রাজর্ষি চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত '৯'য়া দশক' পত্রিকার সাম্প্রতিক
উতসব-২০১৬ সংখ্যায় আমন্ত্রিত সম্পাদকীয় লিখতে আমাকে
অনুরোধ করা হয়েছিল। সেই মুক্তগদ্যটি এখানে উদ্ধৃত হল, যারা ওই
কাগজটি পড়েননি তাঁদের জন্যে।
(এটি আমার একটি পুরনো গদ্যের
পুনর্লিখিত ও পরিবর্ধিত রূপ।) :
আজও লাল রঙ আমাদের শিহরিত করে। কালো কালি দিয়ে ‘লাল’ শব্দটি লিখে তাকিয়ে
থাকলে, ক্রমে প্রপাতের গর্জন শোনা যায়। ঘন নীল রঙের প্রবল ব্যবহার দেখেছিলাম
ক্যান্সার ওয়ার্ডে, হাতে লেগেছিল। যে কোনও সকালেই আবিষ্কৃত হতে পারে, বারান্দা বেডরুম
ভাসিয়ে ঝরে পড়ছে গোপন ও উদ্দাম এক জলপ্রপাত। চেয়ার টেবিল ও বুকর্যাকগুলো খোলা
আকাশের নীচে ইতস্ততঃ । ধোঁয়া উঠছে কুন্ডলি পাকিয়ে। জঙ্গলের তীক্ষ্ণ প্রান্তে
ইউক্যালিপ্টাসের শীর্ণ শাখাকে জড়িয়ে ধরে কেউ ডেকে উঠছে ‘প্রভু...’ !
মাথার ওপরে অসীমে ভাসমান তিন ট্রিলিয়ন অগ্নিপিন্ড থেকে যে হল্কা সতত ঝরে
পড়ছে স্নায়ুতে, তা আমাদের নিয়ত হত্যা করতে চায়। তবুও আমরা জুড়ীগাড়ি চড়ি, রেকাবী
সাজাই, নারীর নাম দিই অরুন্ধতী, ক্লিওপেট্রা। কেননা আমরা সতত শংকিত ও আড়ষ্ঠ। ‘যেতে
যেতে একলা পথে’ –এই গান আমাদের প্রিয় মনে হয়। আতংকই আমাদের প্রেরণা, গান।
কোথায় ছিন্ন হয়েছে আলো, কোথায় রয়েছে হুল, কোথায় সেই শ্বাসগন্ধ, যোনি,
শুককীট, কমলাসন, -আমরা আর সঠিক কখনই জানি না। প্রেমে, বন্দরে, নৈঃশব্দে, সাইরেনে,
বিস্ময় আমাদের প্রথম ও শেষ অবস্থা। হাত কখনো ব্যান্ডেজে, নীল রঙে, স্তনে, মদের
গেলাসে, দোয়াতে। তবুও অভাবরূপ। বিস্ময়। কালো ও প্রকান্ড এক উদয়ের অপেক্ষায়,
নিশ্চিত আমরা সমবেত বসে আছি। আমাদের প্রিয় সমস্ত ফলই গোলাকার ও পতনশীল।
তবুও, আজ অবধি বৃষ্টিতে সমর্পিত হয়ে, ভিজে, মা ডেকে তৃপ্তি পেলাম না। কতবার
জলাধারে, শৈলাবাসে, প্রকৃত রডোডেনড্রনের জানালায় গিয়ে বসা হোল। ফিরে এসে, অফিসে
পর্ষদে কর্পোরেশানে নতুন টেবিল সাজালাম। দেওয়ালে লেখা হোল ‘শ্রী’ ও ‘সিদ্ধি’। ঢের
রাতে বান্ধবী এসে গেয়ে শোনালো ‘আমারে যদি জাগালে আজি নাথ...’। সেই আরামকেদারায়
প্রশ্নবোধক স্যুপের পাত্র হাতে আমাদের কত রাত ঝিঁকচোখে কেটে গেছে।
আমাদের একটা দূরগামী মোটরহোম ছিল, যার চাকার নাম ছিল ‘হবে জয়’। একটা
রাবারের নৌকা ছিল, যার নাম দিয়েছিলাম ‘হাওয়ার রাত’। আমাদের ছিল এক ঝাঁক পায়রা আর
একটা ধূসর আতাগাছ। ছিল নানারকম মদ, তীরধনুক, বর্শা, দক্ষিণাবর্ত শাঁখ, বাঁশি, এসরাজ
ও মোমবাতি। আর গান ছিল কাঙাল হরিনাথের।
ফুলদানিতে ছিল ভ্যান গঘের আঁকা সূর্যমুখী ফুল। তবু আমাদের ফিরে আসতে হয়েছিল।
নিরুপায় আমরা সন্তানের
নাম দিয়েছিলাম ‘জয়’ ও ‘শান্তি’। মনে হয়েছিল, পশমের কম্বলে বুঝিবা আমাদের মানায়। আমরা পশম কিনলাম। তারপর একদিন সহসাই, সমূহ অন্তর্বাস খুলে ফেলে, আরও সর্বস্ব খুলতে
চেয়ে দেখা গেল, যায় না। তখন আমরা অক্ষর ভাঙ্গলাম, ইতিহাসের পাতা কুটি কুটি করলাম। কাব্যগ্রন্থের উতসর্গ
পাতায় এসে থমকে দেখলাম, প্রবল নীল রঙ ও ক্যান্সার ওয়ার্ড।
-একদিন মর্গ থেকে বেরিয়ে শেষ নার্সটির সাথে ভোরের আলোয়। দেখা হোল কাঁটাতারের ওপারে যেখানে হলুদ পলাশ ফুটেছে, সর্বস্ব ছিন্ন করে আগুনফ্রক পরে
ঝাঁপ দিয়েছে আমাদের কিশোরী মেয়ে। দেখা হোল, সাগরসৈকতে জেলিফিশ আর ঝিনুকের পাশে
ঘুমিয়ে আছে আমাদের শিশুপুত্র ; ঢেউ এসে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে তার পোশাকের নীলরঙ ও
শেষ রক্তিম আকাঙ্ক্ষাগুলো। -এবং ‘আকাশ আজ দেবতার
ছেলেমেয়েদের নীল শার্ট পাজামার মতো বাস্তবিক। একা ময়ূর ঘুরছে খালি দোতলায়’ ... । -শংকর লাহিড়ী ।
No comments:
Post a Comment