Monday 11 June 2012

কৌরবের স্বর্ণযুগের সেই দিনগুলো


 


আমি যখন কৌরবকে আবিস্কার করি, ১৯৭৭ সালের শেষ দিকে তখন আমার বয়েস সাতাশ, আর  কমলদার একত্রিশ।  তখন কৌরব-২০ প্রকাশের অপেক্ষায়, এবং ওটাই ওদের শেষ সংখ্যা,    কৌরব আর বেরোবে না, -এইরকম শোনা গিয়েছিলকৌরবের সম্পাদক তখন সুভাষ ভট্টাচার্য। কৌরবের সেই দৈন্যদশার দিনে তাকে আর পাঁচটা কাগজের মতোই মনে হতে পারতো,   কিন্তু তাকে ভিন্নতা দিয়েছিলো প্রতি সংখ্যায় 
‘শিরোনামায় পাঠক’ নামে  সম্পাদকীয় লেখাটা। তবে সুর কিছুটা কেটেছিলো কৌরবের পাতায় পত্রযুদ্ধের প্রবণতা দেখে। আসলে আমি তখন আকৃষ্ট হয়েছিলাম কমল চক্রবর্তীর ব্যক্তিত্বে, তার মধ্যে  কল্পনা, আবেগ ও আমোদের রোমাঞ্চকর মিশ্রণেগ্রাম্য রগড় ও পরিশীলিত শহুরে বাবুয়ানার মধ্যে তার ছিলো অনায়াস  যাতায়াত।  


প্রথম আলাপের পরেই পরস্পর আমরা -‘এই তো পেয়ে গেছি !’ ভেবেছিলাম। আমাকে সাথে পেয়ে প্রচুর উৎসাহে কমলদা তখন নতুন করে আবার ভাবতে শুরু করে কৌরব-২১ (জামশেদপুর বিশেষাংক  ১৯৭৮) থেকে ; -দ্বিতীয়বার শুরুই তো বলবো আমি তাকে। সেই থেকে  কৌরবকে আর পেছনে ফিরতে হয়নি। আমাদের দুজনের সাহিত্যভাবনা ও কান্ডজ্ঞান অনেকটাই ক্লিক করেছিলো, অনেক  মতবিরোধও ছিল, এবং পরস্পরের কাছ থেকে অনেক কিছু শিখেছি। আমি তখন টাটাস্টীলে ইঞ্জিনীয়ার, কমলদা টাটা মোটরস্-এ।


সেইসব  দিনে কৌরবের অনেক নতুন পরিকল্পনাই ছিলো প্রধানত: কমলদার ও আমার। কোনটা কার মাথায় প্রথমে এসেছিলো,  বলা মুশকিল। কারণ প্রতিটি সন্ধ্যায় আমরা দুজনে একসাথে, আর  ছুটির দিনগুলোয় গ্রামে গঞ্জে নদীতীরে পাহাড়ে জঙ্গলে টো টো ; -কখনো বাসে, ট্রেনে, গরুর গাড়িতে, কখনো পায়ে  হেঁটে আদিবাসী নদী আর ধান ক্ষেত পেরিয়ে, -কখনো আমার স্কুটারের পেছনে চেপে কমলদা আমরা কখনো মহুয়ায়, ধামসা-মাদলে, গানে। কখনো  সুবর্ণরেখা নদীর কোনও গোপন বাঁকে জেলে পাড়ার সোনা-খুঁজিয়ে মেয়েদের মুখোমুখি, কখনো   প্রত্যন্ত আদিবাসী গ্রামে ছাতা-পরবে, যেখানে পালকি চেপে রাজা এসেছেন। কখনো টালমাটাল হাটের দিনে কুঁকড়া লড়াইয়ের পাশে।



























< সিংভূমের গ্রামীণ হাটে  কেনাবেচা ও কমলদা। >








< গোবরঘুষি গ্রামে 'ছাতা পরবে' পাল্কি চড়ে রাজা এসেছেন, সঙ্গে রাজপুত্র।  পটমদা ছাড়িয়ে, অনেক মাঠঘাট ধানখেত পেরিয়ে আমি ও কমলদা সেখানে  পৌঁছেছি । >





  




< ঘাটশীলায় সুবর্ণরেখা নদীতে জেলে পাড়ার সোনা-খুঁজিয়ে মেয়েরা। আমাদের দেখে ওদের মায়েরা জঙ্গলে লুকিয়ে পড়েছিল। >






কোনও ভাষার অক্ষরমালার জন্মদাতাকে আমরা আগে দেখিনি। একদিন খুঁজতে খুঁজতে আমরা পেয়ে গেছিলাম পন্ডিত রঘুনাথ মুর্মুর নাম, যিনি সাঁওতালি ভাষার জন্য নিজে তৈরী করেছিলেন 'অলচিকি' লিপি। একদিন আমি আর কমলদা গিয়ে পৌঁছে গেছিলাম সুদূর রায়রংপুরে পন্ডিতজির গ্রামের বাড়িতে। তিনি তখন বৃদ্ধ, অসুস্থ। তবুও অনেকটা সময় আমরা কাটিয়েছিলাম সেই ভাষাপ্রেমিকের সাথে। -এইভাবে নানান  আবিষ্কারে, উন্মাদনায়, উৎসাহে কোথা দিয়ে কেটে যেত সময়। কৌরবকে নতুনতর করে তোলার সেই জেদী দিনগুলো।  

















< রায়রংপুরে, পন্ডিত রঘুনাথ মুর্মুর গ্রামের বাড়িতে >











প্রতিদিন অনেক রাতে বাড়ী ফিরতাম। পাংচারবিহীন ‘ফিরে এসো’ কোয়ালিটির চাকা ছিলো আমাদের। একদিন একটু বেশী রাতে একটু বেশী পান করে স্কুটারে বাড়ী ফিরছি, পেছনের সীটে জর্দাপান মুখে কমলদা।  তারকোম্পানীর রাস্তায় ঘুটঘুটে লোড শেডিংয়ে বাঁকের মুখে হঠাৎ উল্টোদিক থেকে ছুটে আসা একটা ট্রাক, যার ডানদিকের হেডলাইটটা  ভাঙ্গা, যাকে আমি আরেকটা স্কুটার ভেবেছিলাম।




এইভাবে সম্পূর্ণ আশির দশক। মনে পড়ে, ১৯৭৮ সালে দাঙ্গা-কবলিত জামশেদপুরে বিকেলবেলা কার্ফু  শিথিল হওয়ার কয়েক ঘন্টা সময়ে কমলদা তার ভেস্পা স্কুটারে চ’ড়ে দৌড়ে এসে আমাকে পড়ে শোনাতো তার  প্রথম  উপন্যাস ‘আমার পাপ’-এর পান্ডুলিপির সদ্যলেখা অংশগুলো। কমলদার বিয়েতে ব্রিটেনের রানী, মাদার টেরিজা, আর রাশিয়া ও আমেরিকার প্রেসিডেন্টদের নিমন্ত্রণ করার পরিকল্পনা আমিই করেছিলাম, এবং চিঠিও লিখেছিলাম সবাইকেমাদার টেরিজা ও কুইন এলিজাবেথের দাসী উত্তরে শুভেচ্ছা  জানিয়ে বিয়েতে আসতে না পারার জন্যে দুঃখ প্রকাশ  করেছিলেন।  বাকিংহ্যাম  প্যালেসের রয়াল সীল ছিলো সেই খামে।          


তখন কৌরবের প্রত্যেক সংখ্যায় আমাদের সঙ্কল্প ছিল, আগের সংখ্যার মুগ্ধতাকে ছাপিয়ে যাওয়া। আমরা চেয়েছিলাম বাংলাভাষায় পরীক্ষাসাহিত্যের এরিনায় কৌরব নিজেই একটা উন্মুক্ত প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠুক আর প্রতিষ্ঠানবিরোধীতার একমাত্র পথ হোক, কুৎসার বদলে আরও আরও ক্রিয়েটিভ কাজ।   


আমি চেয়েছিলাম কৌরবের ভেতরের লেখাগুলোর মতো তার প্রচ্ছদটাও হোক একেবারে অন্য রকম, নতুন ; যা চিরাচরিত রাবীন্দ্রিক অথবা আর্টস্কুল মার্কা নান্দনিক চিত্রণ থেকে একেবারে ভিন্ন। এই জায়গায় কমলদা আমাকে অনেকটা স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিয়েছিলো। আমরা প্রচ্ছদে একটা নতুন অ্যাবশট্রাকশান আনতে পেরেছিলাম, যা সেই সময়ে অন্য কোনও কাগজে ছিলো না। ক্রমে কৌরবের এই স্পেসটায় সাহিত্যের বড় বড় মহারথীরাও তাঁদের অঙ্কন রেখেছেন; কমলকুমার, বিনয়, শক্তি, সুনীল, প্রকাশ, যোগেন, রবীন, সন্দীপন ও আরও অনেকে।   




কৌরব -৩২, সেপ্টেম্বর ১৯৮১ তে ছিলো যোগেন চৌধুরীর  আঁকা  স্কেচ ও তার নীচে আমার লেখা এই ব্লার্ব।


 -সেই সময় এই ব্লার্বের উল্লেখ  করে  দৈনিক  বসুমতী  কাগজ  লিখেছিল, 'এঁদের বেশির  ভাগ লেখা  সাধারণ  পাঠকের  ধরা ছোঁয়ার বাইরে'। আরও লিখেছিলো, 'কেউ এর বাংলা অনুবাদ চাইলে তার  জন্যে আছে একটা গোটা উপন্যাস, কমল চক্রবর্তীর লেখা স্যার যদুনাথের আদি ভারতবর্ষের ইতিহাস'।     
 








< আমার  'শরীরী কবিতা' বইয়ের প্রচ্ছদের জন্য এটা  ছিলো  আমার আঁকা প্রথম ড্রাফট, যেটা নিজেই পরে রিজেক্ট করেছিলাম।  

পরে আমার জিনস্-প্যান্টের পকেটে  একটা পোস্টকার্ড, তুলি আর ফুলের কুঁড়ি রেখে একটা টেবিল-টপ ইনস্টলেশান তৈরী করি, -তার ছবিই রাখা হয়েছিলো প্রচ্ছদে। সেই গ্লসি পেপারব্যাক  বইটা সম্পর্কে মলয় রায় চৌধুরী স্মরণ করেছেন যে, ওটাই ছিলো কৌরবের প্রথম একটা ঝকঝকে বই । সেই সময় থেকেই আমরা কৌরবের বইয়ের চেহারা নিয়ে ভাবতে শুরু করি। >        
   












ইতিহাস বলে, পরের দশ বছরে কৌরব বাংলা সাহিত্যের মেজর লেখকদের কাছে স্বপ্নের কাগজ হয়ে উঠেছিলোকমলদা তার নিজস্ব কারিশমায় সাহিত্যের অবিশ্বাস্য সব টেবিল থেকে কৌরবের জন্য লেখা নিয়ে আসতো। বাংলা ভাষায় আর কোনও কাগজ তখন ছিলো না যেখানে অমিয়ভূষণ, কমলকুমার, শঙ্খ ঘোষ, শক্তি, সুনীল, সন্দীপন, উদয়ন ঘোষ, সন্তোষ ঘোষ, অসীম রায়, বুদ্ধদেব, পূর্ণেন্দু, উৎপলকুমার, বিনয় মজুমদার, স্বদেশ সেন, তুষার, অমিতাভ, বীরেন্দ্রনাথ রক্ষিত, প্রকাশ-যোগেন-রবীন-পৃথ্বীশ, জগন্নাথ, মলয়, দেবীরায়, কৃষ্ণগোপাল এক সাথে সাহিত্য ও শিল্পকর্ম  করেছেন। দায়সারা নয়, -সিরিয়াস, শ্রদ্ধেয় নির্মাণ গল্প, প্রবন্ধ, কবিতা, পেন্টিং, ইলাস্ট্রেশান, ফটোগ্রাফি।  


সেই  ছিলো আশির দশক, -কৌরবের স্বর্ণযুগ।  সেসব এখন  ইতিহাস, যা আজকের প্রজন্মের কাছে অনেকটাই   অজানা, বা ভয়ংকর ভুল ভাবে জানা।


 






< আমার করা প্রথম মাল্টিকালার পোস্টার, -যেখানে পেপারকাটিং  দিয়ে কোলাজ করা; কৌরব-২৮, সেপ্টেম্বর ১৯৮০।

এটাই ছিল কৌরবের প্রথম ঢাউশ  সংখ্যা, - প্রায় ২২ ফর্মা। নিন্দুকেরা বললো, সিআইয়ের টাকা। > 














আশির দশকের একদম শুরুতেই যে চারটে জিনিষের মধ্যে দিয়ে কৌরবের মেধা ও তারুণ্যের ব্যতিক্রমী ছবিটা ফুটে উঠেছিলো, প্রধানত: যার জন্যে কৌরবের ওপর নজর পড়েছিলো সেকালে সাহিত্যের ‘বড় মহলের’ সকলের, -তা ছিল কৌরবের সম্পাদকীয়, পত্রিকার প্রচ্ছদ, মোটরহোমের উন্মাদনা আর কবিতার ক্যাম্প। এই চারের আকর্ষণে সম্ভব হয়েছিল সাহিত্যের অনেক মহারথীদের কৌরবের জন্য লিখতে উৎসাহিত করা। মোটরহোম পড়ে কেউ কেউ তুষার রায়ের ‘শেষ নৌকা’-র  কথা মনে করেছিলেন; - যদিও  'শেষ নৌকা' ছিলো ষড়যন্ত্র ও ধ্বংসের পটভূমিতে একটা জলযানের যাত্রার কথা,  আর আমাদের লেখায় মোটরহোম হয়েছিলো আরও  মোবাইল, এবং কৌরবের চলমান সৃষ্টিশীলতার  সপক্ষে একটা আন্তর্জাতিক ও আন্তর্বৈষয়িক (ইন্টারডিসিপ্লিনারী) প্রকল্প। এবং সেই যাত্রাপথে কোনও দাতা 'মটরুমিঞা' নয়, আমাদের মদ আমরা নিজেরাই   নির্বাচন করেছিলাম।            


মোটরহোমের মতোই কৌরবের কবিতার ক্যাম্পও ছিল আমার ও কমলদার যৌথ পরিকল্পনা।  ভবিষ্যতের অনেক কিছুর বীজ নিহিত ছিলো এই একটা পরিকল্পনায়। ১৯৭৯-র অক্টোবরে আমরা  দুজনে যেদিন  ঘুরতে ঘুরতে চাঁদিপুর পৌঁছেছিলাম, সেদিন আকাশ ভরা মেঘ ছিলো আর ঝুপ ঝুপ  করে বৃষ্টি পড়ছিল,  - আমরা ভিজে গিয়েছিলাম। ওই হুহু হাওয়া আর বৃষ্টিফোঁটার নির্জনে আমরা দুদিন কাটাই, আর আসার সময়ে সেই নিসর্গে কৌরবের জন্যে একটা খুঁটি পুঁতে আসি।











< প্রথমবার আমরা চাঁদিপুরে, বৃষ্টিতে, অক্টোবর ১৯৭৯ >








সেবার চাঁদিপুরে কমলদা ও আমি সাহিত্য নিয়ে অনেক আলোচনা করেছিলাম, কিন্তু সঙ্গে কোনও টেপ রেকর্ডার ছিলো না। প্রকৃত প্রস্তাবে সেটাই ছিলো আমাদের প্রথম কবিতার ক্যাম্প, কিন্তু ‘কবিতার  ক্যাম্প’  কয়েনেজটা তখনও তৈরী হয়নি।










< চাঁদিপুরে সেই গোলঘরের সামনে কমলদা ও আমি, অক্টোবর ১৯৭৯ >













< চাঁদিপুরে বলরামগুড়িতে সারি সারি জেলেনৌকোর সামনে একটা ঝুপড়িতে বসে নোট নিচ্ছে কমলদা। অক্টোবর ১৯৭৯ >











সেবার ফেরার পথে মনে হয়েছিলো, আমাদের ভাবনাগুলো লিখে ফেলা বোধ হয় জরুরী। কথা হয়েছিলো যে, এবারে আমরা আর  অ্যাকাডেমিক প্রবন্ধ না লিখে মাল্টিমিডিয়া (ছবি, অডিও, স্কেচ) ব্যবহার করে শহর থেকে দূরে জঙ্গলে সমুদ্রতীরে গিয়ে আমাদের বলার কথাগুলো বলবো সবাইকে, আর লিখবো নতুন কবিতা, যা অবশ্যই পরিচিত লিরিক ও বিষয়ভিত্তিক নয়যাকে আমরা পরে বলেছি পরীক্ষা সাহিত্য



(এই নতুন কবিতা কয়েনেজটা প্রথম এসেছিলো ১৯৮৪ সালের শেষে  লেখা আমার ‘মুখার্জী কুসুম’ কবিতায়, এবং পরে ওই বইয়ের প্রচ্ছদেও ছিলো কথাটা :  ‘নতুন কবিতা, আমি পাই না তোমাকে কেন’)  স্বদেশদা তাকেই বলতেন, ‘অন্য কবিতা’; ভাষার অন্যরকম ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তার কথা বলতেন তিনি।    
 



< কৌরব- ৪২, ফেব্রুয়ারী ১৯৮৫; আমার আঁকা প্রচ্ছদ,
এই সংখ্যাতেই 'মুখার্জী কুসুম' সিরিজের প্রথম ১৩ টি কবিতা একসাথে ছাপা হয়েছিলো >




সেই 'প্রথমবারের চাঁদিপুর' থেকে  ফিরে এসে আমি লিখেছিলাম একগুচ্ছ কবিতা, আমার চাঁদিপুর সিরিজ ; যেগুলো ছাপা হয়েছিলো কৌরবের পরবর্তী ‘ছবি ও কবিতা’ সংখ্যাতেই (কৌরব-২৬, জানুয়ারী ১৯৮০) সেই বিখ্যাত সংখ্যাটির প্রচ্ছদে ছিলো উনবিংশ শতাব্দীর চিত্রকর শ্রীমতি বেলনোসের আঁকা ‘তিন জন নর্তকী’ ছবির প্রিন্ট। আর ছিলো প্রকাশ কর্মকারের আঁকা সাতটি স্কেচ, যাদের আমরা ‘চিত্রধ্বনি’বলেছিলাম। 




   
< ‘ছবি ও কবিতা’ সংখ্যা (কৌরব২৬, জানুয়ারী ১৯৮০), -এই সংখ্যাতেই আমার চাঁদিপুর  সিরিজের  একগুচ্ছ কবিতা ছিলো (অগ্রন্থিত), আর ছিলো প্রকাশ কর্মকারের আঁকা ছবি  >




< অঙ্কন : প্রকাশ কর্মকার >




 
সেসময়ের ভার্জিন চাঁদিপুর আমাদের প্রকৃতই আচ্ছন্ন করেছিল। এর কয়েক মাস পরে ১৯৮০-র ফেব্রুয়ারীতে আমরা দুজনে কবি স্বদেশ সেনকে নিয়ে আবার আসি চাঁদিপুরে। ক্যামেরা, টেপ রেকর্ডার, কবিতার খাতা আর ডায়েরী নিয়ে হাত পা ছড়িয়ে ঝাউবনের মাঝে সেই একটা ছোট টিলার ওপরে সেই একটা অপার্থিব গোলঘরে তিনটে দিন একত্রে কাটাই, আর উন্মুক্ত করে দিই আমাদের ভাবনার আর কথার ভান্ডার। সেই ছিলো আমাদের পাতা ‘প্রথম রেকর্ডেড’ কবিতার  ক্যাম্প।  যখন দুপুরবেলা চারদিক আঁধার করে সূর্যগ্রহণ হল, আমরা তিনজনে সমুদ্রতীরে ঝাউবনে বসেছিলাম। সেদিন গোলঘরে পড়া হয়েছিলো অনেক কবিতা, যার  মধ্যে আগের বার চাঁদিপুর থেকে ফিরে লেখা আমার একগুচ্ছ কবিতাও ছিলোএই ক্যাম্পেই স্বদেশদা ও আমি কমলদার চেতন কল্পকয়েনেজটা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করি। সাহিত্যের লঘু গুরু নিয়ে, গদ্য ও কবিতার গঠন নিয়ে সারাদিন অনেক কথা হয়, যার মাত্র কিছু অংশ রেকর্ড করা গিয়েছিলো।

     সেদিনের সূর্যগ্রহণের  স্মৃতি কিছুটা ধরা আছে স্বদেশ সেনের 'পরাণকথা' নামক গদ্যে।


সেবার চাঁদিপুরে কবিতার ক্যাম্প কয়েনেজটা আমাদের মাথায় আসে এই পি ডব্লিউ ডি ক্যাম্প দেখে, আমি যার ছবি  তুলে রেখেছিলাম ।   













<  চাঁদিপুরে বুড়ি বালাম নদীতে নৌকোয় স্বদেশ সেন ও কমল চক্রবর্তী >














চাঁদিপুর ক্যাম্পের লেখা ও ছবি কৌরবে বের হওয়ার সাথে সাথেই কোলকাতায় বড় মহলেহৈ চৈ পড়ে গিয়েছিলো। শ’খানেক লেখক ও পাঠক চিঠিতে  উচ্ছ্বাস জানিয়েছিলেন। কেউ কেউ উষ্মাও। সেইসব চিঠি আছে। এর দুবছরের মধ্যে আরও কয়েকটা ক্যাম্পের কিছু কিছু রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। - সেসময় কলকাতা থেকে সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় চিঠিতে জানিয়েছিলেন, ‘আমরা ঠিক করেছি কৌরবের জন্য এবার সর্বাত্মক সমর্থন দেওয়া ছাড়া আর উপায় নেই’।



<  চাঁদিপুরে মুখোমুখি দুই কবি : স্বদেশ ও কমল,  ফেব্রুয়ারী ১৯৮০ >


  
কবিতার ক্যাম্পের ক্রমপঞ্জি :
১ চাঁদিপুরে প্রথম খুঁটি পোঁতা : (অক্টোবর ১৯৭৯)      
২ কবিতার ক্যাম্প : চাঁদিপুর (ফেব্রুয়ারি ১৯৮০)   
৩ কবিতার ক্যাম্প : মুকুটমণিপুর (জুলাই ১৯৮০)  
৪ কবিতার ক্যাম্প : যোশীপুর, সিমলিপাল (অগাস্ট ১৯৮১)     
৫ কবিতার ক্যাম্প : বেথলা (অক্টোবর ১৯৮১) 

এইসব ক্যাম্পের সবগুলোতেই স্বদেশদা ছিলেন। কারণ আমি স্বদেশদাকে না নিয়ে ক্যাম্প করবো না,  ঠিক করেছিলাম। কিন্তু অনেকেই জানে না যে এইসব ক্যাম্পগুলোর কোনটাতেই বারীনদা ছিল না।  এমনকি ছিলো না কৌরব-সম্পাদক দেবজ্যোতি দত্ত ।

মনে আছে, মুকুটমণিপুর ক্যাম্পে আমাদের সাথে যোগ দিয়েছিলেন কবি ঈশ্বর ত্রিপাঠী ও সিদ্ধার্থ বসু। আর সিমলিপালে সঙ্গী ছিলো নাট্যকার বন্ধু অরিন্দম গুপ্ত।   
   




   


< মুকুটমণিপুর ক্যাম্পে, বাঁ দিক  থেকে  :  কমল চক্রবর্তী,  ঈশ্বর ত্রিপাঠী,  স্বদেশ সেন, ও  সিদ্ধার্থ  বসু>





কবিতার ক্যাম্প যখন পরে বই হয়ে বেরোয় (কৌরব-৬১, জানুয়ারী ১৯৯২), তখন তাতে অজস্র ভুল তথ্য ছিল। এবং কয়েক ঘন্টার আড্ডাকেও সেখানে ক্যাম্প হিসেবে দেখানো হয়েছে।  

সেই দারুণ  আড্ডাগুলোর আমি অডিও রেকর্ড  করে রেখেছিলাম, ফলত:  তাদের হুবহু সংলাপ পাওয়া গিয়েছিলো। ১৯৮১-৮২তে এমনই দুটো দারুণ আড্ডার লিখিত বিবরণ ক্যাম্পের লেখায় ব্যবহৃত হয়েছিল :  হাইওয়ে-৩৩ ধাবায়, কমল-স্বদেশ-শংকর-দেবজ্যোতি। আর কৌরবের দপ্তরে এক সকালে সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের সাথে মুগ্ধ আড্ডায় কমল-শংকর-দেবজ্যোতি। একদিন সমরেশ বসুর সাথেও আমরা দারুণ আড্ডায় বসেছিলাম,  কিন্তু সেটা আমি রেকর্ড করতে পারিনি।  এই   আড্ডাগুলোতেও   থাকা হয়নি বারীনদার।         

বারীনদা ক্যাম্পে এসেছিলো অনেক পরের দিকে চান্ডিল ও বরাইবুরুতে (১৯৮৩-৮৪), যখন কৌরবের কবিতার ক্যাম্প বহুচর্চিত, এবং ইতিমধ্যেই একটা মিথহয়ে গেছে। সেই দুটো ক্যাম্পের কয়েকটা ছবি আছে, ডিটেলস নেই, -পরিবর্তে যোগ হয়েছে অনেক কল্পিত সংলাপ যা জামশেদপুরে বসেই লেখা হয়েছিলো;  -এতে অনেকটা জল মিশে যায় মদে, আর ক্যাম্পের রিডেবিলিটি ও ফ্লেভার নষ্ট হয়।     
   


কৌরবের পরীক্ষা সাহিত্য নামে প্রকাশিত হয়েছিলো দুটো সংখ্যা,  এই দুটো আসলে ছিলো দুটো কবিতার বই; প্রথমটা স্বদেশ সেনের 'রাখা হয়েছে কমলালেবু' (কৌরব-৩৩, মার্চ ১৯৮২), আর দ্বিতীয়টা কমল চক্রবর্তীর 'মিথ্যে কথা' (কৌরব-৪০, জুলাই ১৯৮৪)। এই দুটো বইয়েরই প্রচ্ছদ ও সম্পূর্ণ ডিজাইন আমি করেছিলাম। 



 






এইসব ক্যাম্পের বছরগুলোতেই আমার প্রথম বই ‘শরীরী কবিতা’র অনেক কবিতা লেখা হয়েছিলো। কবিতার আর্কিটেকচার ও তার নির্মাণ নিয়ে নিজের কিছু ভাবনা চিন্তা ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে  উঠেছিলো নিজের কাছে ; -আবিস্কার করেছিলাম কবিতার কেন্দ্রিক চেতনা ও যৌগিক অনুভুতির স্তরগুলো, তার বহির্মুখী ও অন্তর্মুখী বল, তার মনোলোক ও অবচেতন,  দৃশ্যজগত ও কল্পজগতের ব্যবহার,  তার কল্পপথের ফানেল ও স্পাইরাল, সম্পর্ক-আশ্রিত টোকেনগুলো,  বোধের বিন্যাস ও ত্বরণ-অভিজ্ঞতা, ইত্যাদি অনেক প্রসঙ্গ



পরে, ‘শরীরী কবিতা’ বই হয়ে বেরোলে তার ভূমিকায় উল্লেখ করা হয়েছিলো কবিতা-সম্পর্কিত আমার ব্যক্তিগত ঐসব  ভাবনা- সুত্রগুলো। কৌরবে কবিতার আলোচনায় এই উন্মোচনগুলো, ছাপার অক্ষরে ওই ছিলো প্রথম। আজকের সাহিত্য-বাজারের চলতি কথাবার্তা শুনে মনে হয় এই প্রজন্মের অনেকেই পড়েনি কৌরবে  সেই সময়ের লেখাগুলো                    


চাঁদিপুর ক্যাম্পের রিপোর্ট প্রকাশ হওয়ার পরে, ক্রমে এবং অচিরাৎ ১৯৮০ সালেই আমরা বাংলা ভাষায় শ্রেষ্ঠ পত্রিকার সম্মান পাই। কৌরবের যে সংখ্যায়  (কৌরব-২৯, ফেব্রুয়ারি ১৯৮১) এই সংবাদ পেশ করা হয় সেটাই ছিল আমাদের  ‘মোটরহোম’ সংখ্যা। ওই লেখা এবং তার  প্রচ্ছদও করেছিলাম আমি। আর পেছনের কভারে স্বীয় হস্তাক্ষরে কিছু হিজিবিজির মধ্যে লেখা ছিল ‘ডি কে গুপ্ত লহ প্রণাম, আমরা পুরস্কৃত হলাম’। ছিল     ব্রা-র ৩৬ সাইজকে আরেকটু কমানোর কথা, কেননা ‘ঢাউস’ ও  ‘ভলাপচুয়াস’ উপন্যাসগুলো আমাদের পছন্দ ছিলো না।  আরও ছিল একটা গানের লাইন,  -‘গণিমত শাম-এ-গম, রোজা না রোজা’।   কাশ্মীরে পাহালগামে এক হিমেল দুপুরে এই গানটা আমায়  শুনিয়েছিলো এক অন্ধ গায়ক।  


কৌরবের সেই ২৯-সংখ্যার ব্যাক কভারের নীচের দিকে ঐসব কাটাকুটি হিজিবিজি লেখা দেখে  পাতিরামের দোকানে অনেক ক্রেতা নাকি অব্যবহৃত ফ্রেশ কপি চেয়েছিলেন।   


          

মোটরহোম নিয়ে লেখা ও ছবি প্রকাশের সাথে সাথেই তা বিপুল ভাবে অভিনন্দিত হয়েছিলো। এতদিন কৌরব প্রকাশনীর নিজস্ব কোনও প্রতীক চিহ্ন (লোগো) ছিলো না। এর পরেই আমার আঁকা মোটরহোমের একটা ছোটো স্কেচকে কৌরব প্রকাশনীর  প্রথম লোগো হিসেবে ব্যবহার করা হয়, - কৌরবের অনেক সংখ্যায় ও বইয়ে তাকে দেখা গেছে।   






আসলে আমরা নিশ্চিত ও সর্বতোভাবে প্রথাগত শিল্প সাহিত্যকে পেরিয়ে যেতে চেয়েছিলাম। আমাদের কাজের ব্যাপক প্রভাব ও অনুকরণ শুরু হয়ে গেছিলো পরবর্তী বছরগুলোয়। কৌরব-৩১ সংখ্যায় সম্ভবত প্রথম আমরা, -ভেতরের পাতার নীচের দিকের ব্লার্বগুলো ছাড়া, -কাগজের পুটেও (স্পাইন)  এক লাইনের ব্লার্ব  লেখা শুরু করি। পুটে লেখা হয়, ‘কৌরব, অবিশ্বাস ও সন্দেহ ফিরিয়ে এনেছে’  
 

এর পর কৌরব-৩৪  সংখ্যার পুটে (যার প্রচ্ছদে আমার আঁকা ঘোড়া ও মইয়ের স্কেচ ছিলো)  লেখা হয়,  ‘ফেরীঘাট পেরিয়ে যে মেয়েটি একলা যায় তারও ঘোড়া ছিলো না’। এই লাইনটায় আমি যে মেয়েটির কথা লিখেছিলাম তার নাম সুশ্বেতা, তখনও কবি কমলের সাথে তার বিয়ে হয়নি, -কলকাতায় এসে সারাদিন কাটিয়ে বিকেলে ফেরীঘাটে গঙ্গা পেরিয়ে একলা সে হাওড়ায় ফিরে যেত ।    





কৌরবের এই ৩৪ সংখ্যার শুরুতেই    সম্পাদকীয়রূপে কমলদা রেখেছিলো  আমার সেই লেখাটা, যাতে   ছিলো কৌরবের সদর দপ্তরের জন্য  ইন্টিরীয়ার ডিজাইন এবং   কাগজকে অপ্রতিরোধ্য করে তোলবার  অবিশ্বাস্য ব্লুপ্রিন্ট । কাগজ নিয়ে আমাদের আশা হতাশা স্বপ্ন উচ্ছ্বাস জেহাদ সবকিছু ধরা ছিল এর মধ্যে। পরে এই লেখাটাই 'কৌরব দ্বীপপুঞ্জ' নামে আমার 'মোটরহোম' বইয়ের  অন্তর্ভুক্ত হয়।  সেই সময়ে আর কোনও বাংলা কাগজে   সম্পাদকীয়কে এইভাবে পেশ করার কথা ভাবা  হয়নি।  






অগ্রণী সাহিত্যিকদের অনেকেই মনে করেছেন, কৌরবের ক্যাম্প, পরীক্ষাসাহিত্য, গদ্যভাষা ও নানান  ক্রিয়েটিভিটির সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়েছে বাংলা সাহিত্যবাজারে, সংবাদপত্রে, পরিবেশনায়, সিনেমায়, ও অন্যান্য মাধ্যমে। কেউ কেউ লিখে জানিয়েছেন সেই কথাও। আপাতত: মনে পড়ছে এই বিষয়ে কবি উৎপলকুমার বসুর লেখা একটি চিঠি।  



--------------------------


No comments:

Post a Comment