অনুপস্থিতির ছবি, কৃষ্ণগহ্বর M 87 !
১
এতদিন তার রূপের কল্পনা করতেন বিজ্ঞানীরা। প্রায় একশো বছর আগে আইনস্টাইন বলেছিলেন—কৃষ্ণগহ্বরকে দেখতে লাগবে উজ্জ্বল একফালি চাঁদের মতো। এবার, এই প্রথম, বিজ্ঞানীরা তুলতে পারলেন তার আসল ছবি। পৃথিবী থেকে ৫ কোটি ৩০ লক্ষ আলোকবর্ষ দূরে—কয়েক হাজার কোটি নক্ষত্রের সমাবেশে যে কন্যা রাশি বা, ভার্গো নক্ষত্র মহামন্ডলী, সেখানে--‘মেসিয়ার ৮৭’ (M87 or, Virgo A) নামে ১২০০০ star clusters বা, নক্ষত্রপুঞ্জের সমষ্টি নিয়ে যে বিশাল গ্যালাক্সি রয়েছে, তার কেন্দ্রে আছে এই অতিকায় দানবীয় কৃষ্ণগহ্বর।
এই M87 গ্যালাক্সি,
যার আকৃতি জিবেগজার মতো ইলিপটিকাল, তার
মধ্যবর্তী স্ফীতকায় বলের মতো গোলাকার অংশটিই সবচেয়ে উজ্জ্বল, সেখানেই জটলা বেঁধে রয়েছে তার অন্তর্গত সব নক্ষত্রপুঞ্জগুলো। এই গোলাকার
বলটার ব্যাস প্রায় ন’লক্ষ আশি হাজার আলোকবর্ষ। এই বলটারই
কেন্দ্রে রয়েছে সেই অতিকায় দানবিক কৃষ্ণগহ্বর, যা পুরোপুরি
সক্রিয়, প্রতি মুহূর্তে সে গ্রাস করে নিচ্ছে আশপাশের গোটা
গোটা নক্ষত্র ও তাদের গ্রহ উপগ্রহ, সবকিছু। আমাদের মতো প্রায়
নব্বইটা পৃথিবীকে সে গ্রাস করছে প্রতিদিন। অর্থাৎ প্রতি ষোলো মিনিটে যাকিছু সে
গ্রাস করছে, তা আমাদের এই গোটা পৃথিবীর সমান।
আমাদের
সৌরজগৎ যে গ্যালাক্সির অন্তর্ভুক্ত, যার নাম ছায়াপথ বা, মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি, সেটার আকার চরকির মতো
ঘূর্ণায়মান বা, স্পাইরাল। আমাদের পৃথিবী থেকে ২৬ হাজার
আলোকবর্ষ দূরে, তারও কেন্দ্রে রয়েছে এক অতিকায় কৃষ্ণগহ্বর,
যার নাম ‘Sagittarius A’ ; তার মোট ভর ৪৩ লক্ষ
সূর্য্যের ভরের সমান, কিন্তু আকারে সে অনেক ছোট ; তার ব্যাস পাশাপাশি ৩০টা সূর্য্যের মতো।
কিন্তু আজ
যে কৃষ্ণগহ্বর নিয়ে কথা হচ্ছে, সেই মহাকায় ‘Virgo A’ অথবা M87-এর ভর ৪০০ কোটি সূর্য্যের সমান। তার
গ্যালাক্সির ব্যাস ১ লক্ষ ২০ হাজার আলোকবর্ষের সমান। অর্থাৎ এর একপ্রান্ত থেকে
আরেক প্রান্তের আড়াআড়ি দূরত্ব অতিক্রম করতে আলোর বেগে ছুটে গেলেও ১ লক্ষ ২০ হাজার
বছর লেগে যাবে। আর কৃষ্ণ গহ্বরটির তুলনায় আমাদের সমগ্র সৌরমন্ডল—সূর্য্য পৃথিবী মঙ্গল বুধ বৃহস্পতি শুক্র শনি ইউরেনাস নেপচুন প্লুটো নিয়ে
যে বিশাল সাম্রাজ্য—তা অনেকটাই ছোট !! কালো গহ্বরটির ব্যাস
পাশাপাশি ৪-৫টা সৌরমন্ডলের সমান।
তো, সেই
বিশাল অন্ধকারের তো ছবি হয়না, তবে তার চারপাশের অতিতপ্ত
গ্যাসের উজ্জ্বল বৃত্তাকার আলোকিত সাম্রাজ্যকে দেখেই তার অবস্থানকে বুঝে নেওয়া
যায়। সেই আলোকিত ও ক্রিয়াশীল দিগন্তকেই বলা হয় ‘Event Horizon’। সেই আলোকিত বলয় প্রবল বেগে—প্রায় আলোর গতিতেই—ঘূর্ণায়মান । যেন এক বিশাল মহাজাগতিক যাঁতাকলে (Accretion Disk) চূর্ণ করা হচ্ছে গ্রহ নক্ষত্রদের। আলোকিত, কেননা
অতিতপ্ত ও আয়নিত গ্যাসের ঝড়, এবং সেখান দিয়েই হুহু স্রোতে সব
গ্রহ নক্ষত্র তার গ্রাসের মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে, যেন একটা
ফানেলের মধ্য দিয়ে তীব্র বেগে নামছে তারা, আর নিমেষে মিলিয়ে
যাচ্ছে অন্ধ গহ্বরে। এমনকি আলোক রশ্মিকেও সে গ্রাস করে ফেলছে, রূপ তাই ঘোর কৃষ্ণবর্ণ।
তবে এরই
মধ্যে থেকে বেরিয়ে আসছে বিপুল পরিমাণ এক্সরে এবং নানারকম রেডিও তরঙ্গ, আর
অতিতপ্ত প্লাজমা জেট, যার তাপমাত্রা প্রায় ৩ লক্ষ ডিগ্রি
সেলসিয়াস। কৃষ্ণগহ্বরের দিগন্তসীমার বাইরে থেকে ফোটন কণার স্রোত বেরিয়ে এলে দেখা
যাচ্ছে সেই আলো এবং সেই অতিতপ্ত প্লাজমার নীলাভ দ্যুতি, যা
গভীর মহাকাশে আলোকস্তম্ভ হয়ে ছড়িয়ে আছে ৫ হাজার আলোকবর্ষ দূরত্ব অব্দি। আসলে
মহাকাশে এই রকম অতিতপ্ত ও দীর্ঘপ্রসারিত প্লাজমা জেট দেখেই বিজ্ঞানীরা বুঝতে পারেন,
নিশ্চয়ই এর কোনও প্রান্তের কাছেই কোথাও অতিকায় ব্ল্যাকহোল আছে।
কিন্তু এত
এত দূরে এই M87 যে, তার কাছ থেকে যেটুকু
বিকিরণ এসে পৃথিবীতে পৌঁছচ্ছে, তা দিয়ে একটা এক ওয়াটের
বাল্বকে এক সেকেন্ড জ্বালিয়ে তুলতে হলেও বিজ্ঞানীদের টেলিস্কোপের ডিশ অ্যান্টেনাকে
২৫ কোটি বছর ধরে চালু রাখতে হবে। এইজন্য এতদিন সম্ভব হয়নি, এমনকি
হাব্ল টেলিস্কোপও পারেনি ব্ল্যাকহোলটির আলোকিত দিগন্তের ছবি তুলে আনতে, যা দিয়ে গহ্বরটিকে বোঝা যায়।
এর জন্যে
এবার সারা পৃথিবীব্যাপী ছড়িয়ে থাকা অনেকগুলো বিশালাকার টেলিস্কোপকে এক শৃঙ্খলে
যুক্ত করা হয়েছিল এমনভাবে, যেন সবটা মিলিয়ে একটাই অতিকায় টেলিস্কোপ যার আয়তন
আমাদের গোটা পৃথিবীর সমান। এরই নাম ‘ইভেন্ট হরাইজন টেলিস্কোপ’
বা EHT, যা দিয়ে অবশেষে এই অসাধ্য ছবিটি তুলে
আনতে পারলেন বিজ্ঞানীরা।
সারা
পৃথিবীর ৪০ টি দেশের প্রায় ২০০ বিজ্ঞানী কাজ করেছেন এই প্রজেক্টে। চারদিন ধরে
বিভিন্ন দেশের আটটি টেলিস্কোপের একযোগে তোলা ছবিকে (ভাগ্য ভালো যে সব দেশেই
আবহাওয়া ও আকাশ পরিস্কার ছিল সেই সময়ে) প্রায় বছরদুয়েক ধরে বিশ্লেষণ করে, একসাথে
তাদের মিলিয়ে, তার উজ্জ্বলতা বহুগুণ বাড়িয়ে তবে তৈরী হয়েছে
এই ঐতিহাসিক ছবি, যাকে পদার্থবিদ্যা ও জ্যোতির্বিজ্ঞানের
যুগান্তকারী মাইলস্টোন বলা হচ্ছে।
তবে এই
আটটা টেলিস্কোপের পাঠানো কয়েক লক্ষ ছবিকে বিশ্লেষণ করে বিশেষ পদ্ধতিতে তাদের
একত্রিত করার জটিল কাজে যার নাম বিশেষভাবে উঠে এসেছে, সে
আমেরিকার হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এক হাসিখুশি তরুণী, কম্পিউটার
ইঞ্জিনিয়ার, নাম কেটি বাউম্যান, বয়স
মাত্র ২৯।
নীচে শেষ
ছবিতে দেখা যাচ্ছে, আইনস্টাইন যেমন বলেছিলেন, একফালি
চাঁদের মতনই তার রূপ। সম্ভাব্য কারণ, কৃষ্ণগহ্বরের যেদিকে সে
হাঁ-মুখ দিয়ে গ্রাস করছে গ্রহ নক্ষত্রদের, সেই দিগন্তটাই
আলোকিত ; আর গহ্বরের অন্য দিকটা, যা
দূরগামী, তা ক্রমশঃ গভীর অন্ধকারে। যদিও এই ব্যাখ্যা আমার
কাছে খুব বোধগম্য নয়। অবশ্য এই ছবিকে আরও সুন্দর ও উন্নত করে তুলতে বিজ্ঞানীরা
নিরলস চেষ্টা করে যাবেন, বলেছেন।
তবে আজ যে
ছবি আমরা পৃথিবীতে বসে পেলাম, এটা ৫ কোটি ৩০ লক্ষ বছর আগেকার। আজকের
দিনে ব্ল্যাকহোলটির ঠিক কেমন অবস্থা, কী রকম তার রূপ,
তা জানার কোনও উপায় নেই। তা জানা যাবে আরও ৫ কোটি ৩০ লক্ষ বছর পরে,
যখন তার আজকের বিচ্ছুরিত আলোক রশ্মি এই পৃথিবীতে এসে পৌঁছবে,
যদি ততদিন মানবসভ্যতা বেঁচে থাকে।
[ যাঁরা EHT প্রেস কনফারেন্সের বক্তৃতায় আগ্রহী,
তাঁদের জন্য লিঙ্ক
ছবি
১ : এই
সেই M 87 গ্যালাক্সি ; এরই
কেন্দ্রে আছে সেই অতিকায় কৃষ্ণগহ্বর।
ছবি ২ : M 87 কৃষ্ণগহ্বরের ছবি, আগে কম্পিউটারে যেমন নির্মাণ করা হয়েছিল। তখনও আসল ছবি পাওয়া যায়নি।
ছবি
৩ ও ৪ : প্রবল বেগে ঘূর্ণায়মান ব্ল্যাকহোলের মধ্য থেকে বেরিয়ে আসছে অতিতপ্ত প্লাজমা
স্রোত, এক্সরে রশ্মি এবং রেডিও তরঙ্গের বীম, যা মহাকাশে ৫ হাজার আলোকবর্ষ অবদি ছড়িয়ে পড়ছে।
ছবি
৫ : সারিবদ্ধ বিশাল রেডিও টেলিস্কোপ।
ছবি
৬ : এই হোল এখন পাওয়া আসল ছবিটা। কৃষ্ণগহ্বরের আকার এতই
বিশাল যে, তুলনায় তার মধ্যে পাশাপাশি ৪-৫ টা সৌরমন্ডল
স্থান পেতে পারে।
২
'তোমাদের চৈতন্য হোক'-- আমাদের উদ্দেশে,
অর্থাৎ চাষাভুষো রাজাগজা জমিদার নায়েব মুন্সী শ্রমিক মালিক পাটোয়ার
যজমান বাবু বেশ্যা গৃহিণী নির্বিশেষে, সবার জন্যে কথাটা
বলেছিলেন তিনি। ঠাকুর রামকৃষ্ণ। সভ্যতার সমস্ত সংকটের---শোষণ তোষণ কুসংস্কার
স্বৈরাচার ফেরেব্বাজি আর দালালির---মুখোমুখি মানুষের অসহায় অবস্থার প্রতি এই একটি
মাত্র আবেদন ছিল তাঁর। চেতনাকে জাগাতে হবে। মানুষকে বুঝতে হবে তার নশ্বরতা,
তার ক্ষুদ্রতা এবং তার বিপুল অন্তর্শক্তির কথা। এই বিশাল
ব্রহ্মান্ডের স্বরূপ জানতে হবে, বুঝতে হবে প্রকৃতির নিয়ম ও
নশ্বরতাকে,
জন্মমৃত্যুচক্রকে। তাঁর বিশ্বাস ছিল-- মানুষ পারে, পারবে। বলেছিলেন, 'মানুষ কি কম গা?'
তো এই
মানুষই আজ ৫ কোটি আলোকবর্ষ দূরের নক্ষত্রলোকের জন্মমৃত্যুর ছবি তুলে নিয়ে আসছে। এই
বিশাল ক্রিয়াশীল ব্রহ্মান্ডকে চাক্ষুষ দেখে, ভয়ে বিস্ময়ে শিহরণে সে জেগে
উঠছে, বুঝতে পারছে নিজের ক্ষুদ্রতা আর নশ্বরতা। হয়তো এখান
থেকেই তার এক নতুন চৈতন্য হবে, এবার হয়তো নতুন করে ভাবতে
বসবে সে। অথবা, একবার ভোট দিয়ে আসবে। আবার ভোট দিতে যাবে।
এইভাবে বারবার। Time is running out-- বলেছিলেন প্রয়াত
বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং।
গত
কয়েকদিনে ব্ল্যাকহোল M 87 নিয়ে আমার সংক্ষিপ্ত পোস্টটি কয়েক হাজার মানুষ
পড়েছেন, কমেন্ট করেছেন, এবং বিশেষত
শেয়ার করেছেন প্রায় ৩৫০ জন !! এই ভোট আর আইপিএলের বাজারে এটা আমাকে তাজ্জব করেছে।
অর্থাৎ সাধারণ মানুষও আজ এক সম্পূর্ণ অন্য পরিচয়ের খোঁজে চোখ মেলেছেন। শুরু হয়েছে
এক নতুন অন্বেষণ ও উপলব্ধি। আমিও তাঁদেরই একজন।
কৃষ্ণগহ্বরকে
দেখতে কেন তৃতীয়ার একফালি চাঁদের মত হবে--আইনস্টাইন যে কথা ১০০ বছর আগেই
বলেছিলেন--তা আমি বুঝতে পারিনি। হঠাৎই একটা বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা পেয়ে গেলাম। এই
নিয়ে একটা গবেষণাপত্র লিখেছেন বিজ্ঞানী J P Luminet । যাঁরা পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্র, যাঁরা শব্দ ও আলোর ডপলার
এফেক্টের কথা জানেন, তাঁরা বুঝবেন। আলোকরশ্মি যখন তীব্র বেগে
আমাদের দিকে ধেয়ে আসে তখন তাকে অনেক উজ্জ্বল দেখায়, আর যখন
আমাদের থেকে দূরে ছুটে যায় তখন তার দীপ্তি ম্লান হয়ে আসে। এখানে, নীচে, সেই ব্যাখ্যার লিঙ্কটা দিলাম। খুব সুন্দর করে
বুঝিয়েছেন। তবে এর পরেও প্রশ্ন থেকে যায়।
No comments:
Post a Comment