- শংকর লাহিড়ী
একুশ একটা বিষয় । একুশ কি একটা বিষয় ? আমি প্রশ্ন করি আমাকে। একুশে
ফেব্রুয়ারি, একুশ শতক, একুশ বছর বয়স। যখন আমার একুশ বছর বয়স, সেটা ১৯৭১ সাল, সেই
সত্তরের দশক । এবং ‘তুমি যে গিয়াছ চলি, বকুল
বিছানো পথে’। তখনও নিজের কোনো কবিতার খাতা ছিলো না। কৌরবে যোগ দিয়ে, আশির দশকে যখন কাগজ কলম নিয়ে তৈরী হলাম, তখন
বেলা হয়ে গেছে। আমার প্রথম কবিতার বই ‘শরীরী
কবিতা’ প্রকাশিত হয়েছে ১৯৯০ সালে, তখন আমার বয়স চল্লিশ।
জামশেদপুরের ছোট্ট আদিবাসী গ্রাম সাকচি; শাল-নিম-কুসুম-মহুয়া গাছের ছায়ায়
যেখানে এক আদিবাসি দাইমা-র হাতে আমার জন্ম হয়েছিল। আমার কবিতায় কখনো আমি আদিবাসী
শব্দ, তাদের কথ্য ভাষা, ব্যবহার করিনি। সেই কোলেকাঁখে বয়সে, আমি বেশি কাঁদলে বাড়ির
সাঁওতাল পরিচারিকা সুরজমুনি মাকে বলেছে, ‘টুকুন আফিম খাওয়ায়ে দিস কেনে ইয়াকে’। দলমা
পাহাড় আর ডিমনা লেকের ওপার থেকে রোজ দশবারো কিলোমিটার পথ পায়ে হেঁটে সে কাজে আসতো।
তবুও সাঁওতাল, মুন্ডা, হো, ওঁরাওদের ভাষা আমার লেখা থেকে দূরে থেকেছে। আমি জানতাম
না, ‘ইশুভুকিন বুরু’ শব্দের অর্থ কী। বস্তুত, উত্তর কোলকাতার শৈশব জীবন, গাঙ্গেয় হাওয়া, তাল-নারকেল
সারি সারি, লাল দোতলা বাস, ঘুঁটের উনুন, চ্যাঙারীতে সিঁদুরমাখা প্যাঁড়া আর জবাফুল পরিবেশকে
এতটা শাক্ত করে তুলেছিল, যে আমি পাহাড়চটির
মারাংবুরুকে বেমালুম বিস্মৃত হয়েছিলাম। কৈশোরে স্কুলের ছুটিতে জামশেদপুরের পথে, রাতের
স্টীম-এঞ্জিনে-টানা রাঁচী এক্সপ্রেসে কৃষ্ণকায় সাঁওতাল রমণীদের ঘর্মাক্ত নিমতেলের
গন্ধে আমার বিবমিষা হয়েছিল। অনেক পরে, ভোরের আলোয় ধলভূমগড় স্টেশনের লাল মাটিতে
ট্রেন থামলে, হিম কুয়াশায় মহুয়া, শিরিষ ও নিমফুলের অপার্থিব গন্ধে ঘ্রাণে আমার মনে
পড়ে যেত জন্মদিনের সেই সাকচি-গ্রামের কথা।
সত্তরের দশক পেরিয়ে সর্বাঙ্গে ব্যান্ডেজবাঁধা দুই বাংলা। আশির দশকে এসে তখনো
কোলকাতা-কেন্দ্রিক কবিতা, যা চিরকালীন চিৎকৃত দুনিয়ার মজদুর এক হও, অথবা কলেজপালানো ক্যান্টিনসেবীদের
প্রিয়া-প্রেয়সী-পল্লবিনী, হাংরিদের এফোঁড়-ওফোঁড়, কলকাতার যীশু, আর মুক্তমঞ্চে ‘তুমি
ভাঙ্গা বাথরুমে ঝকঝকে মুতের বেসিন’ । অন্ত্যমিল,
অক্ষরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত । ‘ভুলগুলো সরাও আমার লাগছে’, -বলেছিলাম আমি। সাদা কাগজের ধু-ধু নির্জনতা, দোয়াতের তরল
টার্কোয়াজ-- উভয়েই তখন স্থির প্রতীক্ষায়। তখনও শান্তিনিকেতন যাওয়া হয়নি, দেখা হয়নি নোবেল
প্রাইজও। প্রতি বছর দেদার রবীন্দ্র, আনন্দ, বিদ্যাসাগর, বিষ্ণু দে, একাডেমি। ভূমিহীন কৃষকদের মতো
পাঠকহীন কবিদের কাতারে আমি, আমরা, যারা কবিতাকে জলোচ্ছ্বাসের মতো বাজুকার মতো
অন্তর্বাসের মতো কর্তৃত্বময় দেখতে চেয়েছিলাম।
আশির দশকে আমি জামশেদপুরে, টাটাস্টীলে
কর্মরত। শৈশবের সেই সাকচি গ্রাম থেকে তখন মহুয়া গাছের
অন্তর্হিত ছায়া, আর বাড়ির পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া সেই সুবর্ণরেখা নদী । আমার সাদা পাতা একান্তে ধীরে, ক্রমশঃ ‘শরীরী কবিতা’। ...তার আবৃত রহস্য, জলের হিম চ্ছলাৎ শব্দ, মধ্য উরুর
ক্ষত, ভঙ্গুর ফ্রুটবোল, বিনাশী ঘ্রাণ, ফাঁকা কফির টিন, মারমুখী পতঙ্গ, পারলৌকিক
শ্রাব, অদ্ভুত বোতাম, শিরাকাটা চীৎকার, বরফের দেওয়াল, হিম পেন্ডুলাম, রক্তঅস্থিময়
মেঘ, যন্ত্রমানুষ, উন্মাদ ক্যাকটাস, উন্মাদের তীব্র আফটার শেভ, উষ্ণ প্রশ্নবোধক
স্যুপ, চাবুক ও সসেজ ।
কবিতার মর্মে তার প্রবেশপথ কখনো ফানেল-শেপ্ড্। বৃত্তাকার সামগ্রিক থেকে
ধীরে একটি কেন্দ্রিক অনুভূতিতে পৌঁছোনো। বিভিন্ন অনুষঙ্গযোগে ও বিন্যাসে উপস্থাপিত
হয় দুই বহির্মুখী ও অন্তর্মুখী বিপরীত বল। যে বল আর্কাইক, আমাদের সামগ্রিক জড় ও
অজড়ে, দেহকোষে, নক্ষত্রমন্ডলে নিরন্তর কাজ করে।
আমার মনে হয়েছিল, একান্তে নিজস্ব বাগানে বুঝিবা অর্কিড নিয়ে জেনেটিক
কাজকর্ম করে চলেছি আমি। নব্বইয়ের দশকে, পরবর্তী বই ‘মুখার্জী কুসুম’ যেন এরই ফাঁকে একপাশে কিচেন গার্ডেনে
কিছু নতুন প্রজাতির শালগম, টম্যাটো। ...‘নতুন
কবিতা, আমি পাইনা তোমাকে কেন / যেভাবে মুখার্জীর ছেলে / আপন শালীকে নিয়ে
ম্যাকলাস্কিগঞ্জে চ’লে যায় / অসংযত, কৈফিয়তহীন’।
‘মুখার্জী কুসুম’ সিরিজের এই
কবিতাতেই প্রকৃত প্রস্তাবে প্রথম রাখা হয়েছিল, ‘নতুন কবিতা’-এই কয়েনেজ ও তার
লক্ষ্মণগুণ । কবিতার সঙ্গে তৈরী করতে চেয়েছিলাম এমন এক সম্পর্কের আশ্লেষ, যা
প্রথাগত থেকে বিচ্যুত ও অবৈধ। কবিতাকে
নিয়ে যেতে চেয়েছিলাম ম্যাকলাস্কিগঞ্জের মতোই এক নতুন ভূখন্ডে, অন্বেষণ যেখানে
অন্তহীন, ‘অসংযত’ ও বিন্যাস ‘কৈফিয়তহীন’। সেই সময়ে, যখন কবিতাভুবন নিজস্ব ছন্দহীন, সমাসবদ্ধ এবং প্রকৃতই
রাত্রিযাম। --সেই স্পেস-টাইমের প্যারাডাইম ভেঙ্গে শান্টিংয়ের শব্দমালা আলোড়িত করা
গান এবং উন্মুক্ত শরীরে তাকে ছোঁয়ার আর্তি অবিশ্বাস্য !
শরীরী কবিতার প্রচ্ছদে জীপার-খোলা জিনসের প্যান্ট, অথবা মুখার্জী কুসুমে
দরোজার আর্চ, বা পার্কের ল্যাম্পপোস্ট, সবই ক্রমশঃ নতুন এক স্পেস-টাইম ডোমেন।
ম্যাজিকাল মুভমেন্টস, ত্বরণ, মন্তাজ, মিউজিক্যাল অ্যাবস্ট্রাক্সান, - এভাবেই আমি
বোঝাতে চেয়েছি । যে শব্দ যে ভাষায় সঠিক ঝংকার তোলে তাকে আমি সেভাবেই ব্যবহার করেছি
; মৌলবাদীর মতো সর্বগ্রাসী বঙ্গানুবাদের সচেতন বিরোধিতায়।
উৎপলকুমার বসুর ‘হ্যাঁ তোমার কবিতাগুলি / পড়েছিলাম / পাগল প্যান’ আমাকে
থমকে দিয়েছিল। ক্রমে, ‘কবিতাগুলি বাংলা অক্ষরে / পাগল প্যান, আমাকে করো লাজুক’
আমাকে প্রকৃতই প্ররোচিত করে। আমি তাঁর কাছ
থেকে প্রধানতঃ দুটো শব্দ শিখেছিলাম, -নীলিমাবিথার আর মর্ম। ‘বনকুকুরের সারি জঙ্গলের মর্মে
ছুটে চলে’। আর সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের কাছ থেকে আরো দুটো ব্যবহার, -সতত আর নীহার। আইজেনস্টাইনের
‘ব্যাটল্শিপ পটেমকিন’ ছবির মন্তাজে শুধু সেই কশাক-সেনা আর ওডেসা স্টেপ সিকোয়েন্স ছাড়া আর কিছুই আমার কবিতার স্মৃতিতে নেই।
আশি-নব্বইয়ের দশকে আমার কবিতায় কোনও প্রেমিকার নাম কখনোই ছিলোনা ; রিনা,
নীরা, সুখলতা, শেফালি বা সাবিত্রী। কেননা আমি
দেখেছি বরাবরই অনেকটা চড়াই পেরিয়ে, গভীর হ্রেষার শব্দে জেগে উঠে-- লাইলাক,
রডোডেন্ড্রন, কুসুমিত পলাশ। এরই মধ্যে
শহীদ বেদী, অমর বেদী ইত্যাদিও গড়েটড়ে ওঠে।
বাবুর বাগানে সামিয়ানার নিচে ভিড় করে অসুস্থ স্তাবকেরা। তো এটা আমাকে চার্জড্
করে। আর আমি দেখি সফল মানুষদের ; বোর্ডরুমে ও বাগানবাড়িতে, নাচঘরে ; - তারা
সবকিছু, নারীকে, এমনকি কবিতাকেও লুঠ করে নেয়। একটা আতঙ্ক, একটা ইমিডিয়েসী আমাকে
গ্রাস করে, যা আমি কবিতায় তখনো লিখতে পারিনি। ক্রমে আমাকে ছবিতে পেয়ে বসে। আমার
প্রিয় বিষয় ছিল পোর্ট্রেট ; চিবুকের ডৌল,
ভ্রূপল্লব, ঠোঁটের পাউট। আমার মনে হয়েছিল একজন প্রকৃত কবি তিনিই, যিনি সতত মরণশীল,
পুনরপি ক্যামেরাবাহক এক কূট পর্যটক। প্রচলিত কবিতাধারার দেহাতি রোদ্দুরে আমি
চেয়েছিলাম কবিতা বাঁক নিক দুন এক্সপ্রেসের মতো। ইচ্ছে হয়েছিল, ‘একটা দীর্ঘ
সরলরেখাকে স্প্রিং-এর মতো গুটিয়ে এনে একপ্রান্ত ছেড়ে দিয়ে দেখবো কী প্রচন্ড বেগে
লাফিয়ে ওঠে তেজঃপূর্ণ রেখাসকল। আমরা নকল করবো থান্ডার মেঘের গম্ভীর ডাক, আর যে রকম
শব্দে শালের জঙ্গল থেকে লাল পিঁপড়েরা ছড়িয়ে পড়ে গভীর শিকড়ে। সেই শব্দ শোনাবো আমরা
ফাঁকা খনিগর্ভে নির্বাচিত বন্ধুদের’। তখন
নব্বইয়ের দশক শেষ হয়ে আসছে । আমার অন্বেষণ ছিল এক নতুন রহস্যময় ও গভীর
জটিলতা ।
ক্রমে ভাষার অপদার্থতা আমাকে সন্ত্রস্ত করে তোলে। অক্ষরের অধিকার অস্বীকার
করে আমার মনে হয়, শুধুমাত্র প্রাকৃতিক
শব্দমালা দিয়ে রচনা করা যায় নতুন কবিতা, যাকে আমি সিম্ফনি কবিতা বলেছিলাম। আমার
মনে হয়েছিল, রবিশংকরের সেতারের চেয়ে কবিতা অনেক বেশী জটিল ও শব্দিত হ’য়ে রয়েছে
ঝোড়ো হাওয়ায়, বুনো কুকুরের চীৎকারে। একজন মরণপণ গেরিলার ছুটে যাওয়া তীব্র বাজুকায়।
ঝরাপাতা মাড়িয়ে যাওয়ার শব্দে। যেভাবে মাটি ঝরে পড়ে কবরে। -প্রতিটি শব্দই এক রহস্য।
এক গাঢ় ও অসীম অনুভুতি। এভাবে শব্দের পর শব্দ সাজিয়ে শুরু হয় এক নতুন খেলা। ‘দেখি
আমি এই খেলা, সুবর্ণ কুসুম, / আপন সাঁতার জানা তরঙ্গ মাছেরা / সঙ্গী জল জলবাস্প, / পাথরের পশমের উদ্ভিদের পতঙ্গকীটের /
অঙ্গাঙ্গী সম্পর্ক সব’...।
একুশ শতকের বোধোদয়ের জন্য প্রয়োজনীয় যা কিছু, তার একান্ত নতুন প্যারাডাইম ;
Y2K-কে নিয়ে তার ক্ষণিক
ধ্যাস্টামো, চকিত উষ্ণায়ন ও বিশ্বায়ন, বাজার-অর্থনীতি, কম্পিউটার ও ইন্টারনেট
প্রযুক্তি, দূরত্বের সংকোচন, বিদ্যুৎগতি যোগাযোগ, মরণপণ প্রতিযোগীতা, উচ্চনীচতার
নতুন মাপ ও মাপকাঠি, বহুরৈখিক ও বহুবৈষয়িক উপস্থাপনা। প্রয়োজন ছিল ভুলগুলোকে একে
একে চিহ্নিত করা। ত্যাগ করতে হবে এযাবৎ অর্জিত সব শিক্ষা। প্রাণজীবন ও সভ্যতাকে
ধ্বংস থেকে বাঁচাতে ভেঙ্গে ফেলা দরকার পুরোনো প্রকাশভঙ্গি, দৃষ্টিভঙ্গি আর যুক্তির
চিরায়ত ভঙ্গিমাগুলো। সমস্ত মতামতকে আমি সন্দেহের চোখে দেখেছি। সমস্ত ওপিনিয়নই biased and is
valid only from a particular viewpoint, within a space-time domain. সমগ্র বাংলা শব্দকোষ থেকে ‘আপেক্ষিক’ শব্দটাই আমার কাছে সবচেয়ে মূল্যবান
মনে হয়েছে।
এসবই আমার মনোযোগ অধিকার করেছিল। এই সময়ে আমার যোগাযোগ হয় বিশ্বখ্যাত চিন্তা-বিজ্ঞানী
ও ল্যাটারাল থিংকিংয়ের প্রবক্তা ডঃ ডি’ বোনো-র সাথে। আমারই প্ররোচনায় সুদূর ভূমধ্যসাগরীয়
দ্বীপ মাল্টা থেকে সেই প্রথম তাঁকে ভারতবর্ষে ডেকে এনে জামশেদপুরে টাটাস্টীলে মনোজগতিক
ওয়ার্কশপের সুচনা করা হয় । তাঁর ‘সেলফ্ অর্গানাইজিং অ্যান্ড প্যাটার্নিং সিস্টেম’
সম্পর্কিত প্রস্তাবনা আমার একুশ শতকীয় দৃষ্টিকোণকে নির্দিষ্ট করেছিল। ‘ওয়ার্ডরোবে,
স্নানঘরে, বাগানের অন্ধকার কোণে ; কার্পেটের নীচে, স্লেটে, ডায়েরীর পরিশিষ্ট পাতায়’।
ক্রমে নির্মাণের বিবিধ পর্যায় আমার চেতনায় ছড়িয়ে পড়তে থাকে। যাবতীয়
সমুদ্রবন্দর, লাইট হাউস, শততল মিনার, এবং অবশ্যই রন্ধন প্রণালী। কীভাবে আতার
পুডিং, লেমন সুফ্লে, মাশরুম স্যুপ। ফ্রুটবোল, পানপাত্র, ব্লাডিমেরী, ব্লু লেগুন। পদার্থের
কঠিন তরল ও বাস্পরূপ ক্রমে আমি লক্ষ করি। পাইনের বনে কীভাবে কুন্ডলি পাকিয়ে ধোঁয়া
ওঠে, কীভাবে উপত্যকায় ধীরে ছড়িয়ে পড়ে কুয়াশা। টুটেনখামেনের
সমাধির মতো, গ্রানাইটের অন্ধকার দেওয়ালে অঙ্কিত ইয়েরোগ্লিফের মতো, গাণিতিক
‘পাই’য়ের দশমিক মানের (৩.১৪১৫৯২৬৫৩৫৮৯৭৯৩২৩৮৪৬২৬৪৩৩৮...)মতো, ‘ফিবোনাচ্চি’ সিরিজের
সুবর্ণ অনুপাতের মতো সর্বত্র আমি এক নতুন ছন্দকে, ছন্দের নিয়মকে, আবিষ্কার করি। ‘সৃষ্টি-ঘুম-বীজগণিত, ও নিবিড় কুয়াশা আমার
/ আমারই তরঙ্গ অবয়ব’...। প্রকৃত প্রস্তাবে একুশ শতকের শুরুতে এই ছিল আমার কবিতার নির্যাস।
কীভাবে সৃষ্টি হয় কেওস, বিশৃঙ্খলা। কীভাবে ছন্দিত হয়, ভেঙ্গে পড়ে, পুনরায়
গঠিত হয়ে ওঠে আমাদের যাবতীয় সম্পর্ক। এই সুদূর বিস্তৃত প্রাণজীবন, যোনিরক্ত ও
জরায়ুর জং ।
হ্যাঁ, সম্পর্কই আমার দৃষ্টিকোণ। সম্পর্কই আমার টেলিলেন্সে, তারজালিতে,
খলনুড়িতে, বুনসেন বার্নারে।
কফি হাউসে আমি একবারই গিয়েছি । একুশ শতকে । মিনিট পাঁচেকের সেই এপিসোডে আমার মনে পড়েছিলো উৎপলকুমারের কবিতার লাইন, ‘চতুর্দিকে গরাদের স্তব্ধ ছায়া পড়েছে এখন’। অথচ কফির গন্ধ তখনও ছড়ানো ছিলো আমার অনেক কবিতায়। আমার মনে হয়েছিল, বিনির্মাণ সম্পর্কিত সমগ্র ডিসকোর্সকে অনায়াসে দেড় পাতায় লিখে ফেলা উচিত ছিলো কিনা। আমি সমস্ত ভাষাবিদদের কাজকে নিতান্ত পন্ডশ্রম, ও জীবিকার্জনের জন্যে কত ভুল কাজই যে মানুষ করে যাচ্ছে ভেবে পুলকিত হয়েছি। মৃত্যুর আগে দেরিদাও কি বুঝে গিয়েছিলেন সেই কথা ? ভুলগুলো সরাও, আমার লাগছে, -বলেছি আমি।
আমার কবিতায় ক্রমবর্ধমান তৎসম শব্দের আধিক্যের কারণ ছিল আমার আগুন ও পাথরের
কাছাকাছি অবস্থান। ব্লাস্ট ফার্নেসের প্রবাহিত গলনাঙ্কের
পাশে, স্টিলমেল্টিং শপের দাউদাউ আগুনের মুখোমুখি আমি। দানবীয় রোলিং
মিলের নীচে, সংকীর্ণ পাতালপথের তপ্ত গর্জিত বাস্পময়তায়, আদিবাসী কুলি-কামিনদের পাশাপাশি। কনভেয়রে, বাঙ্কারে, পিঙ্গল গন্ধক-বাস্পে, অন্ধকার
খনিগর্ভে, সমুদ্রবন্দরে, খনিজ আকরিকের স্তুপে ; ঘর্মাক্ত, আপোষহীন । বিশেষতঃ একুশ
শতকের প্রথম দিকে প্রকাশিত ‘বন্ধু রূমাল’ বইয়ে আমার সমস্ত শব্দচয়ন এসেছে এইসব
স্পেস-টাইম পরিমন্ডল থেকে। জলপ্রপাতের মতো, জেট এঞ্জিনের মতো, অবিরল স্যাক্সোফোনের মতো একটা টানা
ব্যাকগ্রাউন্ড আছে এইসব লেখার। ‘সময়-দুধের পাত্রে সময়-ঝিনুক ডুবে আছে’। বর্ণমালা
নয়, ক্রিয়াপদ নয়, আমি তো দাঁড় করাতে চেয়েছিলাম আমার পাঠককে ঐ সাস্পেনসান ব্রীজের সামনে। ঐ লাল-হলুদ ডোরাকাটা
চিমনির মাথায়, ধোঁয়া ও উত্তাপের মুখোমুখি।
একুশ শতকের প্রথম দশক পেরিয়ে আসতে আসতে আমার মনে পড়েছিল সেই ‘ভয়েজার’ নামক
মহকাশযানের কথা। আমার কবিতা লেখার প্রত্যেকটি বাঁকেও সে অবিরল ছুটে চলেছে
মাধ্যাকর্ষণের গণ্ডি ছাড়িয়ে একে একে গ্রহদের কক্ষপথগুলো পেরিয়ে ; এখন সে
সৌরমন্ডলের সীমানা ছাড়িয়ে দূরগামী নীহারিকাদের দিকে ধাবমান।
সেইমতো, ‘নীল কাগজ’ সিরিজের লেখাগুলোয় আমি চেষ্টা করেছি, এক প্রান্তিক
দূরত্ব থেকে, যাপিত জীবন সম্পর্কগুলোকে নিবিড় ও অন্তরঙ্গভাবে পুনরায় নিরীক্ষণ
করতে। নতুন ডিকশানে। কবিতা অসমাপ্ত জেনে, জীবন অপূর্ণ দেখে। ‘আমি লিখছি আমারই
জন্যে এইসব লেখা / কাগজে কলমে জলছবিতে, কাঠখোদাই করা / ঢালাই করা ধাতুর গায়ে,
মৃৎপাত্রে জঙ্গল-লতায়’...। ‘আমি লিখছি সেই লেখা যা কখনো শেষ ও সমাপ্ত / হবে না, যা
ভেসে থাকবে জলের ওপর জল হয়ে’...।
হয়তো এই সেই কলম বন্ধ করে চুপ করে বসে থাকার সময়। আর কি নতুন নেই ? ভাবি
আমি। ছিন্নভিন্ন দৃশ্যকে ছবি করে তোলাই এবার কবিতা। কারণ আমার কথারা এখনো অসমাপ্ত । ঘুমে জাগরণে আমি আজও তাদের ধীরে ধীরে
সজ্জিত হয়ে উঠতে দেখি। কাঠ-খোদাইয়ের মতো, লিনোকাটের মতো, অরিগামীর মতো নিপুণতায়
আমি রচনা করি সেই অসমাপ্ত কথারা, আজ দুপুরবেলায় যা যা দেখলাম ।
‘-সাদা লিনেনের ওপর ছলকে পড়েছে গরম কর্ন
স্যুপ ; জানালা-কাচের ওপাশে রাজপথে দগ্ধ মৃতদেহ ঘিরে কয়েকটি ওবি ভ্যান।
-জনহীন মাল্টিপ্লেক্সের অন্ধকার সোফায় সঙ্গমে উদ্দাম দুই যুবক যুবতী। তাদের চশমা চাবি মোবাইল আর মানিব্যাগ ঝাঁট দিয়ে নিয়ে গেল একজন অন্ধ জ্যানিটার।
-আদি গঙ্গায় রাজনৈতিক জোয়ার এসেছে। স্রোতে ভাসছে জরির টুপি, ঠ্যাং-ভাঙা গলিত দেবীপ্রতিমা আর রক্তাক্ত টিনড্রামগুলো’।
-জনহীন মাল্টিপ্লেক্সের অন্ধকার সোফায় সঙ্গমে উদ্দাম দুই যুবক যুবতী। তাদের চশমা চাবি মোবাইল আর মানিব্যাগ ঝাঁট দিয়ে নিয়ে গেল একজন অন্ধ জ্যানিটার।
-আদি গঙ্গায় রাজনৈতিক জোয়ার এসেছে। স্রোতে ভাসছে জরির টুপি, ঠ্যাং-ভাঙা গলিত দেবীপ্রতিমা আর রক্তাক্ত টিনড্রামগুলো’।
মনে হয়, এখনও এতদূর বিস্তৃত এই ভার্জিন
ভূভাগ। এখনও কবিতার পাঠক তাহলে তৈরী হয়নি কি ? আমার কবিতার প্রথম পাঠক তো আমিই। নিশ্চয়ই কোথাও ভুল থেকে গেছে শব্দ-ব্যবহারে। ভুলগুলো সরাও, আমার লাগছে।
-----------------