বলা জরুরি ছিল, আপনি বললেন। কবিতায় জীবন, মৃত্যু ও ঈশ্বরের
থাকা বা না থাকার মত চিরায়ত জিনিষগুলির কথা ওঠার জায়গাটা সংকুচিত হয়ে গেছে এই ('অতিচেতনার কথা') বইটার জন্য। সবকিছু সামলে কবিতা লেখাই আজ কঠিন”।
ii) “আমার স্টেটাসটা কিন্তু আপনার লেখার পরিপ্রেক্ষিতে নয় শংকরদা। ...আপনার
লেখাটি আমি পড়েছি। ‘অতিচেতনার কথা’-ও পড়েছি। অতিচেতনার কথার বিষয়ে আমারও কিছু
মতপার্থক্য রয়েছে, এবং তার কিছু উল্লেখ আপনি আপনার লেখাতেও করেছেন। ফলে, আপনার
লেখা নিয়ে, তার তাত্ত্বিক বা নান্দনিক অবস্থান নিয়ে, আমার ব্যক্তিগতভাবে কোনো
আপত্তি নেই। কৌরবের আভ্যন্তরীণ রেষারেষি বা মনোমালিন্য সম্পর্কে আমার সামান্যতম
ধারণাও নেই। ফলে, আমি ‘অতিচেতনার কথা’ এবং আপনার প্রতিক্রিয়া দুটোকেই বিশুদ্ধ
কাব্যালোচনার চোখে দেখেছি। আপনি ভুল বুঝবেন না”।
iii) “ওদের ক্ষমতায় আঁটে না আপনাকে, আপনার কাজকে সম্মান করা, তাই অক্ষমের
জায়গা থেকে কাদা ছোঁড়ে। তবে এই স্বচ্ছতার প্রয়োজন ছিলো”।
iv) “এখন ফ্যাসিবাদী একটা চাপ রোধ করছি। আমি সাইলেন্স দিয়ে লড়ছি। আই ডোন্ট
ডিসার্ভ টু বি ট্রিটেড অ্যাজ অ্যান ইমোশনাল স্লেভ”।
v) “কী বলব
জানি না... যত দেখছি স্তব্ধ হয়ে যাচ্ছি। কেউ একবারও লেখাটায় যে যুক্তিক্রম আছে,
সেটা নিয়ে কিছু বলল না। প্লিজ পুরো লেখাটা বাদ কেন দেবেন। এত জরুরি একটা লেখা। ইতিহাস ঠিকই বুঝবে এই কাজকে। আজ
বুঝতে পারছে না। কিন্তু আগামীতে বুঝবে। বুঝবেই। নতুন কাজ, জটিল কাজ, বুঝতে সময়
লাগে”।
vi) “আমি
জানি অপরিসীম যন্ত্রণার। আপনি তো আমার চেয়ে বয়সে অনেক বড়, আপনি কি জানেন না,
‘বাংলা সাহিত্য’ পরিসরে যারা ‘সাহিত্য করে’ তারা কি পরিমাণ মৌলবাদী, তারা নিজেদের
অশিক্ষা, বোধহীনতা চাপা দিতে চায় চীৎকার দিয়ে। আপনি আপনার বোধ ও ভালোবাসা হেতুই সব
করেছেন। প্লিজ কিছু আশা করবেন না। কাজ থাকবে, আমার মত কিছু বোকা খালি কাজ দেখে
ভালোবাসবে, সমালোচনা করবে। আশীর্বাদ করুন যাতে চালাক না হয়ে উঠি ও ‘সাহিত্য’
না-করি। প্রণাম নেবেন”।
vii) “এই আক্রমণগুলির আয়ু মুহূর্তেরও কম। কিন্তু শংকর লাহিড়ী আপ্রলয় অবধি থাকবেন, তাঁর ভাবনা, তাঁর নিজস্বতা, তাঁর সাহস, তাঁর কলম, সব নিয়ে”।
vii) “এই আক্রমণগুলির আয়ু মুহূর্তেরও কম। কিন্তু শংকর লাহিড়ী আপ্রলয় অবধি থাকবেন, তাঁর ভাবনা, তাঁর নিজস্বতা, তাঁর সাহস, তাঁর কলম, সব নিয়ে”।
এইরকম মেসেজগুলোই আমাকে শক্তি
যুগিয়েছে এই ক’দিন ; অনেক ট্রমাটিক বিনিদ্র রাতে, অনেক যন্ত্রণায়। কৌরব ও প্রকাশনী
আবার নতুন করে করার প্রস্তাব আমাকে দিয়েছে কমলদা। আমি এখনও সিদ্ধান্তে আসিনি। আমার
বেশি চিন্তা হয়েছে রাজর্ষিকে নিয়ে, যে লেখাটি ছাপতে নিয়েছিল তার আন্তর্জাল
পত্রিকায়। অনেক অভিযোগ এসেছে তার নামেও। অসহ্য শারীরিক ও মানসিক কষ্টে দিন কেটেছে
তার।
১০। আমার সম্পাদনায় স্বদেশ সেনের
কবিতাসমগ্র ‘আপেল ঘুমিয়ে আছে’ শীঘ্রই প্রকাশিত হবে, প্রকাশক কবি কমল চক্রবর্তী।
এছাড়া, বারীনদার স্মৃতির প্রতি একটা ব্যক্তিগত ট্রিবিউট, একটা তিরিশ মিনিটের ছবি
বানানোর ইচ্ছে আছে। বারীনদারই একটা কবিতার নামে ছবির নাম। -কতদিন লাগবে, কত বিনিদ্র রাত ভোর
হবে, জানিনা। সমীরদা বলেছিলেন, ‘তুমি আমাকে ভাবনার জায়গাটায় বারবার পৌঁছে দিতে পেরেছ’।
শিল্প-সাহিত্য-কবিতার জগতে কোথাও কোনও শেষ কথা নেই, স্থির সিদ্ধান্ত নেই। যা কিছু সিদ্ধান্ত, সবই একদিন পৃথিবীর বড় গোল পেটের ভেতরে সেদ্ধ হবে। শিল্পীমাত্রেই
উচিত হয় এক বৃত্ত থেকে অন্য বৃত্তে, কক্ষ থেকে কক্ষান্তরে যাতায়াত, অন্বেষণ। এক এক
দৃষ্টিকোণ থেকে সময়ের বাঁকে বাঁকে এক এক রকমের যুক্তি বিচার উপলব্ধি। এসব হৃদয়ঙ্গম
করার জন্যে চাই সততা, মেধা ও দূরত্বের নির্জনতা। সকল কুশ্রীতা থেকে তাই বাইরে,
দূরে, স্বেচ্ছানির্বাসনে, এবার আমি স্বাধীন ; আমার নিজস্ব বাসভূমিতে, নিজের মতো
কাজে। আমার দরকার ছিল মাত্র পনেরোজন পাঠক, যার বেশি আমি পেয়েছি। এই নির্জন নীলাভ
স্ট্র্যাটোস্ফিয়ার একান্ত আমার। কোনও বায়ুদূষণ, হতাশার কালিমা এখানে স্পর্শ করবে
না। এই পৃথিবী অনেক বড়, অনেক সুন্দর, অনেক রহস্য ও অজানায় ভরা, আজও। আছে তারা আমারই
আবিষ্কারের অপেক্ষায়। কত ছবি আছে, সুর আছে, রঙ আছে, সুগন্ধ আছে। আছেন কত উজ্জ্বল অমলীন
মানুষ। কত তাদের অজানা নতুন কাজ ! কত কাজ বাকি আছে। আমাকে যেতে হবে সেখানেই।
২৯ নভেম্বর, ২০১৭
[*এর ঠিক দু’মাস পরে, ২০১৮ সালের জানুয়ারী মাসের শেষে, আমি বারীন ঘোষালের স্মৃতির প্রতি প্রস্তাবিত ছবিটা নির্মাণ করি। কৌরব নিবেদিত এটা আমার তৃতীয় ছবি। বারীন ঘোষালের একটা কবিতা-বইয়ের নামানুসারে এই ছবির নাম ‘মায়াবী সীমূম’। ছবির দৈর্ঘ্য ৬৫-মিনিট।
কলকাতা বইমেলায় কৌরবের স্টল থেকে অনেকেই এর ডিভিডি সংগ্রহ করেছিলেন। ছবিটা দেখে কয়েকজন আমায় জানিয়েছেন তাঁদের মুগ্ধতার কথাও। -কৌরবের সাথে দীর্ঘ চল্লিশ বছর (১৯৭৭-২০১৭) যুক্ত থাকার পর, এই ছবিটাই কৌরবে আমার শেষ কাজ। -১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৮]