[ পীযূষ বিশ্বাস সম্পাদিত শূন্যকাল পত্রিকার পক্ষ থেকে
২০১৭ সালে নেওয়া সাক্ষাৎকার ]
শ্রী শংকর লাহিড়ী। পরিচয় দেবার জন্য কবি,
গদ্যকার, প্রচ্ছদশিল্পী, পরিচালক – এগুলো শুধুই শব্দমাত্র। আসলে সৃষ্টিশীলতার নানা
শাখায় তাঁর অবাধ বিচরণ। আশির দশকের কবি বলে দাগিয়ে দেওয়া তাঁকে কোনোমতেই যায় না,
কারণ তাঁর কাজ আজও সমান প্রাসঙ্গিক এবং অনেকাংশে এখনকার কবি, লেখকদের চেয়ে অনেক
বেশী আধুনিক। সে তাঁর কবিতাই হোক বা প্রচ্ছদ বা তথ্যচিত্র। এককথায় তাঁর
মুখার্জীকুসুম, শরীরী কবিতা আজও সাহিত্যের জগতে আসা তরুণদের পথপ্রদর্শক তো বটেই,
যেমনভাবে মোটরহোমের প্রচ্ছদ, কোনো প্রচ্ছদশিল্পীর কাছে। এছাড়াও তথ্যচিত্র
নির্মাণেও তাঁর স্বকীয়তা অন্যদের থেকে ওঁকে আলাদা করেছে। নিজের চাকরির ব্যপ্ত
জীবনের অভিজ্ঞতা ও তার প্রকাশ আমরা তাঁর প্রতিটি কাজের মধ্যে পাই। তো এমন এক
শিল্পীর সাক্ষাৎকার আমাদের শুধু যে সমৃদ্ধ করবে তাই নয় এ এক ইতিহাসের সাক্ষ্য হয়েও
থাকবে, যা শূন্যকাল করে আসছে দীর্ঘদিন, এ তারই এক নতুন সংযোজন।
শূন্যকাল – আপনার বর্তমান কাজ ও ভবিষ্যৎ প্রজেক্ট নিয়ে
যদি কিছু বলেন...
শ্রী লাহিড়ী – একটু আগের কথা দিয়ে শুরু করতে পারি। গত তিনটে বছর, ২০১৪ থেকে ২০১৬, খুব
ব্যস্ততায় একটা ঘোরের মধ্যে কেটে গেছে। এই সময়ে পরপর দুটো পূর্ণ দৈর্ঘের তথ্যচিত্র বানিয়েছি ; দুটোরই
বিষয় ছিল কবি ও কবিতা। কিন্তু একদম আলাদা দু’রকমের ছবি, আমি যাদের ‘তন্ত্রচিত্র’
বলেছি।
তার
জন্য প্রচুর পরিশ্রম এবং অনেক নিদ্রাহীন রাতও। যাঁরা দেখেছেন ছবিদুটো, প্রবীণ ও
নবীনরা, অনেকেই উচ্চ প্রশংসা করেছেন। আর একটা শর্ট ফিল্ম, সাড়ে চার মিনিটের, বানিয়েছিলাম কবি
উৎপলকুমার বসুর মৃত্যুর তিনদিন পরে, ওঁর প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ হিসেবে। আশির দশকে কৌরবে আমার লেখালিখি ওঁর খুব
ভালো লেগেছে বলেছিলেন, কয়েকবার চিঠিতে প্রশংসাও করেছেন। তো, তিনবছর ধরে এইসব
সিনেমার পরে আমি একটা ব্রেক চেয়েছিলাম। কয়েকটা দিন শুয়ে বসে, নিজের কালেকশান থেকে কিছু
সিনেমা দেখে কাটিয়ে দেব, বা কোথাও বেড়াতে যাবো রাকস্যাক গুছিয়ে, ভেবেছিলাম। কিন্তু
আমার স্ত্রী হঠাৎই বেশি অসুস্থ হয়ে পড়ায় আমাকে ঘরের দিকে মন দিতে হয়। এই সময়টা আমি
আবার লেখালিখিতে ফিরে আসি। পুরোনো কৌরব থেকে সেকালের অনেকের লেখা নির্বাচন করে আজকের
তরুণদের জন্যে ‘কৌরব-আর্কাইভ্স’ নামে একটা সাইট তৈরী করি। আর কবিতায় ‘অনন্ত
সূত্রধর’ নামে একটা নতুন সিরিজ লিখি, যেটা প্রথমে কৌরবে এবং পরে বাংলাদেশের আন্তর্জাল
পত্রিকা ‘পরস্পর’-এ প্রকাশিত হয়।
এখন যে কাজটা নিয়ে ব্যস্ত রয়েছি সেটা আমার জীবন ও কবিতার সম্পর্ক নিয়ে কিছু আত্মানুসন্ধান ও উন্মোচন। এখানে আমি অনেক কিছু বলেছি, যা আগে কখনো বলিনি। এই লেখাটার প্রথম ৭-টা চ্যাপ্টার আগে ধারাবাহিক প্রকাশিত হয়েছিল, ২০১১ থেকে ২০১৪, রাজর্ষি চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘জার্নি নাইন্টিজ’ পত্রিকায়। তারপর আর লেখা হয়নি। তিনটে বছর সিনেমা নিয়ে ব্যস্ত থাকার পর সেই বাকি লেখাটাই এখন লিখতে হল। মোট ২১-টা চ্যাপ্টারে সম্পূর্ণ বইটা, ‘নীল আকাশ ও অলৌকিক ট্রেক’, এই বছরের শেষেই প্রকাশিত হবে। প্রায় গোটা একটা বছর, ২০১৭, কেটে গেল এই বইয়ের পান্ডুলিপি সম্পূর্ণ করতে। এই বইটা লিখতে পারা আমার কাছে একটা চ্যালেঞ্জ ছিল। তিনশো পাতা জুড়ে এই লেখা-- খুব ভালো লেগেছে লিখতে। আমার জন্ম থেকে শুরু করে ক্রমে একক একটা গাছের মত অনেক ঝড় ঝাপটা সামলে বেড়ে উঠে, তারপর যেভাবে কাজকর্ম ভাবনাচিন্তা ডালপালা ছড়িয়েছে সমকাল অব্দি। এটা লিখতে গিয়ে অনেক কিছু শেখা হয়েছে ; এর ফর্ম এবং কনটেন্ট। পরবর্তী সিনেমায় মন দেওয়ার আগে—সেটা হয়তো হবে ৪০-৫০ মিনিটের একটা পোয়েফিল্ম---তার আগে আমার একটা খুব প্রয়োজনীয় বইয়ের কাজে হাত দিতে হবে, যে লেখাটা শুরু করেছিলাম ১৯৯৭ সালে। সৃজনশীলতার পথ, চিন্তাধারার ভ্রান্তি, ডীপ ইকোলজি, সেল্ফ অর্গানাইজিং সিস্টেম্স, নিউ প্যারাডাইম ইত্যাদি নিয়ে সহজ ভাষায় সবার জন্য খুব রেলিভ্যান্ট আলোচনা। মনের আধুনিকীকরণ, মর্ডানাইজেশান অফ্ মাইন্ড। আগামী দিনের কবিদের জন্য জরুরী, অন্ততঃ যারা শুধু দেওয়ালে পিঠ ঘষে জীবন কাটাতে চায় না। এই লেখার কিছুটা একসময়ে কৌরবে ধারাবাহিক বেরিয়েছে, ‘কবিতার এরিনা’ নামে, ১৯৯৭ থেকে ২০০১ অব্দি সাতটা চ্যাপ্টার। লেখাটা সময়াভাবে থামিয়ে দিয়েছিলাম, কারণ টাটাস্টীলে আমার কর্মক্ষেত্রে সেটা ছিল পিক পিরিয়ড। তো, সেই বড় লেখাটা এবার হাতে নিতে চাই, তবে বইয়ের নামটা হয়তো পাল্টাতেও পারি।
শূন্যকাল – কিভাবে সেই আশি বা তারও আগে থেকে করে যাওয়া
এই কাজের মধ্যে নিত্যনতুন প্রজেক্ট খুঁজে পান? আগের সৃষ্টির আবহ মুছে পরের দিকে
এগোন?
শ্রী লাহিড়ী – এই প্রশ্নটা গভীরের। দেখ, বাংলা
ভাষায় লেখালিখি এখন একটা সীমানা-পাঁচিলের গায়ে এসে ধাক্কা খেয়েছে। এই পাঁচিল, এই
কাঁটা তার, এই কমফর্ট যোন, যা যৌথ হাতে তৈরী করেছে লেখক ও পাঠক, তাকে ভেঙ্গে দেওয়া
দরকার। এইকথা আমরা কৌরবের ক্যাম্পের দিনগুলোতেই বুঝতে পেরেছিলাম। কিন্তু এটা কোনও পাগলা
জগাইয়ের কাজ নয়। এলোপাথাড়ি হাতুড়ি মারার কাজ নয়। সত্তরের দশক শেষ হলে, ক্রমে সর্বত্র
সামগ্রিক ভাবনায় বদল আসে। নানা কারণে।
এবং সেই ছিল আসলে চিন্তাধারায় মুক্তির দশকের শুরু। আমরা বিশ্বাস করতাম, নতুন কাজের
জন্য চারিদিকে বিস্তৃত, ধূধূ, ভার্জিন ভূখন্ড পড়ে আছে ; কোথাও কেউ আটকানোর নেই, যতদূর
যেতে পারবে ততটাই তোমার জমি।
আমার ‘রাখা হয়েছে কমলালেবু’ ছবিটা যদি
দেখে থাকো, ওর একদম শেষের দিকে এক জায়গায় একটা দীর্ঘ টানেলের মধ্যে দিয়ে ক্যামেরা
ছুটে যাচ্ছে--- শটটা নিয়েছিলাম আমস্টার্ডামে--- কিছুদূর গিয়ে সহসা টানেল থেকে
বেরিয়ে এক বিশাল সমুদ্রের মুখোমুখি। আর ভয়েসে শোনা যাচ্ছে কবি স্বদেশ সেনের চিৎকৃত
কন্ঠস্বর---‘নো ওয়ান হিয়ার, নো ওয়ান হিয়ার’! একজনও নেই এখানে, একজনও নেই এখানে। ব্যাপারটা
এরকমই। -এই পরিবেশে, যে সত্যিই নতুন কিছু করতে চাইছে, তার পক্ষে নিত্যনতুন মূল্যবান
প্রজেক্ট খুঁজে পাওয়া কঠিন কিছু নয়।
তবে যারা পারফর্মিং আর্টিস্ট, তাঁরা জানেন
কীভাবে পাবলিককে খুশি করতে হয়। ভীষণ নজরে রাখতে হয় শ্রোতা ও দর্শকের রুচিকে। কারণ
তাঁর সফলতা, স্পনসর, প্রোমোটার, প্রোডিউসার, সবই এক সুত্রে গাঁথা। যত অ্যাটেন্ডান্স,
যত হাততালি, তত সফলতা। কিন্তু কবির এসব দায় নেই। অন্তত যতক্ষণ না সে পুরস্কার আর
রয়ালটির স্বপ্ন দেখে। আর আজকের ইন্টারনেট যুগের কবিতা-পাঠকের ব্যাপারগুলোও খুবই
বিস্ময়, বিরক্তি ও বিষাদের সাথে আমি লক্ষ করে গেছি। তারা মিছরি হাতে পেলে প্রবল
আবেগে বলে ওঠে-- ‘এই মিষ্টত্ব আর কোথাও পাইনি, এই স্বাদ গন্ধ আহা আহা, এ এক
মাইলস্টোন, আত্মাকে ছুঁয়ে যায় এর আবেদন’। এর পরে, যদি তুমি ঠিক নজরে রাখো, কান
পেতে রাখো, দেখবে সে অন্যত্র একগাল মুড়ি খেয়েও প্রবলতর আবেগে বলছে একই কথা-- ‘এই
স্বাদ গন্ধ আহা আহা আত্মাকে ছুঁয়ে যায় বাকরুদ্ধ হয়ে আছি মুড়ি খেয়ে’। এদের তুমি
ক্ষমা ঘেন্না যাই করো, কিছু সৎ ও আন্তরিক বোদ্ধা ছাড়া প্রধানতঃ এরাই আছে ও থাকবে
চারপাশে। এটা আমাকে খুব চার্জ করে, একাগ্র হয়ে নিজের মনের মতো কাজ করতে পারার
পেছনে এটাও একটা ড্রাইভিং ফোর্স। আসলে একজন কবি বা শিল্পী, এক প্রেমিক চিল-পুরুষের
মতোই গরম হাওয়ার থার্মালে ভর করে বিশ্বসংসারকে তার একক দৃষ্টিতে কীভাবে কতদূর দেখছে,
সেইটাই তফাৎ গড়ে দেয়। কতভাবে সে খুঁজে চলেছে চিহ্নগুলো, চিনে নিতে চাইছে বিশ্বপ্রকৃতির
সকল রহস্য-সম্ভার, গড়ে তুলতে চাইছে তার নিয়ত নতুন বাসযোগ্য ভুবন, কতভাবে বাজিয়ে
তুলতে চাইছে তার ঝংকারগুলো আমাদের কানে কানে। -এইটুকু, শুধু এইটুকুর মধ্যেই ধরা আছে
তোমার প্রশ্নের উত্তর।
শূন্যকাল – শুরুতেই কবিতার কথায় আসি, জানতে ইচ্ছা করে কবিতার
বাস্তবতা আর বাস্তবের কবিতার মধ্যে আদৌ কোনো তফাৎ আছে কি? থাকলে তা কি থাকা উচিত না কি নয়?
শ্রী লাহিড়ী – আমরা ভাষা-শব্দ ব্যবহার
করে কথা বলি, লিখি। এইটা যেমন সুবিধের, তেমনই হাড়ভাঙ্গা অসুবিধেরও। বিশেষ করে কিছু
কিছু শব্দ যেমন-- সত্য, বাস্তব, তফাৎ, কবিতা। এরকম আরো অনেক। এগুলো নিয়ে বেশি
ঘাঁটলে বোঝা যাবে গোলকধাঁধায় পড়ে গেছি, সারকুলারিটির ফাঁদে আটকে পড়েছি। তবে ছবি
দিয়ে, গান দিয়ে, কবিতা দিয়ে, কল্পনা দিয়ে মনকে তো ছুঁয়ে যাওয়া সম্ভব। এই ছোঁয়ার সম্ভাবনার
গভীরে আছে লেখক ও পাঠকের স্থান-কাল-পাত্র ও অভিজ্ঞতার রঙরূপের বিন্যাস, যা
পরিবর্তনশীল, যার সবই মনোজগতের অন্তর্গত। এই
মনোজগত তো এক অর্থে অবাস্তব। ভেবে দেখলে, এটা তো সেই বাস্তব নয়, যেখানে নিঊটনের
সুত্র, ইউক্লিডের জ্যামিতি, তাপবিদ্যা ও গতিবিদ্যার চলাচল আছে। অথচ এই জগৎ অবাস্তব
হলেও এই ছোঁয়াটা সত্য।
কিন্তু বাস্তব জগতে কাউকে সেভাবে ছুঁতে
গেলে তার কাছে যেতে হবে, শরীর স্পর্শ করতে হবে। সেই ছোঁয়াটাও বৃহদর্থে কবিতা হয়ে উঠতে
পারে, যদি তা স্পর্শিতার মনোজগতকে বিশেষভাবে ছোঁয়, যদি স্পর্শের স্থূল বাস্তবতাকে পেরিয়ে
সে উপলব্ধি করে প্রেমের ব্যাপ্তিকে, কালের প্রবাহকে। এ প্রসঙ্গে আমার ‘বন্ধু রুমাল’ বই থেকে
‘দাগ’ নামের কবিতার কয়েকটা লাইন মনে পড়লো :
“স্পর্শ করো নাভিবিন্দু,
দেখো
নাভি স্পর্শিত হ’ল।
জানুসন্ধি
স্পর্শ করো, ---জানুসন্ধি ভ্রুপল্লব
জরায়ুর
সঞ্চিত রেণু
রেণু
গ্রন্থি মালা, যাকে স্পর্শ করে বহে
মহাকাল”।
কতটা সঙ্গত হ’ল এই উদ্ধৃতি, জানি না। তবে
এর মধ্য দিয়ে যদি কিছু ভাইব্রেশান্স পাও তাহলে ভালই। কবিতা একান্তই মনোজগতে দান-গ্রহণের
জিনিষ। বাস্তবে শুধু কাগজ কলম দিয়ে কিছু চিহ্ন এঁকে তাকে হস্তান্তর করা হয়। তাই সম্পূর্ণ
‘বাস্তবের কবিতা’ কেমন হতে পারে আমি ঠিক জানিনা। অনেকে বাস্তবের কবিতা বলতে সর্বসাধারণের
প্রাত্যহিক জীবনযাত্রার স্বেদ-অশ্রু-রক্তের আলেখ্যকে বোঝান ; যে কবিতা নিপীড়িত
মানুষের মৌন ম্লান মুখে প্রতিবাদের আবেগাশ্রিত ভাষা যোগায়। তাহলে কি কবিতা---যা
মনোজগতে আমাদের বিশেষভাবে স্পর্শ করে, চেতনায় রহস্যময় ঝংকার তোলে যে তারগুলো, তার
কি কোনও বাস্তবতা নেই? আসলে কবিতার বাস্তবতার স্বরূপই আলাদা। আমাদের অস্তিত্ব,
কগনিশান, প্রসেস অফ লাইফ---যাই বলো তাকে---গড়ে উঠেছে আমাদের বহির্জগত ও
অন্তর্জগতের যৌথতায়। এরা অঙ্গাঙ্গীরূপে জড়িত, structurally coupled । এদের দুটোকে যদি ছাড়িয়ে নিয়ে দেখতে
চাও---মুদ্রার দুপিঠকে আলাদা করে দেওয়ার মতো---তাহলে সমগ্রের অস্তিত্বই বিপন্ন হয়।
উৎকৃষ্ট কবিতায় ওই দুই জগত এসে যুক্ত হয়ে তৈরী করে এক অন্য বাস্তবতা, যা কবিতার
একান্ত নিজস্ব, যাকে আমরা শুধু মনোজগতে উপলব্ধি করি।
এবার জটিলতা সরিয়ে, একটা সহজ উদাহরণ দিয়ে
সংক্ষেপে বলা যাক। বক্তা সন্তোষ কুমার ঘোষ। আশির দশকে চাইবাসার এক আড্ডায় শচীন
দেববর্মণের একটা গান উদ্ধৃত করে বোঝাতে গিয়ে বলেছিলেন, “কবিতা যে কি তা বলা ভয়ানক
শক্ত। কি যে হয়, কি যে হয় না। ‘ছলছল ছলছল নদীর জলে ঢেউ খেলিয়া যায় রে’— ঢেউ তো
খেলেই, এটা সত্যি (বাস্তব), তাই এটা কবিতা নয়। ইট্স এ স্টেটমেন্ট অফ ফ্যাক্ট। কিন্তু
‘ছলছল ছলছল চোখের জলে ঢেউ খেলিয়া যায় রে’--এটা মিথ্যে বলেই কবিতা। (বাস্তবে) চোখের
জলে সত্যি সত্যি অত তো ঢেউ খেলে না, সুতরাং ওখানে জিনিষটা কবিতা হয়ে গেল”।
এটাই কবিতার বাস্তবতা, এই বাড়িয়ে বলাটা,
যা সুনির্বাচিত, যা নিক্তি দিয়ে মাপা। অবশ্য
এর পরেও কিছু পরীক্ষামূলক স্টেজ আছে, যেখানে---স্টেটমেন্ট অফ্ ফ্যাক্ট নিয়ে----আমি
কিছু চেষ্টা করেছি, তবে সে প্রসঙ্গ অন্যত্র।
শূন্যকাল –মূলত আশির দশকে যে সময় আপনি বিচরণ করছেন, নতুন ভাষাকে আবিষ্কার করছেন, নতুন ভাষা বলে একেবারে ভিন্ন ফর্ম, আঙ্গিকের
পরীক্ষার মধ্যে নিজেকে ডুবিয়ে দিচ্ছেন, তার আগে আধুনিকতা বলতে যে যৌনতা বা খুব টাফ
বিষয় নিয়ে হাংরিরা কাজ করে গেছেন, সেই
প্রভাব এড়িয়ে নতুন কিছুর সন্ধান করা কতটা কঠিন ছিল? জরুরীই বা ছিল কতটা?
শ্রী লাহিড়ী – কৌরবে এসে আমি যখন কবিতা লিখতে শুরু করি, ১৯৭৯-৮০, কমলদা আমায়
বলেছিল ‘তুমি অনেক পরে শুরু করলে, তোমাকে দশ বছরের কাজ পাঁচ বছরে করে ফেলতে হবে।
আমরা দুজনে তখন প্রতি সন্ধ্যায় পায়ে হেঁটে, বা স্কুটারে সারা শহর ঘুরে আড্ডা দিতাম।
আর প্রত্যেক ছুটির দিনে আমার নীল পুস্পক স্কুটারের পেছনে কমলদাকে বসিয়ে, বা কখনো ট্রেনে,
বাসে, গরুর গাড়িতে চড়েও সিংভূমের প্রত্যন্ত আদিবাসী গ্রামগুলোয় আমরা দুজন। চান্ডিল, চাইবাসা, ঘাটশীলা, পটমদা,
ঝাড়গ্রাম, রায়রংপুর, হেসাডি, হিরনি, চক্রধরপুর, রাজখরসোয়ান। আমি তখন বুকলিস্ট
বানিয়ে বই পড়া শুরু করেছি, সুদ্দু যেটুকু না পড়লে নয়। তার মধ্যে ছিল বদ্ধদেব বসুর
‘কালের পুতুল’, আবু সাহেবের ‘পথের শেষ কোথায়’। কমলদার বাড়ির পাশেই থাকতেন বাংলা
সাহিত্যের এক অধ্যাপক, ডঃ কনক মহান্তি। পান-দোক্তায় রসস্থ মুখে তিনি আমায় বলেছিলেন—‘শুরুতেই
বৈষ্ণব পদাবলীটা পড়ে নাও। প্রেমের ‘রভস’-কে বুঝতে হবে’। তো আমিও পড়ে নিলাম ; ‘কত মধুরাতি রভসে
গোঁয়ায়লু’ (বিদ্যাপতি)। সেই ছিল শুরু। যে কোনও
শিল্পীত রচনায়, কবিতায় তো বটেই, আধ্যাত্মিকতা এবং যৌনতা দুটোরই খুব মূল্যবান
ভূমিকা আছে। তারা যেন শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের মঞ্চে দুপাশে দুটো তানপুরার মতো, সর্বদাই
পেছন থেকে সুরের জানান দিয়ে যায় কানে। তবে এই যৌনতা ও প্রেম মনোজগতের জিনিষ, বলা
যায় সেরিব্রাল। কিন্তু হাংরিদের লেখায় এটা অনেকটা বায়োলজিক্যাল, শারিরীক। সেসময়ে
অনেকেই সেইসব নিঃসংকোচ উচ্চারণকে বাস্তবোচিত ও নতুন কবিতা মনে করেছিলেন। --বাস্তবের
কথা এখানেই শেষ করি। নানা কারণে এই ‘বাস্তব’ শব্দটা নিয়ে, এর বাস্তবিকতাকে নিয়ে,
আমি হিমসিম খাই। আমি একে পছন্দ করি না।
জীবনানন্দের পরে কবিতায় আমার যা যা প্রিয়
ছিল তার মধ্যে কিছুটা বিনয় মজুমদার, এবং বেশিটা উৎপলকুমার। উৎপল বাংলা কবিতায় একটা নতুন ডিকশান
এনেছিলেন। স্বদেশ সেন তখন সবেমাত্র কিছু উৎকৃষ্ট কবিতা লিখেছেন। কবিতায় বাদবাকি
কাউকে আমার মনে ধরেনি। ঈর্ষা করার মতো পাইনি আর কাউকেই। এছাড়া, এদিকে ওদিকে ছড়িয়ে
থাকা কিছু লাইন, যেমন তুষার রায়, রণজিৎ দাশ। প্রাতিষ্ঠানিক কবিদের প্রচার,
পুরস্কার, আর স্তাবককুলের ভিড়কে আমি পরোয়া করিনি। বড় কবিরা, যাঁরা কিছুটা
বোহেমিয়ান, নিজেদের মনে করতেন শহরের শাসক।
তাঁদের ঘিরে অনেক মিথ তৈরী হয়েছিল, কিন্তু আমার কাছে একমাত্র বিচার্য ছিল তাঁদের লেখা। কলকাতা-কেন্দ্রিকতা আর কফিহাউস আমার
পছন্দের ছিল না। একদিন সন্ধ্যায় নর্থ-শেয়ালদা
লাইনের লোকাল ট্রেনের ভীড়ে একটা দৃশ্য মনে পড়ে। টানা সীটের ওপরে একটা বেওয়ারিশ লাশের গা ঘেঁষে ঠেসাঠেসি করে বসে আছে অফিস ফেরত
নির্বিকার মানুষ। এমন বাস্তবতার ওপর চলন্ত ট্রেনের হ্যান্ডেল ধরে কবিতা আজও দাঁড়িয়ে
আছে, এভাবেই সে দূরগামী, -আমি মানতে পারিনি। কারণ আমি হাজার বছর ধরে পৃথিবীর
পুঁজ-রক্ত-ব্যাধির সাথে, সমস্ত প্রতারণা ও পাশবিকতার ইতিহাসের সাথে পরিচিত ছিলাম। আমার
কাছে আশির দশক ছিল সর্বান্তকরণে নতুন কবিতার দশক। “নতুন কবিতা, আমি পাইনা তোমাকে
কেন” – লিখেছিলাম।
ক্রমে আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে আমি যতটা
দলমা পাহাড় আর সুবর্ণরেখা নদীর, ততটা বাবুঘাট কিম্বা কলেজস্ট্রীটের নয়। তুষার
রায়ের ‘জগন্নাথ ঘাটের গাঁজার পর বাঁজা সন্তানকামী মেয়েমানুষের’ ট্রাজিক গল্প নিয়ে
আমার কবিতা হবে না। বরং ট্রাজেডিকে নতুনভাবে দেখাটাই ছিল আমার কাছে একটা
চ্যালেঞ্জ। “একটি ট্রাজেডি দেখি প্লেট ভরে আছে। হিম, আয়তাকার, বিন্দু বিন্দু নীল ;
ও তার সোনালী রস উপচে পড়ছে টেবিলে।”
–আমি লিখেছিলাম ‘শরীরী কবিতা’-য়। হাংরিদের
লেখালিখিকে আমি ‘এমনটা যে হবে তা তো জানাই ছিল’ ব’লে সরিয়ে রেখেছি। আমার কলেজজীবন (১৯৬৭-১৯৭২) কেটেছিল ঘোর
নকশাল পিরিয়ডে। কিন্তু, হাংরিদের আত্মিক সমস্যাকে কখনো নিজের বলে মনে হয়নি। বস্তুতঃ
আমার লেখা থেকে সকল প্রকার শালা, বাঞ্চোৎ, ঢ্যামনা, ঢলানি, ও চিৎকৃত উচ্চারণ আমি
সজ্ঞানে বাদ দিয়েছিলাম। কলকাতা তখনো নীরেন্দ্রনাথের ‘যীশু’, শক্তির ‘অবনী’, আর
সুনীলের নীরা-য় মজে আছে। ‘তেত্রিশ বছর কেটে গেল, কেউ কথা রাখেনি’ আর ‘ফুটপাথ বদল
হয় মধ্যরাতে’ –এইসব তখন কলকাতার ব্রেকফাস্ট, লাঞ্চ, ডিনার, মদের টেবিল। আমি পরোয়া করিনি। আমার ব্যক্তিগত বায়োকেমিস্ট্রিতে
এইসব কবিতার তেমন কোনও আবেদনই ছিল না। অবক্ষয় আর ডিকাডেন্সের মলিন ফ্রেমগুলো সরিয়ে
একটা অন্যদিকের জানালার সন্ধান ছিলাম। জানতে চেয়েছিলেম সেই জানালা দিয়ে এ’বিশ্বকে
কেমন দেখা যায়। ফলে একটা নতুন ইজেল, নতুন ক্যানভাস তৈরী করা জরুরী হয়ে পড়েছিল। ওই
সময়েই আমি ফটোগ্রাফি আর পেইন্টিং-এর বিশ্বশ্রেষ্ঠ কাজগুলো চিনে নিতে শুরু করি। বিদেশের
বিভিন্ন স্যালোঁর ক্যাটালগগুলো দেখি। চেষ্টা করতে থাকি বিভিন্ন মাধ্যম থেকে কিছু
সাধারণ স্কিল অর্জন করার ; কৌরবের প্রচ্ছদে নতুন নতুন অ্যাবস্ট্রাকশান আনতে যা
আমায় তখন সাহায্য করেছিল।
নতুন ফর্ম বা আঙ্গিকের জন্যে আমাকে বিশেষ কোনও
সজ্ঞান প্রচেষ্টা করতে হয়নি। তবে যত্ন করে ভাষার নতুনকে তৈরী করতে চেয়েছিলাম। নিজস্ব
কবিতার ভাষা এবং গদ্যভাষা। গদ্যকারদের মধ্যে আমার প্রিয় ছিল, হুতুমপেঁচার কালীপ্রসন্ন সিংহের উইট, বাবু
সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের প্রিসিশান আর কমল চক্রবর্তীর গদ্যে যে স্বতস্ফুর্ততা,
ফ্লুয়েন্সি ও রোমান্টিক এক্সপ্যান্স। আর
সারা ‘কথামৃত’ জুড়ে যে ইনফর্মালিটি। এর
সবগুলোকেই আমি আত্মস্থ করতে চেয়েছিলাম।
এগুলো কেউ চিনিয়ে দেয়নি, নিজেকেই খুঁজেবুঝে নিতে হয়েছে। তখন অনেক লেখক ও কবির কয়েকটি শব্দবন্ধকে আমি চিহ্নিত
করেছিলাম। বিনয়ের যেমন ‘প্রকৃত প্রস্তাব’ শব্দটি ; ‘দৃশ্যতঃ সুনীল, কিন্তু প্রকৃত
প্রস্তাবে স্বচ্ছ জলে’। জয় গোস্বামীর ‘ভস্মদল’ ; ফিরে এসো ভস্মদল, মিনু মাসী একা
একা বসে আছে স্কুলে’। রণজিৎ দাশের ‘কেশদাম’ ; ‘নাবিকের জন্য তাই বেশ্যাদের তীব্র
কেশদাম’। তেমনই, উৎপলকুমারের
‘নীলিমাবিথার’, অমিতাভ দাশগুপ্তের ‘উচ্চন্ড’, সন্দীপনের ‘সমূহ’ ও ‘নীহার’। এই শব্দগুলোকে আমি ব্যবহার করেছি, বিশেষতঃ
আমার গদ্যে। পরীক্ষা নিরীক্ষার পথে এইসব আহরণ ছিল।
সেসময়টা আমি ফুটপাথ থেকে গণশক্তি, অথবা শারদীয়
দেশ, অমৃত, পরিচয়, বা কৃত্তিবাস কেনার বদলে, সস্তায় পুরোনো টাইম ম্যাগাজিন,
পোয়েট্রি রিভিয়ু, আর ন্যাশানাল জিয়োগ্রাফিক কিনে পড়ছি। পড়ছি গ্রীক মাইথোলজি,
ব্রহ্মপুরাণ, উপনিষদ। এছাড়া মায়াদের, ইঙ্কাদের, রেড ইন্ডিয়ানদের, মাওরিদের আর আকা
পিগমিদের কথাও। কিছুদুর ছুঁয়ে ছুঁয়ে
যাওয়া, পাত পেতে বসে পড়া নয়। কৌরবে এসে আমার প্রথম কাজ ছিল কবিতার জন্য একটা নতুন
ল্যান্ডস্কেপ তৈরী করা। একটা নতুন অ্যাবস্ট্রাকশান। তার জন্যেই তৈরী হয়েছিল আমাদের
একান্ত আপন কবিতার ক্যাম্প, যা ছিল পরীক্ষানিরীক্ষার আঁতুড়ঘর। আমার প্রিয় বিষয় ছিল
‘ড্রিম উইভিং’। কফিহাউস আর খালাসীটোলার বিপরীতে একটা ওয়াইড-অ্যাঙ্গেল প্যানোরামিক
স্বপ্ন বুনেছিলাম, যার নাম ‘মোটরহোম’ ; কলকাতার প্রিয় দুই বাবু, বিশেষতঃ উত্পলকুমার,
আর সন্দীপনকেও, যা মাতিয়েছিল। সে সময়ে আমি কৌরবের পেছনের মলাটে একটা বিজ্ঞাপন লিখেছিলাম—‘একপাল
ঘোড়া চাই। বাদামী, পিঙ্গল, আটটা। পিতলের
নাল ও স্টিরাপ’। নতুনের সন্ধানে এভাবেই
তৈরী হয়েছি আমি।
শূন্যকাল – কবিতার ভাষা প্রয়োজন, না কি ভাষার জন্য কবিতা? আদৌ কবিতা বলে যা কিছু তা কি
কিছুটা টুকরো করে রাখা কবির ব্যক্তিগত ইচ্ছা বা অবচেতন ছাড়া কিছু?
শ্রী লাহিড়ী – প্রথম প্রশ্নটা অনেকটা সেই দ্বন্দ্ব--- আমার গোঁফ,
নাকি গোঁফের আমি ? সুকুমার রায়ের সেই বিখ্যাত কবিতাটি। সেই সূত্রে বলা যায়, কবিতার
যেমন আছে উন্নত ভাষার প্রয়োজন, ঠিক তেমনই উৎকৃষ্ট কবিতা পারে ভাষার মহিমাকে, মাধুর্যকে,
কর্মক্ষমতাকে অনেকটা বাড়িয়ে দিতে।
যোগ
করতে পারে নতুন অ্যাবস্ট্রাকশান। তাই ভাষারও প্রয়োজন আছে কবিতার। ইংরিজীতে যেমন
ফ্রেন্ড শব্দটি আছে, বাংলা ভাষায় তেমনই আছে ‘বন্ধু’ শব্দটি। তার সাথে আরও শব্দ যোগ করে তার অর্থের পরিসর
বাড়াতে হয়। যেমন, বাল্যবন্ধু, প্রাণের বন্ধু, ছাত্রবন্ধু, শ্মশানবন্ধু। অথচ, এস্কিমোদের
ভাষায় নাকি বন্ধুত্বসূচক তিরিশ চল্লিশটা শব্দ আছে। তার মধ্যে একটি শব্দের মানে---
‘সে আমার বন্ধু, কিন্তু তার সাথে আমি সীল-মাছ শিকার করতে যেতে পারি না’! বাংলা
ভাষায় মাছ নিয়ে একটা শব্দ আছে-- ‘কানকো’। প্রায় সব মাছেরই ‘কানকো’ থাকে, যা দিয়ে
তারা শ্বাস নেয় আর অক্সিজেনের যোগান দেয় রক্তে। কিন্তু তিমি মাছের জন্য আলাদা সেই শব্দটা
হল ‘বেলিন’ (Baleen)। আমি কোলকাতা মিউজিয়ামে
একটা বিশাল তিমির কংকালের বিভিন্ন অংশের নাম ইংরিজীতে লেবেলিং করা দেখেছি, সেখানে দেখানো
ছিল। বাংলায় এর যোগ্য কোনও শব্দ আছে বলে শুনিনি। ভাষার ঐশ্বর্য দিয়ে কবিতায় এবং
কবিতার ঐশ্বর্য দিয়ে ভাষায় নতুন প্রাণরস সঞ্চারিত হয়। ‘রাখা হয়েছে কমলালেবু’ বইতে
কবি স্বদেশ সেন এভাবেই বাংলা ভাষায় প্রাণ সঞ্চার করেছেন।
তোমার দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তরে আমি কবিতার
কোনও সংজ্ঞায় যেতে চাইনা। যদিও অনেকেই সেই চেষ্টা করেছেন, কিন্তু তাতেও কবিতার
সম্পূর্ণকে ধরা যায়নি। জীবনানন্দ কবিতাকে বলেছেন ‘এক ধরণের উৎকৃষ্ট চিত্তের বিশেষ
সব অভিজ্ঞতা ও চেতনার জিনিষ ; শুদ্ধ কল্পনা ও একান্ত বুদ্ধির রস নয়’। আর স্বদেশ
সেন বলেছেন ‘ছিন্নভিন্ন ছবিকে ছবি করাই কবিতা।...কবিকে বুঝতে হলে তার বন্যতাকে বোঝ’। এখানে খেয়াল করলে দেখবে
জীবনানন্দ ও স্বদেশ দুজনেই কবিতার কথায় আভাসে ব্যক্তিকবির প্রসঙ্গ এনেছেন। সেই সূত্রে
কবিতাকে কবি থেকে সম্পূর্ণ পৃথক না করে, যুক্তভাবে দেখলে একটা উন্নত প্রাণজীবনের চেতনার
সমগ্রতার ঝংকৃত অনুভব পাওয়া যেতে পারে। তার একটা কারণ, ব্যক্তি কবি ও তাঁর কবিতার
মধ্যে একটা সম্পর্কের গাঁটছড়া বাঁধা থাকে (structurally coupled)। একজন কবি তাঁর বিবিধ শিক্ষা, মেধা,
বিশ্বজগতের সাথে তাঁর হরেক সম্পর্কের অভিজ্ঞতা, শৈশবের স্মৃতিচিত্রগুলো, অবচেতন থেকে আহরিত নানা আনন্দ-বিস্ময়-বিষাদের
ঘ্রাণ, সবকিছু যোগ করে কবিতা রচনা করেন। এই রচনার পথেই থাকে সকল পরীক্ষানিরীক্ষা ও
কবিতাকে নতুন করে তোলার সজ্ঞান প্রয়াস। আমি মনে করি, উৎকৃষ্ট কবিতার মধ্য দিয়ে
একজন উৎকৃষ্ট কবি তাঁর সমগ্র অস্তিত্বের বোধকে--- যা সতত পরিবর্তনশীল, নানা অভিঘাত
যাকে নিত্য নতুনরূপে বিন্যস্ত করে চলেছে--- তার প্রবাহমানতাকে ক্রমে পরিষ্ফুট
করেন। তবে কবি থেকে কবিতাকে আলাদা করে, শুধু কবিতারই রস আস্বাদন করতে চাওয়ার
মধ্যেও যৌক্তিকতা আছে। কারণ, তা অপেক্ষাকৃত নির্ভার ও সহজসাধ্য।
শূন্যকাল – আপনার কবিতার অসামান্য সব লাইন, ডিকশন, সিনট্যাক্স, এ কি সবটাই সচেতনতা থেকে? নির্মাণ ছাড়া কবিতার কি স্বতঃস্ফূর্ততা বলে
কিছুই নেই? কবিতার শ্রমিক কথাটা আজকাল খুব শুনতে পাওয়া
যায়, তবে সত্যিই কি কবির সাথে যায় এই শব্দবন্ধ, যেখানে তিনিই রাজা, স্বেচ্ছাচারী?
শ্রী লাহিড়ী – কবিতা একই সাথে মেধা, বোধ ও শ্রমের ফসল। এই বোধ মানে জীবনবোধ,
কাব্যবোধ, সবই। এবং শ্রম তো অবশ্যই। প্রত্যেক শিল্পেই এটা সত্য। তবে রচনা সম্পূর্ণ
হলে, চূড়ান্ত পর্যায়ে, তাতে যেন শ্রমের দাগ না থাকে ; গোলাপে যেমন মালীর ঘামের
গন্ধ নেই।
কবিতা নির্মিত হয়, এ কথা সত্য। কিন্তু একে
যদি ইঁট-বালি-সিমেন্ট-লোহা দিয়ে রাজমিস্ত্রীর মতো নির্মাণের কথা ভাবা হয়, তবে মনে
রাখা দরকার, বাড়ি বানানোর প্রক্রিয়াতে এমন অনেক জিনিষও লাগে, যেমন জলের পাইপ,
বিদ্যুতের লাইন, যারা অগোচরে থাকে, দেখা যায় না। তারা রাজমিস্ত্রীর হাতে নির্মিত নয়,
কিন্তু তাদের নিয়ে এসে, ঠিক জায়গায়, নির্মাণের কিছু নিয়ম মেনে ব্যবহার করতে হয়। এভাবেই
কবি কবিতায় ব্যবহার করেন নানা স্মৃতিচিত্র এবং অবচেতন থেকে স্বতঃস্ফূর্ত উঠে আসা
নানা উপাদান। হ্যাঁ, স্বতঃস্ফুর্ত। তবে এটা একটা স্থূল উদাহরণ হয়ে গেল। কবিতার নির্মাণ যদিও ঠিক বাড়ি বানানোর মতো
নয়, তবুও কিছুটা হয়তো আলো পড়লো বিষয়টায়। আমার নিজের বরং কবিতার শরীরকে ওয়াইন অথবা
পারফিউমের গঠনের সাথে বেশি তুলনীয় মনে হয়। তবে সে আলোচনা অন্যত্র করেছি।
কি হয়, ইস্কুলে, পাড়ায়, সবাই এরাজ্যে কবিতা
লিখছে তাই প্রাকৃতিক নিয়মে আমিও লিখতে শুরু করে দিলাম, দু-পাতা ছাপিয়ে প্রচার করে
দিলাম, -এমনটা বেশি দিন চলে না। আজকের দিনে প্রতিষ্ঠানকে মান্যতা না দিয়েও সিগ্নিফিক্যান্ট
কবি হতে চাইলে যৌবনে অনেকটা একক প্রস্তুতি লাগে। -সাহিত্যচর্চায় নেমে আমার নিজস্ব
মডেল হল : দেখো-৪০, ভাবো-৩০, পড়ো-২০, লেখো-৬, ছাপো-৪ ; এটা আগেও লিখেছি। কিছুদিন
আগে কবি দেবারতি মিত্র এটা শুনে, ‘দাঁড়াও, দাঁড়াও শংকর, এটা এখনই ডায়েরীতে টুকে
নিচ্ছি’ বলে লিখে নিয়েছিলেন। এর বিপরীতে, আজকের বেশীরভাগ তরুণের মডেলই হল : দেখো-৫,
ভাবো-১০, পড়ো-৩০, লেখো-৩০, ছাপো-২৫। এইটা
মনে রাখলেই ব্যাপারটা বোঝা যাবে। খেয়াল করে দেখবে, যারা পড়ে, খুব পড়ে, তাদের
বেশিরভাগই যা পড়ার নয় তা-ই পড়ে। একটা গোটা জীবন প্রচূর ভুল বই পড়ে, ভুল শিখে, হেসে
খেলে কাটিয়ে দিয়েছে কত কত মানুষ। আকাশের একটা তারাও তার কম পড়েনি। কিন্তু নতুন
কবির অনেক দায়।
কোনও কবির রচনায় যদি অসামান্য ডিকশান,
সিনট্যাক্স ইত্যাদির পরিচয় পাওয়া যায়, যেমনটা আমরা স্বদেশ সেনের, জীবনানন্দের,
উৎপলের কবিতায় পেয়েছি, তবে বুঝতে হবে কবির অন্তর্লোকের বাসগৃহটি সেভাবেই নিজস্ব
সম্ভারে সজ্জিত হয়ে আছে, যা প্রভাবিত করেছে কবিতার সকল অনুষঙ্গ, ভাষা, শব্দচয়ন ও
বাক্যবিন্যাসকেও। একজন কবিকে তার নিজস্ব বসবাসের
গৃহটাই প্রথমে তৈরী করে নিতে হয়। কিছুটা অলক্ষ্যে হয়, জীবনযাপনে হয়, কিছুটা সজ্ঞান
প্রচেষ্টায়। বিনয়ের একটা কবিতায় আছে—“সৃষ্টির পূর্বাহ্নে দেখ নিজেকেই সৃষ্টি করা
প্রয়োজন হয়”। এভাবেই গড়ে ওঠে কবির
বিশিষ্টতা। না, কবিকে কবিতার শ্রমিক বলা সাজে না ; শ্রমিক মূলতঃ আজ্ঞাধীন।
শূন্যকাল - নতুন কবিতা, অংক কবিতা, ভিস্যুয়াল পোয়েট্রি, না কি দৃশ্যত একক থেকেও
দৃশ্য তৈরী করা কোনটাতে বিশ্বাস করেন, না কি দুটোতেই? পরীক্ষামূলক কবিতার সাথে সনাতন কবিতার আদৌ কোনো পার্থক্য আছে বলে বিশ্বাস
করেন? সনাতন কবিতাকেও পরীক্ষামূলক ভাবে প্রেজেন্ট করা নিয়ে আপনার মতামত...
শ্রী লাহিড়ী – যৌথ কবিতা, অংক কবিতা(?), ভিশ্যুয়াল কবিতা--- এভাবে অনেকে ভাগ করেন। সমালোচকরা করেন আলোচনার বা রেফারেন্সের
সুবিধার জন্যে। এগুলোর সবই কবিতা না হলেও, কবিতাকে নিয়ে এক ধরণের পরীক্ষামূলক কাজ।
কিছুটা পথভ্রান্ত, কিছুটা গিমিক। তবু
কখনো ক্ষণিকের উদ্ভাসে চমৎকৃত করতেও পারে। তবে এগুলো দিয়ে বড় কাজ হয় না, যা সময়ের
মুখোমুখি দাঁড়ায়, বা সাথে নিয়ে চলে। যৌথ কবিতায়---দুজনে মিলে একটিই মেয়েকে প্রেম
করার মতো----আমার কখনো আস্থা ছিল না। আমি কবির একক রচনাতেই উৎসাহ রাখি। সমস্ত
উৎকৃষ্ট শিল্পরচনাই পরীক্ষামূলক, সমস্ত মহৎ কবিতাও সেভাবেই লিখিত হয়। বাঁধাধরা পদ্ধতি
বা কোনও অনুশাসন মেনে তাকে রচনা করে গেলে, ক্রমে তা মূল্যহীন হয়ে পড়ে।
সাধারণ পাঠকের কাছে স্বীকৃতি পাওয়াকে আমি
কোনও শিল্পের উৎকর্ষতার প্রমাণ মনে করিনা। রবীন্দ্রনাথ শেষ বয়সে কেন তাঁর কবিতা
‘গেলেও বিচিত্র পথে, হয় নাই সে সর্বত্রগামী” বলে আক্ষেপ করেছিলেন, জানিনা। সাধারণ
পাঠক সাধারণ কথায়, সাধারণ রসের আস্বাদনেই আমোদিত হয়। নানা তুচ্ছ কারণে কত কিছু
এঁদের ভালো লাগতে পারে। এরা আমোদগেঁড়ে। কিন্তু কবিতা
উৎকৃষ্ট চিত্তের ফসল। পরিশীলিত পাঠকের কাছে সেই কাজ স্বীকৃত হ’ল কিনা সেটাই
বিচার্য। সনাতন কবিতার পাশে আজকের লেখা উৎকৃষ্ট কবিতা সঙ্গত কারণেই স্বাদে, গঠনে,
আঙ্গিকে, ভাষায়, অনেকটাই পৃথক। তবে পৃথক হলেই নতুন হয়না। অনেক নিকৃষ্ট কবিই নিজের
অক্ষমতাকে আড়াল করতে আগড়ম-বাগড়ম লিখে পরীক্ষামূলক নতুন কবিতা বলে চালাতে চান ; তার
জন্য সেই মাপের বেশ কিছু পাঠকও জুটে যায়।
এসব
থেকে দূরত্ব বজায় রাখা দরকার।
শূন্যকাল – আশির দশকের সমকালীন কবিতা সম্বন্ধে আপনি কি
ভাবেন? আসলে যখন লেখা, সে গদ্যই হোক বা কবিতা কিছু অর্থে বাজারি হতে
আরম্ভ করছে,
তার কিছুদিনের মধ্যেই
নবারুণ ভট্টাচার্যের মতে বণিকেরা লেখকদের উদ্ভাবন করবেন, সেখানে বাজারকে অস্বীকার
করে এই পথ খোঁজা কতটা কঠিন ছিল?
শ্রী লাহিড়ী – প্রকৃত কবিকে বাজারের মুখ চেয়ে, বা প্রতিষ্ঠানের হাত
ধরে থাকতে হয় না। তিনি লেখেন নিজের অন্তর্জগতের সাথে যুক্ত থেকে, প্রধানতঃ নিজেরই
জন্য। আরও সমর্পিত, আরও
অন্বেষণ, ক্রমে নিজেকেই ছাপিয়ে যাওয়া। তবে সব বাজারই যে খারাপ, তা নয়। আমাদের
দেশের বিপুল জনসংখ্যার বাজারে, সাহিত্যের শিক্ষিত রুচিশীল মেধাবী পাঠক সর্বদাই
সংখ্যালঘু। পাশ্চাত্য দেশের বই-বাজারে শিক্ষিত পাঠক কিন্তু বিপুলভাবে সংখ্যাগুরু।
সেখানে ব্যাপারটা অন্য রকম। এদেশের সাহিত্য-বণিকরা তাই সংখ্যাগুরু পাঠককুলের রুচির
উপযোগী কবি ও লেখকদের প্রমোট করতে বাধ্য হন, ব্যবসার খাতিরেই। এবং লবি ছাড়া, খূঁটির জোর ছাড়া, উঁচু মহলে
ওঠাবসা ছাড়া বড় পুরস্কারগুলোর শিকেও ছেঁড়ে না। আপোসহীন অনেক যোগ্য কবিই তাই আকাদেমি
পুরস্কার পেয়েছেন বৃদ্ধ বয়সে, মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে। এটা অনেকের কাছে খুবই
অপমানের, আমাকে জানিয়েছিলেন কবি আলোক সরকার।
সেকালে (১৯৮২) সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের
একটা আলাপচারিতা থেকে তোমাকে পড়ে শোনাই। কৌরবের
আড্ডায় আমিই সেই অডিও-রেকর্ড করেছিলাম। সন্দীপন বলছেন : “কৌরব হচ্ছে প্রথম বাইরে
থেকে বেরোনো কাগজ যা সকলকে বিস্মিত করে দিয়েছে। স্তম্ভিত করে দিয়েছে। কৌরব অবাক
করতে পারে। সবাইকে করেছে। সব্বাইকে। না, বাইরে থেকে বেরোনোর ব্যাপারে বলছিই না।
কৌরব প্রথম হাতে নিয়েই বিস্ময়, বাংলা ভাষায় এ কী করে হয়। না, এরা (প্রতিষ্ঠান) তো
কিছু বলবে না। বলতে পারে না, এরা তো আর্টি পেপার। তোমাদের নিয়ে লিখলে ওদের ক্ষতি
হত। ওদের পক্ষে ক্ষতি এই হত যে, ওরা তো-- কোনও যদি লিগ্যাসি না থাকে, তাকে তো ওরা
সঙ্গে রাখে না। লিগ্যাসি বলতে—ওরা মোটামুটি লেখা পড়ে বুঝতে পারবে যে এ আমাদের লোক
না। এবং এখানে দাম দিতেই হবে, সে তুমি যদি ওদের জুতো পালিশও করো”।
অথচ দেখো, কৌরব তো ছিল একটা প্রান্তিক
কাগজ, বাংলার বাইরে। ১৯৭৭ সালের শেষেই যেটা বন্ধ হয়ে যেতে বসেছিল। সেরকম একটা সময়ে আমি কৌরবে যোগ দিই। এবং আশির
দশকে এসেই কি যেন চমৎকার ঘটে গিয়েছিল, বাংলাভাষার নামী কবি-লেখক-শিল্পীদের প্রায়
সকলেই তখন কৌরবে লিখতে চেয়েছেন, লিখেছেন, লিখে গর্বিত হয়ে অন্যদের জানিয়েছেন।
তাঁদের অনেকেই বড় বড় প্রতিষ্ঠানের নমস্য লেখক। এটা কীভাবে সম্ভব হয়েছিল, ভেবে
দেখো। আমাদের পত্রিকার সৃজনশীলতার ভান্ডার দেখেই তো? সম্পাদক কমল চক্রবর্তীর
ব্যক্তিগত কারিশমাও ছিল, কিন্তু সে তো আগেও ছিল। নানা দিক দিয়ে তাই আশির দশকই
কৌরবের স্বর্ণ যুগ। কিন্তু প্রতিষ্ঠান আমাদের কাগজ নিয়ে বিশেষ লেখেনি। তবে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
‘দেশ’-পত্রিকায় আফশোস করে লিখেছিলেন, ‘বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ লিটিল ম্যাগাজিনটা
বেরোয় বাংলার বাইরে থেকে’।
শূন্যকাল – এই যে বাংলা কবিতায় পাশ্চাত্য প্রভাব নিয়ে
আগেও কিছু সমালোচক সরব ছিলেন, এখনও
আছেন, সে নিয়ে আপনার কি মনে হয়? জীবনানন্দের সময় পেরিয়ে আসার এতদিন পরেও ওঁর
মত আধুনিকতা নিয়ে বাংলার কালচারাল বা প্রকৃতিপূর্বক লেখা খুব কমই হয়েছে, তার চেয়ে সামান্য এক্সোটিক কিছু লেখার
মেটিরিয়াল যদি পাশ্চাত্য নির্ভর হয় তাতে ক্ষতি আছে কি?
শ্রী লাহিড়ী – দেখো, সাহিত্য শিল্প জিনিষগুলো তো গ্রহণ বর্জনের
মধ্য দিয়েই নতুনতর হয়। বিকশিত হয়। এতে চেতনার
প্রসার ঘটে। রুচির পরিবর্তনও হতে পারে। তবে নিজেদের শিকড়কে উপড়ে ফেলে তো নয়। অসৎ
না হলে, সেটা সম্ভবও নয়। ভিন্দেশের সাহিত্য-সংস্কৃতির প্রভাবকে নিজের কাজে
লাগানোর জন্যে যথেষ্ট মেধা ও মুন্সিয়ানা প্রয়োজন। বিশেষতঃ কবিতায় যেভাবে
অ্যাবস্ট্রাকশান নির্মিত হয়। রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ, --সবারই লেখায় পাশ্চাত্যের
অনেক প্রভাব তো আছেই। ইউরোপে সঙ্গীত,
চিত্রকলা, চলচ্চিত্র, সাহিত্য সবই পরস্পরকে প্রভাবিত করেছে। ওদেশে কবি ও লেখকদের
বন্ধু ছিলেন সংগীতকার, পেন্টার, চলচ্চিত্র পরিচালক ও অন্যান্য শাখার মানুষরা।
জীবনকে নানা বৃত্ত থেকে, নানাভাবে তাঁদের দেখার সুযোগ হয়। এই ব্যাপারগুলো এদেশে খুব
দেখিনা। বামপন্থী আন্দোলনের সময়কালে,
পঞ্চাশ-ষাটের দশকে, আইপিটিএ-র সুত্রে নাটক-সঙ্গীত-সাহিত্যের কিছু মানুষ কাছাকাছি এসেছিলেন। কিন্তু মুক্তচিন্তার
স্বাধীনতা সেখানে ছিলনা। স্বদেশ সেন কম্যুনিস্ট পার্টির কার্ড হোল্ডার হয়েও একসময়ে
পার্টি ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিলেন, স্বাধীনভাবে লিখতে চেয়ে। এই বিষয়গুলো আমরা কবিতার
ক্যাম্পে আলোচনা করেছি।
আমার ‘উত্তরমালা’ ছবির শুরুতেই কবি ও
প্রাবন্ধিক সমীর রায়চৌধুরী বলেছেন : ‘আমেরিকান কবিতার তুলনায় বাংলা কবিতা অনেক
বেশি গভীর, ঋদ্ধ, তবু স্বভাবদোষে বাঙ্গালী হীনমন্যতায় ভোগে’। কিন্তু আমার মনে হয়েছে, আজকের বিশ্বায়নের
যুগে বাঙ্গালী কবি ও গদ্যলেখকের কবিতা ও গদ্য ক্রমশঃ পিছিয়ে পড়ছে, বর্ণময়
উৎকর্ষতার অভাবে। গোড়ায় যার কারণ, সম্ভবতঃ, প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার ব্যাপ্তির অভাব,
বহুমাত্রিক চেতনার অভাব, --এক কথায় কূপমন্ডুকতা। আজকের কবিতায় কেউ মন্দিরের ঘন্টার
বদলে রিং-টোন লিখলে, সেগুন পাতার বদলে মেপ্ল পাতা লিখলে, সরষে বাটার বদলে মেয়নিজ
সস্ বললে কবিতা নতুন হয়ে উঠলো মনে করেন। কেউ
কেউ ‘কবিতার শত্রু’ বলে চিহ্নিত করেন বিজ্ঞানীকে, দার্শনিককে, নাট্যকারকে, গায়ককে!
এর বিপরীতে, আমি বলতে চেয়েছি বিভিন্ন কর্মক্ষেত্র ও পেশার সাথে পরিচিত হওয়ার,
জীবনের ব্যাপ্তি ও বিস্তারকে অনুভব করার প্রয়োজনীয়তার কথা। বাংলা কবিতার সহজকে
ছেড়ে সময়ের নতুন ও গভীর জটিলতার সন্ধানে যেতে হবে কবিতাকে। আমার কবিতায় সেভাবেই
আমি মনোযোগ দিয়েছি। আমার কবিতাকে কেউ বলেছেন ‘উত্তরাধুনিক’, কেউ বলেছেন
‘অতিচেতনার’, কেউ বলেছেন ‘টোটাল কবিতা’, কেউ বলেছেন ‘ধারামুক্তির’। এইসব ক্লাসিফিকেশান মূলতঃ এসেছে পাশ্চাত্য
প্রভাবে। এগুলো কবি ও পাঠককে বিভ্রান্ত করে।
শূন্যকাল – সেক্ষেত্রে শুধুমাত্র আক্ষরিক অনুবাদ ছাড়া
একটা মোড ধরে রেখে নিজস্ব কাজ করে যাওয়া মানে অন্য অর্থে পাঠককেও সেই পাশ্চাত্য
ফ্লেভার নিজের মত করে দেওয়া নয় কি? কারণ অনুবাদের কাজে নিজস্ব সৃষ্টিশীলতা ঢাকা
পড়ে যায় মাঝারি মানের অনুবাদকদের মধ্যে এটাও তো প্রাচীন প্রবাদ।
শ্রী লাহিড়ী – কবিতার অনুবাদ কখনোই আক্ষরিক করা চলে না। করলে সেটা
আর অনুবাদও নয়, কবিতাও নয়। অনেক শব্দ আছে যার বাংলা প্রতিশব্দ নেই, অনেক আচার-ব্যবহার,
সমাজ ব্যবস্থা, প্রবচন, ইত্যাদি আছে যা
অন্য ভাষা-সংস্কৃতিতে একেবারে অপরিচিত। সেখানে যতটা সম্ভব মূল অনুভবটুকু,
বিমূর্ততা সমেত, নিজের ভাষায় যদি নিয়ে আসা যায়, তবে পাঠক তার স্বাদ-গন্ধের কিছুটা
আভাস পায়। সবুজ ঘাসের ওপর মেপ্ল গাছের রক্তিম পাতা ঝরে পড়ে আছে চারিদিকে, -এই
দারুণ দৃশ্য আমি দেখেছিলাম মিশিগান প্রদেশে। তার সাথে বসন্তে সিংভূমে শাল-সেগুনের
পাতাঝরা দৃশ্যের কিছু মিল থাকলেও দুটি দৃশ্যের ঐশ্বর্যের মধ্যে ভাবগত পার্থক্য
অনেক। অনুবাদককে যেতে হয় এইসব উপলব্ধির মধ্য দিয়ে। আমরা যারা ফরাসি, জার্মান, বা
স্প্যানিশ কবিতাকে ইংরিজী বা বাংলা অনুবাদে পড়েছি,-- আসল কবিতাগুলো সত্যিই কেমন তা
জানতেও পারিনি। ভাষার এইমতো সীমাবদ্ধতা। একে কিছুটা পেরিয়ে ওঠা সম্ভব, কিন্তু তা
সময় ও পরিশ্রমসাপেক্ষ। এবং এটাও একটা ক্রিয়েটিভ চ্যালেঞ্জ। এর জন্য চাই দুদিকেরই
ভাষা-সাহিত্য-ইতিহাস, ধর্ম-বিশ্বাস-সংষ্কার, লোকাচার-রূপকথা-প্রবচন, সময়-ব্যবস্থা,
ইত্যাদি সম্পর্কে জ্ঞান, ও অনুভবের আন্তরিকতা।
শূন্যকাল – এবার কৌরব প্রসঙ্গে আসা যাক। কৌরব গোষ্ঠীর
একেবারে প্রথম দিককার অ্যাক্টিভ সদস্য হিসাবে আপনাকে দেখেছে পাঠক। বহুদিন ধরে
যুক্ত। কৌরবের সেই সময়কার দিনগুলোর যে স্টিল ছবি বা মুভি ক্লিপিংস আপনার
ডকুমেন্টারি বা শর্টফিল্মগুলোতে দেখি তা কি পূর্বপরিকল্পিত?
শ্রী লাহিড়ী – না, পুর্বপরিকল্পিত নয়। সিনেমা করবো কখনো
ভাবিনি। আমার প্রথম ছবি ‘রাখা হয়েছে কমলালেবু’-র মেকিং বা নির্মাণকাহিনীতে এগুলো
নিয়ে বলেছি। লেখাটা ‘কবি সম্মেলন’ পত্রিকায় বেরিয়েছিল কয়েক মাস আগে (মার্চ ২০১৭)। আসলে জীবন সম্বন্ধে, সৌন্দর্য সম্বন্ধে,
সৃজনশীলতা সম্বন্ধে আমার কিছু প্যাশানেট পছন্দ ও উপলব্ধি আছে। আমি একটা দৃশ্যকে,
ঘটনাকে, অঙ্কনকে, অভিজ্ঞতাকে নিজের মতো করে বিনির্মাণ করবো, তার শব্দ, গন্ধ, রঙ,
রূপ, ছবি, কথা, সঙ্গীত--- সবই আমি ধরে রাখবো নিজের মতো করে, তাদের সম্পর্কগুলোকে
ভেঙ্গেচুরে সাজিয়ে বাজিয়ে বুঝবো, দেখবো, খেলবো, ব্যবহার করবো। এই আর কি। এইসব
মিলিয়ে মিশিয়ে একটা ক্রিয়েটিভ পরিমন্ডলের ভেতরে নিজেকে সবসময় রাখা। এভাবেই
জীবনযাপন।
শূন্যকাল – স্বদেশ সেন, কমলকুমার, বা সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় বা আরও
অনেক বিখ্যাত মানুষের সাথে কাটানো দিনগুলো, রাতগুলো বহুলাংশে আপনার তথ্যচিত্র বা
শর্টফিল্মগুলোতে দেখি, তবে আরেকবার ফিরে পেলে ওঁদের কি প্রশ্ন করবেন যা তখনও ওঁদের
কাছ থেকে জেনে উঠতে পারেন নি?
শ্রী লাহিড়ী – সমীর রায়চৌধুরী মৃত্যুর কিছুদিন আগে আমার
কাছে আফসোস করে বলেছিলেন, ‘তুমি যদি আর দশ-বারো বছর আগে আমার কাছে আসতে তবে কৃত্তিবাসের কবিদের
নিয়ে তোমাকে বলতাম একটা ছবি করতে, আমি শক্তি সুনীল দীপক সন্দীপন শ্যামল সবাইকে
নিয়ে, সারা কলকাতা মাতিয়ে রাখতাম সেই ছবি দিয়ে’। সমীরদা তাঁর ব্রহ্মপুরের বাড়ির বারান্দায়
শীতের রোদে খাটিয়া পেতে বসা বন্ধুদের গ্রুপ ছবি দেখিয়ে আমায় বলেছিলেন ওই কথা। ‘উত্তরমালা’
ছবির শুরুর অল্পকাল আগে থেকেই অসুস্থ ছিলেন উৎপলকুমার বসু, কিছুদিন পরেই তাঁর মৃত্যু
হয়। ওঁকে ফিরে পেলে ছবিটাকে
আরও মুল্যবান করা যেত। ছবি সম্পূর্ণ করেও সমীরদা ও আলোক সরকারকে---ওঁরা দুজনেই
ছবিতে অংশ নিয়েছেন---ছবিটা দেখানো যায়নি ; তাঁরাও প্রয়াত হন। সমীরদা আজকের কবিদের লেখা নিয়ে ভালোমন্দ অনেক
কিছু বলতে শুরু করেছিলেন। ছবির কাজের ফাঁকে সবটা শোনার সময় হয়নি। আজ আবার তাঁকে
পেলে সেসব শুনে নিতাম। তবে স্বদেশ সেনকে খুব মিস করি এখন। ওঁর সাথে কবিতার
ক্যাম্পগুলোয় দীর্ঘদিন নানা আলোচনায় কেটেছে, উনি যখন ওঁর শ্রেষ্ঠ কবিতাগুলো লিখছেন। এছাড়াও ভাবনায় রয়েছে আমার পরের ছবি নিয়ে। এখনও
ছবিটা কী নিয়ে হবে, তার কিছুই ঠিক করিনি আমি। একদিন সেই অজানা ছবিটাও করে ফেলবো-- শুধু
এই শিহরণটুকু।
শূন্যকাল – কৌরবের দিনগুলোতে সময়ের থেকে অতটা এগিয়ে
থেকেও কিছু ক্ষেত্রে হয়ত বা যোগাযোগব্যবস্থা বা টেকনলজির সাহায্য থেকে কিঞ্চিৎ
বঞ্চিত হয়েছেন,
এখনকার ফেসবুক বা
ইন্টারনেট থাকলে কি সুবিধে হত বলে মনে হয়, না কি কিছু সময়ের অপব্যবহার থেকে মুক্তি
পেয়েছেন?
শ্রী লাহিড়ী – দেখ, আমার শৈশবে আমি প্রথম লেখা শিখি খাগের
কলম দিয়ে। সারা রাত জলে ভিজিয়ে, সকালে তাকে ছুরি দিয়ে ঠিকমতো কেটে পেনের মত
দোয়াতের কালিতে ডুবিয়ে লিখতে হত। বাবার কাছে শিখেছিলাম। এখন টাচ্-স্ক্রীনে শুধু আঙুল বুলিয়েও ছবি আঁকা যায়। আমি যখন ইঞ্জিনীয়ার হয়ে
টাটাস্টীলে যোগ দিই, তখন সব অংকটংক করতে হত ‘ফ্যাসিট্’-মেশিনে, যেটা দেখতে ঠিক
টাইপরাইটারের মতো। তাতে বোতাম টিপে টিপে আর হ্যান্ডেল ঘুরিয়ে বড় বড় যোগ বিয়োগ গুণ
ভাগ করতে হত। তখনও ক্যালকুলেটর বাজারে আসেনি। পার্সোনাল কম্পিউটার এদেশে আসার সময়ে
টাটাস্টীলে আমাদের সড়গড় করার জন্যে দশ-বারোটা ছোট্ট পোর্টেবল ‘অরিক’ কম্পিউটার কিনে
লাইব্রেরীতে রাখা হয়েছিল, যেগুলো বাড়ি নিয়ে যাওয়া যেত। ওগুলোর
নিজস্ব মনিটর ছিল না ; টিভির সাথে
তারযুক্ত করে ব্যবহার করতে হ’ত। সেটা বোধহয় ১৯৮৫-৮৬ সাল। আমি শনিবার লাইব্রেরীতে সবার
আগে গিয়ে নিজের নামে সেটা ইশু করে, বাড়িতে এনে, উইকএন্ডে রাত জেগে কাজ করতাম। মজার
মজার প্রোগ্রাম লিখতাম বেসিক ল্যাঙ্গুয়েজে। ছোট ছোট গেম্স। তার মধ্যে একটা ছিল
‘প্রে-প্রিডেটর’ মডেল। তোমরা যারা বিষয়টা জানো, তারা বুঝবে, -ওই মডেলটা আমাকে
প্রাণীজগতের বাঁচা-মরা ও নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার বিষয়ে একটা দারুণ অন্তর্দৃষ্টি
দিয়েছিল। সেটা একটা নিজস্ব মাইলস্টোন। পরবর্তী কালে আমি সবসময়ে চেষ্টা করেছি
প্রযুক্তির ক্রমোন্নতির সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবার নিজেকেও পুনোরাধুনিক করে নেওয়া। ১৯৭৫
সালে কর্মক্ষেত্রে যে কাজটা আমি দু’মাসে শেষ করেছি, ২০০৫ সালে তার চেয়েও অনেক বেশি
জটিল কাজ আমি দু’তিন ঘন্টায় শেষ করতে পেরেছি। প্রযুক্তির এতটাই ভূমিকা।
আশির দশকে কৌরবের প্রচ্ছদ এঁকেছি চাইনিজ
ইঙ্ক দিয়ে ট্রেসিং পেপারে, তারপর তার ব্লক বানাতে দিয়েছি। সুবর্ণরেখা নদী পেরিয়ে
‘মানগো’-তে যিনি ব্লক বানাতেন তাঁর নাম ‘খামারু’। সেই খামারুর দোকানে দোতলায় ধরনা
দিয়ে একদিন ব্লক হাতে পেয়েছি। পরে সেই ব্লক নিয়ে গিয়েছি ছাপাখানায়। আরও পরে, যখন
উন্নত কম্পিউটারে আমি প্লান্ট-লেআউট ডিজাইন করছি, তখন ‘অটোক্যাড’-এ কৌরবের
সম্পূর্ণ প্রচ্ছদ এঁকে প্লটারে প্রিন্ট নিয়েছি ; সেটা ছিল কৌরবের বিখ্যাত ‘পাগলা
সংখ্যা’ (মে ১৯৮৯)। এখন আমার ল্যাপটপে নিজের বইয়ের পুরো প্রচ্ছদ ডিজাইন ক’রে কয়েক
ঘন্টার মধ্যেই ই-মেল করে প্রেসে পাঠিয়ে দেওয়া যায়। ব্লক বানানোর ঝামেলাই নেই। মনে আছে,
কমলকুমার মজুমদার কৌরবের জন্য ‘এসো মা আনন্দময়ী’-প্রচ্ছদ এঁকে (কৌরব-২২, ১৯৭৮) পরে
তার ছাপা দেখে মনঃক্ষুণ্ণ হয়ে চিঠি লিখছেন— ‘রঙ ঠিক হয় নাই, ব্লকেও অনেক আঁশ
রহিয়াছে’। ইন্টারনেট আসায় অনেক
সুবিধে হয়েছে অবশ্যই। বিশ্বায়নের যুগে কে কীভাবে কতটা তাকে ব্যবহার করতে পারছে,
দিশা না হারিয়ে, সৌন্দর্যবোধ না হারিয়ে, সেটাই দেখার। এখনকার অনেক ম্যাগাজিনে
ফটোশপে করা প্রচ্ছদ দেখে বোঝা যায় প্রযুক্তি সহজলভ্য হয়েছে, কিন্তু চিত্রকলা বিষয়ে
শিক্ষার অভাব, দর্শনের অভাব।
গড়ে
ওঠেনি রুচিবোধ, শিল্পবোধ, কোনও সচেতন প্রয়াসও নেই। এক কথায়, অশিক্ষিত পটুত্ব।
শূন্যকাল – স্বদেশ সেন, উৎপল কুমার বসু, বিনয় মজুমদার
বা সেই সময়কার আরও অনেক লেখক, নাম করতে গেলে বেশ দীর্ঘ হয়ে উঠবে এই তালিকা, সবার
প্রতি সম্মান জানিয়েই জানতে চাইছি, এঁরা ছাড়া এই যে বাকি কবিদের যে পাঠককূল, তা
নিয়ে মতামত... মানে আপনি বা কৌরবের আপনার সময়কার লেখক, কবিরা চিরকালই তো প্যারালাল
ওয়ার্ল্ড লিটারেচারের সাধনায় মগ্ন ছিলেন, সেই হিসাবে এই বাজারি লেখক বা কবিকূলের এই পাঠককূলের কাছে
আপনাদের সাহিত্যের পাঠক সেইভাবে তৈরি করতে না পারাকে কি ব্যর্থতা হিসেবেই দেখবেন? সেখানে কোনো গাফিলতি দেখতে পান কি? যদিও
কবিতার পাঠক বরাবরই কম, তা’ও কোনো রকম রেজিমেন্টেড নীতি কি নেওয়ার কথা ভাবেন নি
কখনও?
শ্রী লাহিড়ী – দেখো, এই ‘প্যারালাল ওয়ার্ল্ড লিটারেচার’ জিনিষটা একটু
গোলমেলে। এটা দিয়ে সহজে কয়েকটা ব্যাপার কমিউনিকেট করা যায় বলে অনেকেই এই শব্দবন্ধ
ব্যবহার করে থাকেন। কিন্তু এতে বণিকশ্রেণী বা রাষ্ট্রব্যবস্থার নিজের পছন্দের
সাহিত্যকে আলাদা স্বীকৃতি দেওয়া হয়। আমার মতে মেইন-স্ট্রীম আর প্যারালাল ওয়ার্ল্ড,
দুই মিলিয়ে একটাই বিচার্যবিষয়, সেটা হল সাহিত্যিক উৎকর্ষ। তার একটাই মাপকাঠি হওয়া
উচিত। এর জন্যে চাই একটা উন্নতমানের সাহিত্য-আলোচনার পরিসর, যা স্বাবলম্বী, যা
প্রতিষ্ঠান পরিচালিত নয়, যেখানে দুই ওয়ার্ল্ডের সব ফসলকে এক জায়গায় ফেলে মূল্যায়ন
করা যায়। আমি বছর চারেক আগে একবার দেশ-পূজা সংখ্যা হাতে পেয়ে, তার সমস্ত কবিতা পাঠ
করে, আমার ভালো লাগা অনুসারে ১ থেকে ১০এর মধ্যে নম্বর দিতে গিয়ে, সবচেয়ে বেশি
নম্বর দিয়েছিলাম ২.৭, অর্থাৎ ৩-এর কম।
কবির কাজ কবিতা লেখা, অনুগত পাঠককুল তৈরী
করা নয়। যদি না তাঁর নিজের অস্তিত্বের সংকট থাকে। তবে পরিশীলিত পাঠকের
পাঠ-প্রতিক্রিয়া জানা কবির কাছে জরুরী। কবিতা হয় অনেক রকমের। মদের মতোই। যাঁরা
শ্যাম্পেনে রুচি রাখেন, আর যাঁরা বাংলা মদে, দুজনেই নিজের মতো করে উপভোগ করেন
তাঁদের পছন্দের পানীয়। তবে তাঁরা এক টেবিলে
বসেন না। এই আলাদা টেবিল সঙ্গীত-নাটক-চলচ্চিত্র-চিত্রকলা কোথাও এভাবে নেই, যেভাবে
এই জিনিষটা অধুনা বাংলা সাহিত্যচর্চার আসরে দেখা যায়। এটা কিছুটা গোষ্ঠীবদ্ধ রুচির পরিচয়, এই নিয়ে কোনও বিবাদ সঙ্গত নয়। সময়ের সাথে সাথে এই
কোঁদলগুলো মুছে যাবে। লিটিল ম্যাগাজিনের জগতে নানাভাবে ‘রেজিমেন্টেড দখলদারি’ ও
পরীক্ষানীরিক্ষার নামে কবিতার ‘যাচ্ছেতাই অবস্থা’ লক্ষ্য ক’রে শেষ বয়সে স্বদেশ সেন
তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন। বলেছিলেন, ‘অনেক কবি ও কবিতার ক্ষতি হয়ে গেছে, এবার এগুলো
রুখে দেওয়া দরকার’। তবে সময়ের সাথে সাথে ক্রমে
শুভবুদ্ধি ও সাহিত্যবোধের জয় হচ্ছে।
সৎ
এবং রুচিমান সম্পাদক ও পাঠকরা জানান দিচ্ছেন তাঁদের অস্তিত্ব। নতুন কবির কাজ তাই নিজ
অন্বেষণে অবিচল থেকে, বিশ্বপ্রাণপ্রকৃতির বহমান শব্দ-বর্ণ-সুরকে উপলব্ধি ক’রে সাহিত্য
সৃষ্টি করা। অনুগত পাঠককুল তৈরী করা নয়।
শূন্যকাল – এবার তথ্যচিত্র প্রসঙ্গে আসা যাক। ফটোগ্রাফি, ডকুমেন্টারি নিয়ে অনেক উল্লেখযোগ্য কাজ
করেছেন আপনি,
কিন্তু কবিতা, গদ্য মানে সাহিত্য যতটা মৌলিক ব্যাপার, ফটোগ্রাফি বা ডকুমেন্টারি কি ততটাই মৌলিক? মানে জানতে চাইছি সেখানে প্রত্যক্ষভাবে তো
কিছুক্ষেত্রে টেকনোলজির সাহায্য নিতে হয়, সে ক্ষেত্রে মনে হয় না কি যে, কিছুটা হলেও পাথ বদল করতে হচ্ছে টেকনলজির
স্বার্থে? আবার এমনও হয় না কি যে টেকনোলজি নতুন কোনো
দিশা খুলে দিল?
শ্রী লাহিড়ী – সাহিত্যের মতোই ফটোগ্রাফি, ডকুমেন্টারী, সব মাধ্যমেই মৌলিক কাজ অবশ্যই সম্ভব।
তবে প্রকৃত অর্থে পৃথিবীতে কোনও কাজই মৌলিক নয়, হওয়া সম্ভবই নয় ; কারণ আমরা সবাই
বিশ্বব্যাপী সম্পর্কজালে এমনভাবে বাঁধা পড়ে আছি, আর সবসময়েই, সারা জীবন ধরেই, চলছে
কত মানুষের সাথে কত শত তথ্যের, আইডিয়ার আদানপ্রদান। এবং বস্তু জগতেও আমাদের
সর্বক্ষণ সবার সাথে যুক্ত করে রেখেছে বাতাস, যাকে আমরা প্রত্যেক শ্বাসে নিজের
ভেতরে নিচ্ছি। -টেকনোলজিকে কাজে লাগিয়ে অনেক নতুন মাত্রা আনা যায় সব রকমের
রচনাতেই। তবে টেকনোলজির স্বার্থে বড় রকমের ‘পাথ বদল’ করার কোনও যুক্তি নেই। বিশ্বের
অনেক ক্লাসিক ও কালজয়ী সিনেমা তৈরী হয়েছে কম খরচে, নীচু মানের সাধারণ ক্যামেরায়,
শাদা কালো ছবিতে।
শূন্যকাল – তথ্যচিত্রে যে সাউণ্ডট্রাক বা গান বা আবহ
ব্যবহার করেন সেক্ষেত্রে দেখা যায় তা বেশ অভিনব, সেক্ষেত্রে যে ভয়েস ওভার রেকর্ড
করা থাকে সেগুলো কি কোনো অংশে মনে হয় আরও ভাল টেকনলজি থাকলে আরও উন্নতমানের হয়ে
উঠতে পারত?
শ্রী লাহিড়ী – আমার প্রথম ছবিতে, বিশেষতঃ কবিতার ক্যাম্পের কথোপকথন অংশে,
শব্দগ্রহণ উন্নত মানের ছিল না, কারণ সেগুলো সাধারণ অ্যানালগ রেকর্ডারে ৩৫-বছর আগে
রেকর্ড করেছিলাম। সেটাকে এখন ডিজিটাল কনভার্সান করে যতটুকু সম্ভব উদ্ধার করা
গেছে। কিন্তু ছবিতে আমার কন্ঠে যে
ধারাভাষ্য (ভয়েস ওভার) রয়েছে, সেটা সঙ্গীতের ট্র্যাকের মতোই, আধুনিক স্টুডিওতে একই
দিনে, রেকর্ড করা। সবাই তার উচ্চ প্রশংসা করেছেন।
শূন্যকাল – এক্ষেত্রে পরবর্তী প্রজন্মের জন্য এগুলোর
আর্কাইভ করার কথা ভেবেছেন? ইউটিউব ছাড়া নন্দনে শো বা তেমন আরও কিছু কি আরও
ফ্রিকোয়েন্টলি করা যায় না? সেক্ষেত্রে পরবর্তী প্রজন্ম আরও অনেক বেশী করে তা দেখার
সুযোগ পায়।
শ্রী লাহিড়ী – দেখো, এসব ছবি সম্পূর্ণ আমার নিজের সঞ্চয়ের
অর্থে করা। কারণ এগুলো করা প্রয়োজন মনে করেছি। কৌরবের জন্য, আজকের তরুণ প্রজন্মের
জন্য এবং আগামী কালের জন্য। ‘রাখা
হয়েছে কমলালেবু’-ছবির প্রিমিয়ার হয়েছিল কলকাতার নন্দন প্রেক্ষাগৃহে, এবং পরে
জামশেদপুরের বিখ্যাত ‘সেন্টার ফর এক্সেলেন্স’ অডিটোরিয়ামে। ছবির ডিভিডি প্রকাশ
করেছি এবং অমিতাভ প্রহরাজের সৌজন্যে ছবিটা এখন ইন্টারনেটেও অনেকে দেখছেন। এভাবেই
এটা আর্কাইভ্ড হয়েছে। পরবর্তী কালের কবিরা খোঁজ করলে দেখতেও পাবে। দ্বিতীয়
ছবিটারও আর্কাইভাল ভ্যালু অনেক, কারণ নয়জন কবি এতে অংশ নিয়েছেন, যার মধ্যে আছেন
মণীন্দ্র, সমীর, আলোক।
তবে এগুলো তো জোর করে কাউকে বসিয়ে দেখানোর
জিনিষ নয়, সে দায়ও আমার নেই, শুধু তাঁরাই দেখবেন যাঁরা সাহিত্য-শিল্প-চলচ্চিত্র-কবিতার
জগতের লোক, যাঁদের রুচি আছে, অন্বেষণ আছে নতুনের। কবি দেবারতি মিত্র ঠিকই বলেছেন,
‘যাঁরা বাংলা টিভি-সিরিয়ালের দর্শক, তাঁদের জন্যে এই ছবি নয়’। দশদিনব্যাপী বইমেলার
আড্ডা ছেড়ে, তারই মাঝে এক সন্ধ্যায় নন্দনে ছবিটা দেখতে অনেকেই আসতে পারেননি।
কিন্তু বইমেলার মোহ ছেড়ে, শুধু ছবিটা দেখার জন্যে চিত্তরঞ্জন থেকে ভোরের ট্রেনে
কলকাতায় এসে, নন্দনে ছবি দেখে রাতের ট্রেনে আবার বাড়ি ফিরে গেছেন, এমন
কবিতা-প্রেমিক দর্শকও তো এসেছেন।
শূন্যকাল – জীবিত কাল্ট কবিদের নিয়ে আপনি যে কাজ করে
যাচ্ছেন, যেমন মণীন্দ্র গুপ্ত, তার মধ্যে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য কিছু করে যাওয়ার
তাগিদ, অথবা শুধুই সৃষ্টির আনন্দ?
শ্রী লাহিড়ী – ভবিষয়ৎ প্রজন্ম নিয়ে
আমার বিশেষ মাথাব্যথা নেই। তাদের প্রয়োজনীয় মদ মাংস তারা ঠিকই খুঁজে নেবে। আমার
মৃত্যুর পরে পৃথিবী কিভাবে চলবে, লোকে বেশি পাঁপরভাজা খাবে, নাকি জিরাফ পুষবে, আমি
জানতেও পারবো না। এগুলো
করে
যাচ্ছি প্রধানতঃ নিজের জানার আগ্রহে ও নতুন সৃষ্টির আনন্দে। স্বদেশ সেন বলতেন,
‘মিডিয়োক্রিটি আমি একদম সহ্য করতে পারিনা’। আমিও সেভাবেই। তবে বর্তমান প্রজন্ম,
যাদের আমার জীবনকালে দেখতে পাচ্ছি, তাদের কথা মনে রাখি, যারা কিছুটা আন্তরিক চেষটা
করছে। আমাকে কবি মণীন্দ্র
গুপ্ত বলেছিলেন ‘এইসব নিয়ে খুব ভালো সময় কাটবে আপনার’। তো সেটাই দেখার। সময়কাল
জুড়ে, কল্পনার আনন্দে, সৃষ্টির আনন্দে থাকা, এবং উচ্চ মহলে প্রশংসিত হতে পারা। এই
জার্নিটাই তো ডেস্টিনেশান, এই সবটা নিয়েই একটা অলৌকিক ট্রেক। নতুন সৃষ্টির জন্য,
নতুন কবিতার জন্য, এমনই এক জার্নি।
আমার মনে পড়ছে সেই যুবকের কথা, যার সাথে
আমার পরিচয় ছিল না কখনও। কিন্তু তার ভ্রমণকাহিনী
পড়ে যতটুকু জেনেছিলাম, নীলাকাশের নীচে তারও ছিল এক অলৌকিক ট্রেক। চন্ডিগড়-কুলু-মানালী পেরিয়ে, মানালি থেকে
লেহ অব্দি যে পথ গিয়েছে, সেই পথে এক ছোট্ট পাহাড়ি শহর-- দার্চা। এই দার্চা থেকেই
সে শুরু করেছিল হাঁটা। ব্যাকপ্যাকে ছিল শুধু
ক্যামেরা, ল্যাপটপ, জলের বোতল, ওষুধ, আর কিছু শুকনো খাবার। কোনও স্লিপিং ব্যাগ,
টেন্ট, বা রোড ম্যাপ ছিল না তার সাথে। এখান থেকে প্রায় দশ দিনের পথ পেরিয়ে, যাংস্কার-উপত্যকায়
পাদম নামে যে দুর্গম প্রান্তিক জনপদ, সেই অব্দি তার ট্রেক। কোনও দলের সাথে নয়,
প্রতিষ্ঠানের সাহায্য নিয়েও নয়, কোনও গাইডও ছিল না তার সাথে ; সম্পূর্ণ একাকি পথ
চলা, যা আজ অব্দি কেউ নাকি সাহস করেনি। কোনও প্রচার মাধ্যম জানতো না তার কথা। শুধু
দুর্গম গ্রামের মানুষগুলো, যারা প্রথমে শুনে বিশ্বাসই করেনি যে সে একা এসেছে এই
পথে, তাদেরই মুখে মুখে খবরটা ছড়িয়ে গিয়েছিল এক পাহাড় থেকে আরেক পাহাড়ে। বরফে ঢাকা
পাহাড়চূড়া, তীক্ষ্ণ শীতল গর্জনশীল হাওয়ার ঝাপট, মেঘে ঢাকা মনাস্টেরি, পাহাড়ি
গুম্ফা, হিমায়িত হ্রদ। একটা ঘোড়ার পিঠে চাপিয়ে
কারা যেন তাকে পার করে দিয়েছিল খরস্রোতা ‘লাখাং চু’ নদী। আর সতেরো হাজার ফুট
উচ্চতায় ‘শিংগো-লা পাস’ পার করে সে পথ হারিয়েছিল। তারপর কিভাবে যেন সূর্য ডোবার
ঠিক আগে দৈবক্রমে সে পথ খুঁজে পায়। দূরে পাহাড়ের খাঁজে সে দেখতে পেয়েছিল একটা
ছোট্ট হলুদ তাঁবু, যেখানে তারই জন্যে অপেক্ষায় ছিল এক কাপ গরম চা আর রাতের
আশ্রয়। --একজন প্রকৃত কবির কবিতা-পথও তো
থেকে যাবে এমনই অলক্ষ্যে, একাকী, প্রচারহীন, বিপদসঙ্কুল। এমনই হবে তার আনন্দ, অন্বেষণ আর
আবিস্কারগুলো, -আমার মনে হয়েছিল।
ওয়ার্নার হারযোগের একটা ডকুমেন্টারিতে
দেখেছিলাম একটা পরিত্যক্ত ধূ ধূ শহর। পাহাড়ি অগ্নুৎপাতের ভয়ে শহর থেকে সমস্ত লোককে
হঠাৎ সরিয়ে নিতে হয়েছে। ফাঁকা শহরের রাস্তায় রাস্তায় ক্যামেরা কাঁধে একা হারযোগ
ঘুরছেন। পড়ে আছে কয়েকপাটি জুতো। একটা নিঃসঙ্গ গাধা। গাড়ি চাপা পড়া একটা কুকুর।
ক্রমে জঙ্গলের মধ্যে এক আদিবাসি বুড়ো ও তার বেড়াল। বুড়ো গান গাইছে। আর অদূরে
পাহাড়ের মাথায় গাছপালা ও পাথরের ফাটল থেকে হু হু করে বেরিয়ে আসছে ধোঁয়া, বাস্প,
লাভাস্রোত। --একজন প্রকৃত কবি তিনিই, যিনি এরকমই সতত মরণশীল, পুনরপি ক্যামেরা-বাহক
এক কূট পর্যবেক্ষক। তিনি সাংবাদিক নন, এবং কখনো কবিতার সংজ্ঞা নিয়েও ভাবেন না।
আকাশে নিকষ মেঘ, যেন বা বনজ্যোৎস্না, এমন
মায়াবী আলোয় আমি বুকর্যাক থেকে নামিয়ে আনি রেমব্রাঁ। দেখি লাল পিঁপড়ের দল সারি
দিয়ে চলেছে ঘনবর্ষায়। ভ্যান গ’-র সূর্যমুখী তখনও হলুদ হয়ে ফুটে আছে দেওয়ালে,
অমলিন। আর আমারই দিকে তাকিয়ে রয়েছে পল গ্যগাঁ-র আঁকা ছবিতে তাহিতির সেই মেয়ে দুটি।
উন্মুক্ত স্তন। তাদের হাতে হাতে লাল ফুল। নির্জন সমুদ্রতীরে, পাতায় ছাওয়া গোলঘরের
সামনে, সম্ভবতঃ যেভাবে তারা দাঁড়িয়ে ছিল আনুমানিক একশো বছর আগে। সহসা মরণের কথা
ভেবে, অথবা দীর্ঘদিন সন্তানক্ষম থাকতে চেয়ে ওই ফুল তারা অর্পণ করেনি। --কবিতা একই
সাথে অমনি স্থির, বস্ত্রহীনা, দোলায়িত, আমূল। আর কোন শব্দ আমি খুঁজে ফিরবো কলকাতায়,
এই বর্ষারাতে ? যা বর্ণনা নয়, চিত্রকল্প নয়, স্মৃতি নয়। যেখানে সাংসারিক জল ঝরে
গেছে। গাছ ও গাছের উন্মাদ। দোয়াত ও দোয়াতের শান্তি। বাসনা ও বাসনার পুঁজ।
এইসব কথাই আমি জানাতে চাই। কবিতা নিয়ে কিছু লিখতে বসলে এখন আমার মন জূড়ে থাকে সেই তাহিতি মেয়ে দুটি, তাদের হাতে হাতে লাল ফুল। মনে পড়ে, মৃত্যুর মাত্র কয়েকদিন আগে কবি আলোক সরকার তাঁর শয্যাপার্শ্বে আমায় শুনিয়েছিলেন একটি কবিতার লাইন : ‘লালসুতো বোনা ফুল, মাঝে মাঝে নীল সুতো ছিল’।
আমার শুধু মনে পড়ে যায় জঙ্গলের মধ্যে সেই আদিবাসী বুড়ো, যে গান গাইছিল, আর পাহাড়ের মাথা থেকে গলগল করে বেরিয়ে আসছিল ধোঁয়া, বাস্প ও লাভাস্রোত। হয়তো এখন শিংগো-লা পাসের কাছে হঠাৎ ব্লিজার্ডে পথ চলা থেমে গেছে সেই একলা যুবকের ; আরও চার-ঘন্টা পথ পেরোলেই, যদি সে বেঁচে থাকে, হয়তো পেয়ে যাবে একটা গুম্ফার আশ্রয়। হয়তো। এবং এখন কলকাতা শহরের পুরস্কার-মঞ্চে, কবিতাপাঠের লাইনে যাঁরা গাছের নীচে অপেক্ষায় আছেন হয়তো তাঁদের জন্যেও ব্যবস্থা করা হ’ল রাতের আশ্রয়। এসময়ে, এমত সময়ে, এমন শূন্যতার মুখোমুখি, আমার কাছে সৃষ্টির আনন্দ নিয়ে প্রশ্ন করা হলে... আমি তো একটু আগেই বলেছি, কবিতা নিয়ে যা কিছু বলা প্রয়োজন। আকাশে আলো কমে আসছে, আর ক্রমশঃ বাড়ছে হাওয়ার বেগ। তুষারপাত শুরু হওয়ার আগে আমাকেও খুঁজে নিতে হবে পাহাড়ের খাঁজে লুকিয়ে থাকা হলুদ রঙের ছোট্ট একটা তাঁবু।
শূন্যকাল – প্রচ্ছদশিল্পী হিসেবেও আপনার কাজ আমাদের
কাছে এক বড় পাওনা। প্রচ্ছদ করার সময় কি মনে রেখে এগোন? আপনার মোটরহোমের প্রচ্ছদে বিজ্ঞান সম্মত
লেবেলিং আবার একেবারে আধুনিক কাজ স্বদেশ সেনকে নিয়ে করা বইয়ের প্রচ্ছদ, ভিন্নধর্মী... কিভাবে ভাঙেন নিজেকে?
শ্রী লাহিড়ী – এটা কোনও কঠিন ব্যাপার নয়। মনকে মুক্ত রেখে কাজ শুরু করতে
হয়।
নিজেই নিজেকে খুশি করতে চাই। প্রত্যেক কাজে লাগে আলাদা আলাদা দৃষ্টিকোণ। আলাদা ট্রিটমেন্ট,
ইমাজিনেশান, স্কিল। সব মিলিয়ে একটা প্যাশানেট এক্সপ্রেশান।
শূন্যকাল – বর্তমানে প্রচ্ছদশিল্পে অনেক বেশী টেকনলজির
প্রভাব দেখা যায়, আপনার পুরোনো মোটরহোম বা কেটলির প্রচ্ছদ অনেক বেশী শিল্পীনির্ভর।
কিভাবে দেখেন ব্যাপারটিকে?
শ্রী লাহিড়ী – হ্যাঁ, যেকোনও কাজকে শেষ অব্দি শিল্প হিসেবে উত্তীর্ণ হতে
হবে। সেখানে ফেল করলে টেকনোলজির গ্রেস মার্ক কোনো কাজেই লাগবে না।
শূন্যকাল – কোনো প্রিয় চিত্রশিল্পী বা প্রচ্ছদশিল্পীর
কাজ, যা আপনাকে ভাবায়, তাঁর ফর্ম, পদ্ধতি, মিক্সড মিডিয়ায় বিচরণ... একটা যৌগিক
ব্যাপার হিসাবে কিভাবে দেখেন প্রচ্ছদ করা বিষয়টিকে?
শ্রী লাহিড়ী – এদেশে আমার সময়ে দেখা প্রিয় পেন্টারের নাম প্রকাশ কর্মকার (একবার জামশেদপুরে এসে
আমাকে খুব অনুরোধ করেছিলেন ওঁর একটা পোর্ট্রেট ছবি তুলে দিতে)। প্রকাশের অঙ্কন
পদ্ধতিও চেয়ে দেখার মতো। আমি ওঁর জীবন ও ছবির ওপর একটা প্রবন্ধ লিখেছি, যেটা বাংলাদেশের
‘পরস্পর’ আন্তর্জাল পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে (জানুয়ারী ২০১৭)। আমি কৌরবে যোগ দেওয়ার
আগে প্রচ্ছদ নিয়ে ওদের কোনও ভাবনা চিন্তা ছিলনা। আমাকে কিছুটা জেদ ধরে বোঝাতে
হয়েছিল যে, এটা একটা দারুণ ক্রিয়েটিভ স্পেস। ক্রমে কমলদা আমায় সমর্থন করে, উৎসাহ ও
স্বাধীনতা দেয়, কারণ কৌরবের প্রচ্ছদ তখন কলকাতায় আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছিল। এটা
শুরু হয়েছিল দুই মজুমদার, কমলকুমার ও অমিয়ভূষণকে দিয়ে। তার পরে একে একে সুনীল,
শক্তি, বিনয়, সন্দীপন, পৃথ্বীশ, প্রকাশ, রবীন, যোগেন—অনেকেরই অঙ্কন দেখা গেছে
কৌরবের মলাটে। আমিও অনেকবার এঁকেছি। স্কেচ, কোলাজ, ফটোগ্রাফ, ইন্সটলেশান, টেক্সট,
সব রকম।
শূন্যকাল – আপনার ব্লগ বা ফেসবুক প্রোফাইলে আপনার
বিজ্ঞানমনস্কতারপরিচয় পাই, সে দিক দিয়ে দেখলে আবিষ্কারক হিসাবে দেখলে বিজ্ঞান বা
সাহিত্য কোন ব্যাপারটাকে এগিয়ে রাখবেন, এবং কেন?
শ্রী লাহিড়ী – আমার কাছে দুটোই প্রিয়।
তবে আমি নিজেকে সাহিত্যিকের চেয়ে বিজ্ঞানী ভাবতে বেশি পছন্দ করি। সাহিত্য তুমি যেভাবেই
সৃষ্টি করো না কেন, সমগ্র সৃষ্টিরহস্য জুড়ে, তোমার বহির্জগত ও মনোজগতের সকল সম্পর্ক জুড়ে, সর্বত্র রয়েছে বিজ্ঞানের অধিকার। আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগে
এভাবে বিষয়টাকে দেখা হত না।
শূন্যকাল – কাজের সূত্রে আপনার অভিজ্ঞতার ভাণ্ডার
বিশাল। তবে শুধুমাত্র দেখার স্প্যান বাড়ানো না কি খুব সুক্ষতম জিনিষও দেখা - কোনটা
একজন শিল্পীকে ভাস্ট হতে সাহায্য করে বলে আপনার মনে হয়? ম্যাক্রো পারস্পেক্টিভ না মাইক্রো
পারস্পেক্টিভ, কোন বিষয়ে আপনি জোর দেবেন?
শ্রী লাহিড়ী –যদি তুমি কসমোলজি নিয়ে একটু পড়াশোনা করে থাকো তবে
নিশ্চয় জানো যে, মানব সভ্যতার অস্তিত্বের একটুখানি পরিচয়জ্ঞাপক শব্দ-সঙ্গীতের অডিও রেকর্ড নিয়ে, সৌরমন্ডলের সীমানা পেরিয়ে গভীর মহাকাশে আজও ছুটে চলেছে ভয়েজার-২
উপগ্রহটি। এবং এও জানো যে নিতান্ত দৈবাৎ ভাগ্যবলে আমরা পেয়ে গেছি পৃথিবীর মতো সুন্দর একটা
বাসস্থান। মানুষ হিসেবে আমরা যে ‘মেসো’ ওয়ার্ল্ডে থাকি, সেখান থেকে দেখলে মাইক্রো
এবং ম্যাক্রো দুই জগৎই অপূর্ব সুন্দর ও রহস্যময়। দুই জগৎকেই জানা, দেখা, বোঝা
দরকার। তবে একটা সামগ্রিক, বা
হোলিস্টিক ধারণা থাকা খুব জরুরী।
শূন্যকাল - এখনকার প্রজন্মের কবিতার ভাষা কি অল্প লাল? না কি গোলাপি? এখনও লালের দিকে পৌঁছানোর চেষ্টা করছে?
শ্রী লাহিড়ী – এখনকার একুশ শতকের প্রজন্ম এই সময়ের কবিতার উপযুক্ত ভাষা এখনো রচনা করতে
পারেনি, তবে কয়েকজন কিছুটা এগিয়ে আছে। এটা কষ্টসাধ্য কাজ। অনেকরকম প্রলোভন,
প্রচার, জটিলতা, বিশ্বাসের সংঘাত, দিশাহীনতা, নড়বড়ে ভিত, সর্বোপরী কালচরিত্রকে
বুঝতে না পারা, এবং আন্তরিকতার অভাবই হয়তো। এদের পথভ্রষ্ট করার জন্যে অনেক
পুরস্কারের আয়োজন আছে, চতুর স্বার্থ আছে, ফেসবুক নামক একটা চোরাবালি ও কিছু মরুদ্যান
আছে। কবি স্বদেশ সেন ‘নতুন জিভের মতো অল্প লাল ভাষা’-কে চেয়েছিলেন যা অব্যবহৃত, যা
নবীন, কিন্তু স্বেচ্ছাচারী নয়, পাগলা জগাইয়ের মতো নয়।
শূন্যকাল – কবিদের, লেখকদের বা যেকোনো সৃষ্টিশীল
মানুষেরই ব্যাড প্যাচের সময় কমিয়ে আনার টোটকা হিসেবে কি বলবেন? আপনি নিজে সেই সময় কাটিয়ে উঠেছেন কিভাবে? কিভাবে ফিরে গেছেন ছন্দে?
শ্রী লাহিড়ী – আমি ব্যাড প্যাচে বিশ্বাস করি না। অর্থাভাব, শারিরীক
অসুস্থতা, উন্মাদনা, প্রিয়বিয়োগ, সম্পত্তিক্ষয়, রাষ্ট্ররোষ-- এগুলোকে বাদ দিলে,
সৃষ্টিশীল মানুষের ব্যাড প্যাচ আসলে তার নিজেরই মানসিকতাজনিত। এটা কাটিয়ে ওঠার
একটা উপায় জগৎব্যাপী সৃষ্টিশীলতার সাথে সম্পর্কিত হয়ে থাকা। তাকে চিনতে শেখা,
জানা, প্রয়োগ করা। এক বৃত্ত থেকে আরেক বৃত্তে সরে সরে যাওয়া। নিজের জন্য সেইমতো একটা পরিমন্ডল তৈরী করে
বসবাস করা। যখন কবিতা আসে না, তখন তা না আসাই স্বাস্থ্যকর। সেই পিরিয়ডটা দারুণ
ভাবে, বিষ্ময়ে, আনন্দে, শিহরণে, আবিষ্কারে ভরিয়ে রাখা সম্ভব। সেটাকে একটা সুযোগ
হিসেবে দেখি আমি। আমরা যেমন কয়েক বছর পর পর নিজেদের ওয়ার্ডরোব কিছুটা পাল্টাই,
সেভাবে নিজেদের বুকশেলফও কিছুটা পালটে দেওয়া দরকার।
শূন্যকাল - আপনার নিজের কোন কাজ আপনার কাছে নিজেকে
ছাপিয়ে যাওয়া বলে মনে হয়?
এবং কোনটাই বা ফিরে
ঘষামাজা করে আরো ধারালো করতে ইচ্ছে করে?
শ্রী লাহিড়ী – নিজের অনেক কাজই পরবর্তী কালে এখন ফিরে দেখতে গিয়ে বিশ্বাস
হয় না যে একদিন এটা আমিই করেছিলাম। তার একটা কারণ আমি খুব ডিটাচ্ড হয়ে নিজের
কাজকে দেখতে পারি, একদম অপরিচিতের মতো। কবিতা বেশি ঘষা মাজা করে লিখিনা, তাতে
কবিতা ভেঙ্গে পড়তে পারে, স্বতস্ফুর্ততা নষ্ট হতে পারে। তবে সিনেমা এমন একটা জিনিষ,
এত ভাবনা চিন্তা বিনিদ্র রাতের পরেও, উচ্চ প্রশংসার পরেও, মনে হয় আরো কিছু প্রশান্তি,
উজ্জ্বলতা, বিচ্ছুরণ এখানে আনতে পারা যেত।
শূন্যকাল – র্যাপিড ফায়ার বলে যদিও কিছু হয় না, তবু নিখাদ মজা থেকেই সামান্য কটা প্রশ্ন -
* কবি গদ্যকার না পরিচালক কোন ভূমিকায় নিজেকে দেখতে ভালবাসেন?
শ্রী লাহিড়ী – গবেষক, পর্যবেক্ষক।
* মৃত্যুর পরবর্তী স্বীকৃতি না কি জীবদ্দশায় কাল্ট হয়ে ওঠা?
শ্রী লাহিড়ী – নিজের মৃত্যুর পর নিয়ে যে ভাবে, তার
মৃত্যু তো হয়েই গেছে।
* ট্রাভেল শরীরে না কি মাথার ভেতর?
শ্রী লাহিড়ী – সবটা নিয়েই। তবে স্থানান্তর জরুরী ; বিভিন্ন
এরিনার মধ্যে দাঁড়িয়ে সময়কে অনুভব করা।
* ভবিষ্যতের কবিতা না কি অতীতের?
শ্রী লাহিড়ী – ভবিষ্যতের কবিতা ভবিষ্যতে লেখা হবে। অতীতের কবিতা যেমন অতীতেই লেখা
হয়েছিল। আমার কাজকর্ম এইদুয়ের মাঝখানে দাঁড়িয়ে।
* এমন কোনো কবিতা যা আপনার কাছে আলটিমেট...
শ্রী লাহিড়ী – জানার জন্যে মৃত্যু মুহূর্ত অব্দি অপেক্ষা
করতে হবে
আমায়।
শূন্যকাল -অসংখ্য ধন্যবাদ। ভাল থাকবেন। আপনার সুস্থতা
আর সৃজনশীলতা কামনা করি। আপনার সাক্ষাৎকারের শরিক হতে পেরে শূন্যকাল সম্মানিত। এতটা
সময় দেবার জন্য আবারও ধন্যবাদ।
অনেক অজানা কিছু বেরিয়ে এসেছে, আরও অজানা এক শংকর লাহিড়ী বাকি থেকে গেলেন, আসলে ওঁর মত মাপের মানুষকে ক’টা প্রশ্নে
বাঁধতে চাওয়া আসলে প্যানোরামা ভিউতে সমুদ্রের ছবি তোলার মত... তা'ও।
No comments:
Post a Comment